বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০৮

0
1985

#বিবাহ_বিভ্রাট (৮)
*********************
কাজ শেষ করে হসপিটাল থেকে বের হব, এমন সময় আরোহী ফোন করল। “হ্যালো, আরোহী…”

“জবা, তুই কোথায়?”

“হসপিটাল থেকে বের হচ্ছি। কেন রে?”

“তুই থাক, আমি আসছি।”

“তুই কোথায়?”

“তোর কাছাকাছি আছি। আমার আসতে পাঁচ মিনিট লাগবে।”

“ঠিক আছে, আয়।”

আরোহীর ফোন রেখে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আরোহী এসে হাজির৷ খুশিতে একেবারে ঝলমল করছে৷ আমি ওর কাছে যেতেই হাত ধরে বলল, “চল।”

“কোথায়?”

“সিয়াম আসছে।”

“কোথায়?”

“ওশান ব্লু তে।”

“আমি ওখানে গিয়ে কী করব! তুই কী করছিস বল তো? কোন পর্যায়ে আছিস এখন? আমার তো তোকে নিয়ে ভয়ই হচ্ছে।”

“আমরা দু’জন ডিসিশন নিয়ে ফেলেছি।”

“কিসের ডিসিশন?”

“অনলাইন বিজনেস করার। আমি এখন থেকে জিন্সের প্যান্ট পাঠাব আর সিয়াম ওখানে বেচবে।”

“তুই জিন্সের প্যান্ট কোথায় পাবি?”

“এই জবা, এই তুই কী ইচ্ছা করে না বোঝার ভান করছিস? তুই জানিস না কিসের ডিসিশন? আমরা বিয়ে করছি।”

“কবে!”

“সেটাই আজকে ঠিক করব। কাল অথবা শুক্রবারে।”

“এত তাড়াতাড়ি! আরোহী, তোর কী মনে হয় না, মানুষটাকে বুঝতে আরও একটু সময় নেওয়া দরকার ছিল?”

“সময় কোথায় আমাদের? সে তার কথা বলেছে। আমি আমার কথা বলেছি৷ সব ক্লিয়ার করে বলেছি। এরমধ্যে ফোন কোম্পানিগুলোর মতো লুকানো কোনও শর্ত নাই। এখন চল। যেতে যেতে কথা বলি।”

আরোহী ঠিক পথে যাচ্ছে কি না, বুঝতে পারছি না। তাকে জোর করে কিছু বলতেও পারছি না। আমার কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে, ওকে যদি আমি এখন কোনোকিছু করতে নিষেধ করি, ও হয়ত ভাববে, আমার সঙ্গে বিয়েটা হয়নি দেখে, আমি ওকে বাধা দিচ্ছি। অথচ বিষয়টা তো সেটা না। এমন এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যাব, এটা আমি কল্পনাই করিনি। তাছাড়া সিয়ামের মুখোমুখি হওয়ার আমার একদম ইচ্ছা নেই। না যাওয়ার জন্য আরোহীকে বললাম, “আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। মা’র শরীর ভালো না। গিয়ে রাতের রান্না করতে হবে। তুই যা। পরে আমাকে জানাস কী হল।”

“রাত হতে অনেক দেরি এখনও। এমন করিস না। প্লিজ চল।”

“তুই যা আরোহী৷ আমি আরেকদিন যাব।”

“প্রতিদিন কী আমার বিয়ের ডেট ঠিক হবে? সত্যি করে বল তো, তুই যেতে চাচ্ছিস না কেন?”

“আমি কী মিথ্যা বলছি? মা’র শরীর সত্যি ভালো না।”

“আমরা নয়টার আগেই বাসায় পৌঁছে যাব৷ আর যদি দেরি হয়েই যায়, খাবার কিনে নিয়ে যাব। আন্টি আর পলাশ দুজনেই বাইরের খাবার পছন্দ করে। আর একটাও কথা হবে না। এখন চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“আমি না যাই। প্লিজ….”

“আজ পর্যন্ত তোকে ছাড়া আমার জীবনের কেনও কাজ হয়েছে? আর আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্ত, আমি তোকে ছাড়া নেব? ঠিক আছে, আমিও যাব না। আমি ফোন করে সিয়ামকে না করে দিচ্ছি।”

এরপর আর কিছু বলার থাকে না। না গিয়ে আর উপায় নেই। বললাম, “ওনাকে ফোন করতে হবে না। চল, যাচ্ছি।”

————————-

ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। সিয়ামের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা বড্ড অদ্ভুত। গত সপ্তাহে এই মানুষটার সঙ্গে আমার জীবন জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল আর আজকে সেই মানুষের সঙ্গে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার নতুন জীবন শুরু করার কথা হচ্ছে! জীবনটা মাঝে মধ্যে বড়ো বিচিত্র মনে হয় আমার কাছে।

সিয়াম আগেই চলে এসেছে। আমাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “ভালো আছেন, জবা?”

আমিও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে হেসে বললাম, “স্যরি, আপনাকে অপেক্ষা করালাম।”

“না, না। আমি এখনই এসেছি। বসেন, প্লিজ।”

চেয়ারে বসে বললাম, “কেমন আছেন?”

“এই তো, আছি একরকম। সময় খুব খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। প্রতিবার ঢাকায় আসার পর আমার এমন লাগে৷ যাওয়ার সময়টা যেন ঝড়ের গতিতে চলে যায়। এবার মনে হচ্ছে আরও দ্রুত সময় যাচ্ছে।”

সিয়াম, আরোহীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি ফোন করেছিলাম তো। তুমি রিসিভ করলে না।”

আরোহী ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করে বলল, “তিনবার ফোন করেছ! এটা যে সাইলেন্ট হয়ে আছে, আমি তো খেয়ালই করিনি৷”

আমি ওদের দু’জনের কথায় বেশ চমকিত হলাম। এত তাড়াতাড়ি আপনি থেকে তুমিতে পৌঁছে গেছে ওরা! এজন্যই তো সিয়ামের সময় ঝড়ের গতিতে চলছে। ভালোই লাগল বিষয়টা।

ওরা দু’জন বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা বলছে। সিয়ামের বাসায় কে, কী বলছে, সেসব নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আমি চুপচাপ বসে আছি৷ চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। বিয়ের বিষয়টা কতদূর এগিয়েছে, সেটা আমি জানি না। যদিও আরোহী প্রতিটা কথা বলার শেষে, “জবা কী বলিস, জবা এটা ঠিক আছে?” এসব বলেই যাচ্ছিল।

ওদের দু’জনকে দেখে আমার এখন কেমন যেন মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আমি সবসময়ই চেয়েছি আরোহী যাতে খুব ভালো একজন জীবনসঙ্গী পায়। সিয়াম সেই জীবনসঙ্গী কি না, জানি না। আমার শুধু মনে হচ্ছে, ওরা যে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত এত তাড়াতাড়ি নিচ্ছে, এতে কী ওরা কোনও ঝামেলায় পড়বে? পরে গিয়ে কখনও কী ওদের কাছে মনে হবে, তাড়াহুড়ায় নেওয়া সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল?

আরোহী আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কী রে, কী ভাবছিস? তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?”

আমি সত্যি ওর কথাটা শুনিনি। সেটা বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “খালুকে জানিয়েছিস?”

“না। আমি কাউকে জানাব না।”

“এটা হয় নাকি? ঠিক আছে, এটা নিয়ে বাসায় গিয়ে কথা বলব। তুই কী যেন বলছিলি?”

“বললাম যে, সিয়াম বলছে শুক্রবার দুপুরে ওর বাসায় বিয়েটা হোক। শুধু ফ্যামিলির লোকজন থাকবে। কী বলিস?”

“দেখ, যেটা ভালো মনে করিস।”

“সব যদি আমিই মনে করব, তাহলে তুই কী করতে আছিস? কিছু তো বল।”

সিয়াম আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। বললেন, “কথা পরে হবে। আগে বলেন, কী খাবেন?”

কফি ছাড়া অন্য কিছু খাবো না বলার পরও সিয়াম নুডুলস আর পিৎজা অর্ডার করলেন। সিয়ামকে আজকের আগে আমার জানার সুযোগ হয়নি। আরোহীর মুখে তার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি, আমি তাকে সেভাবেই চিনি। এখন সামনাসামনি কথা বলে মনে হচ্ছে, ছেলেটা সত্যিই ভদ্র। তার মাঝে কোনও ভণিতা বা লোকদেখানো বিষয়টা নেই। আরোহী খুব চঞ্চল আর সিয়াম বেশ ধীরস্থির। এই মানুষটা হয়ত আরোহীর জন্য ঠিক মানুষ হবে, যদি না কোনও মুখোশ পরে থাকে।

খাবার আসার আগে তমাল ভাইয়া এসে হাজির হল। ও যে আসবে, আরোহী বা সিয়াম, কেউই সেটা বলেনি। আমার এখন ভীষণ লজ্জা লাগছে। তমাল ভাইয়ার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। সেদিন রাতে রাগের মাথায় তাকে কী সব উলটোপালটা কথা বলেছি, ছিঃ ছিঃ। এখন তো সব কথা মনেও পড়ছে না। কী জানি খিস্তিখেউড় করা খারাপ লোক বলেছিলাম ওকে! ধ্যাত, সে যে আমাকে কী মনে করেছে, আল্লাহ্ ই জানেন। আমি কারও সঙ্গে এমন খারাপ ভাষায় কথা বলি না, অথচ তমাল ভাইয়াকে একসঙ্গে কতগুলো খারাপ কথা বলে ফেলেছি! সব দোষ বড়ো খালার।

তমাল ভাইয়া আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে আরোহীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জবা কেমন আছ?”

“ভালো। তুমি ভালো আছ?”

“হুম।”

খাবার চলে আসায় কথাবার্তায় ছেদ পড়ল। সিয়াম এখানকার খাবার আর ওখানকার খাবারের মধ্যে তুলনা করলেন। টেস্টের পার্থক্যের কথা বললেন। আমি চুপচাপ খাচ্ছি। ওরা তিনজন কথা বলছে। সিয়াম হঠাৎ বললেন, “জবা, আমার একটা বিষয় খারাপ লেগেছে। আমাদের কারণে আপনাদের দু’জনের মাঝে বোধহয় একটু মনোমালিন্য হয়ে গেছে। এই বিষয়টা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। তমাল আসোলে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেনি। ও তখনও আমাদের বিষয়টা ঠিকমতো জানত না। আপনি প্লিজ তমালের ওপর রাগ করে থাকবেন না।”

তার সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে, এগুলোও বন্ধুকে বলে দিয়েছে! অথচ আমি আরোহীকে সেদিনের ফোনের কথা বলিইনি। ইশ, সিয়াম আমাকে কত খারাপ ভাবছে, কে জানে? সিয়ামের কথার উত্তরে কিছু বলতে হবে, তাই বললাম, “আমি তমাল ভাইয়ার ওপরে রাগ করিনি। আসোলে আপনারা দু’জন এত দ্রুত সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন, যে কারণে আমাদের দু’জনেরও বিষয়টা বুঝতে ভুল হয়েছে।”

শুক্রবার দুপুরেই বিয়ের ক্ষণ ঠিক হল। এত অল্প সময়ের মধ্যে এরা কীভাবে কী করবে, জিজ্ঞেস করতেই তমাল ভাইয়া বলল, “আয়োজন করে কোনোকিছু হচ্ছে না। আরোহী, আপনার যা-কিছু কেনাকাটা করতে হবে, আপনি জবাকে নিয়ে করে ফেলবেন। আরেকটা কথা, আমরা একবার আপনাদের বাসায় আসব। সিয়াম, আংকেলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, ওনাকে বিয়ের কথাটা জানাতে চায়।”

আরোহী বলল, “কোনও দরকার নেই। আমি তো সিয়ামকে বলেছি, আমার কেউ নেই।”

আরোহীকে থামিয়ে বললাম, “তমাল ভাইয়া, তোমরা কাল সন্ধ্যায় চলে এসো। আমি খালুর সঙ্গে কথা বলে রাখব।”

আরোহী আমার হাতে চাপ দিয়ে বলল, “কিসের জন্য তুই কথা বলবি? আমি কাউকে জানাতে চাই না।”

“সবসময় বেশি বুঝিস না। চুপ কর।”

আরোহী এরপর আর কিছু বলল না। আমি সিয়ামকে বললাম, ভাইয়া, আপনারা আসেন। খালুর সঙ্গে কথা বলার অবশ্যই প্রয়োজন আছে।”

———————-

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। রিকশায় উঠে আরোহী বলল, “আব্বার কথা কেন আসছে?”

“কারণ তোর আব্বা এখনও বেঁচে আছেন।”

“আমি তাঁকে বলতে চাই না। কোনোকিছু বলতে চাই না।”

“আরোহী, তুই এমন করছিস কেন?”

“জবা, তুই আমার কষ্টটা বুঝবি না। বাপ থাকতেও আমি একা বড়ো হয়েছি। বিয়েটাও আমি একাই করে নিতে পারব। আমার কোনও দায়িত্ব তিনি কোনোদিন নিতে চাননি। আজকেও নিতে হবে না।”

“সমাজ বলে একটা জিনিস আছে। সেটা ভুলে যাস না।”

“কিসের সমাজ? সমাজ তো একটা ভন্ড বিষয়। সমাজ আছে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার জন্য। তোদের সমাজের কেউ কোনোদিন আব্বাকে এসে জিজ্ঞেস করেছে, নিজের মেয়ের সঙ্গে তিনি এমন একচোখা আচরণ করেছেন কেন? তুই আমাকে সমাজের সংজ্ঞা শেখাতে আসবি না।” কথাটা বলে আরোহী ডুকরে কেঁদে উঠল।

আরোহীর অভিমানের জায়গাটা আমি বুঝতে পারি। খালুর প্রতি অভিমানের পাহাড় জমেছে ওর বুকের ভেতর। এই অভিমান এত সহজে মিটবে না। আরোহীর আব্বাকে আমার এতটা খারাপও মনে হয় না৷ আরোহীকে তিনি ভালোবাসেন; কিন্তু পরিস্থিতির ফেরে পড়ে, তিনি মেয়ের প্রতি ভালোবাসাটুকু দেখাতে পারেন না। আরোহীর এই নতুন মা কঠিন স্বভাবের মানুষ। তিনি যে কোনও মূল্যে স্বামীকে হাতের মুঠোয় রাখতে চান এবং তিনি কখনও সৎমা’র চিরাচরিত রূপ থেকে বেরিয়ে এসে, শুধু মা হওয়ার চেষ্টাও করেননি। আমি জানি, তিনি আরোহীকে একটু আদর দিলেই, আরোহী তাঁর জন্য নিজেকে উজাড় করে দিত। তাঁদের সম্পর্কটা অন্যরকম সুন্দর হতো। বেশিরভাগ মানুষই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারেন না। বেশিরভাগ মানুষই ভালোবাসার হাতটা এগিয়ে দিয়ে মহানুভবতা দেখাতে পারেন না।………………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে