প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-৪৪+৪৫

0
355

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৪
________________
“বউ শুনো, উঠো দ্রুত। খাবে চলো এভাবে না খেয়ে ঘুমাতে নেই। বউ শুনছো আমার কথা, উঠো দ্রুত।”

লাগাতার রাগান্বিতাকে কথাগুলো বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। কিন্তু রাগান্বিতা উঠছে না। কতক্ষণ আগেই কক্ষে ঢুকে রাগান্বিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে লাগলো ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ আবার ডাকলো। রাগান্বিতা নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে, চক্ষু দুটো ডলতে ডলতে বললো,“কি হলো এভাবে ডাকছেন যে?”

ইমতিয়াজ পালঙ্কে বসলো। নরম কণ্ঠে শুধালো,
“ওঠো দ্রুত খাবে চলো।”

রাগান্বিতা দোনামনা করলো যার অর্থ সে খাবে না তার খেতে ইচ্ছে করছে না। ইমতিয়াজ শুনলো না রাগান্বিতাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বললো,“আজ তোমার কোনো কথা শুনছি না। তুমি প্রায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ডাকতে চাই কিন্তু পারি না। কিন্তু আজ শুনবো না উঠো দ্রুত আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো চলো আমার সাথে।”

বলেই রাগান্বিতাকে কোলে তুলে নিলো ইমতিয়াজ। রাগান্বিতা চমকে উঠলো, ঘাবড়ে গিয়ে ইমতিয়াজের হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরলো। হতভম্ব স্বরে বললো,
“কি করছেন পড়ে যাবো তো।”

ইমতিয়াজ হাসে। রাগান্বিতাকে নিয়ে বাহিরে বেরোতে বেরোতে বলে,
“আমার শক্ত হাত তোমায় কখনো ফেলতে দিবে না।”

রাগান্বিতা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। মানুষটা যতবার তার সঙ্গে কিছু বলে ততবারই রাগান্বিতা মুগ্ধ হয়। আজও হয়েছে। না এই মানুষটার মাঝে কোনো খুঁত থাকতে পারে না। রাগান্বিতা মুচকি হেঁসে গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমায় কি খুব ভালোবাসেন আপনি?”

ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়ে। উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ যেতেই বলে,
“ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই।”

রাগান্বিতা কিছু বলে না। ইমতিয়াজ পুনরায় হাঁটা ধরে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। রাগান্বিতাকে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। নিজেও বসে। হাত ধোঁয়। খাবার প্লেটে বাড়তে বাড়তে বলে,
“এই রঙিন পৃথিবীতে তুমিহীনা কেউ আপন নেই আমার বউ। যারা ছিল তারা সবাই চলে গেছে তুমি কখনো যেও না। আমি মরে যাবো তবে।”

রাগান্বিতা স্তব্ধ। কি বলবে উত্তর খুঁজে পায় না। কেন পাচ্ছে না নিজেও জানে না। ইমতিয়াজ খাবার প্লেটে বেড়ে নিজ হাতে ভাত মাখলো। এক লোকমা খাবার রাগান্বিতার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“হা কর।”

রাগান্বিতা নিরদ্বিধায় তার মুখ খোলে। পুড়ে নেয় ইমতিয়াজের হাতে মাখানো এক লোকমা খাবার। অমৃতের মতো লাগে সেই খাবার। এত সুস্বাদু কেন! রাগান্বিতা আবার নিজেকে বোঝালো,“এই মানুষটার ওপর অবিশ্বাস করাও বুঝি পাপ।”

ইমতিয়াজ একের পর এক খাবার মুখে পুড়ে দেয় রাগান্বিতার। রাগান্বিতাও খেতে থাকে। হঠাৎ বলে,
“আপনি খাবেন না?”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“কেন?”
“এমনি।”
“আমি খাইয়ে দেই?”

ইমতিয়াজ বারণ করবে ভাবলো, আজ তার জীবনের একটা নিষ্ঠুরতম দিন। ভেবেছিল আজ রাতে না খাইয়েই ঘুমাবে। কিন্তু রাগান্বিতার আবদার কি সে ফেলতে পারে। ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বলে,“তুমি খাইয়ে দিলে আমি বিষ পান করতেও রাজি।”

রাগান্বিতা নিরুত্তর। চুপচাপ। কি বলবে আবারও ভেবে পায় না। আজ তার হলোটা কি ইমতিয়াজের কথার উত্তর কেন দিতে পারছে না।

রাতটা বেশ চমৎকার কাটলো। ইমতিয়াজ রাগান্বিতা একে অপরকে খাইয়ে দিয়ে। জড়িয়ে ধরে একসাথে ঘুমালো। ইমতিয়াজ ঘুমালেও রাগান্বিতা ঘুমায়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে দেখছে ওই সুরঙ্গের মতো জায়গাটায় কি আছে ততক্ষণ পর্যন্ত তার শান্তি মিলবে না। তাকে জানতেই হবে ওখানে কি আছে?”
—-
নভেম্বর ২, ১৯৮১! শীত ভেজা সকাল। কুয়াশা পড়েছে বাহিরে। বাড়ির উঠানের সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির জমেছে খানিকটা। রাগান্বিতা গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায় অপেক্ষা করছে রবিনের। রাগান্বিতা ধরে নিয়েছে ওই জায়গাটার চাবিটা কেউ যদি তাকে দিতে পারে তা একমাত্র রবিনই দিতে পারবে। কারণ কাল রাতে রাগান্বিতা দেখেছে রবিনের পকেটেই ওই চাবিটা আছে। রাগান্বিতা আন্দাজ করছে রবিন রোজই ওখানের চাবিটা নিয়ে বাড়ি আসে এবং রাতে দেখতে যায়। আজ রাগান্বিতাও দেখবে কোনো না কোনো উপায়ে রবিনের কাছ থেকে চাবিটা নিবেই। বলে না হোক, না বলে নিবে তবুও নিবে। আজ ইমতিয়াজ বাড়ি থাকবে না কোথাও একটা যাবে। যদিও রাগান্বিতাকে এই কথাটা বলে নি ইমতিয়াজ। কিন্তু কাল রাতে সে শুনেছে। ইমতিয়াজের তাকে কিছু না বলাটাও একটা সন্দেহের বিষয়। কিছু তো একটা লুকাচ্ছেই ইমতিয়াজ। রাগান্বিতার হুস ফিরলো ইমতিয়াজের ডাকে। তাকে বললো,“বউ আমি যাচ্ছি তুমি সাবধানে থেকো।”

রাগান্বিতা একটু ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ইমতিয়াজের দিকে। বললো,“আজ এতো তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন।”

ইমতিয়াজ রাগান্বিতাকে কাছে টেনে নেয়। বলে,“আমায় খুব মনে করো তাই না?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। ইমতিয়াজ বলে,“শোনো না বউ কাল তোমায় একটা উপহার দিবো বিশেষ উপহার।”

রাগান্বিতা অবাক হয়ে বলে,“কি উপহার?”

ইমতিয়াজ হেঁসে বলে,“উপহার কি আগে বলতে আছে! কাল বলবো তুমি অপেক্ষায় থেকো।”

এই বলে রাগান্বিতার কপালে এক গভীর চুমু কাটে ইমতিয়াজ। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই স্পর্শ তোমার আমার ভালোবাসার শেষ স্পর্শ হবে।”

তক্ষৎনাৎ নিজের কথার উপর নিজেই চমকে উঠলো ইমতিয়াজ। এ কি বলে ফেললো সে। এ কথা তো বলার ছিল না। রাগান্বিতা নির্বিকার চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। মনে হলো সে বোধহয় শুনতে পায় নি ইমতিয়াজের কথাটা। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কি রাগ করলে?”

রাগান্বিতার শীতল চাহনি। কেমন একটু করে যেন বললো,“না।”

ইমতিয়াজ সস্থির নিশ্বাস ফেলে বলে,“তুমি মানো বা না মানো এই ইমতিয়াজ এত সহজে তোমার পিছু ছাড়বে না। মরে গেলেও না।”

রাগান্বিতা এবার মুখ খুলে সরল চাহনি নিয়ে বলে,“রাগান্বিতা বুঝি ছেড়ে যাচ্ছে।”

ইমতিয়াজ কেমন যেন হয়ে গেল। বুকের মধ্যেখানে কেমন একটু করে উঠলো। যন্ত্রণা হলো বুঝি কোথাও। সে বললো,“আমার খুব ভয় লাগে,আমায় কখনো ছেড়ে যেও না বউ।”

ইমতিয়াজ আর দাঁড়ালো না। রাগান্বিতার উত্তরেও অপেক্ষা করলো না। চলে গেল। আচমকা বুকটা জ্বলে উঠলো। কি যন্ত্রণা হলো যে!’

সদর দুয়ার ছেড়ে বাহিরে আসতেই রবিন ভিতরে ঢুকলো। ইমতিয়াজের সঙ্গে দেখা হলো। রবিন জিজ্ঞেস করলো,“যাইতাছো?”

ইমতিয়াজ বললো,“হুম যাবো কতক্ষণ পর।”
রবিন আবার বললো,
“না গেলে হইতো না?”
“আমি সুন্দরভাবে রাগান্বিতাকে নিয়ে বাঁচতে চাই চাচা।”
“যদি ও কোনোদিন জানে?”
“জানবে না। আমি সব লুকিয়ে ফেলবো। ফিরে এসেই আমি চিরতরে ঐ পাতালকক্ষে ঢোকার সকল দুয়ার বন্ধ করে দিবো।”

রবিন নির্বিকার চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। ইমতিয়াজ যেতে নিলো আবার পিছন ফিরে বললো,“আমি রাগান্বিতাকে নিয়ে সুন্দর মতো বাঁচতে পারবো তো চাচা?”

রবিন চাচা কিছু বলবে তার আগেই ইমতিয়াজ চলে গেল এবারও অপেক্ষা করলো না উত্তরের। রবিন চাচা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলেন পলকবিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। কেন যেন তার কান্না আসছে! পোলাডা সেই ছোট বেলা থ্যাইক্কাই খালি কষ্ট পায় কিন্তু কখনো বাঁচার জন্য এমন আকুতি করতে দেখেনি চাচা।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিতা চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। হঠাৎ করে কি যে হলো তার বোঝা গেল না। কেমন যেন সবকিছু খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে সবকিছু বুঝি তার থেকে হারিয়ে যাবে।

রাগান্বিতা জোরে নিশ্বাস ফেললো। শ্বাস নিতে বোধহয় কষ্ট হচ্ছে। এমন বিচ্ছিরি অনুভূতি হওয়ার কারণটাই মাথায় আসছে না রাগান্বিতার।”

রেশবপুরে গন্যমান্য মানুষের সাথে রেজওয়ানের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলছেন মোতালেব তালুকদার। মির্জাপুরের জমিদার সুলতান ব্যাপারীর একমাত্র কন্যার তৃধার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন রেজওয়ানকে। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। মেয়ে অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারি। কথাবার্তাও সুন্দর। রেজওয়ানের পছন্দ হয়েছে মেয়ে। তাই আর দেরি না করে যতদ্রুত সম্ভব বিয়েটা দিতে চাচ্ছেন মোতালেব তালুকদার। বাড়িটাও ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে বউ আসলে বাড়িটা আবার বোধহয় মেতে উঠবে। নাতি নাতনিরা তাকে দাদাজান, দাদাজান বলে ডাকবে দারুণ শোনাবে কিন্তু। আনমনাই হেঁসে ফেললেন মোতালেব তালুকদার।

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-৪৫
________________
রন্ধন শালায় কাজ করছে রবিন। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে রন্ধন শালার দুয়ারের কাছে। দৃষ্টি তার রবিনের জামার বুকপকেটের দিকে। রবিনের গায়ে ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়া। রবিন তাকালো রাগান্বিতার দিকে। বললো,
“কিছু কি কইবা রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা রন্ধন শালার ভিতরে ঢুকলো। মৃদু স্বরে বললো,“আমি কি কিছু করবো চাচা?”

চাচা মৃদু হেসে বললেন,“না লাগবো না আমি একাই সব পারুম।”

রাগান্বিতা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,“চাচা শরবত বানাবো খাবেন?”

রবিন চাচা বেশ অবাক হয়ে বললো,
“এহন শরবত খামু।”
“বানাতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

রবিন চাচা বেশি ভাবলেন না। মিষ্টি হেঁসেই বললেন,“আইচ্ছা বানাও।”

রাগান্বিতা খুশি হলো। বললো,“আমি এক্ষুণি বানিয়ে আনছি।”

চলে গেল রাগান্বিতা। রবিন চাচা তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। সামান্য শরবত বানাতে বলতেই এত খুশি হলো মাইয়াডা। বড় ভালা মাইয়া। ইমতিয়াজ পোলাডায় খালি খালি বাঁচতে চায় না। মৃদু হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রবিন চাচা।

টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দু’গ্লাস শরবত বানাচ্ছে রাগান্বিতা। সে কাজটা ঠিক করছে কি না জানে না। তবে ওই জায়গায় কি আছে জানতে হলে এই কাজটা করতেই হবে রাগান্বিতার। রাগান্বিতা শরবত বানাতে বানাতে হঠাৎই তার শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা একটা কাগজ বের করলো। সেই কাগজের ভিতর ছিল কবিরাজের বানানো একটা ঔষধ। এটা খেলে মানুষ খুব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। ১২ ঘন্টার আগে তার ঘুম ভাঙে না। ইমতিয়াজের ঠিক মতো ঘুম হয় না এসব ভেবে এবার এনেছিল রাগান্বিতা তবে ব্যবহার করা হয়নি। কখনো ভাবে নি এইভাবে কাউকে ঘুমের ঔষধ খাওয়াবে। রাগান্বিতার বড্ড বুক ধুকপুক করছে। কি থাকতে পারে ওই জায়গাটায়।”

যথারীতি শরবত বানিয়ে রাগান্বিতা ছুটে গেল রবিন চাচার কাছে। তারপর একগ্লাস শরবত রবিন চাচার দিকে দিয়ে বললো,
“খান চাচা।”

রবিন নিলো। এক চুমুক দিয়েই বললো,“ভালো বানাইছো তো।”

মৃদু হাসলো রাগান্বিতা। বললো,“আপনার পছন্দ হয়েছে চাচা?”

রবিন চাচা আরেক চুমুক দিয়ে বললো,“হুম অনেক।”

রাগান্বিতা মুচকি হাসলো। রবিন পুরোটা শেষ করে দ্রুত নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। কতক্ষণ যেতে না যেতেই তার ভীষণ ঘুম ঘুম পেল। রাগান্বিতা প্রশ্ন করলো,“আপনার ঘুম পাচ্ছে চাচা ঢুলছেন যে।”

রবিন রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হ কেমন জানি লাগতাছে?”
“কাল রাতে কি চাচি ঠিক ভাবে ঘুমাতে দেয় নি চাচা।”

চাচা হেসে ফেললেন। বললেন,
“তুমিও না কি যে কও। কাইল তো আমি যাওনের আগেই বউ ঘুমাইয়া পড়ছে।”
“ওহ আচ্ছা। চাচা আপনি এক কাজ করুন নিজের ওই কক্ষে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন। আমি বাকি কাজ করে দিচ্ছি।”

রবিন চাচা শুনলেন তার অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে। চাচা ঢুলতে ঢুলতে তার কক্ষে গেলেন। রাগান্বিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এগুলো কি করছে! অন্যায় করছে তবুও উপায় নেই। ওই জায়গাটার কৌতুহল কিছুতেই কাটাতে পারছে না রাগান্বিতা।”

চাচা যাওয়ার মিনিট দশ যেতেই রাগান্বিতা ছুটে গেল রবিন চাচার কক্ষে। গিয়ে দেখলো পালঙ্কে আধমরা হয়ে শুয়ে আছেন। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল। বুকপকেট থেকে চাবিটা বের করলো। সঙ্গে বললো,“আমায় ক্ষমা করে দিয়েন চাচা।”

কথাটা বলেই চাবিটা নিয়ে দ্রুত বাহিরে বেরিয়ে আসলো রাগান্বিতা। তার বুক কাঁপছে, হাত কাঁপছে, অস্থিরতায় চারপাশ বুঝি ধেঁয়ে যাচ্ছে।”
—-
ট্রেনে বসে আছে ইমতিয়াজ। চোখে মুখে ক্রোধের প্রতিচ্ছবি। আজ যাই ঘটুক। এই হতাশা শেষ করেই বাড়ি ফিরবে ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসলো একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। বিষের শিশি পড়ে রইলো নিচে, পাশেই নিথর হয়ে পড়ে থাকা সেই ভয়ানক দৃশ্য। যে দৃশ্য ইমতিয়াজের পুরো জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্য ছিল। ইমতিয়াজ চোখ খুলে ফেললো। বললো,“আজই তোর শেষ দিন। আমি আর কারো জীবন নষ্ট হতে দিবো না। পাষাণ মানুষের জন্য কখনো ফুলের মতো মানুষদের জন্ম হয় না। আজও হবে না।”

ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো বাহিরে। একটু একটু করে সে ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। প্রতিহিংসার আগুন বুঝি আজই শেষ হবে।
—-
ডালপালায় ভর্তি সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। কেমন যেন লাগছে। কোনো ভয়ানক কিছু দেখে ফেলবে না তো। আচমকাই একটা কাক কা কা করে উঠলো রাগান্বিতা আরো কেঁপে উঠলো সে আশেপাশে তাকালো, না দূরদূরান্তে কেউ নেই। রাগান্বিতা জোরে নিশ্বাস ফেললো সে মোটেও ভীতু নয় তবে কেন যেন আজ ভীষণ ভীতু হচ্ছে। রাগান্বিতা নিচে বসলো ডালপালা সরালো। সেই দরজাটা নজরে আসলো। রাগান্বিতা কাঁপা কাঁপা হাতে চাবি দিয়ে দরজাটা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে থাকা কালো আধার বুঝে ধেঁয়ে আসলো। রাগান্বিতা বেশি না ভেবেই আস্তে আস্তে সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার মিললো প্রথমে। রাগান্বিতা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। কতটুকু নামতেই দেখলো দু’ধারে মশালে আগুন জ্বালানো। রাগান্বিতা সাহস নিয়ে একটা মশাল হাতে নিলো। সুরঙ্গের দুয়ার আঁটকে দিল। তবে তালা দিলো না। রাগান্বিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে তার নাকমুখের ঘাম মুছতে মুছতে নিচে নামলো। বেশ গভীরে এই জায়গাটা। রাগান্বিতা সিঁড়ি বেয়ে অনেকদূরে নামলো হঠাৎই দেখতে পেল বিশাল এক কক্ষ তার চারপাশে শুধু হেরিকেন জ্বলছে সঙ্গে দেয়ালে দেয়ালে মশাল। কিছুটা গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার মতো জায়গা। রাগান্বিতা পুরো কক্ষে চোখ বুলালো। কিচ্ছু নেই পুরোটা ফাকা। হঠাৎই নজর গেল তার থেকে অনেক দূরে একদম কর্নারে একটা টেবিল আর চেয়ারের দিকে। রাগান্বিতা একটু একটু করে সেই টেবিলের কাছে গেল। এই ফাঁকা ঘরে রবিন চাচা আর ইমতিয়াজ কি করে। রাগান্বিতা টেবিলের কাছে গিয়ে কিছু পুরনো খাতা আর কাগজপত্র ছাড়া কিছুই দেখছে না। রাগান্বিতা হতাশ হলো সে কি খামোখাই ভুলভাল ভাবছিল। আচমকাই কোথ থেকে যেন একটা কবতুর আসলো কক্ষে। রাগান্বিতা ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলো এতে। সে ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে গেল, টেবিলের সাথে ধাক্কা লাগতেই কিছু বই আর কাগজপত্র গড়িয়ে পড়লো নিচে। রাগান্বিতা তাকিয়ে রইলো কবতুরটার দিকে এটা তো সেই কবুতর যেটা রেশবপুরে বসে তাকে প্রায় চিরকুট দিতো। রাগান্বিতা পায়ের দিকে তাকালো আজও কি যেন নিয়ে এসেছে কবুতরটা। রাগান্বিতা এগিয়ে গেল কিন্তু কবতুর ছুট লাগালো। রাগান্বিতা বুঝেছে এ বার্তা তার জন্য নয়। কবুতর সারা কক্ষে ছুটলো তার পিছু রাগান্বিতা। আচমকাই আগুনের ফুলকিতে গা লাগলেই আহত হয় কবুতর সে ছিটকে পড়ে গেল নিচে। রাগান্বিতা ঘাবড়ে যায় দ্রুত ছুটে যায়। কোলে তুলে নেয় কবুতরকে বলে “এত ভয় পাবার কি আছে আমি তোকে মেরে ফেলবো নাকি।”

এই বলে গায়ে হাত বুলাতে লাগলো রাগান্বিতা। কবুতর চুপচাপ রইলো। রাগান্বিতা কবতুরটাকে টেবিলের উপর রেখে নিচে পড়ে থাকা সব খাতাপত্রগুলো উঠালো। হঠাৎই চোখ গেল একটা খামের দিকে। সে উঠালো। খুললো। পৃষ্ঠার প্রথম লেখাটা পড়তেই তার বুক কেঁপে উঠলো। যেখানে লেখা ছিল,
কুহেলিকা শুনছো তোমার নামে আজই শেষ চিঠি লিখছি। তুমি বারণ করেছিলে আমি যেন আর তোমার নামে চিঠি না লিখি আমি শুনেছি আজকের পর আর তোমায় চিঠি লিখবো না।”
~ ইতি,
আরফান মজুমদার।”

রাগান্বিতা সব কিছু দেখতে লাগলো। একটা কালো রঙের ডাইরি নজরে এলো। রাগান্বিতা খুললো। মাঝপৃষ্ঠায় এলো। যেখানে লেখা ছিল, তোমার মৃত্যু আমার হাতেই লেখা কুহেলিকা। তবে তোমায় আমি নিজ হাতে মারবো না। তুমি মরবে একা একাই তোমাকে মরতে বাধ্য করবো আমি। আমার প্রতিহিংসার প্রথম মানুষ হবে তুমি এরপর তোমার বোন রাগান্বিতা। তাকেও তোমার মতো মারবো প্রথমে চিঠি, তারপর প্রেম, মিথ্যে বিয়ে, কলঙ্কিত শরীর, আর পরিশেষে মৃত্যু। এই শহরে প্রেম মানেই মৃত্যু। তোমাকেও মেরেছি তোমার বোনকেও মারবো।”

রাগান্বিতার পুরো শরীর বুঝি নিস্তেজ হয়ে গেল এক নিমিষে। তার মানে সেদিন ইমতিয়াজ তাকে মিথ্যে বলেছিল আসলে আরফান মজুমদার ইমতিয়াজই। রাগান্বিতার বিশ্বাস হচ্ছে না। চারপাশ ঘুরছে। রাগান্বিতা পৃষ্ঠা উল্টালো। আবারও লেখা দেখলো,

আজ তোমার মৃত্যুর ষষ্ঠদিন চলছে। কাল সপ্তম দিন। আর কালই আমি যাচ্ছি রেশবপুর। তোমার বোনকে দেখতে। অবশ্য তোমার বোনের চেয়ে তোমার মৃত্যুতে তোমার পুরো পরিবার কেমন কাতরাচ্ছে তা দেখার ইচ্ছে আমার বেশি। তোমার বোনের মৃত্যুতে আমি তোমাদের বাড়িতেই থাকবো। তার মৃতদেহের দাফন আমি নিজ চোখে দেখবো তোমারটা তো দেখা হয় নি কিন্তু তারটা দেখবো। ঠিক দেখবো।”

রাগান্বিতার হাত থেকে ডাইরিটা পড়ে গেল। সেই ভরসন্ধ্যা বেলা বাঁশির সুর শুনে দেখতে যাওয়া মানুষটাই নাকি তার বোনের মৃত্যুর কারণ ছিল। আর সে কি না সেই মানুষটাকেই প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেললো। ঘৃণা হচ্ছে রাগান্বিতার। নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে, তাহলে কি তাকে বিয়ে করাটাও একটা ছক ছিল। তবে কি তাদের বিয়েটাও মিথ্যে ছিল। পরক্ষণেই ভাবলো না বিয়েটা তো তার বাবার প্রিয় কাজী সাহেব দিয়েছিল সে মিথ্যে হতে পারে না। তার থেকেও বড় কথা বিয়েটা তো ইমতিয়াজের সাথে নয় মাহাদের সাথে হওয়ার কথা ছিল। তবে কি মাহাদকে বিয়ের দিন ইমতিয়াজই নিখোঁজ করে পরে মেরে ফেলে। রাগান্বিতার মাথা ঘুরছে। এসব কি দেখে ফেললো। শেষমেশ কি না এত ভালোবাসার মানুষটাই মিথ্যে হলো। রাগান্বিতা যেন আজ বুঝলো ইমতিয়াজ তাকে বার বার কেন বলতো। আমায় এত বিশ্বাস করো না বউ?”

রাগান্বিতার বিশ্বাস হচ্ছে না। না এগুলো সব মিথ্যে। ইমতিয়াজ এমন হতে পারে না। তাকে ঠকাবে না। ইমতিয়াজ তাকেই ভালোবাসে। আরফান মজুমদার ইমতিয়াজ নয়। কিছুতেই নয়। ইমতিয়াজ তো বলেছিল আরফান মজুমদার তার বন্ধু ছিল। হতেই পারে এগুলো সব আরফান মজুমদার করেছে। এই জায়গাটাও আরফান মজুমদারের। হুম হতেই পারে। রাগান্বিতা দিশেহারা হয়ে পড়লো। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ইমতিয়াজকে চাই তার, সে সরাসরি সব জিজ্ঞেস করবে। রাগান্বিতা আবার নিচটা দেখলো চোখ গেল তারই আপার হাতে লেখা চিঠির দিকে। রাগান্বিতা কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠিটা উঠালো। দেখলো সেখানে লেখা,
“আমি মা হতে চলেছি আরফান। আর আপনি বলছেন আমাদের পুরো বিয়েটাই মিথ্যে ছিল। এমনটা কেন করলেন আমার সাথে! আমার দোষ কি ছিল! আমাকে এভাবে কলঙ্কিত কেন করলেন! কলঙ্কিত করার জন্যই বুঝি এভাবে গোপন বিয়ে করতে বলেছিলেন। আপনি এত নিষ্ঠুর ছিলেন আরফান। আপনার যদি আমাকে মারারই ইচ্ছে ছিল তবে নিজ হাতে গলা টিপে মারতেন এভাবে কলঙ্কিত কেন করলেন আরফান।”

রাগান্বিতা চিঠি হাতে ঠায় বসে পড়লো। সে কাঁদতে চাচ্ছে কিন্তু কাঁদতে পাচ্ছে না। তার চোখে পানি আসছে না অথচ বুক ফেটে যাচ্ছে। টেবিলের উপর থাকা কবুতরটা আচমকাই ডানা ঝাপটাতে গিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লো। রাগান্বিতা দেখলো পায়ে আঁটকে থাকা চিরকুটটা নিলো। কিছু দেখতেই তার কলিজা বুঝি কেঁপে উঠলো। রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না কুহুর লেখা শেষ চিঠিটা হাতে নিয়েই সে ছুট্টে বের হলো। যতদ্রুত সম্ভব তাকে রেশবপুরে যেতে হবে। রাগান্বিতার গায়ে জড়ানো ছিল শাড়ি, চুড়ি, ভাড়ি অলংকার। চুলগুলো ছিল শক্ত করে খোঁপা করা। রাগান্বিতা আটপাঁচ কিছু না ভেবেই গায়ে কালো রঙের লম্বা চাঁদর পেঁচিয়ে কিছু পয়সা-কড়ি নিয়েই বেরিয়ে গেল। তার মাথা কাজ করছে না। বার বার মন থেকে চাইছে সে যা দেখেছে সব মিথ্যে হোক। এটার কোনোটাই বাস্তব নয়। তার ইমতিয়াজ এতটা পাষাণ কিছুতেই হতে পারে না।”

রাগান্বিতা ঢাকার বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। নিথর পড়ে রইলো ইমতিয়াজের বাড়ি। রবিন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রইলো পালঙ্কে। তার অগোচরে কতকিছু ঘটে গেল সে টেরও পেল না।”
—–
তখন প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে। চারপাশ থমথমে আর নিশ্চুপ। গ্রামের সবাই মাগরিবের নামাজ পড়তে ব্যস্ত। রাগান্বিতা গরুর গাড়ি ছেড়ে নামলো দৌড়ে গেল বাড়ির ভিতরে গা থেকে কালো চাদরটা খসে পড়লো ঠিক বাড়ির উঠানে। পুরো প্রকৃতি তখন নির্জীব। কেমন ভয়ানক লাগছে চারপাশটা। রাগান্বিতা সদর দুয়ার দিয়ে ভিতরে ঢুকলো সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ানক দৃশ্য দেখে ফেললো যা দেখা একদমই কাম্মো ছিল না রাগান্বিতার। রাগান্বিতা দেখলো তারই বাবা মোতালেব তালুকদারের গলায় ধারালো ছুড়ি দিয়ে গলায় পোছ দিয়ে ফেলেছে ইমতিয়াজ। পুরো পৃথিবী বুঝি এক নিমিষেই থমকে গেল রাগান্বিতার। সে ঠায় বসে পড়লো। ইমতিয়াজ দেখতে পেল রাগান্বিতাকে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। রাগান্বিতার বাবার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়লো নিচে। পুরো গলা কাটা মুরগীর মত ছটফট করতে লাগলেন তিনি। রাগান্বিতা তার বাবার দিকে তাকিয়ে কেমন অসহায় লাগছে নিজেকে। রাগান্বিতার বাবা তাকিয়ে রইলেন রাগান্বিতার দিকে। ধীরে ধীরে তার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল সে বুঝেছেন সে থাকছে না আর এই পৃথিবীতে। রাগান্বিতার বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন তবে চোখ দুটো রাগান্বিতার দিকে। রাগান্বিতা নিশ্চুপ, নির্বিকার তার হাত থেকে পড়ে গেল কুহুর চিঠি। ইমতিয়াজের নজরে পড়লো তা। হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল নিচে। ঝনঝনিয়ে শব্দ হলো তাতে। এবার রাগান্বিতার দৃষ্টি গেল তার বাবার থেকে কয়েক কদম দূরে লুটিয়ে পড়ে থাকা রাগান্বিতার ভাই রেজওয়ান তালুকদারের দিকে। তার পুরো শরীর একটা জলজ্যান্ত দানব যেভাবে হামলা করে ঠিক সেভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। রাগান্বিতা এবার তাকালো ইমতিয়াজের দিকে তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। বোঝাই যাচ্ছে কতটা প্রতিহিংসা নিয়ে মেরেছে তার জলজ্যান্ত দুটো প্রিয় মানুষ বাবা আর ভাইকে। রাগান্বিতার দৃষ্টি ছিল ভিন্ন রোজকারের দৃষ্টি থেকে একদমই ভিন্ন। ইমতিয়াজ এই দৃষ্টি আগে দেখে নি। দু’জনেই চেয়ে রইলো একে-অপরের দিকে, ইমতিয়াজ দাঁড়ালো না আর তার আনা ছুরি রেখেই সে বেরিয়ে গেল বাহিরে। রাগান্বিতা স্তব্ধ হয়ে দেখলো একবার তার ভাইয়ের লাশ আর একবার তার বাবার। মনে করতে লাগলো কবতুরের পায়ে লেখা চিরকুটটার কথা। যেখানে লেখা ছিল,
“ভাই রেজওয়ান ভাইরে কি আইজগোই মারবেন?”

#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে