বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০৪

0
2559

#বিবাহ_বিভ্রাট (৪)
*******************
দুই মামা হৈচৈ করেই যাচ্ছেন। ওদিকে সিয়ামরা তিন ভাইবোন কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় আছে! তাঁদের অবস্থা দেখে মনে হল, নেহায়েত ভদ্রলোক বলেই এই পরিস্থিতিতে তাঁরা আমার মামাদের কথার উত্তর দিতে পারছেন না। তমাল ভাইয়া হঠাৎ মামার ওপর চিৎকার করে উঠলেন, “দোষ তো চাচীর। আংকেল, আপনি সিয়ামের সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন না, প্লিজ। চাচী আপনি বলেন, এমন কেন হল? গতকাল রাতেও তো ইয়ানাকে নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বললাম। বলিনি, বলেন?”

বড়ো খালা নিজের গায়ে দোষ নিতে নারাজ। তাঁর ঐ এক কথা, তিনি ভুলে গেছেন। সারাদিন নানান কাজে এত ব্যস্ত থাকেন, যে দরকারি বিষয়টা তাঁর মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। তিনি বারবার এই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলেন।

কেউ যদি শুরুতেই দোষ স্বীকার করে নেয়, এরপর তাঁর সঙ্গে আর ঝগড়া করা বা কথা বাড়ানো যায় না। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, বড়ো খালা বাচ্চার বিষয়টা মোটেও ভুলে যাননি। তিনি ইচ্ছা করেই এই কাজটা করেছেন; কিন্তু কেন করেছেন, সেটাই বুঝতে পারছি না! বড়ো খালার এই কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে একজন অচেনা মানুষকে বাড়ি ডেকে এনে অপমান তো করা হলই, পাশাপাশি তিনি আমাকেও অপমান করলেন।

মা আর ছোটো খালা মিলে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। সামিরা আপু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। মা ওনার হাত ধরে বললেন, খাওয়াদাওয়ার পর সবাই বসে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবেন। আমার এখন আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। কথাবার্তাগুলো শুনতে অসহ্য লাগছে। সবার সামনে থেকে উঠে চলে যাওয়াটা খারাপ দেখায়; কিন্তু এই অবস্থায় এখানে বসে থাকতেও ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ইতস্তত বোধ করে উঠে দাঁড়ালে, ছোটো মামা বলল, “জবা, কিছু বলবি?”

আমি বললাম, “আমি ভেতরে যাচ্ছি।” কথাটা শুনে সিয়াম আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব নাকি ক্রোধ, কী ছিল, ঠিক বুঝলাম না। অবশ্য আমার এখন কোনোকিছু বোঝার মতো অবস্থা নেই। আমি তাঁর দৃষ্টি উপেক্ষা করে ভেতরে চলে এলাম। এভাবে চলে আসতে ভীষণ খারাপ লাগছিল। আমাদের বাসায় এসে একজন মানুষ অপমানিত হচ্ছেন অথচ আমি তাঁর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।

আরোহী আমার রুমে বসে ছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে বলল, “কী রে, এমন হৈচৈ হচ্ছে কেন? বাচ্চা, বাচ্চা কী যেন শুনলাম? কার বাচ্চা? কী নিয়ে কথা হচ্ছে ওখানে আর তুই চলে এসেছিস কেন? ওনাদের সঙ্গে তোর কথা হয়ে গেছে?”

আরোহীর কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। শুধু বললাম, “আরোহী, আজ থাকবি আমার সঙ্গে?”

“কী হয়েছে জবা? কোনও সমস্যা?”

“আমিই সমস্যা। আমি সমস্যা বলেই তো আমাকে বিদায় করার জন্য সবাই মিলে উঠেপড়ে লেগেছে। আমি যে জীবনের আটাশটা বছর পার করেছি, এতে যেন মহা অন্যায় করে ফেলেছি। কেন আমার এত বয়স হয়ে গেল? এরপর তো আমি মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে যাব। তাই কানাখোঁড়া যা পাওয়া যায়, তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিতে হবে! আমার টেনশনে আমার মা-খালাদের রাতে ঘুম আসে না। আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করাই যেন এঁদের সবার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে আমি দম নিলাম। রাগে আমার শরীর কাঁপছে। আরোহী আমার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বল তো? তুই এত রেগে আছিস কেন? ছেলেটার কী কোনও সমস্যা? একটা চোখ নষ্ট? পায়ে সমস্যা? কী রে, বল না?”

আরোহীর বলার ধরণে রাগের মধ্যেও হেসে ফেললাম। বললাম, “ছেলে ঠিক আছে। তাঁর দিকে থেকে কোনও সমস্যা নেই। উনি নিজের সবকিছু পরিস্কার করে জানিয়েছেন। ওনার ওয়াইফ মারা গেছে কিছুদিন আগে এবং ওনার একটা মেয়ে আছে।”

“বলিস কী? তুই এই লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলি? তোর কী মাথা খারাপ!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “জীবনসঙ্গী মারা যাওয়া বা সন্তান থাকা, দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাওয়া কোনও পুরুষ বা নারীর জন্য এমন কোনও ভয়াবহ দোষের বিষয় না, যদি তিনি বিষয়টা না লুকান। তিনি তো সব জানিয়েছেন। লুকিয়েছে বড়ো খালা। বড়ো খালা বাচ্চার কথাটা একদম চেপে গেছে।”

“তোর বড়ো খালাকে আমার সবসময়ই ভেজালের মানুষ মনে হয়, জবা। ধ্যাত, মহিলাটা এমন কেন? গিরগিটি কোথাকার! এখন কী হবে, জবা? কী করবি?”

“কিছুই করব না।”

“তুই ঐ ছেলেটাকে কিছু বলেছিস?”

“ওনাকে বলব কেন! উনি তো কোনও দোষ করেননি। যাকে বলার, তাঁকেই বলব৷ আমার জীবন নিয়ে অযাচিত নাক গলানোর সুযোগ অনেক দিয়েছি৷ এবার আর কেউ নাক গলাতে পারবে না।”

“আমি কী একবার দেখে আসব ওদিকে কী হচ্ছে?”

“কোনও দরকার নেই। চুপ করে বসে থাক।”

পলাশ ঘরে ঢুকে বলল, “আপু, ওরা চলে গেছে।”

বুঝলাম সিয়ামরা চলে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম তমাল ভাইয়াও চলে গেছে কি না। পলাশ জানাল, তমাল ভাইয়া ওনাদের সঙ্গেই বেরিয়ে গেছে। পলাশকে এখন খুব নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে। এই কয়দিন সে মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এখন আবার আগের মতো হাসিখুশি মুখে কথা বলছে।

পলাশ বেরিয়ে গেলে আরোহী বলল, “জবা, আমি পার্লারের মেয়েদের বিদায় দিয়ে, পার্লার বন্ধ করে তারপর আসব। আমার আসতে নয়টা বাজবে। শোন, তুই আন্টির সঙ্গে বেশি চিল্লাচিল্লি করিস না কিন্তু।”

“হুম। আরোহী তুই আসিস কিন্তু।”

————————-

আরোহী চলে গেলে সাজপোশাক পালটে রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে এসে জানালার কাছে বসলাম। দরজাটা ভেজানো আছে তাই বাইরে থেকে টুকরো, টুকরো কথাবার্তা কানে আসছে। প্রথমে কিছুক্ষণ ছেলেপক্ষ নিয়ে কথাবার্তা হল এবং তারপরই সবাই খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে হৈচৈ, হাসাহাসি চলছে। যেন কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা সবার মন থেকে মুছে গেছে। দরজা ঠেলে তমা ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, “জবা আপু, তোমাকে বাইরে ডাকছে।”

“কে ডাকছে? কী কারণে ডাকছে?”

“আম্মু, খালা সবাই ডাকছে। আমরা সবাই খাচ্ছি আর তুমি এখানে একা বসে আছ। লাইট অফ কেন, আপু? অন্ধকারে একা বসে আছ কেন?”

“তমা একটা কাজ করবে?”

“কী কাজ, আপু?”

“বড়ো খালাকে একবার আসতে বলবে আমার রুমে?”

“সবাই তো খাচ্ছে। তোমাকেও তো ডাকছে। তুমি আসবে না?”

“আমি এখন কিছু খাবো না। বড়ো খালা খাওয়া শেষ করুক। তারপর আসতে বলো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

পাঁচ মিনিট পর বড়ো খালা রুমে ঢুকে বললেন, “কী রে তোকে যে ডাকলাম সবাই, তুই আসলি না কেন? কত খাওয়া পড়ে আছে। খাবি না তুই?”

রুমের বাতি জ্বালিয়ে বড়ো খালাকে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “খাবো। আগে তোমার সঙ্গে কথা শেষ করে নিই।”

“তুই একদম ভাবিস না, জবা। এরচেয়েও ভালো ছেলে তোর জন্য খুঁজে বের করব।”

“বড়ো খালা, একটা কথার উত্তর দেবে?”

“কী কথা, বল না?”

“তুমি আমার সঙ্গে এমন করলে কেন?”

“কী করে যে ভুলটা হয়ে গেল! আমার না একদমই খেয়াল ছিল না রে।”

“তোমার অবশ্যই খেয়াল ছিল, বড়ো খালা। তুমি ইচ্ছা করে এই কাজ করেছ। তবে কেন করেছ, সেটা আমি জানি না। কেন করেছ, বড়ো খালা?”

“তুই এটা কী বলিস, জবা? আমি ইচ্ছা করে তোর সঙ্গে খারাপ কিছু করব! তুই আর তমা কী আমার কাছে আলাদা কেউ? তুই আমার মেয়ের মতো। আমি কোনোদিন তোকে তমার চেয়ে আলাদা করে দেখিনি।”

“আমি তোমার মেয়ের মতো, মেয়ে না। তুমি তমার জন্য সিয়ামকে পছন্দ করতে, বড়ো খালা? কখনোই করতে না। তাহলে আমার বেলায় এমনটা করলে কেন? আমার বাবা নেই বলে? বড়ো খালা, আমরা তো কোনোদিন তোমাদের কাছে হাত পাতিনি। আমার মা কী কোনোদিন তোমার সামনে গিয়ে আমাদের জন্য অনুগ্রহ ভিক্ষা চেয়েছে?”

“কী বলিস এসব? শিউলি কোনোদিন আমার কাছে কিছু চায়নি৷ চাইতে হবে কেন? বড়ো বোন হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে না? তোদের বাবা নেই। দাদারবাড়িরও বলতে গেলে নেই। আমরা যদি তোদের না দেখি, তাহলে কে দেখবে, বল?”

“বড়ো খালা তুমি কিছু মনে করো না। তোমাকে আজ একটা অনুরোধ করব।”

বড়ো খালা খুশি হয়ে বললেন, “তুই কী চাস মা, বল আমাকে।”

“আমি একটাই জিনিস চাই, তুমি আর কখনও আমাদের কোনও ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না। আমাদের ভালো-মন্দ নিয়ে তোমাকে একদম ভাবতে হবে না। বাবা চলে যাওয়ার পর কিছুদিন আমরা টলোমলো অবস্থায় ছিলাম। সেই অবস্থা যখন কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, ভবিষ্যতের পথটুকুও আমরা নিজেরাই পার করতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। আমি, আমরা কারও অনুগ্রহ চাই না। কাজেই আজকের পর তোমরা, আমাদের নিয়ে কোনোরকম দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে আসবে না, প্লিজ। আমি বিয়ে করব কী করব না, সেটা একদম আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আমি কী তোমাকে বোঝাতে পেরেছি, বড়ো খালা?”

বড়ো খালা থ হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি বোধহয় কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁকে আমি এমন কঠিনভাবে কথা শোনাব। কথা না শুনিয়ে আমার আর উপায় ছিল না। কাছের মানুষরা মাঝেমধ্যে আমাদের জীবন নিয়ে যা খুশি করার সাহস দেখান। তাঁরা ভুলে যান, সেই অধিকার আমরা তাঁদের দিইনি। তখন বাধ্য হয়েই তাঁদেরকে, তাঁদের অবস্থান বুঝিয়ে দিতে হয়। ঠিক সেই কাজটাই এখন আমাকে করতে হচ্ছে বড়ো খালার সঙ্গে।

বড়ো খালা এতটাই অবাক হয়েছেন যে উনি আমাকে কিছু বলতেই পারলেন না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম, বড়ো খালা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর পরিবার নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

একে একে বাকিরাও চলে গেল। আমি রুম থেকে বের হইনি। ছোটো খালা ছাড়া কেউ আমার রুমে আসেওনি। ছোটো খালা যাওয়ার আগে বলে গেল, আমি যেন মন খারাপ না করি। আগামীতে নিশ্চয়ই ভালো কিছু অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য।

রুম থেকে বের হচ্ছি না দেখে, মা একটা প্লেটে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলেন৷ আমার সামনে প্লেটটা রেখে বললেন, “সবাই এত ডাকল, তুই একবারও আসলি না?”

মা’র ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে আজকে। রাগটা চেপে রাখতে পারলাম না। বললাম, “সবাই ডাকলেই আমাকে যেতে হবে? সবাই যা বলবে, তা-ই করতে হবে আমাকে?”

“তুই এভাবে কথা বলছিস কেন, জবা?”

“কীভাবে কথা বলব? লোকজন দিয়ে আর কত অপমান করাবে তুমি আমাকে? আমার বিয়ে হচ্ছে না দেখে তুমি টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছ? কেন তোমার বোনের মুখের ওপর বলে দিতে পারোনি, যা ইচ্ছা তা-ই প্রস্তাব আনলেই তুমি তোমার মেয়ের বিয়ে দেবে না? তোমার বোন কথা দিয়েছে বলেই শুধু আমি এদের সামনে যেতে রাজি হয়েছিলাম। তুমি এখন দেখলে, তোমার বড়ো বোন কীভাবে সবাইকে অপমান করল? মা, আজকে শেষবারের মতো তোমাকে বলে দিচ্ছি, আজকের পরে আমার বিয়ে নিয়ে কেউ যেন একটা কথাও না বলে। কেউ না, এমনকি তুমিও না। এরকম আরেকটা পরিস্থিতি তৈরি হলে, আমি বাসা ছেড়ে চলে যাব। কথা মনে রেখো, মা।”

মা এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। আমার কথাগুলো মা হজম করতে পারছেন না, বুঝতে পারছি। কথাগুলো আজ আমি ইচ্ছা করেই বললাম। বলতে আমার নিজেরও ভীষণ খারাপ লেগেছে; কিন্তু ইচ্ছা করেই মা’কে আমি আঘাত করলাম। মা’র বুঝতে হবে আমরা এখন বড়ো হয়েছি৷ আমাদের নিজস্বতা বলে একটা বিষয় আছে। কথাগুলো কঠিনভাবে না বললে, তাঁকে বোঝানো যেত না। আমি জানি, মা আজ সারারাত ঘুমাবেন না। কেঁদে রাত পার করবেন। মা’কে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমিও কাঁদব; কিন্তু বারবার অপমানিত হয়ে কাঁদার চেয়ে আজ রাতভর না হয় কাঁদলাম দু’জন।……………………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে