প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৬+১৭

0
759

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__১৬+১৭

”আপনি খুব খারাপ আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী!”

দর্শিনীর বিস্ময়কর অভিমান পূর্ণ কথায় আবিদ গাড়িটা সজোরে থামিয়ে দেয়। ব‍্যাস! সিটবেল্ট না বাঁধার ফলে দর্শিনী মাথার পিছনে সামান্য আ’ঘা’ত পেয়ে মৃদু অ‍্যাহ্ শব্দ করে। আবদি তৎক্ষণাৎ বিচলিত হয়ে ক্রো’ধে ফেটে পড়ে। মুখে কৃত্রিম কঠোরতা ফুটিয়ে কড়া ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘সিটবেল্ট বাঁধতে জানেন না?এখুনি কতো বড় বিপদ হতে পারতো ধারণা আছে?ধ‍্যান কোথায় থাকে আপনার?স্টুপিড!’

আবিদের ধমকে দর্শিনীর চমকে উঠেছে। তখন,আবিদের উপর রাগ করে, সিটবেল্ট না বেঁধে কত বড় অকাজ করেছে বুঝতে পেরে মাথা নত করে ফেলে। আবিদ মূলত গাড়ি থামাতে চেয়েছিল দর্শিনীর অভিমানে জর্জরিত বিস্ময়কর কথায়। তার দর্শিনী তাকে প্রথমবার নাম ধরে বলেছে। শুনতে অদ্ভুত! তবুও দর্শিনীর মুখে নিজের নাম আবিদের অনেক ভালো লেগেছে। দর্শিনী অভিমানে আবিদকে খারাপ সম্বধোন করেছে। এখন আবিদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব‍্যার্থ হলে খারাপ বলা যাবে। এজন্যই আবিদ দর্শিনীকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। কিন্তু বোকা দর্শিনী এখনো বুঝেনি,মেয়েটা এতো আদুরে যে আবিদ বেসামাল হয়ে পড়ে। আবিদের দূর্বলতাকে দর্শিনী ইগনোর ভেবে ভুল করেছে। দর্শিনী ছলছলে নয়নে তাকিয়ে আছে আবিদের দিকে।এতো জোরে ধমক তো তাকে কেউই দেয়না। হয়তো তারই দো’ষ কিন্তু ধমক না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলা যেত না? অনেকক্ষণ যাবত দর্শিনী আবিদকে পরক্ষ করেছে। আবিদের মন নিয়ন্ত্রণহীন অথচ বাইরের দিক দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে শান্ত। নিজের মতো ড্রাইভ করছিল আবিদ। দর্শিনী কথা বলার চেষ্টা করেছে আবিদ তাকায়নি পযর্ন্ত। কথায় আছে যার জন‍্য চুরি করা হয় সেই বলে চোর। আবিদকে খুশি করার জন‍্য লাল শাড়ি,হালকা সাজ অথচ মানুষটা তার দিকে ফিরেও তাকালো না।লোকটি যেন নিষ্প্রাণ মূর্তিন‍্যায়! যার কোন অনুভূতি নেই এমন আচরণ করার মানে কি? দর্শিনীর ভুলটা কোথায়? আবিদ তাড়াহুড়োয় রাস্তার সাইডে গাড়ি থামিয়েছিল এজন্য সমস্যা হয়নি কিন্তু কতক্ষণ এভাবে থাকবে?দর্শিনী নিশ্চুপ হয়ে আছে।আবিদ দর্শিনীকে লাল শাড়ীতে আবৃত অবস্থায়,দ্বিতীয়বার অবলোকন করে। দর্শিনীকে দেখে আবিদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েটাকে দেখলে আবিদের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণে থাকেনা।নিষিদ্ধ অদ্ভুত ইচ্ছে মাথা চাড়া উঠে। আবিদকে তী’ক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করে দর্শিনী কেমন অশান্ত হয়ে পড়ছে। অন‍্যদিকে আবিদ নিজের অস্থিরতা দূর করতে একটু জোরেই বলে,

‘এখুনি এক্সিডেন্ট হতে পারতো। আপনাকে এমন অশান্ত দেখাচ্ছে কেনো? আপনি যেতে না চাইলে আমি বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি,সমস্যা নেই।’

দর্শিনী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আবিদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার জানতে ইচ্ছে করেছে আবিদ কেনো তাকে শাস্তি দিচ্ছে?দর্শিনী কী মুখ ফুটে একবারো বলেছে যেতে চাইনা?সে তো আবিদের সান্নিধ্য চাইছে। কালকে আবিদ চাইছিল দর্শিনীকে লাল শাড়ীতে আবৃত দেখতে। অথচ আজ কী ভুল করলো?প্রিয় মানুষের কাছে প্রশংসা শুনতে চাওয়া কী ভুল?দর্শিনী নির্বিকারভাবে বলে,

‘আপনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেনো আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী? আপনি রাগ করেছেন আমার উপর?’

আবিদ দর্শিনীর অবস্থা বুঝতে পারলো। দর্শিনী আবিদের এড়িয়ে যাওয়ার জন‍্য ক’ষ্ট পাচ্ছে। আবিদ ইচ্ছে করে দর্শিনীকে আরেকটু কথা শোনাতে বলে,

‘অবশ‍্যই রেগে আছি। কালকে আপনার অহেতুক কান্না আমার পছন্দ হয়নি। আপনি ছোট নেই এখন। মেয়েদের বিয়ের পর মা-বাবার থেকে দূরে থাকতে হয় এইটা নিয়ে কান্না করা চাইল্ডিশ কাজকর্ম।’

আবিদ কালকেই বুঝে গেছিলো সব, তাই ইচ্ছে করে এসব বলে অগোচরে হাসছে। এদিকে দর্শিনী অপমানে মাথা নিচু করে ফেলে। আবিদ দর্শিনীর কালকের আচরণকে সরাসরি চাইন্ডিশ বলেছে। অপমানিত হওয়ার কথায়। দর্শিনী আবিদ শাহরিয়ারকে কিভাবে বোঝাবে সে অবাস্তব অনুভূতিতে অশান্ত হয়ে পড়েছিল। সে নিজেও জানে কখন কাঁদতে শুরু করেছিল। আবিদ নিটোল দৃষ্টিতে দর্শিনীকে পরোক্ষ করে।

প্রচন্ড হাসফাঁস করে উঠে দর্শিনী। লজ্জায় অভিভূত দর্শিনীকে দেখে আবিদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসে। মুখের স্নিগ্ধতায় লালের আস্তারণ পড়ে গেছে। দর্শিনী তাকে সব রূপে আকৃষ্ট করে সর্বদা। দর্শিনীকে এই মা’রাত্মক রূপে দেখে কঠোর ব‍্যাক্তিত্বের আবিদের মনে আবারো নিষিদ্ধ আবদার, নিষিদ্ধ ইচ্ছে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ভালোভাবে দমে যায় বলিষ্ঠ সুপুরুষ,কারণ দর্শিনী তার হৃদয়ের শীতলতা। আবিদ নিজেকে সামলে নেয়।দর্শিনীর ভুল ভাবনাকে দূর করতে বলে,

‘দর্শিনী আপনি অমায়িক সুন্দর! আপনাকে আজ এতটা মনোমুগ্ধকর লাগছিল যে আমার সাফোকেটিং হচ্ছিলো। আমি যেন নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব‍্যার্থ হচ্ছিলাম।এজন্য আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার চে’ষ্টা করেছি। নিতান্তই আমার সুবিধার জন‍্য! আপনি ক’ষ্ট পাবেন না প্লীজ।’__বলেই গাড়ি স্টার্ট দেয় আবিদ।

অন‍্যদিকে দর্শিনী আবিদের সহজসরল স্বীকারোক্তিমূলক কথায় ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়। আবিদ দর্শিনীকে লজ্জায় ফেলতে আরো অনেক কিছু বলেছে। এদিকে বারবার কথা এড়াতে দর্শিনী অন‍্যপাশে ফিরে তাকায়।

চৌধুরী বাড়িতে কলিং বেল বেজে উঠে। আদিবা রুম থেকে লাফিয়ে উঠে। প্রিয়দর্শিনীকে দেখার আনন্দে উত্তেজিত সে। পুস্পিতাকে নিষেধ করে দরজা খুলতে।দৌঁড়ে নিচে নেমে দরজা খুলে দেয়।বাহিরে আবিদ দর্শিনীকে পাশাপাশি দেখে তার ভালো লাগা দ্বিগুণ বেড়েছে। দুজনকে অসম্ভব মানিয়েছে। রান্নাঘর থেকে অনুসা বেগম আর পুস্পিতা ছুটে এসেছে। অনুসা বেগমের মনে প্রশান্তির ছোঁয়া বয়ে যায় ছেলে,ছেলের হবু বউকে দেখে। ওদেরকে একসঙ্গে দেখে মনে হয় একে অপরের জন‍্যই তৈরি। আদিবা উচ্ছসিত হয়ে বলে,

‘আমাদের আবারো দেখা হলো দর্শিনী আপু। ড‍্যাম,তোমাকে লাল শাড়িতে মা’রাত্মক লাগছে। মেয়ে হয়েও ভাইয়ের হবু বউয়ের উপর ক্রাশ খেয়ে গেলাম!’

আবিদ ভ্রুঁকুচকে তাকালে আদিবা আমতা আমতা করে। আবিদ কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘দর্শিনী ডাকটা শুধু আমার জন‍্য। আমি ছাড়া এই নামের অধিকার কারো নেই।আজ থেকে দর্শিনীকে সবাই প্রিয়দর্শিনী বা সংক্ষেপে প্রিয় বলতে পারো।’

আবিদ কিছুক্ষণ থেমে আদিবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। আমি ক্লান্ত ঘরে যাবো।’

আদিবা সরে গেলে আবিদ হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়। দর্শিনীকে আদিবা সোফায় এনে বসায়। অনুসা বেগম দর্শিনীর পাশে বসে চিবুক আলতো স্পর্শ করে বলে,

‘মাশ আল্লাহ্! আমার বাড়িতে যেন সাক্ষাৎ চাঁদের আগমন। লাল শাড়িতে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে মা!’

দর্শিনী হবু শাশুড়ির কথায় মিষ্টি হাসে। পুস্পিতা আদিবা পাশেই বসেছিল।তারা কেউ’ই রেডী হয়নি মূলত সবাই হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে তবে’ই কেনাকাটা করতে বের হবে।আজকে সারাদিনব্যাপী তারা কেনাকাটা করবে বিকেলে রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।সন্ধ্যার দিকে আবিদ দর্শিনীকে বাসায় পৌঁছে দিবে।এমনটাই কথা হয়েছিল আশরাফ মুহতাসিমের সঙ্গে শাহরিয়ার চৌধুরীর। অনুসা বেগম পুস্পিতা আর আদিবাকে দর্শিনীর পাশে বসিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আদিবা আর পুস্পিতা দর্শিনীর সঙ্গে খুব ভালো মতো মিশে গেছে। পুস্পিতা দর্শিনীর সঙ্গে ঠাট্টা করতে বলে,

‘প্রিয়দর্শিনী, আমার দেবর কিন্তু স্ট্রি’ক পার্সন। উনার নাকের ডগায় সবসময় রাগ থাকে। তুমি তাকে কীভাবে সামলাবে?নাকি তোমার কাছে রাগ এখনো প্রকাশ করেনি?আবিদ ভাইয়া যে তোমার কাছে রাগ প্রকাশ করবে না আমি জানতাম। এখুনি তোমাকে ছাড়া কিছু বোঝে না পরবর্তীতে কী হবে ভেবে পাচ্ছিনা আমি।’__বলেই হাসতে থাকে। এদিকে দর্শিনীর দিকে উপর থেকে কেউ লোভতুর দৃষ্টিতে চেয়ে
রয়েছে। দর্শিনীর অঙ্গভঙ্গি মেয়েলী অবয়ব সবকিছু গভীর ভাবে পরলোকন করছে।

দর্শিনীর সেদিকে খেয়াল নেই সে আবিদকে নিয়ে ভাবান্তর হয়। আসলেই আবিদ তার কাছে কখনো ভয়ংকর রাগ প্রকাশ করেনি। দু’একবার যা ধমক দিয়েছে এই। কিন্তু প্রতিবার দর্শিনীরই ভুল ছিল। দর্শিনী পুস্পিতার শেষের কথায় উচ্ছসিত হয়। সত্যি আবিদ দর্শিনী ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না?এতটা প্রাপ্তি কী তার পাওনা ছিল? এতকিছু পাওনা বড্ড বেশি হয়ে গেছে।পরীক্ষার সময়টাই তখন তো জানতো না আবিদ বিবাহিত নাকি না। যদি বিবাহিত থাকতো দর্শিনী ক’ষ্ট পেতো। তবুও দূর থেকে তার ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেবের একটিবার দেখা পেতে চেয়েছিল। আর আজ সেই ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেবই তার হবু অর্ধাঙ্গ। আবিদ তার প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোবাসা। আবিদকে পেয়ে দর্শিনী স্রষ্টার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে সারাজীবন।


পুস্পিতাকে অনুসা বেগম রান্নাঘরে ডেকে নেয়। পুস্পিতা যাওয়ার আগে আদিবাকে বলে দর্শিনীকে বাড়িটা ঘুরে দেখাতে। আদিবা দর্শিনীকে সঙ্গে নিয়ে গার্ডেন এড়িয়ায় যায়।সেখানে নানান রকমের ফুলের সম্ভার। দর্শিনীদের গার্ডেনে ফুল রয়েছে কিন্তু এতো সংখ্যক নয়। দর্শিনী আদিবাকে জিগ্যেস করে,

‘এতো সুন্দর মনোমুগ্ধকর বাগান। গার্ডেনের শখ কার?’

আদিবা মুখ ভার করে বলে,

‘আমার ফুপির। ফুপির গার্ডেনিং খুব পছন্দ ছিল। আবিদ ভাইয়া ফুপিকে অনেক ভালোবাসতো। ফুপি এখন দেশে নেই, তাই ফুপির গার্ডেনের পরিচর্যা আবিদ ভাইয়া করে।’

দর্শিনী অবাক হয়। আদিবার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে জিগ্যেস করে,

‘তোমাদের নিজের ফুপি?’

‘হুম!’

‘এখন কোথায় তিনি?’

‘ইউএসএতে থাকে! তিনি দেশে আসতে চাননা। আবিদ ভাইয়ার যখন দশ-বারো বছর তখন চলে গেছে। ভাইয়া ফুপি বলতে পাগল ছিল। আমার ফুপিও আবিদ ভাইয়াকে অনেক স্নেহ করতো,একদম নিজের ছেলের মতো। যদি আবিদ ভাইয়ার বিয়ের কথা জেনে আসে তাহলে ভালো হবে। কিন্তু বলা যাচ্ছে না সম্ভবনা নেই!’

‘ওওও! উনার হাজবেন্ট,ছেলে-মেয়ে সবাই ইউএসএতে?’

‘আমার ফুপি বিয়ে করেনি। আনম‍্যারিড ছিল!’

দর্শিনী অবাক হয় আদিবার কথায়। কৌতুহলবশত জিগ্যেস করে,

‘উনি কী ছেলে বিদ্বেষী?’

‘না এমন নয়। শুনেছিলাম ফুপি কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসত কিন্তু লোকটি বিয়ে করে ফেলে। ফুপিকে ভালোবাসত না লোকটি।ফুপি মানসিক আ’ঘা’ত পেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তাকে দেশ ছাড়তে আম্মু পরামর্শ দিয়েছিল ফুপির ভালোর জন‍্য। কে জানে লোকটিকে ভুলে যাওয়ার জন‍্যই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।এরপর থেকে ভাইয়ার আচরণেও পরিবর্তন আসে। ফুপিকে খুব ভালোবাসতো বলেই তার ছেড়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি। ফুপিই ছোট থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছিল ভাইয়াকে। আসফি ভাইয়া মা-ভক্ত ছিল কারণ সবসময় মায়ের সান্নিধ্যে ছিল।এদিকে আবিদ ভাইয়া ফুপি ভক্ত ছিল। আবিদ ভাইয়া একটা সময় সব কিছুর জন‍্য আম্মুকে দ্বায়ী করতো। প্রচন্ড বাজে ভাবে কথা শোনাতো। মা বলে ডাকত না। হিংস্র’ত্মক আচরণ করতো। এজন‍্য বারো বছর বয়সে ভাইয়াকে আম্মুর থেকে দূরে হোস্টেলে রাখা হয়েছিল। একটা সময় পর ভাইয়া কিছুটা বড় হয় বুঝতে পারে এতে আম্মুর দো’ষ নেই। আম্মু ফুপির ভালো চাইতেন বলে এমনটা করেছিল। এরপর ভাইয়াও ফিরে আসে। তবুও আম্মুকে মা বলে ডাকে না। তবে এতোবছর পর সবকিছু অনেকটাই চেন্জ হয়েছে।’

দর্শিনী বিস্মিত হয়ে শুনে যাচ্ছে আবিদের অতীত। আবিদের ছোটবেলা পরিবারের সঙ্গে কাটেনি। নিশ্চয় সেইসময় মানসিক ভাবে ভে’ঙ্গে পড়েছিল পরিবার বিহীন। বাবা-মা পরিবার সবাই ছিল অথচ কতো দুরুত্ব ছিল তাদের মাঝে! দর্শিনীর সেই মানবীকে দেখতে ইচ্ছে করছে যাকে কঠোর ব‍্যাক্তিত্ববান আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী প্রচন্ড ভালোবাসে। আদিবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। আদিবা দর্শিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে।
আসফি তখন ড্রয়িং রুমে উপস্থিত ছিল। দর্শিনীকে দেখে আসফির মাথা খা’রাপ হয়ে যাচ্ছে। সে একদৃষ্টিতে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে ছিল অন‍্যকিছু। দর্শিনী অসস্থি বোধ করে আসফির চাহনীতে। দর্শিনী হঠাৎ আদিবাকে ফিশফিশিয়ে বলে,

‘আমাকে তোমার ভাইয়ার রুমে নিয়ে চলো।সবকিছু দেখলাম উনার রুমটা দেখা হলোনা।’

আদিবার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে দর্শিনীর কান্ডে। নিজের হবু বরের রুম দেখতে চাওয়ার জন‍্য অসস্থি থাকা দরকার নাকি? হয়তো সবাই আছে বলে লজ্জা পাচ্ছে। আদিবা দর্শিনীকে লজ্জা দিতে চায়না এজন্য মিষ্টি হেসে বলে,

‘চলো আপু! তোমাকে ভাইয়ার রুমটা দেখিয়ে আনি। আফটার অল ওটা তোমার নিজেরও রুম হবে। দেখার অধিকার আছে তোমার।’__বলেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো।

দর্শিনী সবার দিকে তাকিয়ে আদিবার পিছু নিলো। এদিকে সবটা পর্যবেক্ষণ করল আসফি। মনে মনে প্রচুর ক্রো’ধ আ’ক্রোশ জন্ম নিলো। আসফির এখন আবিদের ভাগ‍্যের উপর হিং’সা হচ্ছে। ভাগ‍্য বিদ্বেষী আসফি নিজেই ভাগ‍্যের দিকে চেয়ে আছে যদি কোনভাবে রাজি করিয়ে ফুলটাকে পেয়ে যায়। তাহলে দু’মড়ে মু’চড়ে নিজের কাছে রেখে দিবে। তাহলে ভাইয়ের প্রতি দূর্দান্ত প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

এতোক্ষণে দর্শিনী মনে মনে শান্তি পেলো আসফির অসস্থিকর নজর থেকে সরে আসতে পেরে। ছেলেদের এমন নজর কোন কালেই পছন্দ ছিলনা দর্শিনীর। এজন্যই তাকে আগলে রাখা হতো ছোট বেলা থেকে।আবিদ ছাড়া কোন পুরুষের সান্নিধ্য,অরুচিকরদৃষ্টি তার অসস্থির কারণ। আসফি শাহরিয়ার চৌধুরী সম্পর্কে হবু দেবর। কিন্তু তার আচরণে ভাইয়ের হবু স্ত্রীর প্রতি সম্মান খুঁজে পেলোনা প্রিয়দর্শিনী।


আদিবা রুমের দরজায় নক করলে আবিদ তী’ক্ষ্ম স্বরে বলে উঠে,

‘দর্শিনীকে ভেতরে পাঠিয়ে নিজের রুমে যাও।’

আদিবা ভাইয়ের কথা শুনে হাসতে হাসতে পাশের রুমে যেতে চায়। তার ভাই এতো ট‍্যালেনটেড না দেখেও সব বুঝতে পেরেছে। দর্শিনী আদিবার হাত ধরে ফেলে,ইশারায় তার সঙ্গে যেতে বলে। আদিবা হাতটা সরিয়ে বলে,

‘এতোক্ষণ তো আসার জন‍্য ছটফট করছিলে। ভাইয়া ডাকছে তোমাকে যাও এখন।’

দর্শিনী ফেঁসে গেলো। নিশ্চয় আবিদ তার সঙ্গে মজা করবে এই ব‍্যাপারটা নিয়ে। সে তো আসফির থেকে দূরে সরে আসার জন‍্য বলেছিল। ইশশ আদিবার রুমের কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। ভুলে আবিদের রুমের কথা বলে ফেলেছে। তাকে এখন যেতে হবে নাহলে পরবর্তীতে আবিদ তাকে শাস্তি দিবে নাহলে চরম অসস্থিতে ফেলবে। আদিবা নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। দর্শিনী ইতস্তত হয়ে এগিয়ে গেল আবিদের রুমের দিকে। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে দেখে পুরো রুম অন্ধকার। দর্শিনী হতভম্ব হয়ে গেলো আবিদের রুম দেখে। আবিদ অন্ধকার রুমে কী করছে? দর্শিনী কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে,

‘আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী? আপনি আছেন?আপনার রুম অন্ধকার কেনো প্লীজ লাইটটা জ্বালান। ভয় পাচ্ছি আমি।’

আবিদ দর্শিনীর জবুথবু অবস্থা পরোক্ষ করে বলে,

‘জ্বালাব না। ভয় পেতে থাকুন! আমি এখানেই আছি।’

আবিদের তী’ক্ষ্ম স্পষ্টত উত্তরে দর্শিনী কিংকর্তব‍্যবিমূঢ়। ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হতে যেতে চাইলে পিছন থেকে শীতল হাতের স্পর্শ শাড়ি ভেদ করে মেদহীন পেটে অস্তিত্ব জানান দেয়, আবিদ কাধে মুখ গুজে দিতেই দর্শিনী ফ্রীজড্ হয়ে যায়। তার নড়াচড়া করার শক্তিটুকু যেন হারিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু দম আঁটকে আসছে। আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে,

‘আপনার এমন অবস্থায় আমার রুমে আসা ঠিক হয়নি দর্শিনী। আপনাকে বলেছিলাম আমি নিজেকে অনেকক্ষণ যাবত কন্ট্রোল করে রেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। এরচেয়ে বেশি সহ‍্য ক্ষমতা নেই আমার। এখানে আমি আপনি আর অন্ধকার রুম ভাবতে পারছেন কতটা অসহায় আমি? কীভাবে নিজেকে সামলাবো বলুন আমাকে?ভালোবাসার মানুষকে নিজের রুমে সশরীরে স্ত্রীর রূপে দেখে কেউ কঠোর ব‍্যাক্তিত্ব দেখাতে পারে? যদিও এখনো স্ত্রী হতে পারেননি কিন্তু লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত আপনাকে দেখে আমার বউ বউ পাচ্ছে। একটু লিমিট ক্রস করাটা কী পুরুষ হিসাবে আমার অন‍্যায় হবে?যেখানে কিছুদিন পর আপনি আমার হবেন।’

মমের মতো গলে যায় কঠোর ধৈর্যশীল সুপুরুষটা। দর্শিনী নিস্তব্ধ নিস্তেজ হয়ে রয়েছে। আবিদ ভাবলেশহীন নির্বিকারভাবে বলে উঠে,

‘বহুদিন ধরে আপনাকে নিজের করে নেওয়ার অপেক্ষায় আছি,নিজেকে প্রস্তুত করবেন। আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি দর্শিনী!’___বলেই দর্শিনীকে ছেড়ে লাইট অন করে দেয় আবিদ।

লাইটের আলো পড়তেই দর্শিনী প্রচন্ড লজ্জায় মিইয়ে যায়। আবিদ দর্শিনীর দিকে পূর্ণ নজর দেয়। মেয়েটা আবিদের একটু কাছে আসাতে কতোটা অসস্থিতে পড়ে যায়। মনের অবাধ‍্য অশান্ত অনুভূতিতে হারিয়ে গিয়ে,নিজেকে সামলে নেয় আবিদ। কিন্তু দর্শিনী ফুঁপিয়ে উঠে। আবিদ দর্শিনীর সিচুয়েশন বুঝতে পারছে। মেয়েটা অবাস্তবিক অবাধ‍্য অনুভূতির জন‍্য কাঁদছে। আবিদ দর্শিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটা কেমন কেঁপে উঠছে।

‘সব কান্না আজকেই কেঁদে ফেলবেন? আগামীর জন‍্য কিছু বাঁচিয়ে রাখুন।’

দর্শিনী নিশ্চুপ। আবিদ আলতো হাতে কান্না মুছিয়ে বলে,

‘আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে। বলেছিলাম না আপনার কান্না আমার র’ক্তের থেকেও মূল‍্যবান?কান্না থামান নাহলে প্রিন্সিপাল আশরাফ মুহতাসিম আমার নামে কেস করে দিবে,উনার আদরের কন‍্যাকে কাঁদানোর জন‍্য। আপনি কী চান বিয়ের আগেই আপনার স্বামী জেলে থাকুক?’

দর্শিনী কেমন বেকুবের মতো আবিদকে পরোক্ষ করছে। লোকটি এতো ভালো কেনো? চাইলেই উনি কন্ট্রোল হারিয়ে অনেক বেশিকিছু করতে পারতো। কিন্তু উনি এমনটা করেনি। উল্টো দর্শিনী অজানা কারণে কান্না করে,আবিদকে বিভ্রান্তিতে ফেলল।

‘আপনি কী আমার উপর রাগ করলেন আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী?’

আবিদের এই নামটাকে এখন বেশি ভালো লাগছে। দর্শিনী কী সুন্দর আদুরে স্বরে নাম ধরে ডাকছে। ভালো তো যে কারো লাগবে। আবিদ দর্শিনীকে বিরক্ত করার জন‍্য মজা করে বলে,

‘হ‍্যাঁ করেছি রাগ। কি করবেন এবার?’

‘প্লীজ রাগ করবেন না আমি এমনভাবে কান্না করিনা। আপনার কথায় আমার এমনিতেই কান্না চলে এসেছে। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী?’

আবিদের হাসি পায় দর্শিনীর কথায়। মেয়েটা সরল! আবিদ বলে উঠে,

‘আমার সহজসরল দর্শিনী। আপনার চুলের ঘ্রাণ এতো মিষ্টি কেনো? যে কাউকে ঘা’য়েল করার জন‍্য যথেষ্ট।’

‘আপনি ঘা’য়েল হয়েছেন আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী?’

‘ঘায়েল তো হয়েছি বহুআগে দর্শিনী! আমার জীবনে আপনাকে অনেক আগেই পেয়েছি। এখন হালাল ভাবে স্বাগতম জানানোর অপেক্ষায়।’

বিদ্র – এখন থেকে সুবিধার্থে প্রিয়দর্শিনীকে সংক্ষেপে ‘দর্শিনী’ বলা হবে। বাকি সবার কাছে সে প্রিয়দর্শিনী শুধু আবিদ শাহরিয়ার আর আমার বর্ণনায় ‘দর্শিনী’ থাকবে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে