প্রেমোত্তাপ পর্ব-১৪+১৫

0
321

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৪.
বাহিরে ঝড়। গাছপালা বাতাসে হেলে যাওয়ার উপক্রম। পুরো ঘরময় ছড়িয়ে গেছে ঝড়ের মিষ্টি বাতাস। শীতলতায় ছেয়ে গেছে রুম। মোটা একটা কম্বলের নিচের চিত্রার আদুরে, কোমল দেহটা চুপসে আছে। তার সামনেই অভিজ্ঞ চোখে তাকে পরোখ করছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বাহার। ঘরের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। সোফায় বসে আছে চাঁদনী। মেয়েটারও ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। বার কয়েক হাঁচিও দিয়েছে। ঠান্ডায় জুবুথুবু প্রায়। ডাক্তার বিজ্ঞ চোখে অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মেয়েটার তো অনেক জ্বর। আমি কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করছি তোমরা এনে খাইয়ে দেও।”

তুহিন মাথা দুলাতেই ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তুহিন বোনের ওষুধ আনতে এবং ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেলো। ঘরে রইলো বাহার আর চাঁদনী। চাঁদনীর নাজেহাল অবস্থা চোখ এড়ালো না বাহারের। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“চাঁদ, তোমার গিয়ে এখন ঘুমানো উচিৎ। ঘরে কোনো জ্বরের ওষুধ আছে? থাকলে অবশ্যই সেটা খেতে হবে।”

বাহারের কথায় চাঁদনী ঝিমিয়ে আসা নেত্র যুগল নিয়ে বলল,“না সমস্যা নেই, বাহার ভাই।”

“অবশ্যই সমস্যা আছে। সবাই একসাথে অসুস্থ হয়ে গেলে তো হবেনা, তাই দ্রুত যাও আর ওষুধ খেয়ে ঘুমাও।”

চাঁদনী আর দ্বিমত পোষণ করলো না বাহারের কথায়। সোফা থেকে উঠে চিত্রার মাথায় বার কয়েক হাত বুলালো। মেয়েটা এত আদুরে! চাঁদনীর মনে হয় কেবল- গোটা পৃথিবীর সুখ যদি সে মেয়েটাকে এনে দিতে পারতো! মেয়েটা কিছু আবদার করলে তা পূরণ করতে না পারলে তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। সে জানে, এই যে এতরাতে তারা ঢাকা চলে আসছে, এর জন্য অনেক কথাই তাদের শুনতে হবে। চাঁদনীকে খোঁটা দেওয়া হবে তার সত্তা নিয়ে। এতবছর যাবত বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়ার খোঁটাটা তার মা নিবিড় ভাবেই দিবে। তবুও তার আফসোস নেই। মেয়েটা যে একটু স্বস্তি পেয়েছে সেটাই তার শান্তি।

বোনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়েই চলে গেলো চাঁদনী। পুরো ঘরে কেবল একা রইলো বাহার। চিত্রার শরীর তখন গুটিশুটি মেরে কম্বলের নিচে আরাম খুঁজতে ব্যস্ত। আর বাহার ব্যস্ত সেই চিত্রার মুখে নিজের শান্তি খুঁজে নিতে।

মেয়েটা নড়তে গিয়ে কম্বলের অনেকটা অংশ শরীর থেকে ফেলে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ ঠান্ডা বাতাসে সে কাঁপছে। বাহার এগিয়ে এলো, যত্ন করে কম্বলখানা তুলে দিল শরীরে। চিত্রার গভীর ঘুম মুহূর্তেই হালকা হয়ে এলো। ভেঙে যাওয়া অসুস্থ কণ্ঠ নিয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
“বাহার ভাই..”

বাহারের ব্যস্ত হাত থেমে গেলো। চোখ তুলে তাকালো অসুস্থ মুখটার পানে। আনমনেই সে উত্তর দিলো,
“হুম?”

“বনফুল আসেনি?”

বাহার এবার চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল চিত্রার দিকে। মেয়েটা অসুস্থ অবস্থাতেও বনফুলকে খুঁজছে! বাহার তপ্ত শ্বাস ফেলল। চিত্রার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বলল,
“ও অসুস্থ তো, তাই আসেনি। পরে আসবে। অনেক রাত হয়েছে না?”

“আন্টিও আসেনি তাই না?”

এবারের প্রশ্ন বাহারকে অসহায় করলো। সে অসহায় ভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো উত্তর বিহীন। বাহিরে কালো আকাশের বুকে সোনার কাঠির ন্যায় যেন বিদ্যুৎ চমকালো। গমগমে শব্দে বজ্রপাত হলো আকাশের বুকে। চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাহারের দিকে। বেশ ক্ষাণিকটা সময় তাকিয়ে থাকার পর বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলল,
“দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন যে বাহার ভাই? আপনিও বুঝি দূরে যাওয়ার ছন্দ আঁকছেন মনে? কতটা দূরে যাবেন? বনফুল আর আন্টির মতন দূরে? নাকি আকাশ থেকে মাটির দূরত্বের মতন দূরে?”

বাহার স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। জ্বরে কি মেয়েটা ভুলভাল বকছে! কিন্তু বাহারের হৃদয় মন্দিরতো জানে, মেয়েটা ভুল বলছে না সবটা। আকাশ যতটা কাছের মনেহয় ততটা কাছে তার বসবাস যে নয়। মেয়েটার মন কি সেটা ধরে ফেলল!

চিত্রা আবার বলল, “দূরে যাচ্ছেন?”

“কাছে ছিলামই বা কবে?”

বাহার প্রশ্ন করলো ঠিক কিন্তু উত্তর শুনলো না। চিত্রার উত্তর দেওয়ার আগেই সে প্রস্থান নিয়েছে রুম থেকে। চিত্রাও উত্তর দিলো না। কেবল দু-চোখ ভরে দেখলো সে প্রস্থানের নিয়ম। প্রেমিক পুরুষরা বড্ড পাষাণ হয় বোধহয়। নাহয় এমন করে মন ভাঙতে পারে? বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চিত্রার ভীষণ কান্না পেলো কিন্তু কাঁদলো না। এই কান্নাটা বাহার ভাইকে হারানোর ভয়ে না। এই কান্নাটা নিজের বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ের। সে আজ অনুভব করেছে, এতদিন বনফুলকে জড়িয়ে ধরলে আত্মার যে শীতলতা মিলতো আজ তা আর সে পায়নি। পরিচিত মুখ কোথাও একটা বড্ড অপরিচিত ঠেকলো তার। প্রানপ্রিয় বন্ধুত্ব হারানোর শোক চিত্রাকে আরেকটু নিস্তেজ করলো। অতঃপর সে আবার তলিয়ে গেলো গভীর নিদ্রায়।

_

পৃথিবীতে রাত অনেক আসে কিন্তু কিছু কিছু রাত নিগার মন খারাপ, শূণ্যতা নিয়ে আসে। আজ চাঁদনীর রাতটাও তেমন একটা রাতের অন্তর্ভুক্ত। চোখ ভর্তি ঘুম অথচ মন ভর্তি বিষন্নতার লড়াইয়ে হেরে গেল ঘুম এবং জিতে গেল বিষন্নতা যার ফলস্বরূপ সে জেগে রইল। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনা। কষ্ট হয় বুকে। চোখের সামনে যখন শাহাদাত এবং তার নববধূর সংসার ভেসে উঠে তখন গোটা একটা পৃথিবী চাঁদনীর কাছে অসহ্যকর লাগে। এই অনুভূতির বিশ্লেষণ করা যায় না, আর না কাউকে সংজ্ঞা দেওয়া যায় তার। কেবল বুকে বয়ে বেড়ানোই স্থায়ী।

চাঁদনীর মাথা ব্যাথাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তার বালিশের নিচে থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠল। ঝিম ধরা শব্দে ভারী হয়ে গেল চাঁদনীর মাথা। অথচ ফোনটার থামারই নাম নেই! চাঁদনী আর না পেরে ফোনটা তুলল, রিসিভ করে কানে লাগাতেই অপর পাশ থেকে একটা ব্যস্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ছাঁদে আসুন। আমি আপনাদের ছাঁদে।”

কথাটুকু বলেই সাথে সাথে কলটা বিচ্ছিন্ন করা হলো। চাঁদনী হতভম্ব নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এতরাতে তাকে ছাঁদে ডাকছে! এই ছেলেটার সাহস কত বড়ো! চাঁদনীর মন একরোখা হলো। চ ড় খেয়েও যে ছেলের শিক্ষা হয়নি, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আবার ঘন্টা পেরুতেই তাকে ছাঁদে ডাকছে যে ছেলে সে ছেলের সাথে আর যাই হোক, চাঁদনীর কোনো সম্পর্ক নেই। চাঁদনী চোখ বন্ধ করলো। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা চালালো। ক্ষণে ক্ষণে আকাশে তখন বজ্রপাত হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমাকাচ্ছে নতুন ছন্দে! চারপাশ আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় চোখ বন্ধ করে রাখতে রাখতে চাঁদনীর ঘুম এলো। বোধহয় এক ঘন্টা সে ঘুমিয়েও নিলো নির্দ্বিধায়। কিন্তু মনের খুঁতখুঁত সে ঘুমকেও স্থায়ী হতে দিলো না। আচমকাই ঘুম কেটে গেছে তার। ঘুম ভাঙতেই মাথায় এলো মৃন্ময়ের কথা। ছেলেটা পাগল, কে জানি এখনও ছাঁদে আছে কি-না! আনমনেই চাঁদনীর ভীষণ চিন্তা হলো। শরীরে ওড়না জড়িয়ে সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে ওঠেই হাতে থাকা ছাতাটা মেলে ধরলো মাথার উপর। বৃষ্টি হওয়ায় ছাঁদের বাতিও বন্ধ। অন্ধকারে চাঁদনী প্রায় কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক চাইলো। বার কয়েক ডাকলো ছেলেটার নাম ধরে অথচ কোনো সাড়াশব্দ নেই! চাঁদনী ভাবলো হয়তো ছেলেটা চলে গেছে। যেই না সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াবে তখনই পুরো পৃথিবী আলোকিত করে যেন সোনার কাঠি আদুরে ভাবে তার রূপ এঁকে দিলো আকাশের বুকে। সে আলোয় দেখা গেল ভিজতে থাকা সিক্ত মৃন্ময়ের মুখ। চাঁদনী প্রথমে কিছুটা চমকে গেলেও পরে এগিয়ে গেলো তার দিকে। ছাঁদের লাইটটাও জ্বালিয়ে দিলো কিন্তু আলো খুবই নিভু নিভু। চাঁদনী এগিয়ে গিয়ে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এত রাতে এখানে কী? বে য়া দ বীর সীমা ছাড়াচ্ছো।”

“ভালোবাসা বেয়াদবী হলে আমি হাসিমুখে হাজার বার বেয়াদব হতে রাজি।”

মৃন্ময়ের কণ্ঠ অনেকটা বসে গেছে। কথা গুলো কেমন ভাঙা ভাঙা শোনালো। চাঁদনী ধমক দিল,
“এতটুকু একটা ছেলে কি-না প্রেম নিয়ে পড়েছে। যাও বাড়ি।”

“এই নিন ওষুধ, জানি ঠান্ডা লাগবে আপনার কিন্তু আপনি ওষুধ খাবেন না, তাই নিয়ে এলাম। এক্ষুণি খাবেন এটা তারপর আমি যাবো।”

মৃন্ময়ের কথায় তাজ্জব চাঁদনী। ছেলেটা তাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য এখানে এসেছে! এতটা পা গ ল! চাঁদনীর চোখ ভরে জল এলো। বৃষ্টির জল থেকে সে জল আলাদা করার উপায় নেই তার উপর আঁধার। কিন্তু ছেলেটা কেমন যেন বুঝে গেল! অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আমি আরও চ ড় খেতে রাজি, তবুও কাঁদবেন না।”

চাঁদনী দ্বিতীয়বারের মতন অবাক হলো। ছেলেটা এমন কেন! এই ছেলেটার জন্য আজ তার নিজেকে ভাগ্যবতী লাগছে। কত ভাগ্য করেই না এসেছে সে! নাহয় এমন একটা পা গ ল ছেলের সাথে পরিচয় হতো আদৌ! চাঁদনী ভীষণ স্নেহে মৃন্ময়ের বড়ো বড়ো চুল গুলো এলোমেলো করে দিলো। ছাঁদের হলুদ বাল্বটায় বড্ড স্নিগ্ধ দেখালো সে দৃশ্য।

_

রাত ভীষণ অন্যরকম যাওয়ার পরেই আজ সওদাগর বাড়িতে উলোটপালোট করা একটা দিন এলো। বাড়ির বড়ো মেয়ের নামে রটলো ভীষণ বাজে কথা। তাদের সোসাইটির ফেসবুক গ্রুপে ভাইরাল হলো একটা ছবি। যে ছবিতে সওদাগর বাড়ির বড়ো মেয়ের মুখ স্পষ্ট অথচ ছেলেটার কেবল পিঠ দেখা যাচ্ছে। সওদাগর পরিবার সকালেই ছুটে আসে শহরে। মেয়ের এমন কলঙ্কে দিক ভ্রষ্ট তারা। অথচ চাঁদনী তখনও কিছু জানেনা। দৈনন্দিন কাজের স্রোতে ছুটে গিয়েছে অফিস।

#চলবে
#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৫.

গোছানো একটি জীবনের যখন ছন্দপতন শুরু হয় তখন সে জীবনটা বয়ে বেড়ানো কষ্ট সাধ্য হয়ে ওঠে। চাঁদনীর বেলাও ব্যাতিক্রম হলো না। তার সুন্দর, স্বচ্ছ জীবনটাকে হুট করেই এতটা ঘোলা হয়ে যেতে দেখে সে দিকভ্রান্ত হয়ে গেলো। কান্নার সাহসও হলো না তার চোখ দুটোর। আর কত কাঁদবে! ক্লান্তি বলেও তো একটা জিনিস আছে?

চাঁদনী ফ্যালফ্যাল নয়ন জোড়া মেলে বসে আছে নিজের আঁধার ঘরটায়। বাকরুদ্ধ, বিমর্ষ চোখ গুলো আজ চির নিদ্রা চাচ্ছে। যে চোখে কাজলের আস্তরণ মায়া সৃষ্টি করত আজ সে চোখে ধূ-ধূ মরুভূমি। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পুরুষকে হারিয়েছে, হারিয়েছে সকল রঙ শেষে কিনা চরিত্রটার উপরও এত গাঢ় কলঙ্ক পড়তে হলো?

অভিযোগ অভিযোগে ভারি হয় মন। ফোনের স্ক্রিন অন করে তার আর মৃন্ময়ের আলোচিত সেই ছবিটি দেখে। আপাত দৃষ্টিতে ছবিটিতে অশ্লীলতার ছিটেফোঁটা নেই কিন্তু এই একটা ছবি চাঁদনীর জীবনটা নরক করতে যথেষ্ট। ছবিটি সকাল অব্দি তাদের সোসাইটির গ্রুপে থাকলেও তা আপাতত ফেসবুক তোলপাড় করেছে বিভিন্ন ক্যাপশন সমেত। সেগুলোও খারাপ না, ভীষণ রোমান্টিক ক্যাপশনে তা শেয়ার করেছে মানুষ। অথচ সকলে যা ভাবছে তার এক ফোঁটা যদি সত্যি হতো তবুও চাঁদনীর আফসোস থাকতো না। কিন্তু এটার আগাগোড়া পুরোটাই তো মিথ্যে। কিন্তু তার গালে চ ড়ের ছাঁপ মিথ্যে নয়। তার পরিবারের চোখে তাকে নিয়ে বিস্ময়টা মিথ্যে নয়। সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে নিজের নামে এমন ভয়ঙ্কর কথাটাও তো মিথ্যে নয়!

চাঁদনী ফোনের স্ক্রিনের ছবিটায় কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এখানে যে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে কেউ বিশ্বাসই করবে না। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না তবে চাঁদনীর হাসি মুখটা বেশ স্পষ্ট। চাঁদনী কখনোই কারো সাথে কোনো শত্রুতা করেনি জানা স্বত্তে, তবুও কে এমনটা করল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিনা কারণে কেউ এমনটা কেন করবে! চাঁদনীর মাথায় হুট করে একটা কথা এলো। সবাই যেহেতু ছবিটা দেখেছে তার মানে সবার মাঝে মৃন্ময়ও আছে। কিন্তু এমন একটা ছবি দেখার পরও ছেলেটা তার সাথে একটুও যোগাযোগ কেন করল না? মৃন্ময় যা পা গ ল ছেলে, এতক্ষণে তো তার তান্ডব চালানোর কথা কিন্তু সে এতটা নিশ্চৃপ কেন? চাঁদনী নিজের মনেই প্রশ্নটা করে উত্তর হীন দিশেহারা হলো। তৎক্ষণাৎ কল লাগাল মৃন্ময়ের ফোনে। পর পর কয়েকবার রিং হয়েই ফোনটা কেটে গেল। চাঁদনী তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য উতলা। সে আবার কল দিল। প্রায় কিছুক্ষণ রিং হতেই অপর পাশ থেকে মৃন্ময়ের ঘুম ঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো ইন্দুবালা…”

“মৃন্ময়, কোথায় তুমি? তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”

“কী কথা? বলুন?”

“তুমি কোথায় এখন? আমার সাথে দ্রুত দেখা করো। তোমার সাথে কথা আছে। তুমি কী কিছুই জানো না?”

“কী জানার কথা বলছেন? হয়েছে কী? আমি তো….”

মৃন্ময় বাকি কথা বলার আগেই কলটা বিচ্ছিন্ন হলো। চাঁদনী তখন উন্মাদ প্রায়। আবার ব্যস্ত গতিতে কল দিতেই অপর পাশ থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে উঠল ‘আপনার কলটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।’

চাঁদনীর আর সহ্য হলো না এত লুকোচুরি, এত যন্ত্রণা। সে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত গিয়ে নিজের ফর্মাল পোশাকটা বদলে এলো। সাদা রঙের একটা জামা পড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সওদাগর বাড়ি তখন নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ আগেই সে বাড়ির উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছে বাড়িটাকে। চাঁদনীর বাবা আফজাল সওদাগর প্রায় অসুস্থ হয়ে গেছেন। চাঁদনীর মা রোজা সওদাগর নিজের এত বড়ো মেয়ের গায়েও হাত তুলতে ভুলেননি। চাঁদনীর দাদী অবশ্য চিত্রাকেও কথা শুনিয়েছেন। কী বিশ্রী ভাবে দোষারোপ করেছেন! তার ভাষ্যমতে, না চিত্রা গ্রাম থেকে শহরে আসার ইচ্ছে পোষণ করতো আর না এতকিছু হতো।

ড্রয়িং রুমে কাউকে না পেয়ে সেই সুযোগে বেরিয়ে গেল চাঁদনী। রাত তখন আটটা বাজছে। পথে ঘাটে পথচারী দেখা যাচ্ছে বেশ। চাঁদনী ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, যদি কেউ তাকে আবার কথা শোনায়! সেই ভয়ে। চাঁদনী অনেকটা লুকিয়েই মৃন্ময়দের বাড়িতে উপস্থিত হলো। সংশয়ে তার বুক কাঁপছে। কলিং বেলটা বাজাবে কি-না ভেবে সে ক্লান্ত। তবুও মনে সাহস সঞ্চয় করল, দাঁত মুখ খিঁচে বাজিয়ে ফেলল কলিংবেল। কলিংবেল বাজানোর সেকেন্ড পেরুতেই দরজা খুলে দিল বাড়ির নতুন বউ। মেয়েটা চাঁদনীকে চিনতে সময় ব্যয় করল না। চাঁদনীকে দেখেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
“আরে আপু, আসুন না ভেতরে। আপনাকে দেখাই যায় না। আজ কি মনে করে এলের! আল্লাহ্, ভেতরে আসুন না।”

চাঁদনী চোরা চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আঙ্কেল আন্টি কেউ বাসায় নেই?”

“না তো। ওরা একটু গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।”

“মৃন্ময় আর শাহাদাৎ কোথায়?”

“ভাইয়া তো বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেছেন আর উনি অফিস থেকে এখনও আসেনি।”

চাঁদনীর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। মৃন্ময় শহরে নেই মানেই চাঁদনীর এই সময়টা আরও ভয়াবহ হয়ে যাবে। এটা ভাবতেই চাঁদনীর মাথা ঘুরে উঠলো। তার উপর সারাদিন না খাওয়া। নিলা হয়তো বুঝলো চাঁদনীর অবস্থা। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“আপু, আপনি কী অসুস্থ?”

“না না, নিলা, তেমন কিছু না।”

“ভেতরে আসুন না আপু। এসে বসুন।”

চাঁদনী তাকাল নিলার পানে। মেয়েটা এত স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করছে তার সাথে? মেয়েটা কী চাঁদনীর ভাইরাল হওয়া ছবিটা দেখেনি? হয়তো দেখেনি, দেখলে নিশ্চয় এত ভালো আচরণ করতো না। নিশ্চয় ঠেস দিয়ে কিছু বলত।

চাঁদনীর ভাবনার মাঝেই নিলা আবার বলল, “আসুন না আপু। এসে একটু বসুন। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে অনেক।”

“না নিলা, দরজাটা আটকে দেও। আমার একটু কাজ আছে। পরে আসব।”

কথাটা শেষ করেই চাঁদনী পা আগালো পথের দিকে। পেছন থেকে নিলার আশ্বাস ভরা কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনাকে আমি অনেক বিশ্বাস করি, আপু। আপনি এমন একটা মানুষ, যাকে দেখলেই মনেহয় পবিত্রতা শব্দটা কেবল আপনার জন্য সৃষ্টি। আমি কখনোই আপনার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারিনা। সেখানে এসব ছবি দেখে আপনার ভেঙে যাওয়া মোটেও মানায় না।”

চাঁদনী অবাক চোখে ঘুরে দাঁড়াল। নিলা মেয়েটার মুখে মিষ্টি হাসির রেখা। চাঁদনী যেন ছোটো এই কথা গুলোর মাঝে বিরাট ভরসা খুঁজে পেল। এই হাসিটা কোথাও একটা তাকে আবার নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি দিল। মেয়েটার সাথে তার পরিচয় খুবই সীমিত সময়ের কিন্তু তবুও মেয়েটা কত বিশ্বাস করেছে তাকে। অথচ তার নিজের মা, যে তাকে দশমাস গর্ভে আর এত বছর হৃদয়ে ধারণ করেছে সে মা’ই কেমন ভুল বুঝল। আহারে জীবন!

_

বাহিরে বাতাস, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে প্রায় কাক ভেজা হয়ে চিত্রাকে পড়াতে এসেছে বাহার। মেয়েটা জুবুথুবু হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। জ্বরটা বোধহয় কমেনি। বাহার এসে রাশভারি কণ্ঠে ডাক দিল,
“চিত্রা..”

চিত্রা আধো আধো চোখে তাকাল, অসুস্থ কণ্ঠ বলল,
“আজ পড়াবেন?”

“পড়াতেই তো এলাম। পড়বে না?”

“বাড়ির পরিস্থিতি খারাপ। জানেন না চাঁদনী আপার কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে?”

“আপার ছবি তো ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে।”

“তো?”

বাহারের ভাবলেশহীন উত্তরে চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আপনি তো বলছেন কেন? এটা নিয়ে বাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়েছে।”

“তোমাদের বাড়ির মানুষ গুলা একেকটা তো মগজ ছাড়া। ছবিটাই তো আমি এমন কিছুই দেখিনি। চাঁদনী একটা ছেলের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক একটা ছবি। বন্ধু কিংবা ভাইয়ের মাথাতেও এমনে হাত বুলায় মানুষ। তাই বলে এত হা হুতাশ করতে হবে? তোমরা কী ভাত খাও না ভুসি?”

বাহারের কথা যুক্তিযুক্ত ছিল কিন্তু তা সহ্য হলো না নুরুল সওদাগরের। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“বেয়াদব ছেলে। আমরা ভুসি খাই?”

“সেটা আমি কীভাবে জানব? আমি কী আপনাদের ভুসি কিনে দিয়ে যাই? কিন্তু আপনাদের মাথা থেকে বের হওয়া গোবর মার্কা বুদ্ধি দেখে বুঝতে অসুবিধা হবেনা যে আপনারা কী খান।”

নুরুল সওদাগর তেড়ে এলেন। ধমকে বললেন,
“রাস্কেল।”

“শালা, ভালোর কোনো জামানায় রইল না। ভালো কথা বললেও মানুষ খেঁকিয়ে উঠে।”

নুরুল সওদাগর এবার রেগে বাহারকে ধাক্কা দিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কায় ছেলেটা দু-পা পিছিয়ে গেলেও ঠোঁটে ঝুলানো ছিল মুচকি হাসি। চিত্রা দুর্বল শরীরটা নিয়ে দ্রুত উঠে বসল। তার ভয় হচ্ছে, এখানে কিছু উল্টোপাল্টা না হয়ে যায়। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে বাহার মুচকি হেসে বলল,
“আপনার শরীরে তো ভালোই জোড় আছে। সেজন্য তো বলি ষাঁড় লাথি দিলে মানুষের হাড় ভাঙে কেন। ভুসির অনেক ক্ষমতা।”

বাহারের উদ্দেশ্য ছিল নুরুল সওদাগরকে খ্যাপানো আর সেই লক্ষ্যে সে সক্ষম হলো। নুরুল সওদাগর যখন রেগে চিৎকার দিলেন বাহার তখন হেলেদুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। চিত্রা অসহায় চোখে সেটা দেখল কেবল।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে