প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৯

0
353

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৯(শেষ অংশ)
________________
সাল ১৯৮০। ডিসেম্বর দশ। কনকনে শীতে পঞ্চমুখ সারা বাংলা। কুহেলিকার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ এই শীতেই। তাকে পাঠানো প্রথম চিঠি।
“মেঘ করেছে মনের ভিড়ে,
তোমার তো দেখা নাই,
আমি তো এক নিস্তব্ধ মানুষ
তোমার খোঁজ কোথায় পাই?”
সে’বারই প্রথম ডাকপিয়ন তালুকদার ভিলায় যায় মৃত্যুর বার্তা নিয়ে। কুহেলিকার মৃত্যু। কুহেলিকাকে প্রায় চিঠি পাঠাতাম আমি। অদ্ভুত বিষয় কুহেলিকা প্রেরককে না দেখেই তার প্রেমে পড়ে যায়। লুকিয়ে রাখে ইমতিয়াজের পাঠানো সব চিঠি। কুহেলিকার কাছে ইমতিয়াজ ছিল আরফান মজুমদার। তাদের দেড় মাসের প্রেম আলাপ চলে। এরপর হঠাৎ একদিন ইমতিয়াজ জানে কুহেলিকা ঢাকার বাড়িতে আসছে তার মামার বাড়ি। তখনই ছিল সুযোগ কুহেলিকার সতিত্ব নষ্ট করার।

রাগান্বিতার মনে পড়লো কিছু সেই শীতে কুহু আপা বায়না ধরে সে ঢাকার বাড়িতে যাবে। মামাকে নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কাজের সুবাদে রাগান্বিতার মামা স’পরিবার নিয়ে ঢাকা থাকতেন। রাগান্বিতা অজানা কারণে তাকে পছন্দ করতো না। কুহেলিকা সেই শীতে তাকেও সঙ্গে যাওয়ার কথা বলে ঢাকাতে কিন্তু সে রাজি হয় না। রাগান্বিতার আফসোস হলো সে কেন যায় নি। গেলে বোধহয় এতকিছু ঘটতো না। আবার মনে হয় বোধহয় সে যাবে না জেনেই যাওয়ার কথা বলেছিল কুহু আপা। রাগান্বিতা আবার চিঠি পড়তে শুরু করলো। ইমতিয়াজ লিখেছিল,

‘কুহেলিকা ঢাকা আসে। আমাদের দেখা হয়। কথা হয়। তোমার আপা আমাতে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে আমার এক কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। যা ছিল তার জীবনের চরম ভুল। এটা ঠিক আমাদের বিয়ে হয়। মিথ্যে বিয়ে যার কোনো অস্ত্বিত্ব ছিল না। তবে তোমার আপার কাছে সেই সময় সবই সত্যি ছিল। তোমার আপাকে আমি কখনো স্পর্শ করি নি। তাকে আমি ছুঁতে দেয় নি নিজেকে। আমার স্পর্শ কেমন এটা তাকে কখনো বুঝতে দেয় নি আমি। কারন আমার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। তোমার আপা জানতো না সে রাতের আধারে কার সাথে রাত্রিযাপন করতো। আরফান মজুমদার। এ নামের একজন সত্যি মানুষ ছিল। ছেলেটাও তোমার ভাইয়ের মতো নারীতে আসক্ত ছিল। সেই রাতে থাকতো তোমার বোনের কাছে। তোমার মামার বাড়ি গিয়েই লুকিয়ে রাতের আধারে রাত্রি যাপন করতো কুহেলিকার সঙ্গে আবার কুহেলিকার ঘুম ভাঙার আগেই চলে আসতো। ভাবো ঠিক কতটা নিকৃষ্ট ছিলাম আমি। একটা নিরীহ মেয়েকে অন্য একটা পুরুষ দিয়ে। ছিঃ। সেসময় আমি প্রতিহিংসা নিয়ে এতটাই জর্জরিত ছিলাম ভুল জেনেও সে কাজই করি বারংবার। অবশ্য একে ভুল বলে না বলে অপরাধ।

প্রতি রাতেই তোমার বোনের চোখ কাপড় দিয়ে বন্ধ থাকতো। এ তো ইমতিয়াজেরই একটা কথা ছিল। তোমার বোন সবটা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে মেনে নিতো। ঠিক কতটা ভালোবাসতো সে আরফান মজুমদারকে। সময় চলতে লাগলো শীত শেষে গরমের ছোঁয়া তখন মৃদু মৃদু আসছে। হঠাৎ কুহেলিকা বুঝতে পারে সে মা হয়ে চলেছে। তক্ষৎনাৎ সে চিঠি লেখে ইমতিয়াজ মানে আরফান মজুমদারকে। আর আরফান মজুমদার সে তো দিব্যি খুশি সেই চিঠি পেয়ে। ব্যস! সে’বারই চিঠি লিখে বসে তাদের সম্পর্ক ছিল মিথ্যে, বিয়েটাও ছিল মিথ্যে, শুধুমাত্র কুহেলিকার শরীর ভোগ করার জন্য এতকিছু করে আরফান মজুমদার। চিঠি পেয়ে তোমার বোন ভেঙে পড়ে ওদিকে বাড়িতে তোমার বাবা তার জন্য ছেলে দেখছেন। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। কুহেলিকার কাহিনি এখানেই শেষ। তার সাথে রাতযাপন করা আরফান মজুমদারকেও আমি মেরে ফেলি। কারণ প্রমাণ রাখা যাবে না। এরপরই ঘটে গেল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা। প্রেমের মতো ভয়ংকর কিছু পা দিয়ে ফেলার ঘটনা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার তোমাকে দেখতে যাওয়াই ছিল আমার বিরাট ভুল। তোমার বোন যেমন আমায় না দেখেই প্রেমে পড়ে ভুল করেছিল আমিও তেমন তোমায় দেখতে গিয়ে ভুল করেছিলাম। কল্পনা অনুযায়ী কুহেলিকার মৃত্যুর সাতদিনের মাথাতেই আমি যাই রেশবপুরে। উদ্দেশ্যে একটাই তালুকদার ভিলার শেষ ধ্বংসটা নিজ চোখে দেখা।”

সময়টা তখন সন্ধ্যা। আচমকাই তোমাদের বাড়ির সেই গাছতলায় বসে বাঁশি বাজাতে শুরু করি। এটা নিছকই শখ ছিল। আমি বুঝেনি তুমি তখন আসবে। আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতে ভাবছিলাম তোমার জন্য আমি কি হবো আরফান মজুমদার তো হওয়া যাবে না অন্যকিছু হবো তবে ইমতিয়াজ সিকদার নয়। এক যুক্তিযুক্ত সুন্দর নাম খুঁজছিলাম তখন। ঠোঁটে ছিল বাঁশির সুর। ঠিক সেই মুহুর্তেই হঠাৎ কে যেন শক্তপক্ত কণ্ঠে এসে বললো,“কে! কে ওখানে?”

এটা তার প্রথম কথা ছিল। যার উত্তর আমি দেই নি দ্বিতীয় কথা ছিল,“এই ভর সন্ধ্যাবেলা বাঁশি বাজাচ্ছেন কেন?”

এবার উত্তর দেই। তার তিন নাম্বার প্রশ্নের বেলায় যখন আমি তার দিকে উঠে তাকায়। তুমি বিশ্বাস করবে না বউ,“তোমারে দেখিলাম না যেন আমার সর্বনাশ হইয়া গেল!”

কি অপরূপ সেই রমণী। ডাগর ডাগর গাড়ো কাজলে ঘেরা আঁখিযুগল। চোখে ভয়ানক তেজ। তার চোখ দেখেই মনে হয়েছিল আমি শেষ, আমি নিঃস্ব। তাকে দেখেই শুরুতেই ভুল করে বসি। তার কে আপনি? প্রশ্নের জবাবে বলে ফেলি নিজের আসল নাম, ‘আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার’। অথচ কথা ছিল আমি তার কাছে ইমতিয়াজ সিকদার হবো না। হবো অন্যকিছু! যেখানে শুরুটাতেই ভুল ছিল সেখানে শেষটা কি করে পরিপূর্ণ হতো বলো। তোমায় দেখেই আমি বুঝেছিলাম তুমিই রাগান্বিতা কারণ তোমায় আমি আগে না দেখলেও তোমার সম্পর্কে অনেকটাই জেনেছিলাম। কল্পনায় কিছু সাজিয়েও ছিলাম কিন্তু তুমি ছিলে আমার কল্পনারও অধিনে।’

কুহেলিকাও যথেষ্ট অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী ছিল কিন্তু রাগান্বিতার মাঝে যে ভয়ানক এক চাহনী ছিল তা এক নিমিষেই আমার হৃদয়হরণ করে নেবার মতো দৃষ্টি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়,“তোমার মতো রূপবতী মেয়েদের বুঝি আমার মতো নিষ্ঠুর মানুষদের ধ্বংস করার জন্যই জন্ম হয়।” না হলে আমি তো গিয়েছিলাম খুন করতে, নিজে খুন হতে নয়।’

তবুও নিজেকে সামলেছি। তোমার মায়া থেকে বহুবার নিজেকে আঁটকে রাখতে চেয়েছি। বার বার নিজেকে বুঝিয়েছি এ শহরে প্রেম মানেই মৃত্যু। তবুও আমি ব্যর্থ। প্রকৃতিও বুঝি আমার ধ্বংসই চেয়েছিল। সে রাতেই আমি খুন করে বসি মুরতাসিন নামক এক ছেলেকে। যার সাথে আমার কোনোকালেও কোনো যোগাযোগ ছিল না। তারই রক্ত দিয়ে আমি তোমায় চিরকুট পাঠায় “সে নিষিদ্ধ ছিল”! এই খুনটা করার কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করার পর ফেরার পথে আমার দেখা হয় মুরতাসিনের সাথে। হাঁটার দেখাদেখি শুধু। তখন মোকলেস বলে, “জানো ইমতিয়াজ ভাই এই পুলাডা রাগান্বিতা আফারে খালি বিরক্ত করে হেইদিন দেহি রাগান্বিতা আফা নাইতে গেছে হেও পিছন পিছন যায়।” ব্যস মোকলেসের এতটুকু কথা শুনেই আমার মস্তিষ্ক এলেমেলো হয়ে যায়। এমন রাগ হয় মনে হয় তুমি আমার সম্পত্তি, তোমার ওপর অধিকার শুধু আমার আর কারো নয়। সে রাতেই খুন করে বসি মুরতাসিনকে। ওকে মেরে ঝুলিয়ে রাখি ওই বড় গাছের সাথে। তখন তোমাদেরই গ্রামের একটা ছোট বাচ্চা ছেলে দেখে ফেলে অন্ধকার থাকে বিধায় আমার চেহারা দেখে নি। তবে ছেলেটির বাবা তা চেপে গিয়ে তার মেয়ের জুতো হারিয়ে গেছে এমন কিছু একটা বাহানা দেয়।’

তোমার ভাইয়ের মাথায় আঘাতটাও আমি করি। তাকে দেখলেই রাগ উঠতো। তাই মেরে বসি সেদিন। তুমি হয়তো খেয়াল করো নি তোমার ভাইয়ের সাথে আমার যতবার দেখা হয়েছে ততবারই আমার হাতের মুঠো শক্ত ছিল। মুখে হাসি থাকলেও ভিতরে ছিল বিক্ষোভ। তোমার বাবা মুরতাসিনের খবরাখবর বলতে আমায় ডাকলেন এই প্রথম সাক্ষাৎ তোমার বাড়ি আর তোমার বাবার সঙ্গে। অচেনা মানুষ। তবুও চেনা ছিলাম কুহেলিকার জন্য।

আমি তোমায় চিঠি পাঠাতাম। আমাদের নানাভাবে আলাপ হতো। কখনো নৌকা চড়ে, কখনো বাঁশির সুরে গাছের নিচে পাশাপাশি বসে। তোমার নামের চিঠির শেষে লেখা থাকতো নিষ্ঠুর এক প্রেমিক পুরুষ। আমি ভেবেছিলাম তুমিও কুহেলিকার মতো চিঠির প্রেমে পড়বে। কিন্তু তুমি তা পড়লে না। করলে কি সারাগ্রাম বাসির হাতের লেখা পরীক্ষা করে বসলে তোমার বাবাও জেনে বসলো চিঠির কথা। তিনি তোমার বিয়ে ঠিক করলেন। এ ছিল আমার পরিকল্পনার বাহিরে। এখন নিশ্চয়ই ভাবছো চিরকুট চিঠি যেহেতু আমিই লিখেছি তবে হাতের লেখা কেন মেলে নি। আমার একটা প্রতিভা ছিল তা হলো আমি মানুষের হাতের লেখা দেখে হুবহু লিখে ফেলতে পারতাম। কুহেলিকাকে যে হাতের লেখা পাঠাতাম ভুলবশত সেই হাতের লেখা দিয়ে ফেলি সেদিন। বুঝতে পারি নি তোমায় দেখলেই কেমন ঘোরে হারিয়ে যেতাম। সবই ঠিক ছিল। কারণ কুহেলিকাকে শেষ করার আগে আমি সবই নিজের কাছে আনি কিন্তু কোনোভাবে হয়তো একটা থেকে যায় আর ওই একটাই আমার ধ্বংসের সূচনা হয়। তবে সামলে নিয়েছিলাম। আরফান মজুমদার আমার বন্ধু বলে কাটিয়ে দিলাম। তুমিও বিশ্বাস করে নিলে। এটা তো পরের কথা ছিল।

তোমার বাবাও বোধহয় কুহেলিকা চিঠি পেত এটা জেনে যায় তুমিও পাচ্ছো উনি ঘাবড়ে গিয়ে বিয়ে ঠিক করেন। মাহাদ, মাহাদকে আমিই পাঠিয়েছিলাম তোমায় বিয়ে করাতে। কথা ছিল বিয়ের পর বাসর রাতেই তোমায় খুন করবে কিন্তু হলো না। কোনোভাবে তোমার ভাই বুঝে ফেলে মাহাদই বোধহয় মৃন্ময়ীর ভাই। কিন্তু এটা মিথ্যে ছিল। কিভাবে ধরলো জানা নেই। তোমার ভাই ইমতিয়াজকে চিনতো না। নামও জানতো না শুধু জানতো মৃন্ময়ীর একটা ভাই আছে। মাহাদকেই সেই ভাই ভেবে বসে। বিয়ের দিন রেজওয়ানই মাহাদকে গুম করে। তারপরের টা তো জানোই। আমি বাধ্য হয়েই তোমায় বিয়ে করে করতে চাই। তোমার বাবাও রাজি হয় পরিস্থিতিই এমন ছিল। তোমার ভাই জানলোই না যার হাতে বোনকে দিচ্ছে সেই আসল শক্র।’

মনে মনে তোমায় দেখে আকৃষ্ট হলেও ভিতরে একটাই ইচ্ছে ছিল তোমায় খুন করা। মাহাদকে দিয়ে হবে ভেবেছিলাম কিন্তু তার আগেই রেজওয়ান ওকে মেরে ফেলে। বিয়ের দিন তোমায় যেমন কাটামিশ্রিত গোলাপ দিয়েছিলাম, কুহেলিকাকেও দিয়েছিলাম। কুহেলিকা কাটার আঘাত সইতে পারে নি তুমি সয়ে নিয়ে ছিলে। আমি বুঝে ছিলাম তুমিও আমার মতো প্রথম দেখায় আমাতে মুগ্ধ হয়েছো। এ বিষয়ে আমার ধারণা নেই ঠিক কি দেখে তুমি আমাতে মুগ্ধ হয়েছিলে। তবে ইচ্ছে ছিল একদিন বিকেলে চা খেতে খেতে প্রশ্ন করবো, কিন্তু তা আর হলো না।

আমাদের বিয়ে হলো। তোমায় নিয়ে ঢাকায় এলাম। জাহাজে বসেও তোমায় মারার সুযোগ ছিল কিন্তু মারতে পারি নি। আমি প্রতি রাতেই ভাবতাম তোমায় খুন করবো কিন্তু পারি নি। তুমি আমাতে এতটাই মুগ্ধ ছিলে, আমার ওপর তোমার এত বিশ্বাস ছিল যা আমায় একবারও তোমায় মারতে দেয় নি। কুহেলিকাও আমায় বিশ্বাস করেছিল তবু্ও তাকে মেরেছি কিন্তু তোমায় কেন পারছি না। এসব ভেবে আমি কেমন একটা হয়ে যাচ্ছিলাম। বোনের কবরটা দেখলেই আমি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাই। তুমি সেদিন রাতে রবিন চাচার সঙ্গে যার কণ্ঠ শুনেছিলে সে আমিই ছিলাম। কবরটাও আমার বোন মিনুর ছিল। রবিন চাচার আম্মার নয়। তোমার কণ্ঠ পেতেই সেদিন আমি ছুট্টে আসি তুমি যতক্ষণ রবিন চাচার সঙ্গে কথা বলেছিলে সেই সুযোগ আমি বাড়ি আসি। তোমায় খুঁজতে ছিলাম এমন বাহানা দেই।

এরপর আমরা রেশবপুরে গেলাম তারপর জানলাম দাদিমা নাকি তোমার সেই শাপলারসাজ নিয়ে ভয় পেয়েছিলেন। আমি বুঝেছিলাম উনি বোধহয় কিছু জানেন। কুহেলিকাকে আমিই শাপলার অলংকার পাঠিয়েছিলাম। দেখা হয় নি তবে পাঠিয়ে ছিলাম। সেজেছিল নিশ্চুই আর দাদিমা দেখেন তা। আমার ভয় হলো তুমি কিছু জেনে যাবে। সে রাতেই আমি দাদিমার কক্ষে কিছু খুঁজবো ভেবেছিলাম। কিন্তু যাওয়ার পথে দেখা হয় রেজওয়ানের বন্ধু মনজুর সাথে। সে কি নিয়ে যেন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে আমি তার পিছু নেই তখনই দেখি জঙ্গলের মধ্যে সুরঙ্গের মতো বানিয়ে হাজারো বেআইনি অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে তোমার ভাই। আমি যখন ফিরবো তখনই মনজুর সাথে দেখা হয় আমার। ও ঘাবড়ে যায় আমায় দেখে। দুজনের মধ্যে দস্তাদস্তি হয়। তখনই ও ভাড়ি কিছু দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। আমিও তখন কি দিয়ে যেন ওকে মারি পাশেই নদী ছিল আমি বুঝতে পারি নি ও পরে যায়। আমিও নিচে লুটিয়ে পড়ি। মনজু সাঁতার জানলেও বোধহয় আমার ওকে আঘাত করার কারনে সাঁতরে তীরে আসতে পারে নি। ও মারা যায়। তোমার ভাই ওর নিখোঁজে বিপাকে পড়ে। কারণ ওর বেআইনি ব্যবসার বেশিরভাগ হিসাবনিকাশ কোন সুরঙ্গের কোন চাবি সবই মনজু জানতো। তাই ওকে তখন চিন্তিত দেখাতো। বন্ধুর হারানোর শোকে নয় তার ব্যবসা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে সেই শোকে। এসব আমি পুলিশকে বলে যাবো ওনারা বেআইনির সব অস্ত্র উদ্ধার করে নিবে। আমরা রেশবপুর থেকে ফিরে এলাম। দিনে দিনে তোমার ওপর আমার আসক্তি আরো বাড়ে। তুমিহীনা বাঁচা কঠিন। ভয় হতে শুরু করে যদি তুমি সবটা জেনে যাও। তোমার জানার অন্যতম মাধ্যম ছিল আমার সেই দোতালার তালাবদ্ধ ঘর। কারন সুরঙ্গে যা ছিল তার সবটাই আগে এই তালাবদ্ধ ঘরে থাকতো। তাই সেখানের সব সরিয়ে বাড়ির পিছনে সুরুঙ্গের মতো বানাই তাও তুমি দেখে ফেললে।

যেসব রাতগুলোতে তুমি দেখেছিলে আমি তোমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি সেই সব রাতেগুলোতেই আমার হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। আমি প্রতিবার ভেবেছি তোমায় খুন করবো। গলার কাছে কতবার ছুরি ধরেছি কিন্তু পারি নি। তোমার ঘুমন্ত মুখখানা দেখলেই আমি কেমন হয়ে যেতাম। খালি খালি লাগতো নিজেকে। এরপর তোমার থেকে দূরত্ব রাখা শুরু করি। তুমি আমার অবহেলা নিতে পারতে না। কাঁদতে। তোমার কান্নাও আমার সহ্য হতো না। আমি কি করবো ভেবে পাই না। চারপাশ খালি কেমন লাগতো! জানো যে রাতে আমি তোমায় জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম একটু শান্তি শান্তি লাগছিল। কিন্তু পরে আবার সেই অশান্তি। আমি বুঝেছিলাম তোমায় খুন করা আমার কাম্য নয়। তোমায় খুন করার চেয়ে আমার নিজেকে খুন করাটা সহজ লেগেছিল। এরপরই সিদ্ধান্ত নেই প্রেমনগর যাবো। কিছুদিন সব ভুলে ভালো থাকবো। আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠদিন ছিল প্রেমনগরের ওই সাতটা দিন। তোমায় খুব ভালোবাসি বউ। যতটা ভালোবাসলে নিজেকে খুন করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তার থেকেও বেশি ভালোবাসি। তুমি আমার জন্য কি ছিলে তা যদি তোমায় বোঝাতে পারতাম।’

প্রেমনগর থেকে ফিরে এসে তুমি জানো দাদিমা অসুস্থ, ওনার অসুস্থতার কারণও আমি ছিলাম। সেদিন ঘাটপাড়ে আমার কথাতেই মোকলেস একটা মাকড়সা রাখে, দাদিমা তা দেখে ভয়ে পানিতে পড়ে যান। ভেবেছিলাম পানিতে পড়ে মারা যাবেন কিন্তু না কোন এক মহিলার জন্য বেঁচে যান হয়ে যান অসুস্থ। ভয়টা এতটাই পেয়েছিলেন যে পড়ে মারা যান। দাদিমার মৃত্যুতে তুমি আমায় ধরে যখন কাঁদলে আমি তখন অনুভব করি আমি ভুল করেছি প্রতিহিংসার চাপে পড়ে দুটো মানুষকে খুন করে আমি ভুল করেছিলাম। কুহেলিকাকে মারা আমার ঠিক হয় নি। কিন্তু যতদিনে বুঝেছি ততদিনে সব শেষ।

“আমি একটা মানুষের সাথে বাঁচার জন্য তিনটা মানুষকে খুন করলাম তবুও বাঁচতে পারলাম না। এ আফসোস আমার আজীবন রয়ে যাবে বউ।”

দাদিমাকে মেরেছিলাম ভয়ে তুমি জেনে যাবে এই ভয়ে। ওনায় মারার পর সিদ্ধান্ত নেই আমি রেজওয়ানকে মেরে ফেলবো ওর আবার বিয়েও ঠিক হয় আমি চাই নি ওই মেয়েটা একটা নিকৃষ্ট জীবন পাক। ভেবেছিলাম ওকে মেরে তোমায় নিয়ে ভালো থাকবো। শান্তি মতো বাঁচবো। বোনের স্বপ্নে রাতে ঘুম হতো না আমার কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি তার হিসাব নেই। রেজওয়ানকে মারবো এটা ভেবেই যেন প্রশান্তি পেয়েছিলাম। একটা মানুষকে খুন করার কি যে শান্তি অনুভব হয় সেদিন রাতে জানো না। সে রাতেই তোমায় নিজ হাতে খাইয়ে দেই। সেই রাতেই আমি তোমার জন্য টেলিফোন কিনি। উপহার হিসেবে দেয়ার ইচ্ছে ছিল। শুনেছিলাম মেয়েদের টেলিফোনের কণ্ঠস্বর নাকি মধুর শোনায়। তোমার কণ্ঠ এমনিতেই মধুর ছিল তাও টেলিফোনে কেমন কণ্ঠ হয় জানার খুব ইচ্ছে ছিল। হলো না আফসোস থেকে গেল।’

কে জানতো এভাবে সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে। রেজওয়ানকে মারার সময় ছিল মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত। তোমায় বাবা বেরিয়ে যান নামাজের জন্য সেই সুযোগ আমি বাড়ি ঢুকি রেজওয়ান বের হবে তার আগেই তার বুকে ছুরি চালাই। হতভম্ব সে। তখনই বলে ফেলি আমি মৃন্ময়ীর ভাই। মনে পড়ে কিছু। ও হতভম্ব হয়ে যায় আরো। বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু শুনি নি। নৃশংসভাবে ওকে খুন করি। আমি বুঝে নি তোমার বাবা এসে পড়বেন। খুব জোর চশমা ফেলে গেছিলেন তিনি। ওনাকে দেখে আমার মাথা এলেমেলো হয়ে যায়, তোমায় হারানোর ভয় জাগে আরো। শেষে গিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে ওনার গলায় পোঁচ দিয়ে বসি। তখনই তুমি হাজির এক নিমিষে সব শেষ। তোমার হাতে কুহেলিকার চিঠি। আমি বুঝেছি তুমি সব জেনে গেছো।

যাকে হারানোর ভয়ে আমি তিনটা খুন করলাম সেই হারিয়েই ফেললাম। তোমার চোখে সেই ঘৃণা আমায় এক নিমিষে ধ্বংস করে দিলো। আমি যখন ছুরি ফেলে বেরিয়ে আসি। চারপাশে একটা কথাই বাজছিল “আমাদের আর মিলন নেই।”

এমনটা কেন হলো বউ! আমি তো এমনটা চাই নি। এত ছোট কেন ছিল আমাদের গন্তব্য আর একটু বড় হতে পারতো না। তুমি এগুলো কোনোদিন জানতে না, এটা হতো না। আজ নয় কাল ঠিকই জানতে তবে এত দ্রুত জেনে যাবে এমনটা চাই নি। কেন জানলে বউ, কেন জানলে। আমি তোমায় নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনটায় আফসোস ছিলো খালি, আমি জীবনে কিছু হতে পারি নি। না পারলাম ভালো ছেলে হতে, না পারলাম ভালো ভাই হতে আর না পারলাম ভালো স্বামী। আমি মন থেকে চাইবো আমাদের আবার দেখা হোক। সেই দেখাতেও তুমি আমার হও। আমি তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী হয়ে দেখাবো তোমায়।

রাগান্বিতার চোখ ভেসে আসলো টপ টপ করে পানি পড়ছে চোখ বেয়ে। কাগজের অংশও ফুলে আছে ইমতিয়াজও বুঝি কেঁদে ছিল এখানে। রাগান্বিতা পড়তে লাগলো,

আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল না তাও হলো। বিয়ে হলো, ভালোবাসাও হলো, বিচ্ছেদ কেন হলো বউ। আর একটু সময় কি আমরা একসাথে থাকতে পারতাম না। তুমি তো সব জেনেছো এখন মানতে পারতে কি আমায়। পারতে না যতই হোক আমি তিনটি নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলেছি তোমার আপা,তোমার দাদিমা আর তোমার বাবা। এরা নির্দোষ ছিল। আমার কষ্ট হচ্ছে বউ। আমি জানি তুমি আমায় খুুন করতে আসবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তুমি আমায় মারতে না পারলেও আমি নিজেকে মেরে ফেলবো। প্রতিহিংসা নিয়ে বাঁচা যায় না বউ। আমি পারি নি তুমিও পারতে না। আমি জানি তুমি আমায় আঘাত করতে পারবে না। তাই আমি নিজেই নিজেকে আঘাত করবো ভেবেছি। বাবার সেই রাজকীয় তলোয়ারই হবে আমার শেষ মৃত্যুর অস্ত্র। আমরা আর একবার মুখোমুখি হবো তারপরই সব শেষ। আমি চরিত্রহীন ছিলাম না বউ। আমি তুমি ব্যতীত কাউকে ছুঁই নি। কুহেলিকার সন্তানের বাবা আমি ছিলাম না তবুও তার চোখে আমিই কলঙ্কিত।’

আমি তোমায় ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি,কেন বাসলাম এত ভালো। তুমি কি আমায় ভুলে যাবে অবশ্যই ভুলবে না। আমি ভুলতে দিবো না। আমার মৃত্যু হলেও তোমার আমার থেকে মুক্তি নেই।

তোমার তো বৃষ্টি পছন্দ
আমি না হয় মেঘ হবো;
তোমার তো সমুদ্র পছন্দ
আমি না হয় ঢেউ হবো;

তবুও তোমায় ভুলতে দিবো না
আমি যে শুধু তোমারই রবো।’

আমি পাপী ছিলাম সত্য। তবে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না। আমায় কোনোদিন ভুলে যাইও না। আমি ফিরবো বউ, আজ হোক কাল আমাদের দেখা হবে। হয়তো এভাবে নয় অন্যকোনো রূপে তবুও আমাদের দেখা হবে দেখে নিও। দেখা হবেই। আমার হৃদয়খানা যন্ত্রনায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক,তবুও তুই রাগান্বিতা আমার হয়ে থাক। রক্তমাংস মাটিতে গিলে খাক। তবুও সারা শরীর জুড়ে শুধু তোমারই গন্ধ থাক।’

ইতি,
ইমতিয়াজ সিকদার।

শেষটা পড়েই রাগান্বিতা জ্ঞান হারায় সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় নিচে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন তার মানসিক ভারসাম্য নেই। সে সব ভুলে যায়। মনে থাকে শুধু দুটো জিনিস। যার একটির নাম ছিল ইমতিয়াজ সিকদার আর দ্বিতীয়টি তার বলা একটি কথা, “আমি ফিরবো বউ, আমি ফিরবো। দেখে নিও আমাদের আবার দেখা হবে।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে