প্রয়োজন পর্ব:২৩

0
848

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব:২৩
লেখায়:তানিয়া তানু

“দীপ্তি শুনো, তুমি এখানে আজকে থাকতে পারো। কিন্তু প্লিজ আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।”
উনার উত্তর শুনে গগন বিদায়ী হাসি দিয়ে বললাম,
“তা ধলাচাঁন, এখন ক্যান লাইনে আইছো।”
“প্লিজ দীপ্তি,চুপ করো। মাথা ব্যথাটা ভীষণ কিন্তু!
উনার এমন মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলায় একটু মায়া হলো।তাই বললাম,
“শুন ভাই, আমি ডাক্তার-ফাক্তার নই। শুধু জানি মাথা ব্যথা হলে নাপা এক্সট্রা খাইলেই চইলা যায়। তাই বলতাছি ওষুধ কী আছে?”

“হ্যাঁ,আপু আছে। ঐ বক্সে ভাইয়ার সব ওষুধ আছে। এখন সব খাইয়ে দিতে পারো। ভাইয়া রাত্রের ওষুধ খায়নি।”টেবিলের দিকে ইশারা করে বলায় আমিও সেদিকে তাকালাম। একটা সাদা বক্স পড়ে আছে। ঐটায় উনার সব ওষুধ।
ওষুধের বাক্স খুলে দেখি অনেক ওষুধ সেখানে। গ্লাসে পানি নিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য উনার কাছে গেলেই উনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। উনার এমন ভাব দেখে আবারো রাগ হলো।
“ঐ ছ্যামরা, এমন ভাব নিচ্ছিস ক্যান?”
“আমি কোনো ভাব নিচ্ছি না।”
“তাইলে মাথা ঘুরাইছত ক্যন?”
“ওষুধ খাবো না তাই।”
“খাবি না মানে,, এই বলে উনার মাথা ঘুরিয়ে মুখ চেপে ধরতে চাইলে গ্লাস হাত থেকে জোর করে নিয়ে নেন। তারপর বলেন,
“এইসব ওষুধ খাওয়ার পর খেতে হয়। পূর্বে নয়।”
“আমি তো সেটা জানিই।”
“তাহলে তো হলোই।
” হুম হলো। এই নে এখন খা।” আবারো ওষুধ মুখের কাছে নিলে রাগ দেখিয়ে বললেন,
“দীপ্তি, আমি এখনো কিছু খাইনি।”
“আমিও খাইনি।”পিছন থেকে উনার সাথে নিয়নও এই কথায় বলায় খানিক অবাক হলাম। দুই ভাই খায়নি। ঘড়ির দিকে তাকালে দেখতে পেলাম রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। বুঝলাম এখন তারা খাবে মনে হয়। তাই নিয়নকে তাড়া দিয়ে বললাম,
“যাও নিয়ন, উনার জন্য খাবার নিয়ে এসো।”
নিয়ন আমার কথা শুনে মুখ কাছুমাছু করে বললো,
“খাবার রান্না করা হয়নি।”
ভ্রু কুচকে নিয়নকে বললাম, কেন? উত্তরে বললো, শান্তা আন্টি চলে যাবার পর মকবুল চাচা রান্না করতেন। কিন্তু উনিও দুপুরে চলে যাওয়ায় রান্না করা হয়নি।
“রান্না করে রেখে যাননি?”
“এসে রান্না করবেন বলেছিলেন।”
“তো এখন?”
“আপু তুমি গিয়ে রান্না করো না। খুব ক্ষিধে পেয়েছে।প্লিজ!”
নিয়নের কথা শুনে অবাক হলাম। কিন্তু নিজেরও পেটেও ইদুর মশাই দৌড়াচ্ছে দেখে আচ্ছা বলে রান্নাঘরের দিকে গেলাম।

রান্নাঘর বেশ বড়। সব কিছু কত সুন্দর করে সাজানো! এগুলো মনে হয় শান্তা আন্টি সাজিয়ে রেখেছেন। সে যাইহোক এখন আমার মূল কাজ রান্না করা সৌন্দর্য দেখা নয়। তাই ঝটপট উড়না কোমরে ভাঁজ করে নেমে গেলাম রান্নায়। রেফ্রিজারেটর খুলে দেখলাম মাছ মাংস সবই আছে। নরমালে পচে যেতে পারে এমন সবজিও সংরক্ষণ করা। তাই সেগুলো দিয়ে দু পদের তরকারি ও ভাত রান্না করলাম। একা তো আর সব উপরে নেওয়া সম্ভব না। তাই নিয়নকে ডেকে দুজনে উনার রুমে নিয়ে গেলাম।

উনি চোখ বুজে শুয়ে আছেন। তাই আবারো কপালে হাত দিয়ে দেখলাম আগের থেকে এখন শরীর প্রচুর গরম। জ্বরের পরিমাণ বেড়েছে। আমার হাতের স্পর্শে চোখ পিটপিট করে খানিক তাকিয়ে বললেন,
“বার বার কপালে হাত দিয়ে কী কর?”
“জ্বরের পরিমাণ কতটুকু তা দেখি।”
“থার্মোমিটারের যুগ কী চলে গেছে?”
আমাকে হিটলামি করেই যে এমন কথা বুঝলাম। তাই উনার কথা না শুনার ভান করে চটজলদি নিয়কে বললাম তোমার ভাইকে খাইয়ে দাও। নিয়ন নিজে প্রথম ভাতের লোকমা মুখে তোলার সময়ই এই কথা বললাম। সে আচ্ছা বলে ভাইকে ভাত খাওয়াতে আসছে। অন্যদিকে ভাত দেখে খাওয়ার লোভ জাগছে। কিন্তু এটা আমার বাড়ি নয় বলে খেতে পারছি না। খেলেই বলবে কী পেটুক মেয়েটা!

সোফায় বসে নিয়নের খাওয়ানো দেখছি। পিচ্চি পিচ্চি হাতে সে ভাইকে খাওয়াচ্ছে। উনি শোয়া থাকায় নিয়ন খাওয়াতে তেমন সুবিধা পাচ্ছে না। মুখে পড়ে একটা বিছানা য় পড়ে দশটা ভাতের দানা। নিয়ন খাওয়াতে পারছে না দেখে ধমক দেখিয়ে বিদায় করে দিলো। নিরুপায় নিয়ন! তারই বা দোষ কী?

এদের এমন কান্ড দেখে নিজেই সিন্ধান্ত নিলাম উনাকে খাওয়াবো। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। কিন্তু উনি আমার হাত দিয়ে খাবেন না। পুনরায় রাগ যেন আমার মাঝে চলে আসলো উনার কথায়। তাই রণচণ্ডীর রূপ পুনরায় নিজের মাঝে ধারণ করলাম।

“খাবি না মানে? তুই না খাইলে তোর বাপ খাইবো।”
“না খাইলে কী করবে?”
“রণচণ্ডীর নৃত্য দেখাবো।”
“আচ্ছা দেখাও। কতদিন ধরে নাচ দেখিনি।”
আমি কীভাবে কথাটা বললাম। আর উনি কীভাবে কথাটা নিলেন। তাই পানির গ্লাস এনে উনার কাঁথা এক রকম গা থেকে সরিয়ে বললাম,
“এখানে পানি ঢেলে নাচবো। ঢেলে দেই।”
উনি আমার কথা শুনে যারপরনাই অবাক। বার বার কাঁথা ধরে টানছেন। গেঞ্জি টেঞ্জি কিছুই পড়েন নাই। লোমশ বুক যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেদিকে নজর না দিয়ে উনাকে কথাটা আবারো বলায় খেতে রাজি হয়েছেন। নয়তো এই জ্বরে ঠান্ডা পানি উনার শরীরে লাগতো।যার ফলে শীত বুড়ির মতো টকটক করে কাঁপতেন। যদিও এটা ভণিতা ছিলো।

লজা-শরম ভুলে উনাকে খাওয়ানো শুরু করলাম। প্রত্যেক লোকমাতে উনাকে খাওয়ানোর ফলে আমার হাত অটোমেটিক উনার ঠোঁট স্পর্শ করে। সেই স্পর্শে নতুন এক অনুভূতির রাজ্যে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। যদিও এই স্পর্শ আগেও পেয়েছি।

খাওয়ানোর শেষে উনাকে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। এদিকে নিয়ন খেয়েই ভাইয়ের পাশে ঘুমিয়ে গেল। অন্যদিকে আমার পেটের অবস্থা করুন।রাত দশটা বেজে গেল। না হলো খাওয়া। আর না হলো বাসায় যাওয়া। তবুও অপেক্ষায় আছি ওরা কখন আসবে। জানি আসবে না। এই প্রবল বৃষ্টিরময় হাওয়ায় কে আসবে ঝড় পেরিয়ে। জানের মায়াতো সবারই আছে।

“তোমাকেও কী এখন খাইয়ে দিতে হবে?”
ভাবনার অতল সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলাম। কিন্তু উনার কথায় সাঁতার দিয়ে আবারো ডাঙায় ফিরে এলাম।
“আমি কী বলেছি? আমাকেও খাইয়ে দিন।”
“তাহলে খাচ্ছো না কেন?”
“খাবোই তো।”
উনার এমন কথা শুনে মনে লাড্ডু ফুঁটলো। যাক বাবা মানবতা তাহলে মরেনি। এখনো জীবিত আছে। কিন্তু এমন ত্যাড়াভাবে না বললেও চলতো।

খেয়েদেয়ে আবারো কপালে হাত দিলাম।জ্বরের তাপমাত্রা যেন ক্রমশ বাড়ছে।পিটপিট করে তাকিয়ে চোখ বুজে নিলেন। মনে হলো উনি আর ঝগড়া করতে চাইছেন না। জ্বরের পরিমান প্রচুর হওয়ায় এবার তিনি শান্ত হলেন। কিন্তু আমি এত জ্বর দেখে জলপট্টি দিতে চাইলাম। সুতি কাপড়ের টুকরায় জলপট্টি দিলে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে উনি চোখ খুললেন। কিন্তু বাধাঁ দিলেন না। আমিও জলপট্টি দেয়াওয়ার কর্মে নিযুক্ত হলাম। মাঝে মাঝে আধবোজা চোখে তাকাচ্ছিলেন। চোখে ছিলো অদ্ভুত এক মায়ার খেলা। সেই চোখে তাকালে কেমন জানি অনুভব করি। তাই না তাকিয়ে নিজের কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলাম।

“এই কে আপনি? অয়নের রুমে কী করছেন?”
আচমকা কারোর শব্দে আধবোজা করে তাকানোর চেষ্টা করলাম। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। কারোর হাত আমার শরীরে। তাকিয়ে দেখি দিনের আলো কাঁচের জানালা ভেদ করেও রুমে এসে উপচে পড়ছে। গতরাত্রে উনাকে জলপট্টি দিচ্ছিলাম। এই কথা মনে পড়তেই বিছানা উঠে বসলাম।আমি বিছানায় ঘুমে ছিলাম! কিন্তু আমি তো চেয়ারে বসে জলপট্টি দিচ্ছিলাম। এখানে এলাম কী করে?পাশে নিয়ন ঘুমের বিভোর। কিন্তু অয়ন নেই। বলতে গেলে সারা রুমেই নেই। দরজায় দাঁড়ানো এক মানবী। সমবয়সী হবে হয়তো। দু হাত কোমরে রেখে রাগান্বিত হয়ে মেয়েটা তাকিয়ে আছে। ফ্রান্সের হলেও বেশভূষায় সভ্যই মনে হলো। ও হয়তো দিবিয়া। নিয়নের ফুপির মেয়ে।যে বিয়ের জন্য এখানে এসেছে। বিয়ের কথা মনে পড়তেই এক পলক মেয়েটার দিকে তাকালাম। বেশ সুন্দরী! আমার থেকেও দ্বিগুন। তাহলে তো হলোই। এই মেয়ের সাথেই মনে হয় উনার বিয়ে,,। ভাবতেই পারছি না। বুকের মধ্যে যেন একরাশ।শূন্যতা এসে ভীড় করেছে।

বাথরুমের দরজায় ক্র‍্যাচ করার শব্দে আমি আর ঐ মেয়েটি দুজনই সেদিকে তাকালাম।উনি মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে আসছেন। এই মাত্র গোসল সেরেছেন। কিন্তু এত জ্বরে নিয়ে ভোর সকালে গোসল করলেন কেন?পাশের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা দশটা বেজে গেল। ইয়া আল্লাহ! বাড়িতে আমার টেনশনে না জানি কী হচ্ছে!

“দিবু,তুমি এখানে? কখন আসলে?”
“সব উত্তর পরে দিব। আগে বলো, উনি কে? তোমার বিছানায় উনি কী করছেন?
দুজনের দিকে ভ্যবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছি। নিশ্চুপ কোনো যন্ত্র মানবী হয়ে।
“দিবু,তুমি আসো তো আমার সাথে।” এই বলেই ঐ মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেলেন। উনার দিবু বলা ডাকটায় যেন আমার কষ্ট লুকিয়ে আছে।যতবার এই আদুরে সুরে ডাকা হয় ততবার যেন ডাকটা বুকের মধ্যে তীড়ের মতো বিঁধছে।

চলবে„„„„„

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে