বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০৫

0
2389

#বিবাহ_বিভ্রাট (৫)
*********************
বলতে না পারা কথাগুলো মনের ভেতর জমা করে রাখলে, মেজাজটা বড্ড তিরিক্ষি হয়ে থাকে। গত কয়দিন ধরে মনের ভেতর অভিমানের যতটুকু মেঘ জমা হয়েছিল, মা আর বড়ো খালাকে কথা শোনানোর পর এখন মনের ভেতরের মেঘ সরে গেছে।

খাবার খেতে ইচ্ছা করছে না। আরোহী ফিরলে, ওর সঙ্গে খাবো। খাবারের প্লেটটা ডাইনিং টেবিলে রেখে, পলাশের রুমে উঁকি দিলাম। সে পড়তে বসেছে। মা’র রুমের বাতি নেভানো, দরজার পর্দাও টানা, তাই বোঝা যাচ্ছে না, মা কী করছে। ওদিকে না গিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। চোখের সামনে ভদ্রলোকের চেহারাটা ভেসে উঠছে বারবার। ইশ, উনি কী ভাববেন আমাদেরকে? আমার কী একবার তমাল ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলা উচিত? ওনাকে ফোন করে স্যরি বলব সবকিছুর জন্য? না, থাক। তমাল ভাইয়া যদি উলটোপালটা কিছু বলে, তখন সেটা সহ্য করতে পারব না। তাছাড়া আমি তো কোনও দোষ করিনি আর আমার কাছে তমাল ভাইয়ার ফোন নাম্বারও নেই। ফোন নাম্বার নিতে হলে বড়ো খালাকে ফোন করতে হবে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার এতটুকু ইচ্ছা এখন আমার নেই। যাকগে যা খুশি হোক। এই বিষয়টা নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না। তমাল ভাইয়ার সঙ্গেই বা আমার আর কোথায় দেখা হচ্ছে? তার রাগ বা মন খারাপে আমার কী আসে-যায়?

বিছানায় বসে বালিশটা টেনে নিতেই প্যাকেটটা চোখে পড়ল। এটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। সিয়ামের দেওয়া গিফট। এটা তো আমার কাছে রয়ে গেল। এখন এটা ফেরত দিই কী করে? প্যাকেটটা হাতে নিলাম। র‍্যাপিংটা কী আমার খোলা উচিত? এলোমেলো ভাবনার মাঝে বেখেয়ালেই র‍্যাপিংটা খুলে ফেললাম। চমৎকার প্রচ্ছদের একটা বই বেরিয়ে এল। নাম, “ওড়াউড়ির দিন।” ওনার পুরো নাম আজমাইন সিয়াম। পাতা ওলটাতেই “শুভকামনা” লেখাটা চোখে পড়ল। নীচে আজকের তারিখ লেখা। শুভকামনা কথাটা লেখার সময় মানুষটা কী জানত, আজকের বিকেলটা তাঁর জন্য এমন অপমানের হবে?

প্রথম কবিতাটা পড়লাম। অনাগত সন্তানকে নিয়ে বাবা’র রঙিন স্বপ্ন আর কল্পনার বেলুনগুলোর আকাশের ওড়াউড়ির কথামালা। ওনার মেয়েকে নিয়েই নিশ্চয়ই এটা লেখা। যে বাচ্চার কথা জানার পরই এত হুলুস্থুল! হঠাৎ করে অদেখা সেই বাচ্চাটার জন্য খুব মায়া হল আমার। পরের কয়েকটা কবিতায় প্রেয়সীর সঙ্গে ভালোবাসার, কখনও বা বিচ্ছেদের মুহূর্তগুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ভালোই লাগল পড়তে। যদিও কবিতা আমাকে তেমন একটা টানে না, তবুও এই কবিতাগুলো ভালোই লাগল। হয়ত ভাষার সহজবোধ্যতার জন্য।

আরোহী বলেছিল নয়টার দিকে আসবে। ঘড়িতে দেখলাম দশটা পঞ্চান্ন বাজছে। আরোহী এখনও কেন আসছে না? ওকে ফোন করলাম; কিন্তু ফোনেও পেলাম না। কী জানি ওর আবার কী হল? এত রাতে কী আর ও আসবে? না আসুক; কিন্তু আমাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিতে পারত। আজকে ওকে আমার খুব দরকার ছিল। কী জানি ওর বাড়িতে আবার নতুন করে কোনও ঝামেলা হল কি না? ঐ বাড়িতে তো প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটতেই থাকে। আরোহীর সৎমা এতবছরেও ওকে আপন ভাবতে পারেননি! মানুষ যে কী করে এত সংকীর্ণ মনের হয়, আমি বুঝি না। আরোহী কয়েকবার চেয়েছে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে; কিন্তু ভাইবোনগুলোর জন্য পারেনি। সৎ ভাইবোন হলেও, ওরা আরোহীকে পছন্দ করে, ভালোবাসে।

আমি ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় আরোহীর ফোন এল। প্রায় বারোটা বাজছে। এত রাতে ফোন করার কথা মনে পড়ল ওর? “হ্যালো, আরোহী…”

“জবা, শুয়ে পড়েছিস?”

“এখনই শুয়ে পড়ব। তুই আসলি না, একটা ফোনও দিলি না?”

“দাঁড়া, আমি এসে বলছি।”

“এত রাতে আসতে হবে না। আমি শুয়ে পড়েছি।”

“আরে গাধা, দরজা খোল। আমি তোদের ফ্ল্যাটের সামনে।”

তাড়াতাড়ি উঠে এসে দরজা খুলে দেখি, আরোহী দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাতে কোত্থেকে?”

“সর, ভেতরে ঢুকতে দে আগে। পরে কথা বল।”

আমি সরে দাঁড়ালে, আরোহী আমার রুমে ঢুকে গেল। ওয়ারড্রব থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আমি আরোহীর অপেক্ষায় বসে আছি। ও গোসল সেরে বের হয়ে এসে বলল, “খাবার-দাবার কিছু আছে নাকি?”

“হুম, আছে।”

“তুই খেয়েছিস?”

“খাবো না। তোর জন্য আনব?”

“তোর আনতে হবে না। আমি নিয়ে আসছি।”

দু’মিনিট পর দুইটা প্লেটে খাবার নিয়ে আরহী রুমে ঢুকল। আমার দিকে একটা প্লট এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে ধর।”

“আমার জন্য এনেছিস কেন? আমি তো বললাম খাবো না।”

“কেন খাবি না? ইউএসএ যেতে পারলি না, সেই বিরহে?”

“উলটোপালটা কথা বললে, এক চড় দেবো। এতক্ষণ কোথায় ছিলি আর এত রাতে গোসল করলি কেন?”

“হসপিটাল থেকে সরাসরি এখানে আসলাম।”

“হসপিটালে কেন?”

“মৌমিতার সঙ্গে যেতে হল রে। হঠাৎ মেয়েটার লেবার লেবার পেইন উঠল। ওর সঙ্গে তো কেউ নেই আর ওর ভাইটা তো ছোটোমানুষ।”

“ওর বর কোথায়?”

“তামিম ভাই বরগুনা থেকে রওনা দিয়েছে। সিজার করার জন্য যখন সবকিছু রেডি করল, তখনই ওর নর্মাল ডেলিভারি হয়ে গেল।”

“বাহ, ভালো তো। মৌমিতা এখন কোথায়?”

“হসপিটালেই আছে৷ কী সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে ওর! গালগুলো একদম গোলাপি। বেচারি মৌমিতা ভীষণ দুর্বল হয়ে আছে। ওর বোন আসার পর, আমি চলে এসেছি। এই তুই খাচ্ছিস না কেন? বাসায় কিছু হয়েছে নাকি?”

“কী আর হবে? মা আর বড়ো খালাকে কিছু কথা শোনালাম। তাতে যদি ওনাদের একটু বোধোদয় হয়। আত্মীয়স্বজনেরা কেন যে এই অকারণ ঝামেলাগুলো পাকায়, আমি বুঝি না। আমার মনটা ভালোই হচ্ছে না, আরোহী।”

“মন খারাপ করিস না রে। আত্মীয়স্বজন আছেই ঝামেলা পাকানোর জন্য। সবরকম মানুষকে নিয়েই তো আমাদের চলতে হয়। জানিস, আমার মা নেই দেখে মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়; কিন্তু এখন একটা কথা ভেবে খুব শান্তি পাচ্ছি। আত্মীয়স্বজনের ঝামেলা নেই বলে, আমাকে তোর মতো এত হ্যাপা সইতে হয় না। আমি আমার নিজের মতো চলি। আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কেউ নেই। আমার বাপের কথা বলবি? আব্বা তো আর আমার আব্বা নেই। উনি হচ্ছেন রেহানা বেগমের স্বামী আর তুতুল-শামীমের আব্বা। উনি মাঝে মধ্যে যখন আমাকে শাসন করার চেষ্টা করেন, তখন আমার ভীষণ হাসি পায়। আদরের বেলায় নেই, অথচ শাসনের বেলায় বাপগিরি ফলাতে আসে! ভন্ড একেকটা। বাদ দে এসব কথা। তুই সত্যি করে বল তো, আজকের ঘটনার জন্য তোর কোনও আফসোস হচ্ছে? একবারও কী মনে হচ্ছে, হলেও হতে পারত….”

“না। আমার কোনও আফসোস হচ্ছে না। আমি তো মা’কে বলেই দিয়েছি, আজকের পর আর কখনও যেন আমার বিয়ে নিয়ে কেউ কোনও কথা না বলে। বিয়ে এমন কোনও জরুরি বিষয় না, যেটা না হলে, আমার জীবন থেমে যাবে।”

“কিন্তু আমার যে এখন খুব বিয়ে করতে ইচ্ছা করে। বিয়ে করলে আমি একটা সংসার পাব, কিছু মানুষের আদর পাব। আদর ছাড়াই তো এত বছর কাটিয়ে দিলাম; কিন্তু এখন আদর পাওয়ার, ভালোবাসা পাওয়ার খুব লোভ হয়, জানিস? আমারও খুব ইচ্ছা করে, কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে, কেউ ভালোবেসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। অসুস্থ হলে, কেউ একজন জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। একটা কথা বল তো জবা, আমার জীবনটা কী এভাবেই ফুরিয়ে যাবে? আমার কী কোনোদিন নিজের একজন মানুষ হবে না?”

“হবে। টেনশন করিস না। তোর মাহিন ভাইয়ের কী অবস্থা? সে তো তোর জন্য…….”

“খবরদার ঐ বাটপাড়ের কথা বলবি না। আমার সঙ্গে দুই নাম্বারি করতে এসেছিল। কত বড়ো সাহস!”

“সে আবার কী করল? দুইদিন আগেই তো মাহিন ভাই, মাহিন ভাই বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছিলি।”

“আমি পরশুদিন রাতে জানতে পেরেছি, হারামজাদার বউ আছে।”

“বউ আছে?”

“হুম। কালকে শয়তানটাকে এমন ডলা দিয়েছি, সাহস থাকলে আর কোনও মেয়ের সঙ্গে বদমায়েশি করতে যাবে না।”

“কী করেছিস?”

“করেছি একটা কিছু। ও কারও কাছে বলতেও পারবে না, ওর সঙ্গে আমি কী করেছি।” কথাটা বলে আরোহী একচোট হেসে নিল।

আমি মাঝেমধ্যে আরোহীকে দেখে অবাক হই। মনে হয়, কী নিশ্চিন্ত জীবন ওর। ওর যা মন চায়, ও করতে পারে। আমার মাঝে মাঝে মন চায় আরোহীর মতো বন্ধনহীন জীবন কাটাতে। পারি না। সম্পর্কের সুতোগুলোয় কেমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছি। এত সহজে এই জাল কেটে বের হতে পারব না আমি।

খাওয়া শেষ করে বিছানায় বসে আরোহী বইটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কার বই রে?”

“সন্ধ্যায় যিনি এসেছিলেন।”

“তোকে বই গিফট করল! বাহ্, পড়ুয়া লোক মনে হয়।”

“এটা ওনার লেখা কবিতার বই।”

“বলিস কী, তোর একজন কবির সঙ্গে বিয়ে হচ্ছিল!” আরোহী বইটা উলটে-পালটে দেখতে লাগল। শেষের পাতায় লেখক পরিচিতিতে সিয়ামের ছবিটা দেখে বলল, “সুন্দর আছে তো। চেহারায় একটা কী জানি আছে?”

“কী আছে?”

“আছে একটা কিছু। কী জানি বলে ঐটাকে, একটা আকর্ষণ আছে।”

“তোর পছন্দ হয়েছে?”

আরোহী ছবিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কবিরা নাকি মানুষ হিসেবে ভীষণ উদাস হয়। তুই কী জানিস এটা?”

“না জানি না। জানতে চাইও না। কারণ কবিতা আমার পছন্দের বিষয় না। তাই কবি উদাস না প্রেমিক, সেটা নিয়ে আমার কোনও ভাবনা নেই। কে যেন বলেছিল, কবিরা নাকি ভালো প্রেমিক হয়। সাথে এটাও শুনেছিলাম, সেই প্রেম নাকি কবিতার মাঝেই ফুরিয়ে যায়। বাস্তব জীবনে তার ছিটেফোঁটা হয়ত পাওয়া যায়। বাদ দে তো এসব কথা। আমরা কবি আর কবিতা নিয়ে এত আলোচনা করছি কেন? আমাদের কী আর অন্য কোনও কথা নেই?”

আরোহী আমার কথার উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বইটা দেখতে লাগল।…………………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে