প্রেমোত্তাপ পর্ব-১৬+১৭

0
301

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৬.

গত দু’দিন যাবত প্রকৃতি প্রায় মন খারাপের রূপ নিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি হয় আবার কিছুটা বিরতি নেয়। তারপর আবার অঝোর ধারায় ঝরে। মানুষের প্রাত্যাহিক জীবন যাপনে কিছুটা মিলেছে বিশ্রাম। অনেকে বৃষ্টি দেখে স্কুল যাচ্ছে না, কলেজ যাচ্ছে না, কেউবা নিয়েছে কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি। আবার যাদের পেট চালানোর জন্য সবসময় পরিশ্রম করতে হয় তাদের এখন রিকশা নিয়ে রাস্তার কোণে ভিজতে থাকা ছাড়া উপায় নেই। বৃষ্টিও ধনী গরীবের পার্থক্য বুঝে! তাই তো কেউ তাকে পেয়ে খুশি আর কেউ তার যন্ত্রণায় পেটে ক্ষুধা আর মনে আশা নিয়ে বসে আছে এই বুঝি রোজগার করতে পারবে কিছু।

সেই বৃষ্টি ভেজা এক অবসাদগ্রস্থ দিনে অহি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। কর্দমাক্ত রাস্তা তাকে প্রায় নাজেহাল করেছে। তার উপর কোনো রিকশা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কোনো গাড়িতে সিট খালি নেই অথচ তার আজ গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতেই হবে তাকে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট হয়ে বড়ো বিপাকেই পড়েছে। পড়াশোনা এত কষ্ট জানলে খুব সাদামাটা একটা বিষয় নিয়েই পড়তো নাহয়। অহি তার হাতের ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সময় দেখে নিল। সকাল সাড়ে সাতটা বাজছে। দশটায় পরীক্ষা। বাসা থেকে ভার্সিটির দূরত্ব অনেক তার উপর বৃষ্টি। সে হিসেব করেই একটু আগে বের হয়েছে কিন্তু তাও বৃষ্টির জন্য কোনো লাভই হচ্ছে না। আকাশের রঙও ভীষণ ধোঁয়াশা। সময়টা সকাল সাতটা মনে না-হয়ে যেন মনে হচ্ছে সন্ধ্যা সাতটা। সময় নিজ গতিতে বয়ে যাচ্ছে অথচ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। হাতের ছাতাটা বৃষ্টির ভার বোধহয় আর বহন করতে পারছে না। বাতাসের ছাঁটে বেশ খানিকটা ভিজেও গেছে সে। জামার হাতাটা ছোটো হওয়ায় হাত ভিজে গেছে যার ফলস্বরূপ ভীষণ ঠান্ডাও লাগছে। তন্মধ্যেই একটা বাস ছুটে আসতে দেখে অহি ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়াল, দ্রুত ছুটে গেল বাসটার দিকে। বাসটার গতি ধীর হলেও থেমে গেল না। সেই আধো ছুটন্ত বাসেই প্রায় যুদ্ধ করে ওঠে দাঁড়াল অহি। বাস দেখেই ছাতা বন্ধ করে দিয়েছিল যার কল্যাণে তার শরীর এখন পুরো ভিজে একাকার। অহি বিরক্ত দৃষ্টিতে বাসের এধার থেকে ওধার চোখ ঘুরিয়ে নিল একটু বসতে চাওয়ার আশা নিয়ে। এবং তার ভাগ্যের সুদৃষ্টিতে সে একটা সিটও পেয়ে গেল। যেই দ্রুত ছুটে গিয়ে বসতে নিবে ঠিক তখনই পরিচিত পুরুষ মুখমন্ডলটা তার দৃষ্টিগোচর হলো। সে অবাক কণ্ঠে বলল,
“আরে হুমুর বাপ যে!”

নওশাদ আশ্চার্য ভঙ্গিতে চোখ উঠিয়ে চাইল অহির পানে। সেও অবাক কণ্ঠে বলল,
“আইসক্রিম আন্টি যে! তা আজ তো হুমুর আইসক্রিম লাগবে না কিন্তু তবুও আন্টির দেখা মিলল যে!”

অহি মুচকি হেসেই নওশাদের পাশের সিটে বসল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আন্টির আজ পরীক্ষা, তাই আন্টি বের হয়েছে। হুমু কেমন আছে?”

“আর বলবেন না, হুমু তো প্রায়ই আপনার কথা বলে, তার আইতকিরিম আন্তি বলে কথা। কিন্তু আমরা তো হুটহাট দেখা হওয়া মানুষ সেটা ওকে কীভাবে বলি, বলুন তো?”

“ওর কথা আমারও প্রায় মনে পড়ে। দেখা করিয়ে দিয়েন একদিন।”

“আচ্ছা। তা আপনার কী পরীক্ষা? কোন ডিপার্টমেন্ট? কোন ইয়ার?”

“সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট, থার্ড ইয়ার।”

নওশাদ চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল। অবাক কণ্ঠে বলল, “থার্ড ইয়ার! বুঝা যায় না। ছোটো লাগে। তা সাইকোলজির স্টুডেন্ট, আমি কিন্তু বেশি ইন্টারেস্টেড এই বিষয়টা নিয়ে।”

“স্বাভাবিক ভাবেই এটা নিয়ে যারা জানেনা তারা সকলেই আগ্রহ প্রকাশ করে।”

“তা, আপনি মানুষ পড়তে পারেন?”

নওশাদের প্রশ্নে হাসল অহি। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “বই পড়েই কূল পাই না আর আপনি বলেন মানুষ পড়তে! বড্ড কঠিন কাজ তা।”

“কিন্তু আমার জানা মতে, আইসক্রিম আন্টি সবই বোধহয় পারবে।”

_

চাঁদনী আজ কয়েকদিন যাবত অফিস যায় না। লজ্জায় ঘরের বাহিরেও তেমন যায় না। ফোন, স্যোশাল মিডিয়াতেও সে একটিভ নয়। যেন দুনিয়া থেকে নিজেকে আড়াল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে। কিন্তু আজ বৃষ্টি তার ভেতরটা তৃষ্ণার্ত করেছে। আজ ভিজতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তার, ভিজে অজানা গন্তব্যে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে করছে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। চাঁদনী আলগোছে শরীরের জামাটা পাল্টে নেয়। টাকার ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।

সকাল হওয়ায় রোজা সওদাগর আর অবনী বেগম রান্নাঘরেই ব্যস্ত। তার উপর বাহিরে বৃষ্টি। বাড়িতে তুহিনও আছে। বৃষ্টি বলে সে বের হয়নি। সকলে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। চাঁদনী বেশ আড়াল হয়েই বেরিয়ে গেল।

খুব দ্রুতই সে বৃষ্টির ছাঁট নিয়েও এলাকা ছেড়ে বেরুলো। এতক্ষণ মুখে ওড়না দিয়ে ঘোমটা জড়ানো থাকলেও এলাকা ছেড়ে বেরুতেই ঘোমটা খানা ছাড়িয়ে দেয়। খোলা রাস্তায় প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। বুক ভরে যায় তৃপ্তিতে। আহা, জীবন কতটা নির্মল! মাটির ভিজে গন্ধে তার শরীর তাজা হয়ে ওঠে। মন খারাপ যেন নিমিষেই হারিয়ে যায়। তন্মধ্যেই পেছন থেকে তার এককালীন প্রিয় পুরুষের কণ্ঠ ভেসে আসে,
“চাঁদ!”

চাঁদনী থমকে যায়। বৃষ্টির এমন তুমুল নৃত্যে চোখ মেলে থাকাটা দায় হয়ে যায় তবুও সে তাকায়। শাহাদাৎ এর ছাতার নিচে গম্ভীর মুখটা দৃষ্টিগোচর হয়। শাহাদাৎ আরেকটু এগিয়ে আসে, অবাক কণ্ঠে বলে,
“বৃষ্টিতে ভিজছো যে! ঠান্ডা লাগবে না?”

চাঁদনীর কঠিন চোখে তাকানোর কথা থাকলেও সে তাকায় কোমল ভাবে। ধীরে উত্তর দেয়,
“ঠান্ডা লাগবে কিনা জানিনা। তবে শান্তি লাগছে।”

“তোমার সাথে যে ছেলেটার ছবি ভাইরাল হয়েছে, সেটা কে ছিল?”

শাহাদাৎ এর প্রশ্নে চাঁদনী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ছিল আমার কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী।”

“শুভাকাঙ্ক্ষী যে দুঃখ ডেকে আনল!”

“অভাগা যেখানে যায়, সমুদ্র শুকিয়ে যায়- প্রবাদ বাক্যটা শুনেছিলে? আমি সেই অভাগা। দোষ শুভাকাঙ্ক্ষীর না, দোষ তো আমারই কপালের। তুমিও তো আমার প্রিয় ছিলে, ভাগ্যের জোরে আজ প্রাক্তন। ভাগ্যেরই তো সব খেলা, তাই না বলো?”

শাহাদাৎ কিছুটা মাথা নত করলো। লজ্জিত কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমায় বিশ্বাস করি। তা, আমাকে ক্ষমা করবে না কখনো?”

“করে দিয়েছি অনেক আগে। আমি সবসময় চাই তুমি সুখী হও। সুখী হওয়ার জন্য যদি তোমার আমাকে ছাড়তে হয় তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। আর আজ যখন দেখলাম তুমি আমাকে ছাড়া সত্যিই সুখী, তখন আমার শান্তি লাগছে। বরং তুমি আমার সাথে থাকলে কিন্তু সুখী হলেনা সেটা আমাকে কষ্ট দিত। অথচ আজ শান্তি পাচ্ছি।”

“আমাকে আর চাও না?”

শাহাদাৎ এর অদ্ভুত প্রশ্নে হেসে প্রায় খুন চাঁদনী। হাসতে হাসতে বলল,
“তোমাকে চাওয়া সেদিনই ছেড়ে দিয়েছি যেদিন শুনেছি তুমি অন্য কাউকে চাও। যে আমার, সে আমারই। তার এক অংশ যদি অন্যকারো হয় তবে তা আমার চাই না। অথচ তুমি আগাগোড়া পুরোটাই অন্যকারো। কীভাবে চাই তোমাকে বলো?”

শাহাদাৎ এর লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এলো। চাঁদনী কালো মেঘের পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
“পৃথিবী বড্ড নিষ্ঠুর, যে যাকে ভালোবাসে সে তাকে পায় না। এমনটা কেন হয় শাহাদাৎ? সৃষ্টিকর্তা কী জানেনা? ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া আমরা বড্ড যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকি। এ বেঁচে থাকায় কোনো মহত্ত্ব নেই, শাহাদাৎ। তোমরা কেন দিনশেষে এমন বদলে যাও? তোমরা তো জানোনা শাহাদাৎ, তোমরা একটা মানুষকে মেরে ফেলো হয়তো অজান্তেই।”

_

পুরো শহর যখন বৃষ্টিতে দুঃখবিলাস করছে চিত্রা তখন গায়ে জ্বর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগের মোড়ে। শরীরে দেখা দিয়েছে মৃদু কম্পন। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাহার, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। চিত্রার চোখ-মুখ তখন প্রায় অনেক বেশিই লাল হয়ে আসছে। বাহার ধমক দিল,
“এই মেয়ে, বৃষ্টির মাঝে তোমার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে ভালো লাগছে! অদ্ভুত সব কর্মকান্ড।”

“ভালো লাগছে। আপনি পাশে থাকলে আমার সবই ভালো লাগে।”

বাহার আড় চোখে চাইল মেয়েটার পানে। কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠেই বলল,
“আমি তোমার টিচার হই, মনে রেখো।”

“সেটা তো পড়ার টেবিল অব্দি। শাহবাগের মোড়ে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন আমার সবচেয়ে পছন্দের পুরুষ হয়ে।”

“জ্বর কী আবেগ বাড়িয়ে দিল?”

“না তো, প্রেম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার বড্ড প্রেম পাচ্ছে, বাহার ভাই।”

মেয়েটার লাগামহীন কথাবার্তায় বাহার কপাল কুঁচকে ফেলল। চিত্রার কিছুটা কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখল। না জ্বর তো ততটা বাড়েনি তবে শরীর মোটামুটি ভালোই গরম। কিন্তু উল্টোপাল্টা বকার মতন অবস্থা হয়নি। তবে মেয়েটা ইচ্ছাকৃত এসব বলছে! বাহারকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে! চিত্রা ততক্ষণে বাহারের হাতটা চেপে ধরল, ফিসফিস করে বলল,
“জ্বরটা শরীরের না, মনের। একটু উষ্ণতা চাচ্ছে মন।”

বাহার হাতটা ছাড়িয়ে নিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেটে ফুক দিয়ে বলল,
“পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্টি অনুভূতি কী জানো, রঙনা?”

চিত্রা চোখ উল্টে তাকালো। মন খারাপ নিয়ে বলল, “কী, বাহার ভাই?”

“প্রেমিকার ঠোঁটের চুমু।”

বাহারের লাগামহীন কথায় চিত্রা হতভম্ব। সে বাহারকে অবাক করতে চেয়েছিল কিন্তু বাহার নিজেই এমন কথা বলবে তা যেন সে ভাবতেও পারেনি। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“বাহার ভাই!”

বাহার উচ্চ স্বরে হেসে দিলো। চিত্রার বেশ ক্ষানিকটা কাছে এসে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা কোমল কোমড়টা। ঘোরগ্রস্তের মতন বলল,
“আগুনের সংস্পর্শে এলে মোম গলে আর প্রেমিকার সংস্পর্শে এলে প্রেমিক গলবে না তা কী করে হয়, রঙনা? আমিও তো প্রেমিক হতে চাই, পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি অনুভূতি আমারও তো পেতে ইচ্ছে করে।”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৭.

সওদাগর বাড়ির মিলন মেলা যেখানে হয় সেটা হলো তাদের খাবার টেবিল। রাত হলেই বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ সেই মিলন টেবিলে উপস্থিত হয়। ছোটোবড়ো সকলে একসাথে বসে খাবার খায়। আজও কার ব্যাতিক্রম হলো না। সকলেই খাবার খেতে বসলো একসাথে। বাড়ির মহিলারা সকলকে খাবার পরিবেশন করছে। অন্যান্য দিনের মতন আজকের দিনটি উৎসবমুখর না। থমথমে একটা ভাব বিরাজমান। মাঝে মাঝে চিত্রার হাঁচি-কাশির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে অতঃপর সবটা আবার নিরবতায় আচ্ছন্ন। চামচের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। সকলের মনযোগ খাবার খাওয়ায়৷ যেন মনযোগ সড়লেই বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।

খাবার পথে চিত্রা আবার হাঁচি দিলো। জ্বরে মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা। মেয়েটা নাক টানতেই তার বাবার গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তুমি কী শুরু করলে? বৃষ্টি এলে তো হুশ থাকে না আর এখন সবাইকে বিরক্ত করছো।”

চিত্রা মুখটা আরেকটু নিচু করে ফেলল। মুনিয়া বেগম অবাক কণ্ঠে নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“এ কেমন কথা! হাঁচি-কাশি এলে সেটা কী আটকে রাখা যায়! অদ্ভুত সব কথাবার্তা।”

“তুমিই তোমার মেয়েকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছ মেঝোবউ। এত আহ্লাদ দেওয়ার কিছু কি হয়েছে? মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে সেটা তুমি বকাঝকা না করে আবার তার পক্ষ ধরে কথা বলো তাই-না?”

মুনিয়া বেগম হতাশার শ্বাস ফেললেন। তার চিত্রাকে নিয়ে এই দু’টো মানুষের কী এমন সমস্যা সে বুঝে পায় না। হ্যাঁ, চিত্রা যখন হলো তখন তারা আশা করেছিল তুহিনের পর আরেকটা ছেলে সন্তান হবে যেহেতু তার ভাসুর আর দেবরের কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না। কিন্তু তাই বলে এত সমস্যা হওয়ার আদৌও কোনো যৌক্তিকতা আছে! তাদের তো প্রথম সন্তান ছেলে। ছেলে সন্তান নিয়ে এত হা হুতাশের তো কোনো কারণই সে দেখে না।

মুনিয়ার ভাবনার মাঝেই আফজাল সওদাগর খাবার থামিয়ে নিজের মেয়ের দিকে চায়। মেয়েটার চোখ-মুখ শুকিয়ে শূন্য প্রায়। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ক্লান্ত সে! কত রাত ঘুমায় না! বাবাদের চোখ বোধহয় ফাঁকি দিতে পারেনা চতুরতা। সন্তানের হাহাকার ছুঁয়ে দেয় বাবার চিত্ত। সে শব্দ করে গলা পরিষ্কার করল। মূলত সবাইকে নিজের দিকে মনোযোগী করল। অতঃপর বিজ্ঞ মানুষের ন্যায় মাথা দুলাতে দুলাতে ডাকলেন,
“চাঁদআম্মু….. ”

চাঁদনী তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন। বাবার ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতন বলে,
“বলো, আব্বু?”

“মা, তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো?”

আফজাল সওদাগরের এমন প্রশ্নে চাঁদনীসহ উপস্থিত সকলে অবাক হলো। চাঁদনী কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“এমন কথা বলছো কেন, আব্বু?”

“তুমি উত্তর দেও, আম্মু।”

“হ্যাঁ আব্বু, নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।”

“তুমি কী এটা মানবে যে আমি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা অবশ্যই তোমার ভালোর জন্য নেই?”

চাঁদনীর এবার বুক কাঁপছে। শরীর বেয়ে ঘাম শিশির বিন্দুর ন্যায় গড়িয়ে পড়ছে। বাবা কী এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে এটা মানতে পারবে না? বাবা ভয়ঙ্কর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই তো এভাবে বলছেন। বাবা কী তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে? চাঁদনীর শক্ত চোখের কোণে মুক্তোর দানার মতন অশ্রুরা কত গীতিকাব্য লিখছে! কিন্তু পরিস্থিতির কারণে মুক্তি পাচ্ছে না।

রোজা সওদাগর স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন তুললেন,
“কী বলবে খুলে বলো? ওর বিয়ের ব্যাপারে যে বলেছিলাম সেটা ভেবেছিলে?”

রোজা সওদাগরের কথার পিঠেই চাঁদনীর দাদীও প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“আমি যে ছেলেটার কথা বলেছি তাকে নিয়েই কী কিছু বলবি? ছেলে কিন্তু ভালো।”

চাঁদনী মাথা নিচু করেই রইলো। চোখ বেয়ে উপচে পড়ছে অশ্রু তবে সে তা প্রকাশ্যে আনবে না। ভুল তো তার হয়েছেই এবার নাহয় প্রায়শ্চিত্ত করবে! আর তার এই ভুলে যে অংশীদার ছিল সে তো বেমালুম ভুলেই বসে আছে চাঁদনী নামক মেয়েটার কথা। এই মেয়েটার জীবন যে কতটা নরক করেছে, সেই কথা ছেলেটার অবগত নেই বোধহয়।

চিত্রা অসহায় চোখে তাকালো, ভেঙে আসা অসুস্থ স্বরে বলল,
“বড়ো আব্বু, আপাকে এখনই বিয়ে দিয়ে দিবে? আর ক’টা দিন সময় দিলে…..”

“তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেছ বেয়া দব মেয়ে। বড়োদের মাঝখানে কথা বলতে আসো, লজ্জা শরম নেই? সব তোমার জন্য বুঝলে। একমাত্র তোমার জন্যই আজ এত সমস্যা।”

বাবার ধমকে নাজুক চিত্রার লজ্জায় অপমানে চোখে জল এলো। বড়ো ভাই বুঝলো হয়তো বোনের কষ্ট তাই তো বেশ মশকরা করে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“এ আর নতুন কী? পৃথিবীর সব ঘটনার দোষ চিত্রার। পৃথিবী যদি কোনোদিন গোল থেকে ত্রিভুজ আকৃতির হয়ে যায় তবে সে দায়ভারও চিত্রার।”

“তুহিন!”

“আহা, আমি একটা কথা বলছি তো! কী শুরু করলি নুরু? কথাটা শেষ করতে দিবি তো নাকি?”

আফজাল সওদাগরের ধমকে নিশ্চুপ পুরো পরিবেশ। চাঁদনীর নত মাথার দিকে তাকিয়ে আফজাল সওদাগর প্রশ্ন করলেন,
“আমি যেকোনো সিদ্ধান্ত এখন জানাবো। তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল, আমি কী করবো?”

চাঁদনী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। আফজাল সওদাগর সম্মতি পেতেই জিজ্ঞেস করলেন,
“কাউকে তোমার পছন্দ? মানে, কাউকে ভালোবাসো?”

চাঁদনী চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। চোখে তার অশ্রুতে টইটুম্বুর। কণ্ঠ কাঁপছে। তবুও বহু কষ্টে উত্তর দিল,
“বাসতাম আব্বু।”

উপস্থিত মহলে যেন নিবিড় বজ্রপাত হলো। চাঁদনীর মা হায় হায় করে ওঠল। চিত্রার চোখে জমলো জল। তার আপার যে এ কথাটা বলতে কতটুকু বুক ফেটেছে তা বোধহয় তার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। রোজা সওদাগর তখন অগ্নিশর্মা। মেয়ের দিকে তেড়ে যেতে নিলে বাঁধা দিলেন আফজাল সওদাগর। ধমকে বললেন,
“যদি ওর শরীরে একটা টোকাও পড়ে তবে তোমার শরীর কত টুকরো হবে তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। আমার ক্ষমতা নিশ্চয় তুমি ভুলে যাওনি?”

রোজা সওদাগর নিজের স্বামীর এহেন ধমকে যেন কিছুটা শিহরিত হলেন। দাঁড়িয়ে গেল শরীরের লোমকূপ। স্বামীর অতীত তার অজানা নয়। একসময় ভয়ঙ্কর লোক ছিলেন তিনি। চাঁদনী নিজের বাবার পানে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। বাবা কী এমন বলবেন যে সবাইকে এতটা চুপ করিয়ে দিচ্ছেন! নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু!

আফজাল সওদাগর আবার মেয়ের পানে তাকালেন, কোমল কণ্ঠে বললেন,
“ভালোবাসতে? তার মানে এখন বাসোনা তাই তো?”

চাঁদনীর কথাটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে তবুও সে উত্তর দিলো, “না।”

“কতদিনের সম্পর্ক ছিল?”

চাঁদনী অস্বস্তি জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল, “প্রায় আট বছর।”

থেমে গেলো সকলের শ্বাস প্রশ্বাস। বি স্ফোরি ত নয়ন জোড়া মেলে সবাই চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অথচ চাঁদনীর দৃষ্টি নত। চিত্রা তখন নিঃশব্দে কাঁদছে। তার আপার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সেটা কীভাবে বুঝাবে সবাইকে?

অবাকের স্বরে অবনী বেগম বললেন, “আট বছর!”

চাঁদনী কেবল উপর-নীচ মাথা নাড়লো। চাঁদনীর মা রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
“সেজন্যই বিয়ে করতে চাইতে না? আমাদের ঘাড়ে এত বছর বসে খেয়েছ মাথা আর সেদিন খেলে ইজ্জত। ছিহ্!”

“আম্মু, সব তো খেয়েই ফেললাম তোমাদের এবার বোধহয় তুমি আমার জান খেতে চাচ্ছো?”

চাঁদনীর ধীর একটা বাক্যে মায়ের স্বত্তা নেড়ে উঠলো। আফজাল সওদাগর নিজের স্ত্রীর পানে তাকালেন চোখ রাঙিয়ে। লোকটার চক্ষু রক্তজবা প্রায়। রোজা সওদাগর তা দেখে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দিলেন। ছুটে চলে গেলেন নিজের ঘরে। পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হতে এবার শ্বাস ফেলে পুরো দমে কথা বললেন আফজাল সওদাগর,

“চাঁদমা, আমি তোমার বাবা। আমি অবুঝ নই। আমি বুঝতে পেরে ছিলাম আমার মেয়েটা ভালো নেই। বেশ অনেকদিন যাবত সে খারাপ আছে। তোমার মা বুঝেনি। সেটা তার ব্যর্থতা। তোমার ছবি নিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হলো যা তোমার প্রাপ্য নয়। তবুও অপমান জুটেছে তোমার ভাগ্যে। ঐ যে, মানুষ অন্যের ভালো সহ্য করতে পারেনা। সেই জন্য বোধকরি আমাদের সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের হিংসে করা কোনো মানুষ দুর্বলতা বানিয়ে নোংরামি ছড়িয়ে দিয়েছে এলাকা জুড়ে। এতে কী হয়েছে? বড়জোর মানুষ তোমাকে খারাপ ভাবছে। তবে মানুষের ভাবনায় কী আর আমার ফুলের মতন চাঁদের গায়ে কলঙ্ক লেপে যায়? যায় না। তুমি ভয় পাচ্ছো আব্বু তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে খারাপ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কি-না? কিন্তু তোমার আব্বুর এখনো এতো মন পাষাণ হয়নি। তুমি দীর্ঘ আট বছর কাউকে ভালোবেসেছ। তাকে এত সহজে তুমি হয়তো ভুলতে পারবে না। আমি চাইও না তোমার উপর কিছুটা চাপিয়ে দিতে। তবে আম্মু, বাবা হিসেবে চাই তুমি ভালো থাকো। আর সেইজন্যই আমি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে অন্যকোনো সম্পর্কের সাথে জড়াবো না। কিন্তু তোমাকে বাঁচাতে আমি তোমাকে এ দেশ থেকে পাঠিয়ে দিব অন্য কোথাও। তুমি একা থাকবে, ভালো থাকবে, নিজেকে গুছিয়ে নিবে সেই প্রত্যাশায়। আর আমি তোমার পাশে আছি। ভালো থাকার জন্য তোমার আরেকটা মানুষ প্রয়োজন এটা আমি বলবো না। একাও ভালো থাকা যায়। আর তুমি আপাতত একা-ই ভালো থাকবে। তুমি বলেছিলে তোমার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছে। বরফ দেখার ইচ্ছে। তোমার সেই শখ পূরণ করবে তোমার বাবা। তুমি খুব শীগ্রই সেখানে চলে যাবে। তোমার ভিসা তৈরী। ভেবেছিলাম তোমাকে উপহার হিসেবে দিব, সেই জন্যই না জানিয়ে তোমার ভিসার কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। কে জানতো সে উপহার তোমাকে একটা বার বাঁচানোর জন্য কাজে লাগাতে হবে! আমার পরম ব্যর্থতা, তোমাকে দেশ ভ্রমণের ভিসা দিতে পারলাম অথচ ভালো থাকার মানুষটাকে হয়তো দিতে পারলাম না। তুমি ভালো থাকবে চাঁদ। ভালো থাকবে তুমি। তাই না আম্মু?”

চাঁদনী বাবার থেকে এতটা ভালোবাসা বোধহয় আশা করেনি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। আফজাল সওদাগর চেয়ার ছেড়ে ওঠে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদে উঠলেন পাহাড়ের মতন বাবাও। সন্তানের অসহায়ত্বে বাবাও যে নিজেদের বড়ো ব্যর্থ মনে করেন! উপস্থিত সকলের চোখেই অশ্রু। চিত্রাও ডুকরে কেঁদে উঠলো। চাঁদনী আপার এত ভালো ভাগ্য দেখে তার আজ তৃপ্তি লাগছে। যাক, অন্তত কিছুতো পেলো মানুষটা!

_

মধ্য রাতে বাতায়নের কোল ঘেষে জ্যোৎস্না হামাগুড়ি দিচ্ছে চিত্রার ঘরের মেঝেতে। আজ পুরো এলাকাতে বিদ্যুৎ নেই। কিছু একটা কারণবশত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঘুম নেই মেয়েটার চোখে। বাহার ভাইয়ের সাথে সেদিন রাস্তায় কথা বলার পর আর দেখা হয়নি। তার অসুস্থতার জন্য পড়াতে আসেনি মানুষটা। গত কয়েকদিন যাবতই মেয়েটার থেমে থেমে জ্বর আসছে আর শুকনো কাশি দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকেই বোধহয় এই সমস্যা।

হুট করেই বাহির থেকে গিটারের শব্দ ভেসে এলো। চিত্রার অবসাদ ছুটে গেলো। বাহার ভাই অনেকদিন পর গিটার ধরেছে বোধহয়। অনেকদিন গিটারের শব্দ পায়নি সে। তৃষ্ণার্ত মন সে শব্দ পেয়ে উল্লাসিত হলো। আগে বিদ্যুৎ কখনো ভুল করে যদি রাতে না থাকতো, চিত্রা আর বনফুল তখন রাস্তায় ফুটপাতে বসে কত গল্প করতো! তাদের এলাকায় যেন মেয়ে দুটোর হাসির শব্দে পুষ্প বৃষ্টি হতো! আর আজ, ভাগ্যের খেলা তাদের দু’জনকে দুই পৃথিবীতে আবদ্ধ করেছে।

চিত্রার ভাবনার মাঝেই রাস্তা থেকে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো। চিত্রা জানালার দিয়ে রাস্তায় চাইলো। বনফুল বরাবরের নিয়ম অনুযায়ী আজকেও হাসছে তবে আজকে তার সাথে চিত্রা নেই হাসছে নোঙর নামক মেয়েটা। চিত্রার কান্না পেলো। কেঁদেও দিল সে। বাহারের গিটার তখন উন্মাদনা ছেড়ে করুণ স্বরে বাজছে। প্রেমিকার মনের ভাব কী বুঝেছেন লোকটা? কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার তুমুল কাশি শুরু হলো। মুখ চেপে ধরতেই হাতে তরল কিছুর উপস্থিতি অনুভব করল চিত্রা। হাতটা চোখের সামনে ধরতেই জ্যোৎস্নার আলোয় চিকচিক করল লাল রঙের তরল পদার্থ। পাশের ছাঁদের বাহার ভাইয়ের অবয়বটাও নিশ্চুপ। তার গিটারের সুর হুট করে ছন্দপতন হলো। তার গিটারও কি বুঝলো ঝড়ের পূর্বাভাস!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে