বইছে আবার চৈতী হাওয়া পর্ব-০১

0
1111

বইছে আবার চৈতী হাওয়া

ক্যাম্পাস থেকে বের হতে হতে প্রায় নয়টা বেজে গেল আশিকের I অবশ্য প্রতি সোমবারেই এমন হয় I ক্লাস শেষ হতে হতে পাঁচটা বেজে যায় I এরপর টিএসসিতে একটা আবৃত্তির আড্ডা থাকে I ঠিক ক্লাস বলা যায় না ওটাকে I আড্ডা বললেই ভালো বোঝায় I সেটা শেষ হতেও প্রায় আটটা বেজে যায় I কয়েক দফায় চা সিগারেট চলে I বেশ কবছর হয়ে গেল আশিকের ওখানে I এখন ওকে সিনিয়ার বলা যায় I আজ টিএসসি থেকে বের হবার পর রাসেলের সঙ্গে দেখা I কাকতালীয়ভাবে নয় I রাসেল বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ওর জন্যই I দেখা হলে বলল
– চল মামু I চিপায় একটু বসি I মাল আনছি I
এটাও নতুন কিছু নয় I বেশ ক’বছর হয়ে গেল I ক্যাম্পাসের গলি-ঘুপচি তে বসে ওরা কজন মিলে এভাবেই গাঁজা টানে I আজ নেশাটা কিছুতেই ধরছিল না I এক সময় বিরক্ত হয়ে আশিক বলল
– কিসের ভালো মাল ? ফালতু জিনিস I কোথা থেকে আনস ?
– আজকাল ভালো জিনিস পাওয়া যায় না মামু ? দাম ও বাড়ছে i
– বাদ দে i আমি উঠলাম I
– আরেকটু বসো মামু I অন্য প্যাকেটটা খুলি i
– লাগবেনা I

আশিক উঠে পড়ে I হাঁটতে ইচ্ছা করছে না আজ I একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে I রিক্সা চলছে ধীরগতিতে I যেন কোনো তাড়া নেই তার I তাড়া অবশ্য আশিকের ও নেই I মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না I বাড়ির জন্য কোন টান অনুভব করে না ও I বাবার সঙ্গে দেখা হয় না কতদিন , একই বাড়িতে থেকেও I

আশিকের বাবা আরিফুজ্জামান I দুদে উকিল I বাড়িতেই চেম্বার করেছেন একতলায় I ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচ তলাটা পুরোটা জুড়েই ড্রইংরুম আর তার চেম্বার I সন্ধ্যা হলেই ক্লায়েন্টদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায় I রাত প্রায় নটা পর্যন্ত চলে I ঠিক 9:30 উনি ডিনার করেন I তারপর ঘন্টাখানেক চেম্বারে সময় কাটান I আশিক চেষ্টা করে ওই সময়টাতে বাড়ি ফিরতে I যেন বাবার মুখোমুখি হতে না হয় I আফসিন থাকে ওর পড়াশোনা নিয়ে I আশিকের চেয়ে তিন বছরের ছোট ও I এমনিতে খুব ভাব I কিন্তু মেয়েটা অতিরিক্ত পড়ুয়া I

আশিক ঘোলাটে চোখ এদিক ওদিক তাকায় I চারিদিকে আবছা অন্ধকার I সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলোয় সবকিছু কেমন অপার্থীব লাগে Iরিক্সা ফুলার রোড ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে I কালভার্টে প্রচুর কপোত-কপোতী বসে প্রেম আলাপ ব্যস্ত I আনমনা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে ও I সত্যি কথা বলতে , ওর কখনো ইচ্ছা করে না এখানে বসতে I সময় নষ্ট I একটা ভালো কবিতা লিখতে গেলে অনেক বেশি ফোকাস দরকার I এসব ফালতু জিনিস এ সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়না I এমন না যে নারী সঙ্গ ওর পছন্দ নয় I মাঝে মাঝে মনে হয় ,একান্ত কেউ একজন থাকলে ভালো হতো I যাকে নিয়ে কবিতা লেখা যেত I

আশিকের খুব ইচ্ছে ছিল বাংলা সাহিত্য পড়ার I এইচ এস সি তে ভালো রেজাল্ট থাকা সত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা দিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে পড়বে বলে I সুযোগ ও পেয়েছিল I ভাইভা বোর্ডে শিক্ষকেরা যখন জিজ্ঞেস করলেন আর কোন সাবজেক্টে চান্স পেয়েছে কিনা ,আশিক একটু লজ্জিত গলায় বলেছিল
– বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম একশ জনের মধ্যে আছি I হতভম্ব শিক্ষকেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন I অতঃপর একজন রেগে গিয়ে বললেন
– বের হয়ে যাও এখান থেকে I কেন ফালতু সময় নষ্ট করতে এসেছ ?
আশিক বুঝতে পারছিল না কি জবাব দেবে I শিক্ষকদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন , তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন
– শোনো ছেলে I কি নাম তোমার ? আশিকুজ্জামান ,তাই না ? কোন সাবজেক্টে চান্স পেয়েছ ?
আশিক সাবজেক্টের নাম বলল
– তাহলে এখানে কি করতে এসেছ ? মজা দেখতে ?
– না স্যার I আমি একজন সাহিত্যিক হতে চাই I
– সাহিত্যিক হয়ে কি করবে ? চাকরি বাকরি কিছু পাবেনা , হতাশায় গাজা খাওয়া শুরু করবে I বুঝতে পেরেছ ?
আশিকের প্রায় মুখে চলে এসেছিল যে ‘ স্যার গাজা তো এখন ও খাই I কিন্তু ভয়ে সেকথা বলতে পারেনি I স্যারেরা কিছুতেই ওকে ভর্তি নিলেন না I বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করে দিলেন I

ওর মন খারাপ দেখে বাবা বলেছিলেন I
-এত মন খারাপ করার কিছু নেই I তুমি চাইলে যে কোন সাবজেক্টে পড়েই সাহিত্যিক হতে পারবে I তোমার ইচ্ছা এবং ডেডিকেশনটাই ইম্পর্টেন্ট I কবি নজরুল ,শরৎচন্দ্র ,নীহাররঞ্জন গুপ্ত ওনারা কেউ বাংলা সাহিত্যে অনার্স করেননি , কিন্তু তারা কালজয়ী সাহিত্যিক হয়েছেন I যে সাবজেক্টে চান্স পেয়েছ সেখানেই পড় I একবার মাস্টার্স পাশ করে ফেললে আমি আর তোমাকে সাহিত্যিক হওয়া থেকে আটকাবো না I
অগত্যা বাধ্য হয়েই আশিককে সাহিত্যের আশা বাদ দিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে হল I ভর্তি হল ঠিকই কিন্তু পড়াশোনায় মন বসাতে পারলো না I কোনমতে সেকেন্ড ক্লাস হাতে রেখে ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত চলে গেল I তবে সাহিত্যচর্চা ও কখনোই ছাড়েনি I নিজের মতো করে পড়াশোনা করেছে I এছাড়াও ডিপার্টমেন্টের যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব ওর I শুরু থেকেই এই দায়িত্ব ও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে I এবং সফলও হয়েছে শতভাগ I ডিপার্টমেন্টের কোন অনুষ্ঠান ওকে ছাড়া হয়না I

সামনেই নবীন বরণ I এবার ব্যতিক্রমী কিছু করার ইচ্ছা আশিকের I ওই নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ লক্ষ্য করলো রিক্সা ফুলার রোড থেকে বেরিয়ে ডান দিকে যাচ্ছে অথচ যেতে হবে বামে I আশিক নীলক্ষেত এ যাবে বলে রিক্সা করেছে I কেন যেন রিকশাওয়ালাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না I আশিক ওর গেরুয়া রঙের চাদরটা গায়ে আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নীল I নভেম্বরের মাঝামাঝি I শীত পড়তে শুরু করেছে I হঠাৎই রোকেয়া হলের উল্টা দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখে ওর চোখ আটকে গেল I ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে I মুখ দেখা যাচ্ছেনা I সোডিয়াম লাইটের আলোতে খোলা চুল গুলোকে সোনালী আভা I আশিক চেয়ে রইল অপলক I কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে I কিন্তু মাথায় একটা লাইনও আসছে না I নেশাটা বোধ হয় ধরতে শুরু করেছে I মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে I আশিক বিড় বিড় করে বললো

সমস্ত দিনের শেষে
শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল,
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল
সব পাখি ঘরে আসে
সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার
মুখোমুখি বসিবার ……………….

কে তুমি ?
চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে