বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০৬

0
2085

#বিবাহ_বিভ্রাট (৬)
********************
আজকে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছি। আমার আইডি কার্ডের তথ্য সংশোধন করতে দিয়েছিলাম। নতুন কার্ড চলে এসেছে। সেটা তুলতে হবে। ব্যাংকেও কিছু কাজ আছে। সেগুলোও আজ শেষ করতে হবে। আমি তৈরি হয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়ালাম। মা এখনও আমার সঙ্গে কথা বলছেন না। এত রাগ করার কী আছে, বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ আগে মাসের বাজার এসেছে। মা লিস্টের সঙ্গে জিনিসপত্র মিলিয়ে নিচ্ছেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে, নিজের কাজে মন দিলেন। আমি বললাম, “মা, আমি যাচ্ছি।”

কোনও উত্তর পেলাম না। আমি কাজে যাওয়ার জন্য আটটায় বাসা থেকে বেরোই, অথচ আজ দশটায় কেন বেরোচ্ছি, এটা জানতে মা’র একবারও ইচ্ছা করল না? আমারও আর কথা বলতে ইচ্ছা হল না। নিঃশব্দে গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে, বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। এতক্ষণ আমার অন্যরকম প্ল্যান ছিল। আমি ভেবেছিলাম দুপুরের মধ্যে হাতের কাজগুলো শেষ করে, আজকে মা আর পলাশকে নিয়ে বাইরে কোথাও খাবো; কিন্তু এখন প্ল্যান চেঞ্জ করে ফেললাম। আজকের পুরো দিনটা আমি নিজের জন্য খরচ করব৷ শুধু খরচই করব না, মন খুলে, হাত খুলে খরচ করব৷ বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসার চালানোর টেনশনে নিজের সাধ-আহ্লাদ, এমনকি নিজের অনেক প্রয়োজনও পাশ কাটিয়ে গেছি। আজ আমি খরুচে হব, আজ আমি বেহিসেবী একটা দিন কাটাব।

আইডি কার্ড তুলে, ব্যাংকের কাজ শেষ করতে দুপুর হয়ে গেল। ওখান থেকে সোজা গাউসিয়ায় চলে এলাম। গাউসিয়ায় একসময় প্রতিমাসেই আসা হতো, অথচ আজকে প্রায় চার বছর পর এখানে এসেছি৷ ঢাকা শহরের প্রতিটা এলাকায় মার্কেট গড়ে ওঠায়, অনেকেই প্রয়োজনীয় কেনাকাটা নিজেদের এলাকার বা কাছাকাছি মার্কেটেই সেরে ফেলে। দোকান ঘুরে, ঘুরে ঝলমলে সব পোশাক দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। এত সুন্দর একেকটা কাপড়! আজকে পছন্দ করে দামি একটা থ্রিপিস কিনব। একটা থ্রিপিস পছন্দও করলাম। দাম জিজ্ঞেস করলে দোকানী বললেন, বারো হাজার টাকা! মনে হল ভুল শুনলাম। আমার চেহারা দেখে দোকানী নিজেই আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন। বললেন, “আপু কম দামের মধ্যেও ভালো ড্রেস আছে। সাত/আটের মধ্যে দেখাই?”

সাত হাজার কম টাকা? তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। বড়ো দোকান বাদ দিয়ে ছোটো দোকান ঘুরে, ঘুরে অবশেষে, সাড়ে চার হাজার টাকায় একটা থ্রিপিস নিলাম এবং এটা কেনার পর থেকে মনের মধ্যে কেমন খচখচ করতে শুরু করল। গত আড়াই বছরে হিসেব করে প্রতিটা টাকা খরচ করা এই আমি, হঠাৎ এত টাকায় একটা ড্রেস কিনে ঠিক হজম করতে পারছি না। আমরা মধ্যবিত্তরা খুব সহজে নিজের গন্ডি ভেঙে বের হতে পারি না। এটা আমাদের বড়ো এক সীমাবদ্ধতা। একদিন নিজ ইচ্ছায় বাঁচতে গেলেও, হাজারটা ভাবনা এসে ইচ্ছায় ব্যাঘাত ঘটায়। রোজকার চাল-তেল-নুনের হিসাব মাথার ভেতর অংক কষতে থাকে। এখন যেমন এই ড্রেসটা কেনার পরই মনে হচ্ছে, এই সাড়ে চার হাজার টাকায় আমি সাত/আট মাসের ভাতের চাল কিনতে পারতাম। মনটা খারাপ হলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে বোঝালাম, একটা দিন অন্তত আমি নিজের খুশির জন্য ব্যয় করতেই পারি। জামা কিনে বের হয়ে, ম্যাচিং জুতো আর জুয়েলারি কিনলাম। মা’র জন্য একটা পার্স আর পলাশের জন্য দু’টো টি-শার্ট নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম৷

———————

“তুই নিউমার্কেট যাচ্ছিস, এটা আমাকে বললে কী হতো? আমিও যেতে পারতাম।”

“আমার তো যাওয়ার প্ল্যান ছিল না। হঠাৎ করেই হয়ে গেল।”

“তখনই ফোন করতিস।”

“মাথায় ছিল না রে। তুই এই সময়ে পার্লারে ব্যস্ত থাকবি, তাই তোর কথা চিন্তাই করিনি।”

“পার্লারে তো লাইলি আর তানিয়া আছেই। আমি যেতে পারতাম।”

“আচ্ছা বাবা, এরপর তোকে ছাড়া আর কখনও যাব না।”

কেনাকাটার জিনিসপত্র দেখতে দেখতে আরোহী বলল, “আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।”

“কী কাজ করেছিস?”

“শুনে তুই রাগ করবি না তো?”

“রাগ করার মতো কিছু করেছিস?”

“ঠিক বুঝতে পারছি না। আগে একটা কথার উত্তর দে।”

“কী কথা?”

“সিয়ামকে নিয়ে তোর কোনও ভাবনা নেই তো?”

“সিয়াম কে?”

“সিয়াম কে, মানে? আমার সঙ্গে ফাজলামো করবি না।”

“ওহ, স্যরি। আমি সত্যি ভুলে গেছি। ওনার কথা আমার মনে থাকার কথা না। এখন বল, তুই কেন ওনার কথা জানতে চাচ্ছিস?”

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে, জবা।”

“তাকে কেন, কাউকে নিয়েই আমার কোনও ভাবনা নেই।”

আরোহী আমার কাছে এগিয়ে এসে, আমার হাত ধরে বলল, “জবা, আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।”

“কী করেছিস, বল না? তুই এমন ইতস্তত বোধ করছিস কেন?”

“আমি ওকে নক করেছিলাম।”

“কাকে?”

“সিয়াম।”

“সিয়াম? আমাদের বাসায় যিনি এসেছিলেন….”

“হুম, সে-ই।”

“কোথায় নক করেছিস! তাঁকে তুই কোথায় পেলি? তাঁর কোনও কন্টাক্ট নাম্বার তো আমার কাছেও নেই। তাহলে তুই কীভাবে….”

“শোন না, আজমাইন সিয়াম লিখে ফেসবুকে সার্চ দিলাম। তারপর খুঁজে পেয়ে গেছি।”

“এত সহজে?”

“হুম, সহজই ছিল। বইয়ের ছবিটাই প্রোফাইলে ঝুলছে। দেখেই চিনে ফেলেছি। আমি ম্যাসেঞ্জারে নক করেছি।”

“কেন?”

“কেন জানি না। আবার হয়ত জানিও।”

“কী হেঁয়ালি করছিস আরোহী?”

“আমি যদি ওনার সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গে কথা বলি, তুই কিছু মনে করবি?”

“কার বিয়ে?”

“তোর তো না। তুই তো নিজেই সরে গেছিস। আমি নিজের কথা বলছি।”

“তোর জন্য?” আমি অবাক হলাম।

“হুম আমার জন্য। আমার জন্য কে ভাববে বল? আমার মা নেই মানে কেউই নেই। আমার ভাবনা তাই আমাকেই ভাবতে হয়, জবা।”

“আরোহী তুই ভালো মতো ভেবে কথাটা বলছিস? ওনার একটা মেয়ে আছে। তুই এডজাস্ট করতে পারবি কি না ভেবেছিস?”

“এত বছর ধরে তো এডজাস্ট করেই আসছি। কেন জানি না, আমার নিজের মা নেই বলেই হয়ত, বাচ্চাটার জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছে। মা ছাড়া বড়ো হওয়া কী যে কষ্টের, সেটা আমি জানি, জবা। এই বাচ্চাটা হয়ত আমার মতো এতটা দুর্ভাগা না। আবার কে জানে, হয়ত আমার চেয়েও বেশি কিছু অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য।”

আমি আরোহীর কথা শুনে শুধু অবাক হচ্ছি। ও কতদূর ভেবে বসে আছে!

“কী ভাবছিস, আমি অনেকদূর ভেবে ফেলেছি? ভাবতে হয় রে। স্বপ্নটা বড়ো হলে তবেই না কিছুটা পেতে পারি। স্বপ্নই যদি ছোটো হয়, পাওয়ার খাতা তো শূন্য রয়ে যাবে। শোন আমি ঠিক করেছি, আমি সিয়ামের সঙ্গে কথা বলব৷ সরাসরি বিয়ের কথা বলব। সে তো বিয়ে করতেই এসেছে। তারপর যা হবে, দেখা যাবে। তুই শুধু বল, তোর কোনও সমস্যা আছে কি না?”

“আরোহী, তুই একই কথা বারবার কেন বলছিস? সিয়ামকে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি ভাবছি তোর কথা। এত বছর শুধু কষ্টই করলি। আবার না নতুন করে কোনও কষ্টে জড়িয়ে যাস।”

“আমি জানি, তুই আমাকে নিয়ে অনেক ভাবিস। আমাকে নিয়ে ভাবার তো একজনই আছে। সেই মানুষটা হচ্ছিস তুই। আরেকটা কথা কী জানিস, কষ্টকে ভয় পাই না, একদম না। জীবনে এত কষ্ট পেয়েছি, এখন আর কোনও কষ্টই আমাকে কাবু করতে পারবে না।”

বুঝতে পারছি না, আরোহী ভুল করছে, না ঠিক করছে। জিজ্ঞেস করলাম, “সিয়ামের সঙ্গে কী কথা হয়েছে?”

“তেমন কিছু না। পরিচয় দিয়েছি। পরিচয় না দেওয়া পর্যন্ত কথা বলতে চাচ্ছিল না। ভদ্রলোক আছে রে। তুই মিস করলি।”

“আবার বাজে কথা?”

“সেদিনকার ঘটনার জন্য হালকা-পাতলা স্যরি বলেছি। আজ রাতে ওর সঙ্গে কথা বলব। ফোন নাম্বার নিয়েছি। আমি শুধু ভাবছি, আন্টি যদি জানতে পারে, এই বাসায় আমার ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে।”

“মা’র চিন্তা তোর করতে হবে না। তুই নিজের কথা চিন্তা কর।”

“আমি তো নিজের কথাই চিন্তা করছি। দেখছিস না কেমন নিজের বিয়ের জন্য উতলা হয়ে গেছি। নিজেই নিজের বিয়ের ঘটকালি শুরু করে দিয়েছি। লোকজন শুনলে, বেহায়া মেয়ে বলবে। ছেলেটাকে দেখে ভালো মনে হয়েছে। অবশ্য ভালো-মন্দ তো চেহারা দেখে বোঝা যায় না। ওটাও ভাগ্যের খেলা। অনেকটা জুয়ার মতো। হয় জিতে যাবি অথবা নিঃস্ব হবি। সিয়ামের টাকাপয়সা আছে, ইউএসএ থাকে। এমন পাত্র তো আমার জন্য স্বপ্নের মতোই রে, জবা। নিজের ভাগ্যটাকে একবার ঝালিয়ে নিতে চাই। চেষ্টা করে দেখি, ভাগ্য আমার জন্য কতটা সুপ্রসন্ন হয়।”

আমি সিয়ামকে নিয়ে ভাবছি না। আমার যত ভাবনা আরোহীকে নিয়ে। ওর আগামী দিনগুলো যেন সুন্দর হয়। সেটা সিয়ামের সঙ্গে হোক অথবা অন্য কারো সঙ্গে।

———————–

রাতে শুয়ে পড়েছি। ঘুমটা এসেই গিয়েছিল, ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ছুটে গেল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। এত রাতে কে ফোন করল? ধরব না দেখে মোবাইল ফোনটা রাখতে গিয়ে স্ক্রীণে চাপ লেগে, ফোন রিসিভ হয়ে গেল। অগত্যা কথা বলতে হল, “হ্যালো…..

“এটা কী জবার নাম্বার?”

“জি। কে বলছেন?”

জবা, আমি তমাল।”

“তমাল ভাইয়া? তুমি এত রাতে!”

“স্যরি, এত রাতে বিরক্ত করার জন্য।”

“না, না। ঠিক আছে। ভাইয়া কেমন আছ?”

“আমি তো ভালো আছি। জবা একটা কথা জানতে চাই।”

“বলো।”

“তুমি কী কোনও গেম খেলছ?”

“আমি গেম খেলছি! কার সঙ্গে?”

“তোমার বন্ধুকে দিয়ে সিয়ামকে নক করেছ কেন? তোমাদের কী ওকে আরও অপমান করা বাকি আছে?”

আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম তমাল ভাইয়ার কথা শুনে। ওর প্রশ্নের কী উত্তর দেবো, বুঝতে পারছি না।………………………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে