প্রেমোত্তাপ পর্ব-১৮+১৯

0
305

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৮.

উত্তপ্ত গরম, ঘামে ভিজে একাকার চিত্রা। আজ কলেজ এসেছে এডমিট কার্ড নিতে। এইতো আর কিছুদিনের মাথায় তার পরীক্ষা শুরু হবে। এডমিট কার্ড নিতে এসে ভীড়ে সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। মাথা ঘুরছে খালি। এত রোদও যে আজ কী মনে করে ওঠলো সে বুঝে পাচ্ছে না। কী বিরক্তকর!

এডমিট কার্ড নিয়ে চিত্রা কলেজ থেকে বেরুতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দমবন্ধ ভাবটা কিছুটা কম লাগছে। চিত্রা ডানে-বামে তাকালো। রিকশার খোঁজ করলো। কোনো রিকশা নেই আশেপাশে। যেদিন প্রয়োজন পরে সেদিনই রিকশা গুলো উধাও হয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে! চিত্রাকে বিরক্ত করতে বাহার ভাইয়ের পাশাপাশি প্রকৃতিও সচেষ্ট।

চিত্রা আশপাশ তাকাতেই তার ডান দিকের গলিটাতে বনফুলকে ছুটে যেতে দেখা গেল। চিত্রা কিছুটা বিস্মিত হলো। বনফুলের কলেজ এ রাস্তায় না। এতটা দূরে মেয়েটার একা আসারও কথা না। কিন্তু ও এখানে কী করতে এলো! বনফুল তত চতুর মেয়েও না যে একা একা এখানে চলে আসবে। তাহলে এখানে কেন এলো মেয়েটা! চিত্রার কপাল কুঁচকে গেলো চিন্তায়। সেও কিছুটা ছুটেই সে গলির দিকে গেলো। বনফুল ততক্ষণে অনেকটা দূরে৷ চিত্রা জোরে ডাক দিতে গিয়েও দিলো না। কি মনে করে যেন থেমে গেলো। বনফুলের হাবভাব তার স্বাভাবিক ঠেকছে না। মেয়েটা কেমন সাবধানী চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিসের ভয় মেয়েটার? কিসের ভয়ে সে এমন করছে! চিত্রা পায়ের গতি আরও বাড়ালো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। দ্রুত ছুটতে গিয়ে চলন্ত এক মোটর সাইকেলের সাথে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ে সে পথের ধারে। মুখ থুবড়ে পড়ায় বা-হাতটা চিনচিন এক তীক্ষ্ণ ব্যাথা করে উঠলো। সেই ব্যাথায় ঘুরে ওঠলো চিত্রার মাথা। অসহ্যকর ব্যাথাটা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা গগন বিদারক চিৎকার দিয়ে ওঠে। মটর সাইকেলের ছেলেটা তৎক্ষণাৎ তার গাড়ি থামিয়ে ছুটে এলো। ছেলেটাকে ঝাপসা চোখে দেখে চিত্রা বিড়বিড় করে ওঠলো, ধীর স্বরে বলল,
“আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও।”

তারপর মেয়েটা জ্ঞান হারালো। শূন্য মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে গেলো।

_

অহি ভার্সিটি থেকে ফিরতেই অপ্রিয় মহিলার মুখমন্ডল দর্শন করে বিরক্ত হলো। বিরক্তি ছড়িয়ে পড়লো তার চোখ-মুখে। সে নিজেকে কিছুটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেই তার রুমের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যোত হলো কিন্তু শেষমেশ সে আর যেতে পারলো না, তার আগেই মহিলাটা হাসি মুখে কাছে এলেন, গদোগদো করে বললেন,
“আমার অহু কেমন আছে?”

অহি বিরক্ত চোখে তাকালো। ড্রয়িং রুমে তার বাবা, চাচা, বড়ো আব্বু, বড়ো আম্মু, মেঝো আম্মুসহ সবাই উপস্থিত। সাথে মহিলাটার স্বামীও এসেছেন বোধহয়! এত গুলো মানুষের সামনে বাজে ব্যবহার করতে বাঁধলো অহির। তাই কিছুটা তিতে কণ্ঠেই বলল,
“ভালো থাকারই তো কথা। ভালো থাকবো বলেই তো সবার এত আয়োজন। খারাপ থাকার সুযোগ নেই।”

অহির এমন আচরণেও মহিলাটার গদোগদো ভাব কমলো না বরং সে আহ্লাদ করে নিজের আঁচল দিয়ে মেয়েটার ঘাম মুছিয়ে দিতে নিলেন। কিন্তু এত আহ্লাদ বোধহয় সহ্য হলোনা অহির। তাই মহিলাটার হাত কিছুটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে অবনী বেগমের উদ্দেশ্যে চেচিয়ে বলল,
“আমি কলেজ থেকে এলে যে শরবত দিতে হয় সে-ই প্রথাও কী সবাই ভুলে গেছে? সবাই কী পেয়েছে, হ্যাঁ? যার যা মন চাইবে, সে আমার সাথে তা-ই করবে?”

“অহি!”

নিজের বাবা আমজাদের সাবধানী ডাক ভেসে এলো। বাবা বোধহয় তাকে শান্ত হওয়ার জন্য এই ডাকটা দিলেন। অহি বাবার দিকে তাকাল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপনি একটা মানুষই…”

অহির কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই অবনী বেগম রান্নাঘর থেকে শরবত নিয়ে এলেন। চোখ-মুখ তার ফুলে আছে। শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে আধভাঙা কণ্ঠে বললেন,
“আমি খেয়াল করিনি তুমি এসেছো। নেও।”

অহি শরবতের গ্লাসটা কিছুটা টেনেই নিলো। তন্মধ্যে আমজাদ সওদাগর স্ত্রীকে ধমকে বললেন,
“খেয়াল কোথায় থাকে তোমার? বাসায় করোটা কী তুমি?”

“কেন, আপনাদের খোশামোদ করে।”

বাবাকে উত্তরটা দিয়েই অবনী বেগমের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আর হ্যাঁ আপনি, খেয়াল আর কবে করবেন? কে এলো, কে গেলো সব খেয়াল করুন। সংসারটা আপনার। চোখ ফুলিয়ে কাঁদলে আর কণ্ঠস্বর ভাঙলেই যদি জগতে সুখে থাকা যেত বা সবটা পাওয়া যেত তবে আমার সকল অশ্রু আমি বিসর্জন দিতাম।”

অহি কথা শেষ করেই ভদ্রমহিলার দিকে তাকালো। ভদ্র মহিলা বিমূঢ়। বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে বললেন, “অহু বড়ো হয়ে গেছিস!”

“বড়ো হয়ে গেছি কি-না জানিনা তবে সামলে নিয়েছি। এর জন্যই তো ছেড়ে গিয়েছিলেন, তাই না?”

মহিলা আর জবাব খুঁজে পেলেন না। তার সাথে আশা ভদ্র পুরুষটি তখন ওঠে দাঁড়াল। কিছুটা মিষ্টি হেসে এগিয়ে এসে অহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পিতৃ-স্নেহে। কোমল কণ্ঠে বললেন,
“তুমি বেশ বুদ্ধিমতী, মা। ভালো আছো?”

অহি চেয়েও লোকটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে পারলো না। কিন্তু ধীর কণ্ঠে জবাব দিল,
“ভালো আছি। আপনারা আসছেন, বসুন, খাবেন তারপর চলে যাবেন। আমি আশা করবো এই ভদ্র মহিলা যেন এ বাড়িতে আর না আসেন।”

অহির তীক্ষ্ণ কথাতেও বিচলিত হতে দেখা গেল না লোকটাকে। সে শান্ত ভঙ্গিতেই বলল,
“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ উনি তোমার….. ”

“সরি টু সে, উনি আমার কেউ না আঙ্কেল। আপনি ভুল কথা বলবেন না।”

অহির আচরণে ভদ্রমহিলার চোখের কোণে অশ্রু দেখা গেল। অশ্রু এলো অবনীর চোখের কোণে। মুখ তার ভীতিগ্রস্ত। নুরুল সওদাগর ওঠে এলেন, বিজ্ঞ কণ্ঠে মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন,
“শিমুল, কেঁদে লাভ নেই। মেয়েটা তোমার আচরণে অনেক ব্যাথা পেয়েছে যার কারণে আজ সে পাথর। তুমি তোমার প্রাপ্য আচরণেই তার কাছ থেকে পাচ্ছো।”

শিমুল নামের মহিলাটি তার চোখের স্বচ্ছ গ্লাসটা খুললেন। চোখের অশ্রুখানি আলগোছে মুছে বললেন,
“আমাদের তোমাকে প্রয়োজন।”

“আমার আপনাকে প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজনে যে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে তাকে আমার চাই না।”

“অহি, তুমি ওর সাথেই যাবে। ওদের সাথেই থাকবে। আর কোনে কথা না।”

আমজাদ সওদাগর নিজের কথাটা বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে। অহি ফেটে পড়লো ক্রোধে। হাতের কাচের গ্লাসটা সর্ব শক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো। চিৎকার দিয়ে বলল,
“আপনারা কেউ আমাকে ভালোবাসেননি। সবসময় নিজেদের কথা ভেবেছেন। আপনারা তো নিজেদের কথা ভেবে সুখী হয়েছেন, আমাকে কেন ফেলেছেন বাতিলের খাতায়? একটা সন্তানকে যদি মা-বাবা হয়ে সুখই দিতে না পারেন তো জন্ম দিয়েছিলেন কেন? বাবা-মা হিসেবে আপনারা ব্যর্থ। মানুষ হিসেবে আপনারা ব্যর্থ। একটা মানুষের সুখ কেড়েছেন আপনারা। শৈশব থেকে কত মানুষের ঠাট্টার পাত্রী হয়েছি আমি। এসব আমি ভুলবো না। ভুলবো না। এ বাড়ি থেকে আমার লাশ বের হবে, আমি তো না-ই।”

কাচের গ্লাসের টুকরো গুলো পা দিয়ে মাড়িয়েই অহি নিজের রুমে ছুটে চলে গেলো। পেছনে ফেলে গেলো কিছু ব্যাথাতুর, অবাক দৃষ্টি। বিষাক্ত অতীত কখনো সুখের স্বাদ দিতে পারে না যে!

_

অফিসের কাজে ব্যস্ত হাত চাঁদনীর। চাকরিচ্যুত হওয়ার চিঠিটাও সে জমা দিয়ে ফেলেছে। জমে থাকা কাজ গুলো সম্পন্ন করে তুলে দিবে দায়িত্বরত সিনিয়র অফিসারের হাতে তারপর তার ছুটি, চির অবসাদ। ছুটি দিবে আপন মানুষ, ছুটি দিবে দেশ। তার মনের সাথে সাথে তার দেহ ভুগবে একাকীত্বে। তাও ভালো, কেউ তখন আর কাঁদাবে না তাকে, কেউ তাকে আর ঘটা করে হাসবে না। কেউ তখন তাকে পাওয়ার জন্য ‘বেয়াদব’ হতে চাইবে না। তাও ভালো, কেউ তখন আর জানবে না চাঁদ মেয়েটা মরছে রোজ।

এসব ভাবতেই হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো চাঁদনীর ভেতর থেকে। তন্মধ্যেই তার কলিগ মামুন সাহেব উপস্থিত হলো কার কক্ষে। নিজের চকচকে দাঁত গুলো দেখিয়ে হেসে বলল,
“কী মেডাম, চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন শুনলাম?”

চাঁদনীর ব্যস্ত হাত থামলো। না চাইতেও মামুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,
“ঠিকই শুনেছেন।”

“চাকরি ছাড়বেন কেন? দোষ তো করেছেন আপনি, চাকরি তো না।”

মামুন সাহেবের ঠেস মারা কথায় কপাল কুঁচকালো চাঁদনী। কিছুটা অবুঝ হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“জি? বুঝিনি।”

মামুন সাহেব এগিয়ে এলেন। চাঁদনীর সামনের চেয়ারটাতে বসে পা ঝুলাতে ঝুলাতে কেমন বিদঘুটে হাসি দিয়ে বললেন,
“সাদা জামাতে বৃষ্টিতে ভিজে প্রেমিকের সাথে ছবি তো আপনি তুলেছেন। অফিস বা চাকরির দোষ কী?”

চাঁদনী ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই লোকটার সাথে কথা বলতে তার রুচিতে বাঁধছে। এর মাঝেই তার ফোনে নোটিফিকেশন এলো। মৃন্ময়ের উনপঞ্চাশটা কল আর ছিয়ানব্বইটা ম্যাসেজ। সবশেষ মানে বর্তমান ম্যাসেজটা জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্ক্রিনে। সেখানে ছোটো করে লিখা ‘আমি অফিসের নিচে ইন্দুবালা, তাড়াতাড়ি আসুন।’

চাঁদনীর মাথা গরম হলো ছেলেটা পেয়েছি কী তাকে? আজ এর একটা বিহিত সে করবেই। তার উপর মামুন সাহেবের গা জ্বালা হাসিতে সে অতিষ্ঠ হয়ে যেই না ওঠে চলে যেতে নিবে তখনই পেছন থেকে লোকটা বলে ওঠলো,
“ভিজে জামায় আপনাকে দারুণ লাগছিল।”

লোকটার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হবে না কারো। চাঁদনীরও হয়নি। কিন্তু সে প্রকাশ করলো না তার ঘৃণা। বরং মুচকি হেসে বলল,
“আপনার আর সুইটির অন্তরঙ্গ কিছু ছবিও দারুণ। ভাবীকে দেখাবো, কী বলেন?”

মামুন সাহেবের মুখের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। চাঁদনী গা দুলাতে দুলাতে নেমে গেলো অফিস থেকে।

অফিসের বাহিরে আসতেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মৃন্ময়কে তার চোখে পড়লো। রাগটা সাথে সাথে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো। সে কিছুটা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে এমন মাঝ রাস্তায় সশব্দে চ ড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে। ছেলেটা আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। কেবল বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “ইন্দুবালা…”

“আই হেইট ইউ, মৃন্ময়। তোমার বাচ্চামো আজ আমার চরিত্রে কলঙ্কের কালি লেপেছে। কখনো ক্ষমা করবো না তোমাকে। কখনো না।”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৯.

জানুয়ারির ব্যস্ত শহরে এখনো ঝিমিয়ে আসা শীত উঁকি দেয়। কৃষ্ণচূড়ার লাজুক ডালে এখনো শূন্যতা উপস্থিত। এখনো শহরের অলিতে-গলিতে প্রেমের প্রত্যাখ্যান জ্বলজ্বল করছে ডিসেম্বরের বিদায়ে। কোথাও বা তুমুল আহ্লাদে প্রেম গাঢ় হচ্ছে! এই এত হওয়া- না হওয়া ব্যাপারটার মাঝেই একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। যেই ঘটনায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে সওদাগর বাড়ির সুখ। সেই বাড়ির চঞ্চল প্রাণে আজ করুণ আহাজারি। হসপিটালের গাঢ় পরিবেশে সেই আহাজারি জীবন্ত, সতেজ এবং যন্ত্রণার।

চঞ্চল চিত্রার দেহ এখন নিস্তেজ প্রায়। ক্লান্ত চোখের পাতা এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। হসপিটালের গুমোট করিডোরে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে প্রিয়জনেরা। ভাইয়ের দেহ ভেঙে আসতে চাচ্ছে চিন্তায়। আদুরে বোনের এই বিরাট ব্যাথা যে তার সহ্য হচ্ছে না। সে আজকে ভার্সিটি ছিল। হুট করে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো, জানানো হলো তার বোনের এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কথা। তারপর সে যেন প্রায় ঘোরের মাঝেই ছুটে এলো। তার সাথে এলো নিরু মেয়েটিও। মাহিন— চিত্রার এক্সিডেন্ট যার বাইকের সামনে ঘটেছিল, তার উপর ক্ষেপে যায় তুহিন। ক্ষুব্ধ হয়ে ছুটে যায় প্রহার করতে। কিন্তু ছেলেটা থামায় তুহিনকে, বিনীত স্বরে জানায় দোষ তার নয়। সে সাবধানেই চালাচ্ছিল। হঠাৎ চিত্রা কোথা থেকে ছুটে এলো সে ঠাহর করতে পারল না। মধ্য গতির বাইকটি থামতে থামতে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। তুহিন তবুও থামতে চায় না তবে সামলায় নিরু। ততক্ষণে বাড়ির প্রায় সকলে উপস্থিত হয়। চাঁদনী আপা, অহি, চিত্রার মা, চেরি, অহির মা-বাবা, আফজাল সওদাগরসহ সকলে।

প্রিয়জনদের দীর্ঘস্থায়ী অপেক্ষার পালা শেষ হলো, ডাক্তার বেরিয়ে এলো সুসংবাদ নিয়ে,
“চিত্রা সওদাগরের এখন অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। তবে…..”

ডাক্তারের অযাচিত বিরতি বড়োই অসহ্যকর ঠেকল সওদাগর পরিবারের কাছে। মুনিয়া বেগম সহ্য করতে পারল না সে বিরতি। ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালেন,
“তবে?”

“উনার বা’হাতের আঘাত মারাত্মক পর্যায়ে ছিল যার জন্য তার কবজির হাড়ে ফাটল ধরেছে বলা যায়। আমরা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। এবং যেহেতু মাথায় ও পিঠেও আঘাত পেয়েছে সেহেতু দু’দিন আমরা অবজারবেশনে রাখবো তাকে। অতিরিক্ত ব্যাথা থেকে জ্বর আসবে। আর এখন জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান ফিরলেই তার সাথে দেখা করতে পারবেন।”

উপস্থিত সকলের মাঝে তুহিনকে বেশি ভেঙে পড়তে দেখা গেল। সে ধপ করে বসে পড়ল সাথের চেয়ারটাতে। মুখ ঢেকে ফেলল যন্ত্রণায়। মেয়েটা কত বেশিই না ব্যাথা পেয়েছে! ছোটো নাজুক শরীরটা কতটা আঘাত পেল! তুহিন যেন বাইক চালানো ছেলেটার উপর আরও একধাপ বেশি রেগে গেল। কেবল প্রকাশ করল না। মুনিয়া বেগম হলেন ছেলের আশ্রয়স্থল। এই ভয়ঙ্কর বিপদেও সে দৃঢ় স্বরে বললেন,
“তুহিন, এটা সামান্যই। ওর জানের ক্ষতিও তো হতে পারতো? তাই না? কিন্তু বেঁচে গিয়েছে। সেজন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ নয় কী?”

মুনিয়া বেগম সদা কঠিন থাকার একটি ক্ষমতা নিয়ে জন্মিয়েছেন বোধহয়। কখনো, কোনো ব্যাপারে তাকে মারাত্মক রকমের বিচলিত দেখা যায় না। সবসময় বিপদে ভেঙে আশা মানুষের ভরসা হয়েই থাকেন তিনি।

অহি মিহি স্বরে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। ক্ষণে ক্ষণে নাকও টানছে। চাঁদনী যে কাঁদছে না, তেমনটা নয়। তবে অহির কান্না, চেরির কান্না সামলানোর দায়িত্ব যেহেতু তার ঘাড়ে পড়েছে তাই তার আর আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে কান্না করা হচ্ছেনা। তবে তার ভেতরটা ভেঙে আসছে। চিত্রা তার খারাপ সময়ের কঠিন ঢাল। অভিমানী মেয়েটাও চাঁদনী আপাকে বাঁচাতে বড়োদের সামনে বুক পেতে রাখে। চাঁদনী আপার কষ্ট দেখে, সে-ই মেয়েই তো হাউমাউ করে কাঁদে। পৃথিবীতে আমাদের জন্য কান্না করা মানুষের বড়োই অভাব। বেঁচে থাকা মানুষের জন্য সচারাচর কেউ কাঁদতে চায় না। কাঁদে তো মৃত মানুষের জন্য। অথচ সেই প্রথা মিথ্যে করে দিয়ে, চিত্রা প্রায় রোজই কাঁদে চাঁদনী আপার দুঃখে। এই মেয়েটাকে হারালে, চাঁদনী যে নিজের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল শুভাকাঙ্খীকে হারাবে! কত-শত ভাবনার মাঝেই চাঁদনীর ফোন বেজে উঠল খুব গোপনে। ফোনের ভাইব্রেশনের তোপে কাঁপছে যেন শরীরও। চাঁদনী ভ্রু কুঁচকালো, ফোন বের করতেই, ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘মৃন্ময়ের’ নাম্বারটি। মৃন্ময় নামটা দেখেই চাঁদনীর রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেল। ভেতর ভেতর ভোঁতা একটি রাগ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার চরম সর্বনাশ করেও, এমন মাঝ রাস্তায় চ ড় খাওয়ার পরেও কী এই নির্লজ্জটার শিক্ষা হবে না? চাঁদনী ফোনের দিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। চাঁদনী জানে, সে যতক্ষণ ফোন না ধরবে ততক্ষণ একটানা ছেলেটা ফোন দিতেই থাকবে। তাই সে অপেক্ষা করে দ্বিতীয়বার কলের জন্য। কিন্তু চাঁদনীর অপেক্ষারা সময় বাড়িয়ে সেকেন্ড থেকে মিনিট হয়, অথচ দ্বিতীয় কলটি আর আসেনা। ক্ষণে ক্ষণে চলতে-চলতে মিনিটের কাটা পাঁচে গিয়ে ঠেকে। চির-পরিচিত অভ্যাসটি মিথ্যে হয়ে যায় কোন সে অবহেলায়! নতুন নিয়মে। ছেলেটি আর কল দেয় না। চাঁদনী তীর্থের কাকের ন্যায় নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। অতঃপর সে অনুভব করে, তার অপেক্ষা, কেউ একজন উপেক্ষা করে নিয়ম বদলে ফেলেছে। ভেতর থেকে ভারী শ্বাস বেরিয়ে আসে। বদলে যাওয়ার এই পৃথিবীতে সকল নিয়ম যে অনিয়মেই এসে ঠেকে, চাঁদনী তা ভুলে গেল কী করে!

চিত্রার জ্ঞান ফিরতেই কেবিনে ভীড় করে তার প্রিয়জনেরা। চিত্রা চোখ মেলে তাকায়। তীক্ষ্ণ একটি ব্যাথা তার শরীর জুড়ে ছড়াছড়ি করে। সে ঘোলা চোখে চারপাশে তাকায়। আবছা দৃষ্টিতে সকলের মুখ দৃষ্টিগোচর হয়। তুমুল ব্যাথা নিয়েও চিত্রা ক্ষীণ হাসলো। অসুস্থ স্বরে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি।”

এতটুকু কথা বলতে গিয়েও যেন মেয়েটা হাঁপিয়ে উঠল। অহির ফ্যাচফ্যাচ কান্না ততক্ষণে শব্দতে রূপান্তরিত হলো। চিত্রা হাসল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
“এ আমি কী দেখছি! ছোটো আপা আমার জন্য কাঁদছে?

অহি এবার পুরোদমে কেঁদে উঠল, শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
“তুমি এত কেয়ারলেস কেন? এজন্যই তুমি বকা খাও। সাবধানে চলতে না পারলে রাস্তায় বের হবে না। শুধু শুধু আমাদের চিন্তায় ফেলেছ। তোমাকে যদি আর একা বের হতে দিয়েছি, তো দেখো।”

“ভাগ্যিস বের হয়েছিলাম! নাহয়, ছোটো আপা যে আমায় এত ভালোবাসে, সেটা কী জানতাম নাকি!”

মেয়েটা এ অবস্থাতেও দুষ্টুমি করে যাচ্ছে দেখে অহির মায়া আরও বাড়লো। সেই মায়া নিয়ে সে আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিল বোনের চোখ-মুখ। অহির ভাব-ভঙ্গিতে কখনো এত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু ভালোবাসা যে খুব বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। চিত্রার ডান চোখের কার্নিশ ঘেঁষে খুব গোপনে পালিয়ে গেল মুক্তোর মতন অশ্রুবিন্দুরা৷ একে একে বাড়ির সাকলেই তাকে আদর করল। কিন্তু তুহিন দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা দূরে, দরজার সাথে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নিরু। বাড়ির সকলের আদরের পালা যখন শেষ হলো, তখন নিরু এগিয়ে এলো, মিষ্টি হেসে শুধাল,
“ভালো আছো?”

চিত্রা শুনল প্রশ্নটা, তবে জবাব দিল না। বরং মুখ ফিরিয়ে নিল সাথে সাথে। নিরু মেয়েটা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল বোধহয় চিত্রার আচরণে। তবুও চিত্রার মাথায় আদুরে হাত রাখল, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“সুস্থ হয়ে উঠো তাড়াতাড়ি। তোমার ভাই তো তোমার এ অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে নিজের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে।”

“আপনি তো আছেন, সামলানোর জন্য। আপনি থাকলেই আমার ভাইয়ের আর কিছু লাগবে না।”

চিত্রার গলার স্বর কঠিন। তাজ্জব বাড়ির লোক। মুনিয়া বেগম ধমকে উঠলেন,
“চিত্রা!”

নিরু মেয়েটার মুখে তবুও হাসি। সে চিত্রার মাথায় হাত আগের মতন রেখেই উত্তর দিল,
“আমি সামলাতে হয়তো পারবো কিন্তু তোমার শূন্যতা আদৌও আমি পূরণ করতে পারতাম? তোমার ভাইয়ের জীবনে তোমার জায়গাটা ঠিক কী, তা বোধকরি আমার বলে দিতে হবে না, তাই না? তাহলে কেন শুধু শুধু আমার সাথে তোমার তুলনা করে তোমার নিজের জায়গাটাকে হালকা করছো?”

মেয়েটার কথা শুনে, চিত্রার শক্ত মুখের আদল নরম হলো। কিন্তু সে তবুও নিরু মেয়েটার উপস্থিতি ভালো ভাবে নিতে পারল না। পুরোনো ক্ষতে নতুন জ্বলন তৈরী হলো। ভাইয়া আর এই নিরু মেয়েটার জন্যই আজ তার এবং বনফুলের সম্পর্কে ঘূণে ধরেছে। নরম হয়েছে বন্ধুত্বের শক্ত ভিটে। চিত্রার চোখে যন্ত্রণার অশ্রু। আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতো। আজকে তার পাশে বসে বনফুল মেয়েটার হাউমাউ করে কান্না করার দৃশ্য হতে পারতো। বোকা বোকা কণ্ঠে মেয়েটা হয়তো চিত্রাকে বকতো। বন্ধুত্বের বন্ধন আরও গাঢ় হতো, হয়তো। কিন্তু কিছু হলো না তেমন, কিছু না। সব বদলে গেছে। তার এমন ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা জেনেও বনফুলের মন গলেনি। আসেনি মেয়েটা তাকে দেখতে। কিচ্ছু আর আগের মতন নেই, কিচ্ছু না। চিত্রার কোমল মনে আছড়ে উঠল শূন্যতা। সে ফুপিয়ে কেঁদে দিল সেই শূন্যতা সামলাতে না পেরে। ভাইয়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“চলে যাও তুমি, ভাইজান। চলে যাও। তুমি আমার সুখে কালি দিয়েছ, তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। চলে যাও।”

তুহিন ফ্যালফ্যাল করে বোনের ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর মিনিট পেরুতেই মাথা নত করে কেবিন ছাড়ল। সকলেই এ-সব হতবিহ্বল চোখে দেখল। এছাড়া তাদের করার যে কিছুই নেই।

_

আকাশের বুকে বিরাট রূপোর থালার মতন চাঁদ এঁঁকে নির্বিকার হাসছেন সৃষ্টিকর্তা, একেকটা তাজা-তাজা প্রাণের অসহ্য ব্যাথা দেখে। ভাবছেন, মনুষ্য জন্ম গেল দুঃখ পুষেই! অথচ মানুষ চাইলেই দুঃখ ভুলে সুন্দর জীবন সাজাতে পারত।

চাঁদনীর ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তার জামায়। চুলের জলে ভিজে গেছে পিঠের একাংশ। অথচ মেয়েটার হেলদোল নেই। সে শূন্য চোখে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। হসপিটাল থেকে এসেই গোসল করেছে। গরম-শীতের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সে প্রায় জুবুথুবু। মোবাইল স্ক্রিনে থমকে গেছে তার অপেক্ষারা। চির স্থায়ী ভাবেই হয়তো!

সে হতাশার শ্বাস ফেলল। টানা দেড় ঘন্টা যাবত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পরও পাশের বিল্ডিং থেকে আজ চিরপরিচিত স্বরে কেউ ‘ইন্দুবালা’ বলে ডাক দেয়নি। এমনকি কেউ আধো আদ্র সুরে গান তুলেনি ‘ইন্দুবালা গো, ইন্দুবালা গো’ বলে। নিজের এহেন ভাবনায় বিরক্ত চাঁদনী। না, সে মৃন্ময়কে ভালোবেসে এসব ভাবছে তেমনটা না। সে ভাবছে অভ্যাসবশত। মানুষ সব বদলাতে পারলেও অভ্যাস বদলাতে তার বহু সময় লাগে। তাই হুট করে চাঁদনী চাইলেও তো আর অভ্যাস বদলাতে পারছে না। অভ্যাসের তোপে না চাইতেও ভেবে ফেলছে ছেলেটাকে। তন্মধ্যেই চাঁদনীর ফোনে নোটিফিকেশন আসে। সে ফেসবুক অন করতেই মৃন্ময়ের কতগুলো হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখতে পায়। কোথাও একটা গিয়েছে সে, কারো বিয়ের অনুষ্ঠান বোধহয়! বন্ধু-বান্ধবের সাথে আনন্দের ছবি দিয়ে ভাসাচ্ছে নিউজফিড। কই, মৃন্ময়ের মুখের কোথাও তো দুঃখের কোনো প্রলেপ নেই! তবে! তবে চাঁদনী কেন তাকে ভেবে দেড়টা ঘন্টা বিসর্জন দিল? নিজের প্রশ্নের ভারে নুইয়ে আসে চাঁদনীর অনুভূতি। সবশেষে সে ব্লক করে মৃন্ময়ের ফেসবুক আইডিটা। হতাশার শ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্য করে বলে,
“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, মৃন্ময় শাহাদাৎ এর ভাই!”

ব্যস্, এখানেই হয়তো আরেকটা সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোলাগার পুষ্প অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো!

_

হসপিটালের বেডে চিত্রার ক্লান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। সাথে হতাশাও। কিসের একটা বুক ভার করা অনুভূতি তাকে শান্তি দিচ্ছে না। কিসের সেই অনুভূতিটা? বনফুল আর বাহারের অনুপস্থিতিই কী সেই বুক ভারের কারণ? মুনিয়া বেগম বসে আছেন তার বেডের পাশেই। চোখে রাজ্যের ঘুম তবে মেয়েকে পাহারা দেওয়ার জন্য ঘুম আর হয়ে উঠছে না।

নিস্তব্ধতা ঠেলে চিত্রার কেবিনে কারো প্রবেশ ঘটতেই সজাগ হয়ে গেলো মুনিয়া বেগমের ক্লান্ত দেহ। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের স্বামীকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“তোমার সময় হয়েছে তাহলে!”

নুরুল সওদাগর স্ত্রী’র পানে চাইল গম্ভীর দৃষ্টিতে, রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
“সময় হয়েছে বলেই এসেছি। এক্সট্রা কথা আমার পছন্দ নয়।”

মুনিয়া বেগম হয়তো আরও দু-চারটে কঠিন কথা বলতেন কিন্তু চিত্রার কোমল মুখ পানে চেয়ে মায়ের ভাষারা নরম হয়ে গেলেন। স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে চুপ হয়ে গেলেন সে, মুহূর্তেই। নুরুল সওদাগর গম্ভীর পায়ে এগিয়ে এলেন, গমগমে স্বরে বললেন,
“সাবধানে চলতে পারো না? সামনে পরীক্ষা তোমার, আর তুমি হা-পা ভেঙে বসে আছ?”

চিত্রার মাথা নত, ক্ষীণ স্বরে উত্তর দেয়,
“সরি, আব্বু।”

চিত্রা ভেবেছিল তার বাবা হয়তো আরও কয়েকটা কথা শোনাবেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাবা আর বকা-ঝকা করলেন না। কিয়ৎক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে অতঃপর প্রস্থান নিলেন। মুনিয়া বেগমও স্বামীর এহেন আচরণে তাজ্জব। হজম করতে পারল না ব্যাপারটা। তাই তৎক্ষণাৎ স্বামীর পেছন পেছন সে-ও বেরিয়ে গেল। চিত্রা হতাশার শ্বাস ফেলল। অবশ চোখে আশপাশ তাকাতেই মায়ের ফোনটা চোখে পড়ল। একবার ফোন, আরেকবার বাহিরে দৃষ্টি দিয়েই চিত্রা ফোনটা তুলে নিল। যন্ত্রের মতন ডায়াল করল মুখস্থ নাম্বারটিতে। প্রথমবারে অপর পাশ থেকে রেসপন্স এলো না। চিত্রা তাই ব্যস্ত গতিতে আবার কল দিল। এবার বার কয়েক রিং হতে বাহারের মেঘমন্দ্র কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কে বলছেন?”

চিত্রার চোখ বুজে আসে। মায়ের নাম্বারটাও লোকটার কাছে সেভ নেই! হাহ্! দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় হসপিটালের কেবিন। বাহার আবার শুধায়,
“কাকে চান?”

চিত্রা সময় নিল না, ঝটপট উত্তর দিল, “আপনাকে।”

অপর পাশ উত্তর শুনে তুমুল নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো। পরপর চিত্রার অসুস্থ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনাকে চাচ্ছি, দিবেন কী আমায়?”

বাহার কিঞ্চিৎ হাসল চিত্রার প্রশ্নে। ধানমন্ডির বিশাল হসপিটালের সামনের পার্কেই তার অবস্থান। সেখান থেকে হসপিটালের দিকে তাকিয়ে সে গাঢ় স্বরে উত্তর দিল,
“আমি যে সওদা করতে পারিনা। পারলে না-হয় আদান-প্রদানের বিষয়টা আগানো যেত!”

“ভালোবাসতে পারেন কী? সেটা পারলেই হবে।”

“পারিনা।”

চিত্রার উৎফুল্ল ভাব মিইয়ে এলো বাহারের উত্তর শুনে। চোখ জুড়ে টইটম্বুর হয়ে এলো অশ্রুরা। লোকটা কী তাকে চিনতে পারেনি! সংশয়ে মন টলে চিত্রার। উভয় পক্ষই নিরব তখন। প্রায় সেকেন্ড পেরুতেই নিরবতা ভেঙে প্রিয় পুরুষ বলে উঠল,
“রঙ্গনা, এই ভালোবাসতে না পারা আমিকে নিয়ে তুমি কী করবে বলো! কেন যেচে যন্ত্রণা টানছো, বলোতো? তাজা প্রাণে ব্যাথা পাওয়ার এত ইচ্ছে!”

চির-পরিচিত সেই ডাক শুনে চিত্রার চোখ বুজে এলো। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“আপনি যন্ত্রণা হলে, আমি নির্দ্বিধায় তা বইতে রাজি।”

বাহার হাসল, বিবশ কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছ কেন, মেয়ে? যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর আগেই কেঁদে ভাসাচ্ছ! তুমি জানো না? তুমি কাঁদলে সকল যন্ত্রণা নরম হয়ে যায়, তুমি কাঁদলে সকল ব্যাথা সুখ হয়ে যায়। কেঁদেই কী তাই মাত দিতে চাচ্ছ, মেয়ে? তবে শুনে রাখো রঙ্গনা, তোমার জন্য- যন্ত্রণার বাহার, সুখ হতেও রাজি।”

বাহারের কথায় ফিক করে হেসে উঠল চিত্রা। পরপরই বাবা-মায়ের তুমুল কণ্ঠ ভেসে আসতেই সে থেমে গেল। সেখানে কান দিতেই আবছা ভাবে বাবার কণ্ঠে তার বিয়ের কথা ভেসে এলো।

#চলবে…..?

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৯ এর বর্ধিতাংশ:

একটি গাঢ় ভোর কুয়াশার আবছা চাদর জড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে পদচারণ করছে প্রকৃতি বক্ষে। খুব দূর থেকে আধো ঘুমু শহরের কালো কাকটি তার কর্কশ কণ্ঠে ডেকে-ডেকে দিশেহারা প্রায়। সূর্য উঠেনি। জানুয়ারিতেও বোধহয় সূর্যের ছুটি শেষ হয়নি। শীতের হালকা প্রলেপ আজও আকাশ জুড়ে লেপা। চিত্রা ঘুমিয়ে আছে তার কেবিনে। বিভোর ঘুমে সে মগ্ন। তার সামনে বসে আছে তুহিন। চোখ গুলো যেন রক্তজবা। সারারাত ঘুমায়নি ছেলেটা। যদি বোনের ঘুম ভেঙে যায়! রাতে যদি বোনের কিছু প্রয়োজন পড়ে! মা’কেও পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ি। বোনের বিশাল দায়িত্বের ভারে চোখ আর বন্ধ করার ফুরসত মেলেনি। চিত্রার শরীরে ধুম জ্বর। মধ্য রাতের দিকেই জ্বর এসেছে। জ্বরের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন ডাক্তার, তবে কোনো কাজ হয়নি। থেকে থেকে জ্বর বাড়ছে মেয়েটার। তুহিন অবশ্য বাড়িতে এই খবরটা পৌঁছায়নি। এমনেতেই সকলে চিন্তিত, তার উপর এমন খবর দিলে সবগুলো আবার হৈহল্লা করে ছুটে আসবে। তুহিন বরাবরই ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। হুটহাট সে কোনো সিদ্ধান্তই নেয় না। কেবল সেদিন বিকেলে বনফুলকে চড় মারা ছাড়া।

সেই বিকেলের কথা ভাবতেই দীর্ঘশ্বাসে ভারি হলো তার বুক। বোনটা জ্বরের ঘোরেও প্রায় অনেকবার মেয়েটার নাম নিয়েছে। খুব দেখতে চাচ্ছে। কিন্তু তুহিনের যে কিছুই করার নেই! আদৌও কিছু করার নেই! প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতেই মনের গহীনে একটি অনাকাঙ্খিত উত্তর উঁকি দিল। সে তার ডালা-পালা মেলে জবাব দিল— ‘পথ আছে, পথ আছে’। তুহিন বড়ো শ্বাস ফেলল। উপায় আছে। অবশ্যই আছে। এতক্ষণ দুঃখের ঘোরে সে-ই উপায়ের কথা মাথায় আসেনি। সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ যখন ভীষণ দুঃখ কিংবা সুখে আবেগে আপ্লূত থাকে তখন তার ব্রেইন ভাবতে চায় না কোনো কিছু নিয়ে। কথায় আছে না, আবেগ আর বিবেক… দু’জন দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বী।

এত শত ভাবাভাবির কার্য স্থগিত রেখে তুহিন নিজের মোবাইল বের করল, ফোন লাগাল চির-পরিচিত নাম্বারটাতে। যেই নাম্বারটিতে সে কখনো কল দেয়নি এই জীবনে, পড়েছিল পরিত্যক্ত অথচ প্রয়োজনীয় হয়ে। প্রথমবার রিং হতে হতে কেটে গেল। অপরপক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। তুহিন তাই আবার কল লাগাল। দ্বিতীয়বার আর তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। সেকেন্ডের মাথায়ই অপর পাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হলো। পরপরই সজাগ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো।”

তুহিন যতটা স্বাভাবিক ভাবে ফোন দিয়েছিল, অপর পাশে ফোন রিসিভ হওয়ার পর সে আর ততটা স্বাভাবিক থাকতে পারল না। তার যেন মনে হল, বিরাট এক দুঃসাহসিকতার কাজ সে করে ফেলেছে। এটা করা উচিৎ হয়তো হয়নি। মেয়েটা তার থেকে নিজেকে আড়াল করে ভালো থাকতে চাচ্ছে, শক্ত হতে চাচ্ছিল, আর সে কিনা মেয়েটাকে আবার দুর্বল করে দিল! তুহিনের ভাবনার মাঝেই অপর পাশ থেকে আবারও ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো,
“তুহিন ভাই, কিছু বলবে?”

তুহিন যেন ডাকটা শুনে চমকে গেল তৎক্ষণাৎ। বিস্মিত চোখে বার কয়েক ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। তার জানামতে, সে কখনো এই নাম্বার থেকে বনফুলকে কল দেয়নি, তবে মেয়েটা পেল কোথায় নাম্বার? বিস্ময়ে তুহিনের কথা হারিয়ে যাচ্ছে, কণ্ঠ দিয়ে বের হচ্ছে না শব্দ। বহু কষ্টে তবুও উচ্চারণ করল,
“তুমি আমার এই নাম্বারটি কোথায় পেলে?”

“কেবল এইটা না, এই অব্দি তুমি যতগুলো সিম চেঞ্জ করেছ, সবগুলোর নাম্বারই আমার জানা। রবি সিম তোমার দু’টো, গ্রামীণ একটি, টেলিটক একটি এবং বাংলালিংক তিনটে সিম। এর মাঝে সবচেয়ে ব্যবহারকৃত সিমটি হলো গ্রামীণ। আর টেলিটকটি ব্যবহার করো তোমার অফিসের কার্যক্রম চালাতে। বাকি গুলো তেমন ব্যবহার করো না। ঠিক?”

তুহিন যেন আজ পর পর হতভম্ব হচ্ছে। বনফুলের শেষ প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচেকা খেল, অবাক হয়ে শুধাল,
“সবই তো দেখি জানো!”

“হয়তো! তবে তুমি যে চ ড় মারতে পারো, সেটা আগে কখনো জানিনি। তবে এখন জানি।”

বনফুলের শেষ কথাটা কেমন তীক্ষ্ণ ছিল! তুহিনের বুক যেন এফোড় ওফোড় করে দিল মুহূর্তেই। অপর পাশে থাকা মেয়েটিও চুপ। সে হয়তো নিজের প্রিয় মানুষের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছে মন ভোরে। তুহিন থামল, নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“একটা কথা রাখবে, বনফুল?”

“কী?” জবাব দেওয়ার সময় বনফুলের কণ্ঠ যেন অত্যাধিক রকমের শীতল মনে হলো। তবে পাত্তা দিল না সেটা তুহিন। বরং অসহায় কণ্ঠে বলল,
“একবার কী হসপিটালে আসবে বনফুল? চিত্রা তোমাকে বড়ো দেখতে চাচ্ছে।”

তুহিনের আবদার মিনিট পেরুতেই বনফুলের নিরব তাচ্ছিল্যের ভাষায় হেঁয়ালি হয়ে উড়ে গেল। বনফুল উত্তর না দিয়ে তৎক্ষণাৎ বিচ্ছিন্ন করল কলটি। তুহিন চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার উচিত হয়নি মেয়েটাকে কল দেওয়া। মেয়েটার দিক না ভেবেই সে আবার আঘাত করল! বয়ঃসন্ধির মেয়েরা আবেগের দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো বিষয় থেকে এগিয়ে। তাদের জীবনে আবেগ প্রাধান্য পায় সবচেয়ে বেশি। আর সে আবেগে তারা যদি কিঞ্চিৎ আঁচড় পায় তাহলে তারা হয়ে উঠে ধ্বংসের বীজ। সবকিছু ধ্বংস করতে তারা সচেষ্ট।

“কেন কল দিলে, ভাইজান? ও তো আসবে না। আমি জানি।”

হুট করে চিত্রার অসুস্থ কণ্ঠ ভেসে আসতেই তুহিন চমকে বোনের দিকে তাকাল। মেয়েটার জ্বরে মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ বেয়ে নিরবে নিভৃতে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণারা। ভাই স্বান্তনা দিতে চাইল কিন্তু চিত্রা যেন অনেক বুঝদার হয়ে গেলো। বুঝদার কণ্ঠে বলল,
“আমি কষ্ট পাচ্ছি না, ভাইজান। মোটেও কষ্ট পাচ্ছি না। তুমি চিন্তা করো না, ভাইজান। আমি সামলে নিব নিজেকে।”

তুহিন ভাষাহারা। তার এত বছরের জীবনে নিজেকে এত বেশি অসহায় সে কখনোই অনুভব করেনি। আজ মনে হচ্ছে, নিজের বোনের কথা ভেবে অন্তত তার নিজের ভালোবাসা ভুলে যাওয়া উচিত ছিল। সে বড়ো ভুল করে ফেলেছে, বড়ো ভুল।

_

চিত্রার অসহ্য রকমের জ্বরে নাজেহাল অবস্থা তবুও সে বেডে শুয়ে থাকছে না। কিসের একটা অস্থিরতা তার শরীর জুড়ে। ধরণীর বুকে তখন অপরাহ্নের মুগ্ধতা। আজান দিচ্ছে চারপাশে। পাখির মৃদু কিচিরমিচির শব্দে সে আর বসে থাকল না কেবিনে। তার মা আর ভাই গিয়েছে ডাক্তারের চেম্বারে রিপোর্ট নিয়ে। আশপাশ ফাঁকা পেতেই সে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। এই ধুম জ্বর নিয়ে সে করিডোর জুড়ে পায়চারী শুরু করল। হুট করে তার পা থেমে গেল করিডোর দিয়ে বাহিরে তাকাতেই। অনাকাঙ্খিত মানুষটাকে হসপিটালের ভেতরে ঢুকতে দেখে তার আনন্দরা যেন বাঁধ ভাঙলো। বনফুল হসপিটালে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করছে, তার পেছনে বাহার ভাইও!

চিত্রা করিডোর ছেড়ে এগিয়ে গেল। বনফুল সকল রাগ ভেঙে তার কাছে এসেছে, এটা সে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। চিত্রার মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। তবে সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। যখন সে দেখল বাহার আর বনফুল গাইনী বিভাগে প্রবেশ করছে। চিত্রা অবাক, হতভম্ব। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে দেখল সেখানে বাহারের বান্ধবী ঐ নোঙর নামের মেয়েটাও আছে। কেবল আছে না, সে বাহার ভাইয়ের কাঁধে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে