প্রয়োজন পর্বঃ ২৫

0
783

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ২৫

লেখায়ঃ তানিয়া তানু

” লাশ ধুয়ে ফেলেছি। এখনই কী খাটিয়ায় রেখে দিবো।”

“হ্যাঁ, এখুনি রেখে দাও। এই কেউ কাপনের কাপড় আনো তো।”

লাশ শুনেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। নীরব নিস্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মায়ের মতো আমিও পাথর হয়ে গেছি। তবে জানার জন্য উৎসুক হয়ে আছি। কার লাশের কথা পাড়ার চাচারা বলাবলি করছেন?

কাপনের কাপড় নিয়ে একজন ঢুকলো পর্দা আবৃত এক জায়গায়। আমাদের কলতলার পাশে বেশ খানিক জায়গা নিয়ে পর্দা আবৃত করা হয়েছে। সম্ভবত এখানেই লাশ ধুয়া হয়েছে। কিন্তু কার লাশ?

আচমকা নজর পড়লো কয়েকজন মানুষের দিকে। তারা একজন লম্বা মানুষকে ধরে-সরে খাটিয়ায় রাখছেন। মুখের কিছু অংশ দেখে বুকে শূন্যতা ঘিরে ধরেছে। হাহাকারে জর্জরিত হচ্ছে অন্তর। হ্যাঁ,আমার বাবা এখন লাশ হয়ে গেছে। আমাদের ভালোবাসা,আমাদের ছায়াতল আর নেই। ভাবতেই বুকটা বার বার কেঁপে উঠছে।

আবারও বেশ কিছু কথা কানে আসছে। পাশে কয়েকজন মহিলা তীর্যক কথাবার্তা বলছে। তবে সেটা আমার গত রাত্রে না আসা নিয়ে নয়। আমি কেন এখনো বাবার কাছে যায়নি তা নিয়ে কথা বলছে। আবার আমাকে কয়েকশ খারাপ উপাধি দেওয়াও হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কী করে এই মুখটা শেষবারের মতো মৃত দেখবো। এই মুখটা তো আমি সন্ধ্যেবেলা টিউশনি করে ফিরে এসে হাসিখুশিতে দেখি। বিছানায় বাবা বাবা বলে ছোটবোনের সাথে খেলিতে দেখি। কী হাসিমুখেই নআ বাবা আমাদের সাথে কথা বলতেন। আজ পর্যন্ত পাওনাদের বিষয় নিয়ে কথা বলেননি। এমনকি একদিন টাকা দিতে না পারায় মানুষের সামনে চড় খেয়েছিলেন। সেটাও কাউকে বলেননি। আমি তো পাড়ার এক বান্ধুবির কাছ থেকে জেনেছিলাম।
এগুলো ভাবতেই অশ্রু পূর্ণ চোখ হয়ে গেল। অশ্রুতে চোখ ভরে যাওয়ায় চারপাশ কেমন ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। ঝাপসায় নজর পড়লো বিথীর দিকে। ও বার বার হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছছে। সারা চোখ ফুলে গেছে। অনেকক্ষণ কাঁদায় এমন হয়েছে। দ্যুতিকে খোঁজা শুরু করলে দেখলাম ও আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে খাটিয়ার দিকে।আমিও ধীর পায়ের ওর পথ অনুসরণ করে চলছি।

“বাবা, ও বাবা,তুমি এত্তো ছকালে ঘুমাইছো কেরে? ও বাবা,ওঠো। ওঠো না, আমি দোকানো যাবো তো।” দ্যুতি এই কথাগুলো বলেই বাবাকে ধাক্কানো শুরু করছে। দ্যুতির কথায় আকস্মিক মাও হেচকি তুলে জোরে বিলাপ করে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। মায়ের কান্না দেখে বিথীও চিল্লিয়ে বাবা বাবা বলে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি এদের সবার এমন কান্না দেখে। নিজের কান্নাকে আটকাতে পারছি না। ঠোঁটে কামর দিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি। বিলাপ করতে করতে মা এক সময় বলে ফেললেন, “আমি তোমারে কইছে এরারে খুঁজতে যাইয়ো না। এরা আইবো। চিন্তা কইরো না। তুমি আমার কথা না হুইনা বাইর অইয়া ঘরে চিন্তা লইয়া আইছো। বৃষ্টিত ভিইজা আইছো। কেরে আমার কথা হুনলানা?”

“কেমনে মরছে গো, আন্টি?”
“স্টক করছে বে। কিতাই বা করতো। সেয়ান সেয়ান পুইরাইন যদি সারারাত বাইরে থাকে। টেনশনে তো মরবোই।”
নতুন একজন এলে বাবার মৃত্যু কথা বলাবলি করছে দুজন পড়শী। এদের কথা শুনে ধপ করে পড়ে গেলাম মেঝেতে। এবার পূর্ণ নজর দিলাম আমাদের অন্ধের নড়িকে। হাস্য উজ্জ্বল চেহারা আর নেই! সেই চেহেরায় ধারণ করেছে শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া চেহারা। চোখের কোণে এখনো দুশ্চিন্তার চাপে গর্ত হয়ে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে চামড়া পেকে গেছে। এগুলো দেখতে দেখতে আমি জোরে কান্না শুরু করে দিলাম। বাবা বাবা বলে আমিও এবার চিৎকার দিলাম। কেউ এসে সান্ত্বনা দিলো না। কারণ আমি যে ছায়াতল হারাবার একমাত্র কারণ।

বাবার সারামুখে কান্না করতে করতে হাত দিয়ে আদরের মতো বুলিয়ে বলছি।
“বাবা ওঠো, দেখো আমি এসেছি। চিন্তা করছিলে না আমার জন্য। দেখো আমি এসেছি। তোমার সব চিন্তা শেষ বাবা। তোমায় তো ফোন করেছিলাম। একটু ঘর থেকে বের হতে। নেট পেয়ে আমার কথা শুনতে। আচ্ছা তুমি তো জানতে আমি টিউশনিতে গেছি। তাহলে এমন টেনশন করলে কেন বাবা? তুমি তো জানো টেনশনে তোমার বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। ও বাবা, কথা বলছো না কেন? ও বাবা একটু চোখ খুলে দেখো আমি এসেছি। এবার তোমার সব চিন্তা শেষ তো।”

“চিন্তা কী করে শেষ হলো?” আচমকা আপা আমার সামনে এসে এই কথা বললে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললাম, “শেষ তো হলোই। আমি তো এলাম। আর কিসের চিন্তা?”
“তুই এলি। বেবলি তো আসে নাই।”
বেবলির কথা বলতেই মনে হলো এতক্ষণ হলো আমি তারে এখনো দেখিনি। সবাই তো এই উঠানেই।আপাকে প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসায় বললাম,”মানে? উত্তরে রুষ্ট হয়ে বললো, সেও তোর মতো দুপুর থেকে নিখোঁজ। তুই তো সকাল হয়েও এলি। কিন্তু সে এখনো এলো না।” আপার কথায় যারপরনাই অবাক হলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে অবাক চোখে আপার দিকে তাকিয়ে তাকলাম। বেবলি নিখোঁজ মন থেকে সেটা মানতেই পারছিলাম না। অসহায় হয়ে বললাম, “তোরা ভালো করে খুঁজেছিস তো।”

“ও তো শানুদের বাসায় ছিলো। সেখান থেকে নাকি বিকেল বেলায় বাইর হয়ে গেছিলো। কিন্তু এখনো আসেনি। বাবা নাকি অনেক জায়গা খুঁজেছেন। আজ সকাল থেকে তোর দুলাভাইও তো অনেক জায়গায় খুঁজলো। দেখ ওর চিন্তা দেখ। মনে হচ্ছে নিজের বোন হারিয়ে গেছে।”

শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিকে বাবা অন্যদিকে বেবলি। না বাবা এই পৃথিবীতে নেই তো কী হয়েছে। ওনার জান্নাতগুলার দায়িত্ব তো আমার হাতে রেখেছেন। আমাকে এখন বেবলিকে খুঁজতে হবে। মনে মনে এগুলো বলে সাহস এনে হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছে দাঁড়ালাম। আচমকা মা এসে আমার গলা জড়িয়ে বিলাপ করতে করতে বলেন, ও দীপ্তি রে,আমার সিতুরে এনে দে। ও কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচুম না রে। আমার অবুঝ মাইটারে আইনা দে। আর বকতাম না। মারতাম না। এখন আইনা দে। (মা।রাগে বেবলি বললেও সব সময় সিতু বলে ডাকেন)।

মায়ের কান্না দেখে নিজেও কান্না করে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি এনে দেবো তোমার সিতুরে। তুমি চিন্তা কইরো না মা।
মায়ের থেকে বাঁধন ছাড়িয়ে বাইরে চলে আসলাম। ভেতরটা কেমন গরম। সেখানে কতগুলো মলিন মুখের কান্না দেখে সহ্য করা যায় না। প্রাণটা এতক্ষণ ধরে শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছিলো।

বেবলিকে খুঁজতে হবে। এই চিন্তা নিয়ে দু কদম পা ফেললেই শুনতে পেলাম পিছন থেকে দুলাভাই ডাকছেন। দাঁড়িয়ে পড়লাম। দুলাভাই এসে বললো, “দীপ্তি, তুই আর খোঁজে পাবি না। আমাদের থানায় জিডি করতে হবে।” দুলাভাইয়ের কথায় মতামত দিয়ে হ্যাঁ বললাম। দুজনে চলে যেতে মনে হলো ছবি নেওয়া দরকার। মানুষের ভীড় টেলে আবারো কতগুলো গরম নিশ্বাসের ভেতর ঢুকে গেলাম। এ্যালবাম থেকে একটা ছবি বের করে খানিক তাকিয়ে রইলাম। বেবলি দুই চুলের বেনীতে মাথা ত্যাড়া করে হাসি দিয়ে ছবি তুলেছে। হাসিতে কী অপরূপা লাগছে! আমার বোন। আমার বেবলি। এই বলেই ছবিতে এলোমেলো চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিলাম।বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে মনে হলো টাকার চাপে বোনটাকে কতদিম জড়িয়ে ধরা হয়নি। এবার পেলেই অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরবো।

পুলিশ স্টেশনে গেলেই সেখানে দেখতে পেলাম ফাইল দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে কর্মরত অফিসাররা। ভাইয়া আর আমি লম্বা সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বলছি, ভাইয়া আমরা নিজেরা জিডি লিখবো না কী উনারা লিখবেন?”
“আমরা লিখে ভেজাল বাড়িয়ে লাভ নেই।ওরাই লিখুক দেন।”

কাঠের দরজা খুলেই ঢুকে পড়লাম পুলিশের জিডি লেখার ওখানে। সেখানে গেলে জিডি লিখবো বলে একজন এখান থেকে সেখানে পাঠায়। এদের এমন ব্যবহারের রুষ্ট আমি। কিন্তু এদের সহায়তা অনেক প্রয়োজন বলেই চুপ করে আছি। অবশেষে ঠিক জায়গায় গেলে জিডি লিখাতে বললাম। সে হারিয়ায় যাওয়া শুনে বললো,” মাত্র একদিন হলো। দু তিন-দিন যাক। তারপর না হয় লিখেন। চলে আসবে। বয়ফ্রেন্ডের সাথে দুদিন মস্তি করেই চলে আসবে।”
পুলিশের এমন ব্যবহার শুনে রাগ প্রচন্ড বেড়ে গেল। তবুও নিজেকে সংযত করে বললাম, ও একটা অবুঝ মেয়ে। খুব ছোটও। বয়ফ্রেন্ড নেই ওর।”
পুলিশ অফিসার আমার কথা শুনে ঠোঁট উলটিয়ে বললো, “অবুঝ। যা বিবরণ তাতে অবুঝ মনে হয় না। ক্লাস এইটে পড়ে। বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। সে যাইহোক জিডি যেহেতু লিখাতে এসেছেন তাহলে এক হাজার টাকা দিন। জিডি লিখাতে টাকা লাগে।”

টাকা শুনেই দুলাভাই আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বর্তমানে আমার ব্যাগে দশ টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই। ভাইয়ার দিকে তাকালে বলেন, আমার ওয়ালেটে পাঁচশ হবে।”

হঠাৎ তখনি কতগুলো পুলিশ এসে বললো, স্যার এখন এমপি মহোদয় বাইরে ভাষণ দিতে যাবেন। আমরা কারা কারা যাবো?”
পুলিশ এই শুনে উতলা হয়ে ওদের কাছে চলে গেল। তারপর ওদের বাইরে নিয়ে গেল।
ভালোই হলো। টাকা তো নেই আমাদের কাছে চলে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে।

বাইরে আমি আর দুলাভাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আপা ফোন করায় জানাযায় যাবার জন্য চলে গেলেন তিনি।

আকাশে দীর্ঘশ্বাসের বায়ু ছেড়ে পরিবেশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কত বড় পুলিশ স্টেশন! অবাক চোখে তাকালাম কতক্ষণ।

“দীপ্তি, তুমি এখানে?”

চলবে„„„„„„„„

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে