প্রয়োজন পর্ব: ২৪

0
884

#গোল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৪
লেখায়: তানিয়া তানু

অনেক্ষণ এই রুমে থাকায় নিশ্বাস আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। উনি মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গেলেন? এই চিন্তায় মাথা ঘামাচ্ছি। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

“ফুপি, দিবুর সারপ্রাইজে সত্যি আমি ভারি অবাক হয়েছি। আপনারা যে আসবেন, সেটা তো কল্পনার বাইরে ছিলো।”
“সব হলো দিবিয়ার জন্য।ওর জন্যই এখানে আসা। বলেছিলামই তো ওর বাঙালী ছেলে ভীষণ পছন্দ। বিয়ের বয়স তো হয়ে গেল তাই ওর জন্যই তোমার কাছেই আসা।”

উনাদের কথোপকথন এক পর্যায়ে বুঝলাম মহিলা মেয়ের বিয়ে উনার সাথে দিতে এসেছেন। আচ্ছা সত্যি কী এই মেয়ের সাথে উনার বিয়ে হবে? উনি কী আমাকে আর ভালোবাসেন না? সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় চলে গেলাম রুমে। ব্যাগ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় দরজায় দেখলাম উনি দাঁড়িয়ে আছেন।

“শুনুন, সকালের নাস্তা খেয়ে যাবেন প্লিজ।” এই কথা বলেই বাথরুমের কিসের একটা পোষাক নিয়ে গেলেন। ভালো করে দেখিনি সেটা। উনার ভিন্ন রকমের ব্যবহার আমি রুষ্ট। কী সুন্দর করে বিদায় করে দিচ্ছেন! তাও আবার নাস্তা করে যেতে বললেন। এগুলো ভাবতেই ধপ করে বিছানায় বসে গেলাম। চোখ দিয়ে যেন প্রবল বৃষ্টি পড়ছে।

“আপনি এখনো নিচে যাননি। সেখানে আমার ফুপি আছে। প্লিজ যান। ফুপি আজ রান্না করে আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন।উনি আপনাকেও ডেকেছেন।”

অশ্রু পূর্ণ চোখ নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনি ভ্রুক্ষেপ না করে আয়নায় গিয়ে চুল ঠিক করছেন। উনার পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম।
“আপনার জ্বর মনে হয় কমেনি। আজই অফিসে চলে যাবেন?” চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলাম। আয়না দিয়ে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,
“অনেক দিন কামাই করেছি। আর নয়।আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। আর হ্যাঁ খেয়েদেয়ে চলে যাবেন।”

নীরব হয়ে মেঝেতে খানিক তাকিয়ে রইলাম।

“নিয়ন, এই নিয়ন,উঠ। ফুপিরা চলে এসেছে।” নিয়নকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। নিয়ন আড়মোড়া হয়ে ভাইয়ের কথা শুনে ধড়পরিয়ে উঠলো। খুশির ঝলক যেন সারামুখে বিস্তৃত হলো। উঠেই ফ্রেশ হুওয়ার জন্য বাথরুমে গেল।

“আমার নাস্তা খাওয়ার প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ।” অনেক কষ্টে এই কথা বললাম।
কিন্তু উনি কিছুই বলছেন না দেখে ব্যাগ নিয়ে দরজার কাছে চলে গেলে আকস্মিক শুনতে পেলাম উনি বলছেন,
“চলেই যাচ্ছো তাহলে?”
উনার কথায় যেন মস্ত বড় নদীর বাঁধ ভেঙে গেল। দৌড়ে দু হাত দিয়ে আকঁড়ে ধরলাম উনাকে। এদিকে উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। যান্ত্রিক মানবের মতো হয়ে আছেন। অন্যদিকে আমি কান্না করে উনার ইউনিফর্ম ভিজয়ে দিচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,
“নিজেই তো বললেন চলে যেতে।”
“রাতের মতো অধিকার খাটিয়ে বলা যায় না বুঝি?”
“কোন অধিকারের থাকবো?”
“আমার জীবনসঙ্গী হয়ে।”
উনার এই কথায় মাথা তোলে তাকালাম। জ্বরে শুকিয়ে যাওয়া হাস্য উজ্জ্বল চেহারা।

“ভালোবাসি।” টুপ করে কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে বহু আকাঙ্ক্ষিত কথাটি বললেন। উনার ঠোঁটের স্পর্শে সারা শরীরে ঠান্ডার মতো এক শিহরণ বেয়ে গেল। লজ্জায় মুখ নামিয়ে রাখলাম। উনি দু হাত দিয়ে এবার আমাকে জরিয়ে মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে চেপে রাখলেন। উনার বুকের প্রতিটি হৃদাস্পদনের শব্দ আমার বুকের মাঝে তুমুল ঝড় তুলছে। কিন্তু পরক্ষণে দিবিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। উনাকে দিবিয়ার সম্পর্কে বললে উনি বলেন,
“উনারা কয়েকদিন আগেই এখানে এসেছেন দিবিয়ার বিয়ের পাত্র খোঁজার জন্য। আবার আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কাজের জন্য এতদিন সারপ্রাইজ দিতে পারেননি। আর আমিও নিলার বিয়েতে ছিলাম। গতকাল বিকেলে আসার কথা ছিলো কিন্তু বৃষ্টি হওয়ায় আসতে পারেননি। তাই ভোর সকালেই এলেন। শুধু উনি নয় আমাদের ড্রাইভার শুদ্ধ সবাই চলে এসেছে।জানো, ফুপি সব রান্না করেছে। আমার নিচে যেতে দেরী হচ্ছে বলেই।দিবু এসেছিলো উপরে। এসে আমাদের এইভাবে দেখে। কিন্তু বুঝ দিয়ে ফেলছি।

উনার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বললাম, কী করে বুঝিয়েছেন?”
উনিও টোল পড়া হাসি দিয়ে বললেন, “বলেছি ঐ যে বিছানায় মেয়েটাকে দেখে এলে ও তোমার হবু ভাবি।”

“ও রাগ করেনি?”
“কেন?”
“কারণ ওর তো বাঙালী ছেলে পছন্দ। আপনিও তো বাঙালী।”
“ধুর বোকা, বাঙালী ছেলে ফুপির পছন্দ কিন্তু দিবুর নয়। তবে বাংলাদেশের একটা ছেলেকে ভালোবাসায় ওর মাকে এই কথা বললো। বাংলাদেশের ছেলেকে পছন্দ হওয়ায় বাঙালীও এখন পছন্দ হয়ে গেল।”
“এই দেশের ছেলেকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ,ফেসবুকে নাকি একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। আর কথা বলতে বলতে এক সময় ভালোবাসা। কিন্তু ফুপিকে এই বিষয়ে বলতে লজ্জা করে বলেই আমার মাধ্যমে ও বলতে চায়। তাই আমার কাছে ফুপিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসা।তাই একটু আগে ফুপিকে ছেলের সম্পর্কে বলে এসেছি। তিনি ভেবেচিন্তে পড়ে জানাবেন বলেছেন।

উনার কথা শুনে মনে মনে হাজার শুকরিয়া জানালাম সৃষ্টিকর্তার প্রতি।

“চলো নিচে যাই।” এই বলেই আমার হাত উনার হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ করলেন। আঙ্গুলে আঙ্গুলে খেলায় ছলে নিচে নিয়ে গেলেন। সেখানে নিয়ন, দিবিয়া মেয়েটাও তার মা বসা আছেন। নাস্তা এখনো করেনি। উনার জন্য মনে হয় অপেক্ষা করছিলেন।

“এসো দীপ্তি, তোমার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম।
মনে মনে, আমার জন্য? বলে উনার দিকে তাকালাম। উনি ইশারায় উনার পাশে বসতে বললেন। উনার কথায় আন্টির পাশে গিয়ে বসলাম। মহিলার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চুলে সুন্দর করে খোপা করা। দেখতেও মাশাল্লাহ। তবে দিবিয়া বেশি সুন্দর। পুরো শেতাঙ্গের মতো। তাই তো শুরুতে হিংসে হয়েছিলো।

“মা,এবার তাহলে তুমি এই দেশে দুটো বিয়ে খেতে পারবে। কত বছর আগে খেয়েছিলে!”

উনার পাশে বসার পরপরই দিবিয়া মেয়েটি এই কথা তার মাকে ইঙ্গিত দিয়ে বললো। আন্টি শুধু মুচকি হাসলেন। এনাদের কান্ডে বেশ লজ্জা পেলাম। একটু অবাকও হলাম। মেয়েটা কী সুন্দর নিজের বিয়ের কথা বলে গেল! নিশ্চয় ওর মা রাজি হয়ে গেছে।
” অয়ন শুনো, আগামীকাল দীপ্তির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। মেয়েটার এমন কেয়ারফুল আচরণ আমার ভারি ভালো লাগলো। নিয়ন তো গত রাত্রের ঘটনা বললো। আমি চাই না বেশিক্ষণ দেরী করতে।”
আন্টির কথায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করতে গেলে তড়িৎগতিতে মাথা উঁচু করলাম। কারণ মা-বাবার কথা মনে পড়ে গেল। নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করছে। একরাত মেয়ে বাড়িতে নেই। এই নিয়ে মনে হয় এতক্ষণে পাড়া-পড়শী কুৎসা রটিয়েছে। ভাবতেই বুকটা ধড়ফড় করছে।
“আন্টি আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। কাল যে এখানে ছিলাম। সেটা উনারা জানেন না।”চঞ্চল হয়ে চেয়ার থেকে উঠে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কথাটা বললাম।

“কীহ? তোমার মা-বাবা জানেন না।”অবাক হয়ে বলায় আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
“তাহলে এখুনি যাও।তারা এতক্ষণে অনেক টেনশন করছেন নিশ্চয়। অয়ন ও কে ড্রপ করে দিয়ে এসো।”

উনার কথায় তাড়াতাড়ি বললাম, “না আন্টি, আমি একাই যেতে পারবো। আমার সাথে উনাকে দেখলে মানুষ আরো বেশি কিছু এড করে নানান কথা বলবে। ওরা ভারি নীচু মনের। এক কথায় হাজার কথা বানিয়ে বলে ফেলে। এদেরকে এক লাইন দিয়ে ভাবসম্প্রসারণ করতে বললে রচনাও বানিয়ে ফেলতে পারে।”

আন্টির মেয়ে দিবার মুখ হা হয়ে গেল আমার কথা শুনে। আন্টি আচ্ছা বলায় আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু উনি কিছুই না বলায় হতাশ হলাম।

সদর দরজায় পার হতেই উনি ডাকলেন। পিছন ফিরে দেখি ক্রমশ উনি আমার দিকে এগুচ্ছেন।
এসে দু হাত দিয়ে দু গাল ধরে মুখ উঁচু করে কপালে আবারো ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললেন, যাও, কেউ যদি তোমাকে কিছু বলে তবে আমাকে বলিও।দেখিও তাদের কী হাল করি! আমি উনার কথায় মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে চলে আসতে একটা কথা মনে হওয়ায় বললাম,
“আন্টিকে কী আপনি আমার সম্পর্কে বলেছেন?”
উনি মৃদু হেসে বললেন, সবার আগে দিবিয়া বলেছে। তারপর আমি। শেষে তোমার গুনগান নিয়ন করেছে। আশ্চর্য হলাম উনার কথায়। কিন্তু দেরী হওয়ায় মুখ মলিন হাসি বজায় রেখে চলে আসলাম। দিবিয়ার কথা মনে পড়লো। দুজনই কী বুদ্ধিমান! দুজনের স্বার্থে দুজন লড়ে গেছে।

এই মূহুর্তে হাঁটা মানে বেশি দেরী করা। তাই না হেঁটে বাড়ির মোড়টায় নামিয়ে দেওয়ার জন্য একটা রিক্সা ডাকলাম।

রিক্সা থেকে দু কদম হাঁটার পরই আমাদের বাড়ি। আজকে এত বেলা হলো তবুও চারপাশে যেন পিনপতন নীরবতা। ক্রমশ বাড়ির দিকে এগুচ্ছি আর হৃদস্পদন দ্বিগুন আকারে বেড়ে যাচ্ছে।

বাসার বাইরে অনেক মানুষের জটলা পেকেছে। বুকটা অজানা ভয়ের আশঙ্কায় ছ্যাঁত করে উঠলো। এত মানুষের ভীড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকাই যাচ্ছে না। হঠাৎ দুলাভাইকে দেখে আটকে গেলাম। এতদিন পর! মনের মধ্যে দুর্ভাবনা যেন গেঁথে বসলো ভীড় ঠেলে ঢুকলাম বাড়ির ভিতর। আমাকে দেখে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। প্রতিবেশিরা শুরু করেছে তাদের বলাবলি।
” না জানি মেয়ে কোন ছেলের সাথে ঘুমিয়ে এসেছে। নষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটা!”
“অভাবে তো নষ্ট হবেই। অভাবীদের তো শরীর ছাড়া কিছুই নেই। সেটাই কাজে লাগিয়েছে।”
উনাদের কথায় প্রচুর কষ্ট লাগলেও সেদিকে আমার নজর একদমিই নেই। আমার পুরো নজর আমার মায়ের দিকে। এলোমেলো অবস্থায় উঠোনে পাথর হয়ে বসে আছেন। যেন এই পাথরে কোনো প্রাণ নেই। আপা ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসলো। খানিক পর অনুভব করলাম এলোমেলো কয়েকটা থাপ্পড় আমার গালে পড়লো।
“ছিহঃ দীপ্তি, ছিহঃ তুই এমন কাজ করতে পারলি। আজ শুধুমাত্র তোদের জন্য,,,,” থাপ্পড় মেয়ে এই কথাগুলো বলে একদলা থুথু আমার সামনে ফেলে দিয়ে কান্না করতে করতে অন্যত্র চলে গেল। কিন্তু আপু কেন মারলো? আর এরাই বা আমাদের বাড়িতে কেন? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার এদের কর্মকান্ডে আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

” লাশ ধুয়ে ফেলেছি। এখনই কী খাটিয়ায় রেখে দিবো।”

চলবে„„„„„„„„

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে