প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৬+৪৭

0
351

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৬
________________
সেই ঘটনার পর মাঝখানে কেটে গেল তিনটে দিন। রেশবপুরে পুলিশ এসেছিল এই ভরসন্ধ্যা বেলা গ্রামের জমিদার মশাই আর তার পোলার মৃত্যুতে সবাই শোকাহত। কি থেকে কি হয়ে গেল কেউ বুঝচ্ছে না। রাগান্বিতা তাদের সদর দুয়ারের সামনে বসা। চোখ মুখ স্বাভাবিক যেন কিছু হয় নি। রাগান্বিতা গত তিনটে দিনের একটা দিনও কাঁদে নি। সে তার বাবার কথা রেখেছে রাগান্বিতা কাঁদে নি। একদম শক্ত ছিল। গ্রামের মানুষরা তো অবাক। বাপ, ভাই মইরা গেল অথচ রাগান্বিতা কেমনে এত স্বাভাবিক থাহে। বাড়িতে পুলিশ এসে রাগান্বিতাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে এ বিষয় কিছু জানে কি না। উত্তরে রাগান্বিতা বলে, না সে কিছু দেখে নি সে আসার আগেই কেউ তার বাপ আর ভাইকে মেরে ফেলে গেছে। অবাক করার একটা বিষয় হলো রাগান্বিতা ইমতিয়াজের ফেলে যাওয়া সেই ছুরিটাও লুকিয়ে ফেলে। এরপর কেটে গেল তিনটে দিন।

স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রাগান্বিতা। ক্রোধ আর প্রতিহিংসায় চোখ দুটো জর্জরিত। রাগান্বিতা ভেবে ফেলেছে সে খুন করবে। যে ছুরি দিয়ে ইমতিয়াজ তার বাবা আর ভাইকে মেরেছে সেই ছুরি দিয়েই সে খুন করবে ইমতিয়াজকে। রামু পাশে দাঁড়িয়ে রাগান্বিতার। চোখ বেয়ে পড়ছে তার নোনা পানি। এগুলা কি ঘটে গেল তাদের সাথে ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে রামুর। রামু রাগান্বিতার পাশে বসলো। চোখ মুছতে মুছতে বললো,“এগুলান কি ঘইট্টা গেল আফা? এহন কি হইবো আমগো?”

রাগান্বিতা তাকালো রামুর মুখের দিকে। বললো,“কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রামু তাও থামলো না তার কান্না পাচ্ছে খুব। এত কষ্ট বোধহয় জীবনেও পায় নি রামু। মোতালেব তালুকদার যথেষ্ট ভালো মানুষ ছিলেন তাকে কত ভালোবাসতো। তার পরিবারকেও ভালোবাসতো। অথচ সেই মানুষটাকেই কেউ কিনা নিঃসংশয়ভাবে খুন করলো। কে করলো কেমন ঘৃণ্য কাজ। রামু রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“ইমতিয়াজ ভাই তো আইলো না আফা। উনি কি জানে নাই এহানের ঘটনা?”

রাগান্বিতা শান্ত স্বরে বললো,
“হয়তো জানে নি জানলে নিশ্চয়ই আসতো।”
“তুমি একটা চিডি লেখতা আফা।”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না কেমন এক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। হেঁসে হেঁসে বলে, “আবার চিঠি। তুমি কি জানো রামু এই চিঠি কতটা ভয়ংকর একটা জিনিস।”

রামু চরমভাবে অবাক হলো রাগান্বিতার কথা শুনে। বললো,“চিডিতে আবার কি ভয়ংকর আফা?”

রাগান্বিতা আবারও হাসে। বলে,“আছে ভয়ংকর কিছু তুমি বুঝবা না। আচ্ছা শোনো কাল সকালে আমি চলে যাবো। তুমি কি এই বাড়িতে থাকবা?”

রামু ভয়ে ভয়ে বলে,“আমার খুব ভয় লাগতেছে আফা।,”

রাগান্বিতা বলে,
“তাইলে থাকার দরকার নেই তুমিও কাল বাড়ি চলে যেও।”
“আর এই বাড়ির কি হইবো?”
“কিছু হবে না। আমি থাকবো এখানে।”
“তুমি থাকবা কেমনে?”
“পরে বলবো।”
রামুও আর প্রশ্ন করে নি।

পরের দিন। ফজরের ধ্বনি শুনতেই সদর দুয়ারের মেঝেতে শুয়ে থাকা রাগান্বিতা উঠে বসলো। গত তিনদিন রাত্তির যাবৎ সে মেঝেতেই ঘুমিয়েছে। রামু কতবার ঘরের ভিতর গিয়ে ঘুমাতে বললো কিন্তু রাগান্বিতা শুনলো না। রাগান্বিতা দ্রুত কলপাড়ে গেলো চোখে মুখে পানি দিলো। গায়ের সব অলংকার বাড়ির এখানে ওখানে পড়ে আছে। তবে রামু সব গুছিয়ে রেখেছে। রাগান্বিতা ফজরের নামাজ পড়লো। পুরো বাড়ি জুড়ে বিষণ্ণতা চারপাশে কেউ নেই একমাত্র রাগান্বিতা ছাড়া। কুহু আপা নেই, দাদিমা নেই, বাবা নেই, ভাই নেই আছে শুধু রাগান্বিতা। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাগান্বিতার মনে হচ্ছে ইমতিয়াজ তাকে কেন মারলো না? মারতে তো তাকেই এসেছিল তবে তাকেই কেন বাঁচিয়ে রাখলো। রাগান্বিতা তার কক্ষের আলমারি খুললো। শুনেছে অপরাধীদের নাকি সাদা পোশাক পড়িয়ে শাস্তি দেয়া হয়। রাগান্বিতাও আজ অপরাধ করবে। স্বামী হত্যা করার মতো এক যগন্যতম অপরাধ। নিশ্চয়ই এই অপরাধ করার পর তাকেও সাদা পোশাক পড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে। রাগান্বিতা আলমারি সাঁতরে তার মায়ের একটা শাড়ি বের করলো। লোকে বলে মায়ের শাড়িতে নাকি মেয়েদের খুব সুন্দর দেখায়। রাগান্বিতারও উচিত নিজেকে সুন্দর দেখানো। পুরো রানীর মতো সেজেগুজে সে স্বামী হত্যা করতে যাবে। কত সুন্দর না বিষয়টা। হেসে ফেলে রাগান্বিতা। সাদা শাড়ির মত বদলালো। সে নজরকাড়া সৌন্দর্যে ঘেরা একটা জামদানী শাড়ি বের করলো। গায়েও জড়িয়ে নিল। গা, হাত, পা ভর্তি সোনার অলংকার জড়ালো, চোখে দিল গাড়ো কাজল। চুলগুলো খোঁপা করে ফুল লাগালো। যেকোনো পুরুষ রাগান্বিতার রূপ দেখে এক নিমিষেই ঘায়েল হয়ে যেতে পারে তেমন সাজলো রাগান্বিতা। রামু দেখলো রাগান্বিতার সেই ভয়ংকর সাজ। তার বুকটা ধক করে উঠলো রাগান্বিতা এগুলো কি করছে? বাপ ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি। সে ছুট্টে বেরিয়ে গেল তার ভয় হচ্ছে রাগান্বিতার এহেম কান্ড দেখে। রাগান্বিতা সেজেগুজে আবার আলমারি খুললো বের করলো ইমতিয়াজের রেখে যাওয়া সেই ছুরিটা। এখনো রক্তের রঙে লাল হয়ে আছে ছুরিটা। রাগান্বিতা গায়ে কালো চাদর জড়ালো। নিজেকে ঢেকে নিলো পুরোপুরি। ছুরিটাকে চাদরের আড়ালে রেখে চোখে ভয়ংকর রাগ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য স্বামী হত্যা। তার বাপ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নেয়া।

রামুর গ্রামের মানুষজন নিয়ে আসতে আসতে রাগান্বিতা বেরিয়ে যায়। রামু ভয়ংকর ভাবে ঘাবড়ে যায় হঠাৎ করে হলো কি তার রাগান্বিতা আপার!’
—–
তখন বাজে দুপুর তিনটে। রাগান্বিতা এলেমেলো পায়ে ঢাকার রেলস্টেশন থেকে বের হলো। বাড়ির গন্তব্য আর বেশিদূর নয়। রাগান্বিতা সামনে যত এগোচ্ছে একটু একটু করে বুঝি তার শক্তি কমছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলাচ্ছে। তার বাবার নিথর দেহ, ভাই আর আপার মুখখানা মনে করছে। নির্জন একটা রাস্তা আশেপাশে কেউ নেই। রাগান্বিতা একা একা হাঁটছে। এমন সময় কোথা থেকে যেন তাকে ঘিরে ধরলো কয়েকটা বখাটে ছেলে। তাকে উদ্দেশ্য করে সামনের দুটো ছেলে বললো,“সুন্দরী রমণী এই ভরদুপুরে যাচ্ছো কই?”

রাগান্বিতার ক্ষিপ্ত চাহনি। তার একঝলকের চাহনি দেখেই সামনের দুটো ছেলে ঘাবড়ে গেল। এমন ভয়ানক চাহনি বুঝি এ জীবনে কখনো দেখে নি। পিছনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো বললো,“আইবা নাকি আমাগো কাছে তোমার রূপের আগুনে নিজেদের জ্বালাতে চাই।”

ব্যস রাগান্বিতা ক্রোধে ভরা চোখ দুটো বুঝি আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মাথা থেকে চাদর সরালো। চাদরের আড়াল থেকে বের করলো ধারালো অস্ত্র। রাগান্বিতা ওই ছেলেটার দিকে এগিয়ে এগিয়ে যেতে বললো,“আজ তোর সব জ্বালা আমি একদিনে মিটাবো।”

আচমকা রাগান্বিতার এহেম ভয়ানক রূপে ঘাবড়ে গেল সব ক’টা ছেলে। একটা সাহস দেখাতে কাছে আসতেই ধারালো ছুরি দিয়ে হাতে আঘাত করে বসলো রাগান্বিতা। সঙ্গে সঙ্গে কলকলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো ছেলেটার হাত থেকে। আর কেউ সাহস করে এগোতে পারলো না রাগান্বিতার দিকে। সবকটা ভয় নিয়ে পালালো। কিছু সময় যেতেই রাগান্বিতা নিজেকে সামলালো। চাদর দিয়ে ঢেকে নিলো নিজের মুখ আর ছুরি। কতদূর এগিয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো মোটরগাড়ি। গাড়ি থামলো রাগান্বিতা ঠিকানা বলে উঠে বসলো। একটু একটু করে ছুটে যেতে লাগলো নিজের গন্তব্যের দিকে। হঠাৎই রাগান্বিতা খেয়াল করলো গাড়ির চালক বার বার পিছন ঘুরে তার দিকে কেমন দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে। রাগান্বিতা বিষয়টা বুঝতে পেরেই হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,“আর একবার যদি তোর ওই চোখ নিয়ে পিছনে তাকাস তবে ওই চোখ আমি উপড়ে ফেলবো। পরবর্তীতে এই সুন্দর পৃথিবী দেখার জন্য তোর চোখ থাকবে না।”

গাড়ি চালক ঘাবড়ে গেলেন। কি ঝাঁজ ছিল রাগান্বিতার সেই কথায়! চালক পরবর্তীতে আর রাগান্বিতার দিকে তাকানোর সাহস করে নি।”

রাগান্বিতা নিশ্চুপে বসে রইলো। ভাবলো, এই দুনিয়ার মানুষগুলো বড্ড নোংরা। এরা খালি নারীদের শরীরের প্রেমে পড়ে, মনের প্রেমে পড়তে জানে না।”
——
ঘন্টা দেড় যেতেই মোটর গাড়ি এসে থামলো ইমতিয়াজের বাড়ির সেই গেটের সামনে রাগান্বিতা নামলো। শাড়ির আঁচল থেকে পয়সা বের করে দিলো গাড়ির চালকের দিকে। চালক টাকা নেয়ার পাশাপাশি রাগান্বিতার হাতটা বাজে ভাবে স্পর্শ করলো। রাগান্বিতা ক্ষিপ্ত হয়ে বাম হাতে থাকা ছুরিটা বের করে চালকের হাতে আঘাত করে বসলো। চালক চমকে উঠলেন। রক্ত পড়া চেপে ধরলেন দ্রুত। রাগান্বিতা ভয়ংকর এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

পরবর্তীতে কোনো নারীর দিকে কুনজরে তাকানো আর বাজে স্পর্শ করার আগে এই ক্ষতের কথা মনে করবি, মনে করবি কোনো এক নারী তোর দৃষ্টি আর চরিত্র সংযত করার একটা সুযোগ দিয়েছে। চালক ঘাবড়ে গেলেন কিছু বলবে তাও পারলো না। এক ষোড়শী নারীর মাঝে এত তেজ সে এর আগে দেখেনি। চালক পয়সা নিয়ে চলে গেল। রাগান্বিতা ভিতরে ঢুকলো, চারপাশ পুরো থমথমে। তিনদিনেই বুঝি চারপাশ মরে গেছে এমন লাগছে। রাগান্বিতা একটু একটু করে হেঁটে যাচ্ছে ভিতরে। হাতে তার শক্ত করে চেপে ধরা ভয়ংকর অস্ত্র। চোখে মুখে প্রতিহিংসার ছাপ।”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৭
________________
থমথমে পরিবেশ। চারপাশ কেমন গম্ভীর। মনে হয় ভুতুড়ে কিছু। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ। এমন লাগছে বাড়িতে কেউ নেই। রাগান্বিতা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে ভিতরে। পশ্চিমা আকাশ বেয়ে তখন কতগুলো কালো কাক ছুটে যাচ্ছিল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশটাও কেমন থমথমে দেখাচ্ছে। রাগান্বিতার নিশ্বাস আঁটকে আসছে। সে যতটা সাহস নিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত আসছিল। ঠিক ততটাই দূর্বল হয়ে হাঁটছে। সামনে যত এগোচ্ছে তত যেন তার আর ইমতিয়াজের কাটানো সুন্দর সুন্দর মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে। তার মনে হচ্ছে সে যা দেখেছে, যা পড়েছে সব মিথ্যে একটাও বাস্তব নয়। বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। কি নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে। রাগান্বিতা দূর্বল হলো তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু রাগান্বিতা দমলো না। নিজেকে প্রস্তুত করলো যা ভেবে এসেছে তাই করবে। রাগান্বিতার পুনরায় চোখে মুখে ক্রোধ ফুটে উঠলো। সদর দুয়ারের কাছে এসে জোরে নিশ্বাস ফেললো। রাগান্বিতা সদর দুয়ার ধাক্কা মারবে তার আগেই বাহির থেকে এক ভাড়ি বাতাস এসে দুয়ার খুলে দিল। রাগান্বিতা অবাক হলো বাড়ির দরজা খোলা কেন! ভিতরে কি কেউ নেই! রাগান্বিতা তার বাম পা’টা আগে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। পুরো বাড়ির নিচটা ফাঁকা। কেমন ছমছমে পরিবেশ। রাগান্বিতা উপরে উঠে গেল তাদের কক্ষ দেখলো না ইমতিয়াজ বা রবিন চাচা কেউই নেই। তবে কি ইমতিয়াজ পালিয়েছে। হঠাৎই প্রথম দিনের সেই তালাবদ্ধ কক্ষ থেকে কিসের যেন শব্দ আসলো।রাগান্বিতা কোতুহলী সেই কক্ষের দুয়ারের কাছে গেল। এবারও একই ঘটনা ঘটলো রাগান্বিতা দুয়ারের বারি দেয়ার আগেই সেটা খুলে গেল। রাগান্বিতা হাতে অস্ত্র নিয়ে কক্ষে পা রাখলো গায়ের চাদর নিচেই ফেলে এসেছে। রাগান্বিতা কক্ষের দুয়ার খুলতেই দেখলো। কক্ষের একদম সোজাসুজি তারই চোখের সামনে টেবিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ইমতিয়াজ। এলেমেলো মুখ,অগোছালো চোখ, কেমন ক্লান্তকর শরীর। ইমতিয়াজকে দেখেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো রাগান্বিতার। তার আবারও মন চাচ্ছে, তার সাথে ঘটে যাওয়া গত তিনটে দিনের ঘটনা সব মিথ্যে হোক, নয়তো স্বপ্ন হোক, এমন বিচ্ছিরি স্বপ্ন রাগান্বিতা কখনোই দেখতে চাইবে না। রাগান্বিতা মায়া মায়া নিয়ে ভিতরে পা রাখবে এরই মাঝে তার সামনে ভেসে আসলো তার আপার মুখ, সে মা হতে চলেছিল ইমতিয়াজ সেই সন্তানের বাবা, বিচ্ছিরি বিষয়। ভিতর কাঁপলো রাগান্বিতার না এটা অন্তত মিথ্যে হোক। আরফান অন্যকেউ হোক। তাকে হীনা ইমতিয়াজ অন্যকাউকে ছুঁয়েছে ভাবলেই এই ছুরি দিয়েই নিজের কলিজা কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা আবার নিশ্বাস ফেললো। অস্ত্র হাতে পা রাখলো ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসলো বাবার সেই নিথর দেহ, ভাইয়ের সেই ভয়ানকভাবে আঘাত প্রাপ্ত শরীরটা। রাগান্বিতা এবার সংযত হলো। শক্ত করে ছুরিটা চেপে ধরলো। রাগে মাথার রগ ফুলে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে হলো ইমতিয়াজকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সোজা তার বুকে আঘাত করা। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ তখনও একইভাবে বসা, সে এখনো তাকায় নি রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা এতে খানিকটা অবাক হলো ইমতিয়াজ কি টের পায় নি সে এসেছে। রাগান্বিতা যখন ইমতিয়াজের থেকে এক হাত দূরে তখন ইমতিয়াজ তাকালো রাগান্বিতার দিকে। ইমতিয়াজের দৃষ্টি দেখতেই থমকে গেল রাগান্বিতা। কেমন মায়াভরা ওই মুখে। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“আমি জানতাম তুমি আজ আসবে, আমায় খুন করার জন্য হলেও তুমি আসবে।”

রাগান্বিতা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ দ্বিধাহীন বলে,“কোথায় আঘাত করবে বলো তো গলায় নাকি বুকে। আমি চাইবো তুমি ঠিক আমার এই বাম পাশের বুকের মধ্যখানে আঘাত করো।”

রাগান্বিতার হাত কেঁপে উঠলো ইমতিয়াজের কথা শুনে। কিন্তু নিজেকে সামলালো। চোখেমুখে পাষাণের ছাপ এনে ধারালো ছুরিটা ইমতিয়াজের গলা বরাবর রেখে বললো,“কথার তালে ভুলাতে চাচ্ছেন?”

ইমতিয়াজ হাসে। কি নিদারুণ দেখায় সেই হাসি। বলে,“তোমার রূপ বলছে আজ আমার ধ্বংস নিশ্চিত।”

রাগান্বিতা বিষম খায়। কিছু বলতে পারে না।
ইমতিয়াজের পাশে ছিল রাজকীয় একটা তলোয়ার। এটা কারো বুকে একবার ঢুকিয়ে দিলেই সে শেষ। ইমতিয়াজ তার পাশে থাকা সেই বিশাল তলোয়ারটা রাগান্বিতার দিকে দিয়ে বলে,“ছুরি নয় তুমি এইটা দিয়ে আঘাত করো আমি কিছু মনে করবো না।”

রাগান্বিতার রুহুটা বুঝি কেঁপে উঠলো এতে। সে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ আবার বললো,“কি হলো ধরো? তোমার ভাইকে যে অস্ত্র দিয়ে মেরেছি সেই অস্ত্র আমার গায়ে ছোঁয়াবে না। এইটা ধরো।”

বলে রাগান্বিতার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে তার তলোয়ারটা দিলো। রাগান্বিতা নিলো। এবার ইমতিয়াজ আবার বললো,
“এবার মারো।”
“আপনার কি ভয় হচ্ছে না?”
“ভয় কিসের! এমনটা যে হতো এটা বোধহয় আমি জানতাম। তবে এত দ্রুত চাই নি। এবার মারো তো কথা বেশি হয়ে গেলে মায়া বেড়ে যাবে।”

রাগান্বিতা মৃদু হাসে। তলোয়ারটা ইমতিয়াজের ডানদিকের বুকে তাক করে বললো,“আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আপনায় খুন করতে পারবো না?”

ইমতিয়াজ আবার হাসে। নিজের হাত দিয়ে তলোয়ারের মুখটা ডানদিকের বুক থেকে বামদিকে দিয়ে বলে,“তোমার কি মনে আছে বউ তোমায় সেদিন প্রেমনগর যাওয়ার পথে আমি বলেছিলাম। তুমি কি মানবে একদিন তুমি আমায় খুন করতে চাইবে?”

রাগান্বিতার শরীর কাঁপছে। ইমতিয়াজ আরো বলে, তোমার মনে আছে তুমি সেদিন চোখে মুখে বিস্ময়ের ছায়া নিয়ে কি বলেছিলে।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। ইমতিয়াজ বলে,আমি বলছি তুমি বলেছিলে,“আমি আপনায় কেন খুন করতে চাইবো। আপনায় খুন করার আগে যেন আমি ঝলসে যাই।”

সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিতার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল। ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো তার পানে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লো ইমতিয়াজের সামনে। চোখে পানি চলে এসেছে তার। রাগান্বিতা ছল ছল দৃষ্টি নিয়ে বললো,“এমনটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজের বিস্মিত চেহারা। থমথমে মুখ। কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা। সে বললো,
“আমি বাধ্য ছিলাম।”
“কিসের বাধ্যতা?”
“তোমায় বলতে বাধ্য নই আমি।”
“শেষটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না।”
“তুমি আমার অগোচরে আমার তৈরি পাতালকক্ষে গিয়ে ভুল করেছো।”
“আমায় একটু ভালো কেন বাসলেন না ইমতিয়াজ?”
“তোমায় ভালো না বাসলে আজ কুহুর পাশের লাশটা তোমার থাকতো।”

তড়িৎ বুকটা কেঁপে উঠলো রাগান্বিতার। কত সহজে কথাটা বলে দিলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ মাথা নুইয়ে নীরব স্বরে শুধালো, “আমার হৃদয় চিঁড়ে বললে যদি তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমায় ভালোবাসি তবে আমি তাই করতে রাজি।”

রাগান্বিতা স্তব্ধ বনে গেল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলালো চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,“আমি সব ভুলে যাবো ইমতিয়াজ আপনি হীনা আমি নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না। বিশ্বাস করুন আমি সব ভুলে যাবো। আপনি আমার বাবা ভাইকে কেন মেরেছেন আমি কোনোদিন প্রশ্ন করবো না। কোনোদিন জানতেও চাইবো না এর কারণ। আমি আপনায় নিয়ে বাঁচতে চাই। আপনি শুধু এতটুকু বলুন আমার আপা আপনার জন্য কলঙ্কিত হয় নি আরফান মজুমদার আপনি নন। আপার পাঠানো চিঠিটাও আপনার জন্য নয়। এতটুকু বলুন এগুলো মিথ্যে। আমি কথা দিচ্ছি আমি সব ভুলে যাবো গত তিনটে দিন যা যা হয়েছে আমি সব ভুলে যাবো। আমি ভুলে যাবো আমার রেশবপুরে কেউ ছিল। শুধু আপার বিষয়টা মিথ্যে হোক। আমার আপা ফুলের মতো পবিত্র ছিল। আপনি একবার মুখ ফুটে বলুন, বউ এটা মিথ্যে কুহু আমার জন্য মরে নি। কলঙ্কিতও আমার জন্য হয় নি।”

ইমতিয়াজ নিরুত্তর। রাগান্বিতার চোখে মুখে শেষ আশা ইমতিয়াজকে পাওয়ার। কিন্তু সেই আশাও আর রইলো না। ইমতিয়াজ মাথা নিচু করে বললো,
“মিথ্যে বললে যদি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যেত তবে আজ আমি মিথ্যে বলে তোমায় নিয়ে আরেকবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম।”

রাগান্বিতার পুরো শরীর জুড়ে এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। কি সাংঘাতিক শোনালো ইমতিয়াজের কথাটা। আচ্ছা সত্য এত তীক্ষ্ণ কেন! রাগান্বিতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড অসয়হায় লাগছে। কি কষ্ট হচ্ছে যদি কাউকে বোঝানো যেত। ইমতিয়াজ বললো,
“আরেকটা সত্যি শুনবে বউ? সবই তো জেনেছো এটাও জানা উচিত। এটা শুনলে বোধহয় তুমি আমায় মারতে আর দেরি করবে না।”

রাগান্বিতা তাকালো। আরো সত্যি আর কি সত্যি থাকতে পারে। ইমতিয়াজ বললো,
“তোমার দাদিমাকেও আমিই মেরেছি।”

রাগান্বিতার পায়ের নিচে মাটি বুঝে সরে গেল। এ কি বলে ফেললো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“দাদিমাকেও আপনি মেরেছেন?”
“হা উনি তো মাকড়সা ভয় পেতেন। সেই মাকড়সার ভয় দেখিয়েই ওনাকে মেরেছি। উনি অনেকটা জানতেন ভয় ছিল তুমি জেনে যাবে।”

রাগান্বিতার ঘৃণা আসলো। তড়িৎ গতিতে ইমতিয়াজের শার্টের কলাট চেপে ধরে বললো,
“আপনি এতটা নিষ্ঠুর কি করে হলেন?”
“আমি শুরু থেকেই নিষ্ঠুর ছিলাম।”
“আমার নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে এই আপনায় আমি ভালোবাসতাম।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না। চুপ করে রয়। সময় যায়। রাগান্বিতা ভিতরে ভিতরে ঢুকরে মরছে। একদিকে প্রতিহিংসা অন্যদিকে ভালোবাসা। রাগান্বিতা আবার ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। কলাট ছেড়ে দেয় কেমন শূন্যতায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। এটা তো সত্যি, এত সত্যের মাঝেও একটা কঠিন সত্য হলো ইমতিয়াজের প্রতি রাগান্বিতার ভালোবাসা। ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। ভালোবাসার মানুষকে কি আঘাত করা যায়! রাগান্বিতা তাকায় ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বলে,
“এমনটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”
“বলে দিলে কি আমি আবার তোমায় আগের মতো পাবো। তুমি পারবে আবার আগের মতো আমায় ভালোবাসতে। যখনই তুমি আমার কাছাকাছি আসবে তখনই তোমার বাবা আর ভাইয়ের মুখটার কথা মনে পড়বে। তুমি পারবে না আমার কাছাকাছি হতে। তোমার আপা, তার মৃত্যু। না। আমাদের আর মিলন নেই।”

কথাটা বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট কথা ছিল। কি বিচ্ছিরি শোনালো “আমাদের আর মিলন নেই।”

রাগান্বিতা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে অসহায় স্বরে বললো,“আমার কি করা উচিত বলুন আমাকেও মেরে ফেলুন ইমতিয়াজ? এই বিচ্ছিরি পৃথিবী আমার জন্য নয়। আমাকেও খুন করুন।”

সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল আরেক বিস্মিত ঘটনা। রাগান্বিতার পাশে থাকা তলোয়ারটা উঠিয়েই নিজের বুকের ভিতর তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের আকস্মিক কান্ডে রাগান্বিতার রুহু কেঁপে উঠলো। এ কি করে বসলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের মুখ দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো। রাগান্বিতা দিশেহারা হয়ে পড়লো। এটা কি করলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা সব ভুলে ছুটে গেল ইমতিয়াজের কাছে। ইমতিয়াজের মাথাটা বুকে চেপে ধরলো। চারপাশ কেমন ঘুরছে। এত রক্ত সে কি করে বন্ধ করবে। রাগান্বিতা অগোছালো স্বরে বললো,“এটা কি করলেন আপনি? আমায় ছেড়ে চলে যাইয়েন না ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মিটমিট চোখে রাগান্বিতার দিকে তাকালো অস্পষ্টভাবে বললো,“আমার সব মিথ্যের মাঝে তোমায় ভালোবাসাটা সত্যি ছিল বউ। প্রতিহিংসা নিয়ে বাঁচা যায় না। গত সাতটা মাস এই যন্ত্রণা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। আমি চাইনা তুমিও সেই যন্ত্রণা সহ্য করো। আমার এ জীবনে বিশাল একটা আফসোস রয়ে গেল বউ, তুমি আমার হয়েও আমার হইলা না।”

ব্যস আর কিছু শোনা গেল না। ইমতিয়াজ নামক নিষ্ঠুর মানুষটা আর রইলো না। রাগান্বিতা থ মেরে বসে রইলো। আচমকা কি ঘটে গেল। তার চারপাশ ঘুরছে। ইমতিয়াজ আর নেই। তাকে বউ বউ বলে ডাকা মানুষটা আর নেই। পুরো কক্ষে রক্তে ভরপুর। রাগান্বিতার শরীর, শাড়ি সব ইমতিয়াজের শরীরের রক্তে টুইটুম্বর। রাগান্বিতা পাথর হয়ে গেল। তাদের শেষটা এমন কেন হলো! সে তো এমনটা চায় নি। কেন হলো এমনটা! রাগান্বিতা আচমকা চিৎকার দিয়ে উঠলো। বললো,“এমনটা করতে পারেন না আপনি, আমায় ছেড়ে যেতে পারেন না। ইমতিয়াজ আমি আপনায় ভীষণ রকম ভালোবাসি। কেন হলো এমনটা! কেন করলেন এমনটা!

রাগান্বিতা চিৎকার দিয়ে কাঁদলো। তার কাঁদার শব্দে বুঝি ইমতিয়াজের পুরো বাড়ি ভুমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো। চারপাশে যেন একটা কথাই তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল,কেন হলো এমনটা? কেন হলো শেষটা এত বিষাদময়? কেন কেন!

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে