বইছে আবার চৈতী হাওয়া পর্ব-৬৮ এবং শেষ পর্ব

0
853

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
শেষ পর্ব

তুমি কি জান যে তোমাকে আমার কি ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করে? একবার বলতে ইচ্ছা করে “তোমাকে দেখেছি সেই কবে কোন বৃহস্পতিবার তারপর এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না।”

এই দক্ষিণের জানালায় আমি রোজ এসে বসি। জানতো, কেউ শহর থেকে এলে তাকে এদিক দিয়েই আসতে হয়। আমি চেয়ে থাকি। প্রতিদিনই মনে হয় এই বুঝি তুমি এলে। এখানে বসে থাকতে থাকতে কার্নিশের সব কাক শালিক আর চড়ুইদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ওরাও এখন আমার সঙ্গে বসে তোমার জন্য অপেক্ষা করে। আচ্ছা, সত্যি করে বলতো আমার কথা কি তোমার একটুও মনে পড়ে না?

কতদিন হয়ে গেল তোমাকে একটা কথা বলবো বলে অপেক্ষা করে আছি। কত কি ভেবে রেখেছিলাম কেমন করে বলবো। কি দিয়ে শুরু করব। জানিনা এই চিঠিটা যখন তুমি পাবে তখন আমি থাকবো কিনা। খুব ইচ্ছা ছিল, একথা শুনে তুমি কি বলো তা দেখার। কি জানি এই জীবনে আর তা দেখা হবে কিনা।

এটুকু পড়ে আশিক থামলো। জানালার বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঝড়ো হাওয়া। বাসটা একটা বিপদজনক বাক পেরিয়ে রাস্তার একপাশে দাড়াল। যাত্রীদের মধ্যে উদ্বেগ। কেউ কেউ উঠে এসে জানতে চাইছে কি হয়েছ। আশিক হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ঘড়ি দেখল। তিনটা দশ। এখনো আরো ঘন্টা দেড়েকের পথ। এর মধ্যে বাস থেমে থাকলে আরো দেরী হবে। ওর ফোনে কোন চার্জ নেই। কাল রাত থেকে অসংখ্যবার মীরাকে ফোন করেছে। ওর ফোন বন্ধ। আশিক চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল ,আল্লাহ মীরার যেন কিছু না হয়। ও যেন ঠিক থাকে। চোখ মেলে ও নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ওর ঈশ্বরে অভক্তি জন্মেছিল। তীব্র অভিমান নিয়ে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। কিন্তু আজ এই পরিস্থিতিতে এসে অনুধাবন করছে, কি তুচ্ছ ওর অস্তিত্ত আর কি পরম ক্ষমতাধর মহান সৃষ্টিকর্তা। আশিক আবার চোখ বন্ধ করে বলল “হে আল্লাহ আমার ভুলের শাস্তি তুমি ওকে দিও না। আমি এ জীবনে করা আমার সমস্ত ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি পরমকরুনাময়, আমাকে ক্ষমা কর আর আমার ভালবাসাকে সুরক্ষিত রাখ।

বাসটা আবার চলতে শুরু করেছে। আশিক চোখ মেলে আবার পড়া শুরু করল।

তুমি কি জানো তোমার আমার মধ্যে কেউ আসতে যাচ্ছে? ওই হতচ্ছাড়া ডাক্তার আমাকে ভীষণ ভয় দেখিয়েছে জানো তো। কি সব মাথা মুন্ডু বলেছে, আমি তার কিছুই বুঝতে পারিনি। বলেছে আমার কি সব জীবনের ঝুকি আছে। আরো কি সব যেন আছে আমি তার কিছুই বুঝিনি। আমি শুধু একটা কথা জানি। আমি জানি তুমি আমার কিছুই হতে দেবে না। কোনদিন ও না। আচ্ছা, তুমি কবে আসবে?

কাল আমরা সবাই বিরিশিরি গিয়েছিলাম পিকনিক করতে। তুমি নিশ্চয়ই গেছো সেখানে আগে। এই জায়গাটা আমার এত প্রিয়। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম যখন তোমাকে বাড়ি নিয়ে আসব তখন একসঙ্গে এসে বিরিশিরির জলে গা ভেজাবো। কি সুন্দর একটা ঝকঝকে দিন ছিল কাল, কিন্তু আমার মনের মধ্যে ছিল বর্ষার মেঘ। কিছু ভালো লাগছিল না। কেন এমন হয় বলতো? এই, এত আনন্দ, এত হাসি এত লোকের মধ্যেও নিজেকে কেমন একা লাগে আমার। আগে কখনো এমন হয়নি জানো তো। কি যে হল আমার আমি নিজেও জানি না ছাই। তোমার কথা এত বেশি মনে পড়ে। মন খারাপে, মন ভালোতে, একাকীত্বে, জনসমাগমে। আর কিভাবে বুঝাই বলোতো।

এখন কেন যেন মনে হয় তুমি আর আসবে না। আর কোনদিন তোমাকে দেখতে পাবো না। এই জীবনে হয়তো আর দেখাই হবে না। আচ্ছা, বলতো আমি যদি না থাকি তখন কি তোমার আমাকে একটুও মনে পড়বে না? আমার মাঝে মাঝে কি ইচ্ছা করে জানো

ইচ্ছে করে শুরু থেকে শুরু করি আমার জীবন।
তোমাকে দেখলে ইচ্ছে করে মরে যাই, মরে গিয়ে পুণ্য জল হই
কখনও তৃষ্ণার্ত হলে তুমি সেই জল যদি ছুঁয়ে দেখো।

তুমি যদি আমার এই চিঠি পড়ছো তার মানে তুমি ফিরে এসেছ। যদি সত্যিই তুমি এটা পড়ছো তাহলে আমি জানি আমার চাইতেও অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছ। তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি মনের মধ্যে কোন গ্লানি রেখো না। যদি আর কখনো আমাদের দেখা না ও হয় তবু জানবে তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমার মনের অন্ধকার জগত একটু আলোকিত করতে। কি জানি হয়ত আমিই পারিনি।
তুমি ভাল থেক।
তোমার মীরা

শেওলা ধরা পুরনো দিনের ছাদের, দক্ষিণের রেলিং ঘেঁষে একটা পেয়ারা গাছ। দুটো বিশাল পেয়ারা ঝুলছে। ছোট ছোট আরো কয়েকটা পাতার ফাঁকে আনাচে-কানাচে উঁকি দিচ্ছে। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে গাছের পাতা আর ফলগুলোতে খুশির আমেজ। মীরা পেয়ারা গাছটার কাছে এসে পেছন ফিরে দাঁড়ালো। প্রতিদিন এখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে ও। আজ থেকে ঠিক করেছে আর ওদিকে তাকাবে না। এত আশা ভঙ্গ আর নিতে ইচ্ছা করে না। ছাদে আসার আগে চাচি বারবার নিষেধ করেছিলেন। বলছিলেন বৃষ্টির কারণে ছাদ পিচ্ছিল হয়ে আছে। মীরা অবশ্য এমন কিছু দেখতে পেল না, বরং বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে ধুয়ে মুছে ছাদটা কেমন পরিষ্কার হয়ে আছে। মৃদু হাওয়া বইছে। বৈশাখেও চৈত্রের আমেজ। সেই দিনটা ও এমনই ছিল। এমনই এক চৈত্রের সন্ধ্যায় ওরা কাছে এসেছিল। এখন মনে হয় কত যুগ কেটে গেছে। আর কি আসবে না ওর জীবনে সেইরকম সোনালী দিন।
ডানদিকে একটা বড় কামিনী গাছ। ঝেপে ফুল এসেছে এই বছর। কি মিষ্টি সুগন্ধ ছড়িয়েছে চারিদিক। বৃষ্টি ভেজা কামিনী ফুলের গন্ধে বাতাস ম ম করছে। মীরা অস্ফুটে বলল
বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্‌রে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ
পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুল্‌ছে মহুল বন,
ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন!
কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই!
কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর-
কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর?
তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই?
কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই!
আশিক যখন বাস থেকে নামলো তখনো চারিদিকে ঝকঝকে আলো। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে সাড়ে চারটা বাজে। এখান থেকে একটা সিএনজি নিলে আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আশেপাশে কোন সিএনজি দেখা যাচ্ছে না। এখানেও বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিল। সেই কারনেই হয়ত বাস স্ট্যান্ডটা একদম ফাকা। কোনার দিকে একটা সিএনজি দাড়িয়ে আছে। আশিক উঠতে নিলে চালক জানাল যে একটু পর পর স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওকে রিক্সা নিতে বলল। কাছাকাছি কোন রিক্সা ও দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া, রিক্সায় গেলে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যাবে। এম্নিতাই খুব অস্থির লাগছে, তাই আর দেরি না করে উঠে পরল।
মনে হচ্ছে এটা ওর জীবনের দীর্ঘতম জার্নি। পথ যেন শেষই হচ্ছে না। আশিক অধৈর্য কন্ঠে জানতে চাইল
আর কতক্ষণ লাগবে?
এইতো আইসা পরসি
আর একটা বাক নিলেই মীরাদের বাসার গলি। এরপর আর এক কিলো মিটারের মতন। বাকটা ঘুরতেই সিএনজি বন্ধ হয়ে গেল। আশিকের মনে হল সিএনজি না ওর হৃৎপিণ্ডটা বন্ধ হয়ে গেল।

মীরা হাত বারিয়ে কামিনি গাছের একটা ডাল ধরল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। শরীরটা এমন হাল্কা লাগছে কেন? সামনে তাকিয়ে দেখল কোথা থেকে একটা শালিক পাখি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। মীরার বুকের ভেতরটা কেপে উঠল। এই অলক্ষুণে পাখিটা এখানে কেন এল? চাচী বলছিলেন এক শালিকে দুঃখ হয়। তবে কি সত্যি খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। আশিকের কিছু হয়নি তো?

আশিক ওর ব্যগটা কাধে নিয়ে প্রানপণ দৌড়ে যাচ্ছে। পথ যেন না কমে আরো দীর্ঘ হচ্ছে। দূরে অস্পস্টভাবে মীরাদের বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে। ছাদের রেলিং বেয়ে গোলাপী বাগানবিলাসের ঝাড় নেমেছে। বাড়ীটা যত কাছে আসছে ওর বুকের ভেতরের অস্থিরতা ততই বাড়ছে। কেন মনে হচ্ছে মীরা ঠিক নেই। ওর ভীষণ বিপদ।
দুর্বল কামিনি গাছের ডাল বেশীক্ষণ মীরার ভার বইতে পারল না। ছাদের ভেজা মেঝেতে পরে ওর শরীরটা কেঁপে উঠল। ঝাপসা চোখে দেখল শালিক পাখিটা এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল হয়ে। ওর চোখ বুজে এল। জ্ঞান হারানোর আগে ও দেখল কোথা থেকে আরেকটা শালিক এসে আগের পাখিটার পাশে দাড়িয়েছে। মীরা হাত বাড়িয়ে পাখি দুটোকে কাছে ডাকল। পাখি দুটো এল না। তারা ভীষণ মগ্ন নিজেদের মধ্যে।

পরিশিষ্ট

বইমেলায় ঢুকে মীরা হতভম্ব হয়ে গেল। গেট থেকে শুরু করে স্টল পর্যন্ত আজস্র মানুষের বিশাল লম্বা লাইন। মীরার পরনে হাল্কা বেগুনী শড়ি। ওর হাতের মধ্যে হাত জরিয়ে রেখেছে ওদের পাঁচ বছরের ছেলে মাশুক। ওর চোখে রাজ্যের বিস্ময়। ও পাশ ফিরে মা কে বলল
-এতগুলো মানুষ কি বাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে মা?
মীরা হাসল একটু, তারপর বলল
-তাইতো মনে হচ্ছে। চলো তো দেখি।
মীরা লাইনে না দাড়িয়ে স্টলের দিকে এগিয়ে গেল। লাইনে দাড়িয়ে থাকা অপেক্ষা রত মানুষ গুলো বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। দূরে স্টলের ভেতর আশিককে দেখা যাচ্ছে। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পাঠকদের অটোগ্রাফ দিতে। সামনে তাকিয়ে আশিক থমকে গেল। হাত নেড়ে ও হাসল। মীরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এত বছর পরে ও এই হাসি দেখলে ওর বুকের মধ্যে কাঁপন ধরে। আশিক স্টল থেকে বেরিয়ে এসে মীরার হাতে একটা বই দিয়ে বলল
-মীরা এটা লেখক কপি। তুমি এখানে অটোগ্রাফ দাও।
মীরা এবার আর অবাক হল না। এটা আশিকের পঞ্চম বই। প্রতিবার ও এই কাজই করেছে। মীরা প্রথম পাতাটা খুলে দেখল সেখানে লেখা
উৎসর্গ
আমার মীরাকে
তার পরের পাতায় লেখা

কে চায় সোনার খনি তোমার বুকের এই স্বর্ণচাঁপা পেলে?
তোমার স্বীকৃতি পেলে কে চায় মঞ্চের মালা
কে চায় তাহলে আর মানপত্র তোমার হাতের চিঠি পেলে,
তোমার স্নেহের ছায়া পেলে বলো কে চায় বৃক্ষের ছায়া
তোমার শুশ্রূষা পেলে কে চায় সুস্থতার ছাড়পত্র বলো,
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ চায় শ্রেষ্ঠ পদ
কে চায় তাহলে বলো স্বীকৃতি বা মিথ্যা সমর্থন,
তোমার প্রশ্রয় পেলে কে চায় লোকের করুণা
বলো কে চায় তোমাকে ফেলে স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রাজ্যপাট?
বলো না তোমাকে পেলে কোন মূর্খ অন্য কিছু চায়,
কে আর তোমার বুকে স্থান পেলে অন্যখানে যায়!

সমাপ্ত

আজকের পর্বে অনেকগুলো কবিতা আছে। প্রথমটা আর শেষটা মহাদেব সাহার লেখা। চৈতি হাওয়া কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। চিঠির মধ্যে আরো একটা কবিটা আছে সেটা তসলিমা নাসরিনের লেখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে