প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৯+২০

0
290

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন সকালে নাস্তার পর তাহমিদ বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। শুক্রবার হওয়ায় আজ রায়হান আহমেদ বাসায় আছেন। তিনিও তাহমিদের সাথে যেতে চাইলে, তাহমিদ তাকে সাথে নেয়না। সে কোন বন্ধুর সাথে রাজশাহীর বাহিরে যাবে। ওর ফিরতে বিকেল কিংবা সন্ধ্যা হবে। তাই রায়হান আহমেদকে মানা করে দেয়। তবে তাহমিদ তাকে জানায়, রাতে সে রায়হান আহমেদের সাথে ঘুরতে বের হবে। রায়হান আহমেদও সহাস্যে তাহমিদের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।

বেলা এগারোটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রাজিয়া খালা দরজা খুলে দেন। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। ততক্ষণে নায়লা আঞ্জুম ও শায়লা হাসান ড্রয়িংরুমে এসেছে। দরজার অপরপাশে দাঁড়ানো মানুষকে দেখে তারা প্রায় দৌড়ে যায় সেখানে। জড়িয়ে ধরে স্বামী-সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মহিলাকে।

রাজিয়া খালা পিছিয়ে চলে এসেছেন রান্নাঘরে। তার সর্বশরীর কাঁপছে। কোন কাজ করার শক্তি তার হাতে কিংবা শরীরে নেই। এক পর্যায়ে তিনি মাথা ঘুরে পরে যান। কুহু আর দুইজন মেইডের সাহায্য নিয়ে খালাকে নিয়ে রুমে যায়। তার মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করে। কিন্তু তিনি সুস্থ হওয়ার পর থেকেই মুখে কুলু পেতে বসে রয়েছেন। কুহু খালার হঠাৎ কি হয়েছে, তা অনেকবার জানতেও চেয়েও কোন উত্তর পায়নি।

অনেকক্ষণ এভাবে খালা স্বাভাবিক হয়ে রান্নাঘরে আসলেন। কিন্তু তার মুখ থমথমে হয়ে আছে।

” কুহুপু, এদিকে এস, আমার কাজিনের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। এরা হচ্চে আমার কাজিন নাহিয়া আর মিশাল। ওরা সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছে। ” রিশা উচ্ছ্বসিত হয়ে কুহুর সাথে ওর কাজিনদের পরিচয় করে দেয়। এবারই ওরা প্রথমবার দেশে এসেছে।
কুহুও ওদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। কুহু লক্ষ্য করল মেয়েটার বয়স পনেরোর আশেপাশে। আর ছেলেটার বয়স সম্ভবত দশ বছর।

এরইমধ্যে রায়হান আহমেদ ড্রয়িংরুমে আসলে, কুহু দেখল ওর চাচা মনমরা হয়ে বসে আছেন। তার মুখে কোন হাসি নেই। তিনি একনজর কুহুর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। কোন কিছু বললেননা তার ভাতিজীকে। অথচ ছুটির দিনে তিনি যতবারই ড্রয়িংরুমে আসেন, ততবারই কুহুর সাথে কথা বলেন। আজ তার ব্যতিক্রম দেখে কুহু কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে। ও বুঝতে পারছেনা খালা আর চাচার কি হয়েছে!

বিকেল পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। কুহু রুমে বসে পড়ছে। সৃজন নিশোর সাথে বাগানে খেলছে। সেখানে রিশা, নাহিয়া আর মিশালও আছে।

ড্রয়িংরুমে নায়লা আঞ্জুম, শায়লা হাসান বসে অতিথিদের সাথে গল্প করছিল। সেখানে রায়হান আহমেদ এবং খালেদ হাসানও রয়েছেন। তাদের সামনে হরেকরকমের নাস্তা।

” ভাইয়া, তুমি এসেছ? ভেতরে গিয়ে দেখ আমাদের বাসায় মেহমান এসেছে। ”

কুহু রুম থেকে নিশোর কথা শুনে বুঝতে পারে তাহমিদ এসেছে। রুমের জানালা খোলা থাকায় ওদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছে কুহু। এ বই বন্ধ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাসায় কে এসেছে, কিংবা আসেনি সেই বিষয়ে ওর বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই।

তাহমিদ নিশোর কথা শুনে ওর দিকে তাকায়। নিশোর পাশে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ে দুটোকে চিনতে পারলনা। শরীর ক্লান্ত থাকায় তাহমিদ কোন বাড়ায়না। ঢুকে পরে বাসায়।

কুহু তাহমিদকে ভেতরে আসতে দেখেই রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সে এখন নিশ্চয়ই তার বিখ্যাত ব্ল্যাক টি চাইবে।

” আপা, এই যে তাহমিদ এসে গেছে। দেখ তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে। ” ভেতরে ঢুকেই নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে তাহমিদ সামনে তাকায়। সোফায় বসে থাকা মানুষটিকে দেখে ওর মাথায় আ’গু’ন ধরে গেছে। চোখদুটো র’ক্তবর্ণ হয়ে গেছে। কপালের দুইপাশের শিরা দপদপ করছে।

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছেন রাজিয়া খালা। তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

” তাহমিদ, কেমন আছ বেটা? কত বড় হয়ে গেছ তুমি! আমাকে চিনতে পেরেছ? ” সোফা ছেড়ে উঠে এসে ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল মিথিলা আরজুমান্দ। সে তাহমিদের গালে হাত রেখেছে।

” ডোন্ট টাচ মি। আপনার সাহস তো কম নয়, আমাকে স্পর্শ করেছেন! আমাকে স্পর্শ করার আপনি কে? হতে পারেন আপনি এই বাড়ির মেয়ে, কিন্তু আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ”

তাহমিদের চিৎকার শুনে দুই পা পিছিয়ে যায় মিথিলা আরজুমান্দ। তার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।

” তাহমিদ, তুমি এভাবে আপার সাথে কথা বলছ কেন? তুমি কি ভুলে গেছ, সে তোমার মা? একজন সন্তান হয়ে মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধছেনা? ছিহ্ তাহমিদ ছিহ্। ” নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠল।

” বিবেকবোধ তোমার আছে! কিংবা তোমাদের আছে? যদি থাকত তবে এই মহিলাকে তোমরা বাসায় ঢুকতে দিতেনা। তোমরা আজ প্রমান করে দিলে তোমরা সবাই বিবেকবর্জিত জীব। হতে পারে এই মহিলা তোমাদের বোন। কিন্তু সে কখনোই আমার মা নয়। কোন মা নিজের সুখের জন্য তার নয় বছরের সন্তানকে ফেলে, অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে পারেনা। সে তোমাদের বোন হলেও, কখনো সে আমার মা হয়ে উঠতে পারেনি। ” রাগে তাহমিদ কাঁপছে। ও দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

কুহু স্তব্ধ হয়ে গেছে। একি শুনছে ও!
রাজিয়া খালা কাঁদছেন।

” বেটা, তুমি এভাবে বলছ কেন! আমি তোমার মা। তোমাকে দেখার জন্য আমি এতদূর ছুটে এসেছি। তুমি…… ।
মিথিলা আরজুমান্দ কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই তাহমিদের হুংকারে তাকে থামতে হয়।

” জাস্ট শাট-আপ। আমি আগেই বলেছি, আপনি আমার কেউ নন। আপনি আমাকে দেখতে মোটেও আসেননি। আপনি এসেছেন এখানকার সবাইকে নিজের সুখের সংসার দেখাতে। আমাকে যদি এতই ভালোবাসতেন তবে ফেলে রেখে যেতে পারতেননা। একটাবারও আপনি ভাবেননি, আপনি চলে যাবার পর আমার কি হতে পারে। যে ছেলে একা ঘুমাতে ভয় পেত, অন্ধকারে ভয় পেত, আপনি চলে যাবার পর সেই ছেলের প্রতিটা রাত কেমন কেটেছে, সেটা যদি জানতেন তবে আপনি নিজের মুখ কখনোই তাকে দেখাতেননা। সমাজের চোখে তাকে প্রতিনিয়ত কতটা হেয় হতে হয়েছে, সেটা যদি আপনি জানতেন তবে আজ নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে আসতেননা। আজ এত বছর পর হঠাৎ করে ভালোবাসা দেখাতে হাজির হয়েছেন কেন? কেন নিজেকে মা বলে দাবী করছেন? আমার মা এই যে রাজিয়া খালা। যিনি আমাকে আগলে রেখেছেন আজ অব্দি। ”

তাহমিদ রাজিয়া খালাকে টেনে মিথিলা আরজুমান্দের সামনে নিয়ে আসল। ও কাউকে বলতে না দিয়ে নিজেই বলে চলেছে।

” জানেনতো, আপনি যাবার পর বাবা আমাকে পর করে দিয়েছে। সে আমাকে ঘৃ’ণা করতে শুরু করে। এরপর সে আরেকটা বিয়ে করল। সৎমায়ের হাত ধরে আরেকবার নরক দর্শন করলাম আমি। উঠতে বসতে বাবা আর সৎমা মিলে অপমান করতে শুরু করল। যদি দাদু না থাকত আমি বোধহয় শেষ হয়ে যেতাম। সে আমাকে সব কটু কথা থেকে রক্ষা করেছে। আমার যখন আপনাকে সবথেকে বেশি দরকার ছিল, তখন আপনি আমার পাশে ছিলেননা। ক্লাসের সবাই যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের মা’কে নিয়ে আসত, তখন আমি দূরে থেকে তাদেরকে দেখতাম। যখন প্রতি পরীক্ষায় টপার হতাম, তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য আপনি ছিলেননা। আপনার অভাবে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। আমি ছন্নছাড়া হয়ে এদিকসেদিক ঘুরতে থাকলাম। এতকিছুর পর আজ আপনি এসেছেন মাতৃত্বের দাবী নিয়ে! শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না। আপনি জন্ম দিয়েও আমার মা হতে পারেননি, যেমনটা হয়েছে রাজিয়া খালা। আমার পুরোনো ক্ষ’তে আঘাত করতে কেন আবার আসলেন? কেন আসলেন? কেন? কেন? কেন আসলেন? ” তাহমিদ উন্মাদের মত করছে। ও দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টানছে। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে।

তাহমিদের এরূপ আচরনে সবাই ভয় পেয়ে গেছে। কুহু অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এরূপ আচরন করতে তা কুহু অনুধাবন করতে পারছে। তাহমিদের কষ্ট দেখে ওর বুকের ভেতর হাহাকার করছে।

রাজিয়া খালা তাহমিদকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। তিনি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

” ও বাপজান, তুমি ইকটু শান্ত হও। এম্নে কাঁন্দেনা, বাপ। তোমারে এইভাবে দেখবার পারতাছিনা আমি। ও বাপ, তুমি শান্ত হও। ” রাজিয়া খালা তাহমিদের মাথায়, চোখেমুখে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

” এরা সবাই খারাপ, খালা। এরা একজোট হয়ে ঐ মহিলাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এরা কেউ আমাকে পছন্দ করেনা, এটা আমি ভালো করেই জানতাম। কিন্তু নানিমার টানে এদের অবহেলা উপেক্ষা করে আমি এখানে আসতাম। আজ এরা এদের রূপ দেখিয়েই দিল। একজন আমার সুখ কেড়ে নিয়ে নিজের সংসার সাজিয়েছে। গত উনিশ বছর ধরে আমি আমি সেই দহনে নিঃশেষ হচ্ছি। আজ আবার এরা নতুনভাবে আমার সেই দহনে অনলের প্রলেপ দিয়েছে। এখন বাকিটা জীবন আমি বাঁচব কি নিয়ে? দুনিয়াটা এত নিষ্ঠুর কেন, খালা? নাকি দুনিয়ার সব নিষ্ঠুরতা শুধু আমার জন্যই বরাদ্দ! ” তাহমিদ রাজিয়া খালার হাত ছাড়িয়ে ওপরে যেতে চাইলে, খালা ওকে আটকায়।

” কই যাও, বাপ? তুমি এখানে বস, আমি তোমার জন্য শরবত নিয়া আসতাছি। ”

” আমি চলে যাব, খালা। এই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে যাব। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে আমি পা’গ’ল হয়ে যাব। ” তাহমিদ চোখ মুছে বলল। এরপর ও সোজা নিজের রুমে চলে গেল।

ড্রয়িংরুমের সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিথিলা আরজুমান্দ ভাবতেই পারেনি, তাহমিদের মনে তার জন্য এত ঘৃ’ণা জমেছে। সে হতভম্ব হয়ে তার মেয়ে নাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বাসার ভেতরের চিৎকার শুনে ওরা বাগান থেকে ভেতরে এসে সবকিছু শুনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
রিশা এতকিছু জানতনা। সে-ও সবার মত হতবাক।

রাজিয়া খালা দৌড়ে ওপরে চলে আসে। তাহমিদ ব্যাগে ওর কাপড় তুলছিল। রাজিয়া খালা এসে ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নেয়।

” ও বাপজান, তুমি এভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিওনা। তুমি কোথাও যাইবানা। ”

” খালা, তুমি আমাকে আটকিওনা প্লিজ। আমি এখানে থাকলে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব। ” তাহমিদ খালার কাছ থেকে ব্যাগ নেয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে।

” বাপজান, তুমি চইলা গেলে কুহু মা’য়ের কি হইব ? তুমি ছাড়া তারে নিরাপত্তা কে দিব? এতিম মাইয়াডার ভবিষ্যৎ কি হইব? তুমি না তাকে ভালোবাস। তাইলে তারে ফেইলা রাইখা যাইবা কেম্নে! ” এবার তাহমিদের হাত থেমে যায়। ও এতক্ষণ কুহুর কথা ভুলেই গিয়েছিল।

ও ধপ করে বিছানায় বসে পরল। দুহাত দিয়ে খামচে ধরল নিজের চুল। এ কোন পরীক্ষা উপনীত হয়েছে ওর সামনে?

বিঃদ্রঃ গত তিনদিন থেকে আমি অসুস্থ। এর ওপর বাসায় মেহমান। মেহমানদারী করে, অসুস্থ শরীর নিয়ে এতটুকুই লিখতে পেরেছি। আপনারা কেউ মনঃক্ষুণ্ন হবেননা।

চলবে…….
#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী জামী

রিশা এতক্ষণ অবাক চোখে মিথিলা আরজুমান্দকে দেখছে। ও এতদিন অনেক কিছুই জানতনা, যেগুলো আজ জেনে গেছে। ও জানত ওর বড় খালামনি দেশের বাহিরে থাকে। স্বামীর সাথে তার বাকি দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড থাকে। কিন্তু ও ঘুনাক্ষরেও জানতনা, ওর বড় খালামনি তাহমিদকে এভাবে ফেলে রেখে গেছে! নায়লা আঞ্জুম সব সময় ওদের বলেছে, মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তান নিয়ে সুইজারল্যান্ড থাকে। ও ভেবেছিল, বড় খালামনি এভাবে চলে যাওয়ায় তাহমিদ তার মা’য়ের ওপর রাগ করেছে। কিন্তু আজ ও এসব কি শুনল! হঠাৎই ওর মন বিদ্রোহ করে বসল। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা ওর মা, খালামনিদের অসহ্য লাগতে শুরু করল। বিশেষ করে মিথিলা আরজুমান্দকে।

” ছিহ্ খালামনি, তুমি এমন কাজ কিভাবে করেছিলে? তোমার একবারও ভাইয়ার কথা মনে হয়নি! তোমার জন্য ভাইয়া এত কষ্ট পাচ্ছে। একজন মা হয়ে তুমি এমন কাজ করলে কিভাবে? ” রিশা আবেগের বশে কথাগুলো বলল।

মিথিলা আরজুমান্দ রিশার দিকে আহত চোখে তাকায়।

” রিশা, তোমার এতবড় সাহস, তুমি বড় আপার সাথে এভাবে কথা বলছ? বেয়াদব মেয়ে, আদবকায়দা ভুলে গেছ? ” নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠল।

” রিশা, তুমি আমার সাথে এস। আমরা রুমে যাই। এখানের সার্কাস দেখতে মোটেও ভালো লাগছেনা। যারা তাহমিদের মত ছেলের মূল্য দিতে জানেনা, তারা আবার মানুষের পর্যায়ে পরে নাকি! ” রায়হান আহমেদ স্ত্রী’র কথায় পাত্তা না দিয়ে, রিশাকে বললেন।

” আমি এখন রুমে যাবনা, বাবা। আমি ভাইয়ার কাছে যাব। এই দুঃসময়ে ভাইয়ার কাছে থাকা জরুরী। ”

” চল, আমরা দুজনেই তাহমিদের কাছে যাই। ” রায়হান আহমেদ মেয়েকে নিয়ে পা বাড়ালেন দোতলায়।

” দাঁড়াও, রায়হান। আমিও যাব তোমাদের সাথে। এখানকার অসুস্থ পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ” খালেদ হাসানও তাহমিদের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

রায়হান আহমেদের সাথে নিশোও দোতলায় যায়।

মিথিলা আরজুমান্দ লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। স্বামী- ছেলেমেয়েদের সামনে তাকে এভাবে লজ্জায় পরতে হবে, তা সে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।

মিথিলা আরজুমান্দের স্বামী নাহিদ সারোয়ার চোখ গরম করে স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে এত বছর পর প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে জানলে, সে কখনোই এখানে আসতনা।

নাহিয়া আর মিশাল অবাক চোখে ওদের মা’কে দেখছে। ওদের মা’য়ের এরূপ জঘন্য অতীত আছে সেটা ওরা ভাবতেই পারছেনা। এর জন্যও ওদের বাবাও যে দায়ী সেটা কিছুতেই ওরা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা। তাহমিদের কান্না ভেজা চোখ, অসহায় মুখ নাহিয়ার চোখের সামনে ভাসছে।

” ছিহ্ মম, তুমি এতটা জঘন্য! আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা। নিজের সুখের জন্য তুমি একটা পরিবার ভেঙে দিয়েছ! তুমি একটাবারও তোমার ছেলের কথা চিন্তা করোনি? এখনতো আমার মনে হচ্ছে, তোমার প্রয়োজনে তুমি আমাদেরও ছেড়ে যেতে পার। আই জাস্ট হেইট ইউ। এ্যান্ড সেইম অন ইউ, মম। ”

” নাহিয়া, মাই বেইবি, তুমি এভাবে বলোনা। তুমি আমার কলিজা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আমার কিউটি বেইবি। ” মিথিলা আরজুমান্দ ব্যগ্র কন্ঠে বলতে থাকে।

” ভালোবাসা মাই ফুট। আমার মনে হয় তুমি কাউকে ভালোবাসতে জানোনা। তুমি শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে জানো। যদি কাউকে ভালোবাসতে তবে ঐ ভাইয়াটাকে কষ্ট দিতে না। তার ক্রন্দনরত মুখটা দেখে আমার নিজের প্রতি ঘৃ’ণা হচ্ছে। আর পাপা, তুমিও কম যাওনা। একটা সংসার ভাঙার চিন্তা তুমি কিভাবে করতে পারলে? তুমি একবারও ঐ ভাইয়ার দিকটা ভাবতে পারনি! ”

” নাহিয়া সোনা, রিল্যাক্স। এত হাইপার হয়োনা, সোনা। এসো আমরা বসে কথা বলি। তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোন, তাহলেই সব বুঝতে পারবে। ” নাহিদ সারোয়ার তার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” নো পাপা, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং রাইট নাও। বোথ অফ ইউ আর কালপ্রিট। আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু সুইজারল্যান্ড রাইট নাও। তোমরা যদি না যাও, তবে আমি একাই চলে যেতে পারব। ”

নাহিদ সারোয়ার বুঝতে পারছে তার মেয়ে এখন কোন কথা শোনার অবস্থায় নেই। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে। সে মিথিলা আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে বলল,

” মিথিলা, রেডি হয়ে নাও। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হব। নাহিয়া সোনা তুমিও রেডি হয়। আর মিশাল তুমিও। ”

মিথিলা আরজুমান্দ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পরল। এতদিন পর তাকে অতীতের তিক্ত পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে হবে তা সে ভাবতেই পারেনি।

তাহমিদ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল। এরপর উঠে আবার ব্যাগ হাতে নিল।

” খালা, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব ঠিকই, কিন্তু এখনই রাজশাহী ছাড়ছিনা। জয় রাজশাহী থেকে গেলেই তবে আমিও ঢাকা ফিরব। তুমি এই কয়টা দিন একটু সামলে নিও। বাসার বাহিরে কুহুর সকল বিষয় আমি দেখব, সে আমি যেখানেই থাকিনা কেন। ” থমথমে গলায় বলল তাহমিদ।

” আমি তোমার মত কইরা পরিস্থিতি সামলাইতে পারবনা, বাপজান। এতিম মাইয়াডা তুমি না থাকলে ভাইসা যাইব। রায়হান ভাই যতই চেষ্টা করুক, নায়লার হাত থাইকা তারে তুমিই পারবা রক্ষা করতে। তুমি এই বাড়ি ছাইড়না। তুমি চইলা গেলে তোমার নানিমা ম’ই’রা যাইব। হেই মানুষটা তোমার মুখ চাইয়া, আর তার পোলাডারে দেখবার লাইগাই বাঁইচা আছে। তুমি এইভাবে যাইওনা, বাপজান। ” রাজিয়া খালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।

তাহমিদ নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। এদিকে রাজিয়া খালার কান্না ওর বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। এই মানুষটার চোখের পানি ও সইতে পারেনা।

” ভাইয়া, তুমি সত্যিই চলে যাবে? যেওনা, ভাইয়া। তুমি চলে গেলে আমরা একা হয়ে যাব। ” রিশা দৌড়ে এসে তাহমিদের হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিল।

তাহমিদ সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় ওর দুই খালু রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন।

” তাহমিদ, তুমি এভাবে হুটহাট কোন সিদ্ধান্ত নিওনা। রা’গ কখনো কারো ভালো করতে পারেনা। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ঠান্ডা মাথায় নিও। ” রায়হান আহমেদ সস্নেহে বললেন। খালেদ হাসান মাথা নাড়িয়ে রায়হান আহমেদের কথায় সায় দিলেন।

নিশোও এসে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল। সকলের এমন আকুতি হেলায় ঠেলতে পারলনা।

” ঠিক আছে। আমি কোথাও যাচ্ছিনা। তবে ঐ ভদ্রমহিলা যতক্ষণ এই বাসায় আছে, ততক্ষণ আমি এখানে থাকছিনা। সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে, তুমি আমাকে জানিয়ে দিও, খালা। ”
তাহমিদ আর এক সেকেন্ডও রুমে দাঁড়ালনা। দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

ড্রয়িংরুমের সকলে তাহমিদকে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তাহমিদ তাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

মিথিলা আরজুমান্দ ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে! কত সুদর্শন হয়েছে সে! কিন্তু একটিবারও তার ছেলে তাকে মা বলে ডাকলনা, এই আফসোস তার আজীবন থেকে যাবে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে করে নিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস আর ছেলের ঘৃ’ণা।

রাত তিনটা দশ। তাহমিদ এখনো বাসায় ফেরেনি। রাজিয়া খালা তাকে ফোন করে মিথিলা আরজুমান্দ চলে গেছে সেইটা জানিয়েছেন। কিন্তু তাহমিদের বাসায় ফেরার নাম নেই। কুহু আর খালা অস্থির চিত্তে ড্রয়িংরুমে বসে তাহমিদের অপেক্ষা করছে। খালা কয়েকবার ওকে ফোন করলেও তাহমিদ আর ফোন রিসিভ করেনি।

আরও দশ মিনিট পর কলিং বেল বাজলে কুহু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ওর মধ্যে এই মুহূর্তে ভয়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাহমিদকে দেখবার জন্য ওর মন কেমন করছে। বিকেলে মানুষটার চুপসানো মুখ দেখে ওর ভিষণই কষ্ট হচ্ছিল।

দরজা খুলে দিতেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তাহমিদকে দেখে কুহুর বুকের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে। মানুষটা এক নজর কুহুর দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করেছে। এই কয়েক সেকেন্ডেই কুহু তাহমিদের লাল চোখদুটো দেখতে পেয়েছে। চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ে থাকা টি-শার্টে ধুলোবালি লেগে আছে। প্যান্টেও তাই। কুহু একপাশে সরে দাঁড়ালে তাহমিদ ভেতরে ঢুকে সোজা ওপরে যেতে চাইলে খালা ওকে ডাক দেয়।

” বাপজান, তুমি মুখহাত ধুইয়া আস, আমি খাবার গরম করতাছি। ”

” আমি খাবনা, খালা। ”

” আমি আর কুহু মা’য় তোমার জন্য অপেক্ষা করতাছি। আমরাও খাই নাই। তারে অনেক বইলাও আমি খাওয়াইতে পারিনি। সে আমার কথা শুনলইনা। তার একটাই কথা, তুমি না খাইলে সে-ও খাবেনা। ”

তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

” তোমার সাথে সাথে দেখছি এই মেয়েটাও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শিখে গেছে! মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার মোক্ষম হাতিয়ার তার কাছে আছে। সে ভালো করেই জানে দুনিয়ার সবাইকে ইগনোর করলেও, আমি তাকে ইগনোর করতে পারবনা। এই মেয়ে ক্রিয়ার বিপরীত ক্রিয়ায় বিশ্বাসী। সে প্রতিক্রিয়া দেখতে ভালোবাসে। তাই সে না খেয়ে আছে এত রাত রাত পর্যন্ত। আর আমিও অসহায় মানুষ সর্বদাই তার ফাঁদে পা দিতে একপায়ে রাজী। খাবার গরম কর আমি দশ মিনিটেই আসছি। ”

কুহু তাহমিদের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ও ভিষণ লজ্জা পেয়েছে। কেন যে খালা ঐ খোঁ’চা কুমারের সামনে কথাটা বলতে গেল!

তবে তাহমিদকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে খালা ও কুহু দুজনেই হাঁফ ছাড়ল।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে