বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০৭

0
2033

#বিবাহ_বিভ্রাট (৭)
**********************
“হ্যালো, জবা শুনতে পাচ্ছ?”

“হুম, বলো।”

“আমি একটা প্রশ্ন করেছি, উত্তর পাইনি এখনও।”

“কী উত্তর শুনতে চাও?”

“তুমি যেটা করছ, ঠিক সেটাই শুনতে চাই।”

“আমি কিছু করছি না।”

“আরোহী তোমার বন্ধু না? তুমি তাকে দিয়ে ফোন করাওনি সিয়ামকে?”

“তোমার বন্ধু কী তা-ই বলেছে? আমি ফোন করিয়েছি? মানুষটা তো ভয়ংকর মিথ্যুক!”

“তুমি ফোন করিয়েছ, এটা বলতে হবে কেন? এটা তো স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে। তুমি অস্বীকার করবে, আরোহী নামের ঐ মেয়েটা তোমার বন্ধু না?”

“আরোহী আমার বন্ধু। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড; কিন্তু আমি আরোহীকে দিয়ে ফোন করাইনি।”

“তাহলে কী আরোহী নিজ থেকেই ফোন করেছে? তার কী নিজ থেকে ফোন করার বিশেষ কোনও কারণ আছে?”

“সেটা তুমি আরোহীকেই জিজ্ঞেস করো।”

“আমি কেন তাকে জিজ্ঞেস করতে যাব? আমি তো তাকে চিনিই না। তারচেয়ে তুমি বলে দাও, তুমি আসোলে কী চাচ্ছ। তুমি কী কোনও অপরাধবোধে ভুগছ? তোমার কী এখন মনে হচ্ছে, সিয়ামের সঙ্গে কথা বলা উচিত? তুমি কী বিষয়টা এগিয়ে নিতে চাও? ভালো একজন পাত্র হাতছাড়া হয়ে গেল দেখে এখন কী তোমার আফসোস হচ্ছে, জবা? নিজ থেকে বলতে পারছ না বলেই কী বন্ধুকে দিয়ে নক করিয়েছ?”

মেজাজটা হঠাৎ করেই কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেল। এতক্ষণ চুপচাপ তমাল ভাইয়ার কথা শুনছিলাম। ভেবেছিলাম, তার কথা শেষ হলে ফোন রেখে দেবো; কিন্তু এই মানুষ তো কাহিনি অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে! সে ভাবছে, আমি এখন সিয়ামের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চাচ্ছি! আমাকে কী এতই লোভী মনে হয় এদের? দরজাটা ভেজানো ছিল। বিছানা থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে এসে বললাম, “তোমরা কী মনে করো নিজেদেরকে? আর তোমরা মেয়েদেরকেই বা কী মনে করো? একজন মেয়েকে যখন যা খুশি তাই বলা যায়, তাই না? তোমার চাচী কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়া বলে দিলেন, ছেলেদের তিনি কথা দিয়ে দিয়েছেন! তিনি কী একবারও আমার মতামতটা জানতে চেয়েছিলেন? আমি এক বাচ্চার বাপকে বিয়ে করব কি না, এটা জানার কী কোনও প্রয়োজন ছিল না?”

“উনি আমার চাচী হওয়ার আগে তোমার খালা হয়েছেন। ওনার ভুলের জন্য তুমি আমাকে কথা শোনাতে পার না।”

“এই যে তুমি রাত বারোটায় ফোন করে আমাকে এতগুলো ফালতু কথা শোনালে, তুমি কী ভালোভাবে সবকিছু জেনে, তারপর ফোনটা করেছ? নাকি ধরেই নিয়েছ, আরে এ তো মেয়েমানুষ, এর সঙ্গে এত ভেবেচিন্তে কথা বলার কী আছে? আরোহী ফোন করেছে মানেই হচ্ছে, আমি ওকে দিয়ে ফোনটা করিয়েছি! আশ্চর্য কথা বললে তুমি। শোনো, মিঃ তমাল, তোমার বন্ধুকে বিয়ে করার জন্য আমি মারা যাচ্ছি না। তোমার বন্ধু কেন, দুনিয়ার আর কোনও ছেলেতেই আমার কোনও আগ্রহ নেই আর তোমার মতোন ছেলের সঙ্গে কথা বলার পর তো যেটুকু আগ্রহ বাকি ছিল, সেটাও আর নেই।”

“আমার মতোন ছেলে মানে? তুমি কী বুঝাতে চাচ্ছ জবা? স্পষ্ট করে বলো।”

“আমি তোমাকে কিছুই বুঝাতে চাচ্ছি না। এতটুকু যখন নিজে থেকে বুঝে নিয়েছ, বাকিটাও নিজেই বুঝে নাও।”

“জবা, তুমি আমার সঙ্গে এমন চিৎকার করে কথা বলছ কেন!”

কখন যে গলার স্বর সপ্তমে চড়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। অবশ্য কেউ আমাকে এমন করে উত্তেজিত করে দিলে, তখন আমি আর নরম সুরে কথা বলতে পারি না। গলা চড়িয়েই বললাম, “তোমার উলটোপালটা কথাই আমাকে চিৎকার করতে বাধ্য করেছে।”

“আমি উলটোপালটা কথা বলছি! মানে চোরের মা’র বড়ো গলা আরকি। সবকিছু তোমার প্ল্যান মাফিক চলছে আর আমি হয়ে গেলাম দোষী? শোনো জবা, এত রাতে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। আমি শুধু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, সিয়ামের কোনও ক্ষতি হলে, সেটার জন্য তোমাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।”

“তুমিও একটা কথা জেনে রাখো, এতদিন আমি জানতাম তুমি একটু মুডি; কিন্তু আজকে জানলাম, তুমি রাস্তার ধারে খিস্তিখেউড় করা লোকের মতো ঝগড়াটে।”

“কী বললে তুমি! আমি খিস্তিখেউড় করি! কী খিস্তি করেছি তোমার সঙ্গে, বলো?”

“বলব না৷ আমি এখন রাখব। তোমার সঙ্গে কথা বলার মতো কোনও ইচ্ছা আমার নেই।”

“আমার কথার জবাব না দিয়ে ফোন রাখতে পারবে না ”

“তুমি হচ্ছ একটা যা-তা। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনও কথা নেই।”

“যা-তা মানে!”

“যা-তা মানে, আমার মাথা।”

“জবা তুমি নিজে বুঝতে পারছ তো তুমি আমার সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলছ? এখন তো তোমাকেই মনে হচ্ছে, রাস্তার ধারের…..”

আমি রাস্তার ধারের কী, সেটা শোনার আগেই ওর মুখের ওপর লাইনটা কেটে দিলাম। এখন সারারাত ভেবে মরুক কী খিস্তি করেছে। মা গো মা, এই ছেলেটা যে এতটা ঝগড়াটে, এটা তো আমি কোনোদিন বুঝিনি। এর সঙ্গে আমি যদি আর কোনোদিন কথা বলেছি তো…..

———————–

“আপনি ভালো করে ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তো? আবেগে পড়ে একটা কাজ করে ফেললেন আর পরে গিয়ে সেটার জন্য অনুশোচনা করে অশান্তি তৈরি করবেন, সেটা হওয়ার চেয়ে এখনই ভালো মতো ভেবে নিন।”

“আমি ভালো করে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। টিনএজ এর সময়টা তো পেরিয়ে এসেছি আরও কয়েক বছর আগেই। এখন আমার আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বা বয়স কোনোটাই নেই। তাছাড়া আমার জীবনের যত সিদ্ধান্ত, সবই তো আমিই নিয়েছি। আমাকে নিয়ে ভাবার বা আমার জন্য সময় দেওয়ার তো কেউ নেই। আপনি ধরে নিন, আমি এতিম। আমার কোথাও কেউ নেই। চিন্তাভাবনা তো করবেন আপনি। আপনি কী এমন একজন মেয়ের সঙ্গে নিজের জীবন জড়াবেন, যার দেওয়ার মতো কোনও পরিচয় নেই। মানে আমাকে বিয়ে করলে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘড়ি, সাইকেল টাইপ কোনও যৌতুক পাবেন না কিন্তু।”

“হা, হা, ভালো বলেছেন। আপনি খুব মজার মানুষ। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েই সেটা বুঝেছি।”

“আপনিও মজার মানুষ। ভেতরে প্যাঁচ-ঘোচ নেই।”

“কী করে বুঝলেন?”

“আপনি যেভাবে আমাকে বুঝেছেন?”

“এত সহজে কী মানুষ চেনা যায়?”

“যায় তো। আমি চিনতে পারি। জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছি তো। এই ধাক্কাগুলো খুব ভালোভাবে মানুষকে চিনিয়ে দিয়েছে।”

“বুঝলাম।”

“আমার না হয় কেউ নেই; কিন্তু আপনার তো সবাই আছে। আপনার ফ্যামিলি থেকে কোনও আপত্তি করলে?”

“কে আপত্তি করবে? জীবন তো আমার। বড়ো আপু অবশ্য একটা কথা বলেছে। আরেকটু ভালোভাবে দেখেশুনে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে।”

“সেটাই ভালো। আপনি ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।”

“কিন্তু আমি তো সেভাবে চিন্তা করি না।”

“আপনি কীভাবে চিন্তা করেন?”

“ধরেন আপনার সঙ্গে বা আপনার জায়গায় যদি অন্য কোনও মেয়েও হয়, আমি কয়েকবার দেখা করলাম। দেখা করে আমি ততটুকুই বুঝব, যতটুকু আপনি আমাকে বুঝতে দেবেন। আপনার বা সেই মেয়ের মনের ভেতর যদি অন্য কোনও দুরভিসন্ধি থাকে, সেটা কী আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব? মানুষ তো কোনও বস্তু না যে চোখের দেখায় তাকে মেপে ফেলা যায়। তবে হ্যাঁ, মানুষের কথাবার্তা, আচরণ, খাওয়ার ভঙ্গি, চলার ভঙ্গি থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। সেই অনুমান থেকেই আপনাকে কিছুটা চিনেছি।”

“কেমন চিনলেন?”

“আপনি স্পষ্টভাষী। যা বলার, সরাসরি বলেন। এটা ভালো গুন। অন্যের জন্য খুব ভাবেন। আবার নিজের পাওনাটাও ঠিকমতো আদায় করে নেন। কী৷ ঠিক বললাম?”

“বাহ, আপনি তো আমাকে ভালোই চিনেছেন।”

“আপনি বলছেন ঠিকঠাক চিনতে পেরেছি?”

“কিছুটা তো পেরেছেন।”

“ইয়ানার ঘুম ভেঙে গেছে। ওকে সময় দিতে হবে। এখন আর কথা বলতে পারছি না। অনেক রাতও হয়েছে। আপনি শুয়ে পড়েন। ভালো থাকবেন।”

“আপনিও ভালো থাকবেন।”

“পরশুদিন পাঁচটায় দেখা হচ্ছে তাহলে। ফোনে কথা বলে নেবো।”

হুম, বাই।”

ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন পড়া শেষ করে মোবাইলটা আরোহীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এইসব কী আর তুই এই কয়দিন কোথায় ছিলি? তুই ওনার সঙ্গে দেখাও করে ফেলেছিস এর মধ্যে? এতকিছু হয়ে গেল আর আমি কিছুই জানি না!”

বলছি রে বাবা। আন্টি কোথায় রে?”

“মা, বড়ো মামার বাসায় গেছে।”

“শোন, কাজ যখন করতেই হবে, দেরি করে লাভ কী?”

“দেখা করেছিস কবে!”

“আমি একবার না, ওর সঙ্গে দুইবার দেখা করেছি।”

“কী বলিস?”

“হুম। মঙ্গলবারে আর গতকাল।”

“দেখা করে কী করলি?”

“দেখা করে কী করব আবার? কথা বললাম। কথাবার্তা বলে দু’জন, দু’জনকে বুঝতে চেষ্টা করলাম।”

“কী বুঝলি?”

“জবা, তুই আমার ওপর রাগ করছিস না তো?”

“আরে বোকা, এই এক কথা কেন বারবার বলিস? এই কথাটা বলে তুই আমাকে দূরের মানুষ করে দিলি, আরোহী।”

“স্যরি, দোস্ত। আর বলব না। শোন, কালকে বিকেলে আবারও আমরা দেখা করব। আমরা দু’জন মিলে হয়ত কাল একটা সিদ্ধান্তে আসব।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

“সত্যি বুঝতে পরছিস না?”

“বুঝতে পারছি; কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। এত জলদি, কীভাবে কী!”

“সিয়াম আর পনেরো দিন ঢাকায় আছে। তারপরই চলে যাবে। যদি কিছু হয়েই যায়, খামোখা সময় নষ্ট করে লাভ কী, বল? জবা, তুই আমার সঙ্গে আছিস তো?”

“আমি তোর সঙ্গে সবসময় আছি।”………………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে