প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৮+১৯

0
784

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__১৮

আবিদের এমন অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডে অসস্থি লজ্জায় মিইয়ে করুণ অবস্থা দর্শিনীর। দর্শিনীকে আরেকটু অসস্থিতে ফেলার জন‍্য আবিদ ইচ্ছে করে তার দিকে এগিয়ে আসে।দর্শিনী ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। এভাবে একটা সময় পর দেওয়ালের সঙ্গে পীঠ ঠেঁকে গেলে,আবিদ দর্শিনীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আবিদের চোখে মুখে দু’ষ্টু হাসি। দর্শিনী মাথা নিচু করে ফেলে। আবিদ মুখটা দর্শিনীর কাছে এগিয়ে নিয়ে আসলে দর্শিনীর শরীর ঝিমঝিম করে ঝাঁকুনি দেয়। দর্শিনী ভাবতে পারছেনা আবিদ কী করতে চাইছে? দর্শিনী ভয় পেয়ে দ্রুত চোখ বন্ধ করে নেয়। আবিদ দর্শিনীর করুন অবস্থা বুঝতে পেরে।নিজের অদম‍্য ইচ্ছে দমন করে ফেলে। সে দর্শিনীকে অবাক করে দূরুত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পর আবিদের অস্তিত্বের আভ‍াস না পেয়ে দর্শিনী চোখ খোলে। আবিদ মুচকি হেসে দর্শিনীকে লজ্জায় ফেলতে জিগ্যেস করে,

‘কী ভেবেছিলেন দর্শিনী?ভয় পাবেন না বিয়ের আগে আপনাকে এভাবে স্পর্শ করবো না। আপনি কী লজ্জা পাচ্ছেন? আপনাকে এভাবে আকষর্ণীয় লাগছে দর্শিনী।’

দর্শিনী অদ্ভুতভাবে নেত্র পল্লব ঝাঁপটায়। আবিদের প্রতিটা আদুরে কথাবার্তায় তার শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। এটা কী তার উ’ন্মাদ ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব বোঝেনা? দর্শিনী লজ্জা পেয়ে মিষ্টি হেসে রুম থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে আবিদ শাড়ির আঁচল ধরে ফেলে। দর্শিনী শাড়ির আচঁলে হাত রেখে ছাড়াতে চেষ্টা করে। আবিদ শক্তিশালী বলিষ্ঠ হাতে হালকা করে ধরে আছে।কিন্তু দর্শিনী শক্তি প্রয়োগ করে ছাড়াতে পারছে না। দর্শিনী অসহায় কন্ঠে বলে,

‘ছাঁড়ুন প্লীজ। এতোক্ষণে সবাই খুঁজছে আমাকে।’

আবিদ ব‍াঁকা হাসে। দর্শিনীর উদ্দেশ্যে নির্বিকারভাবে বলে,

‘যদি না ছাঁড়ি?কেউ কী ছেড়ে দেওয়ার জন‍্য ধরে?আপনি সবসময় পালাই পালাই করেন কেনো দর্শিনী?’

দর্শিনী শাড়ির আচঁল নিয়ে টানাটানি করছে। আবিদ একটু একটু করে দর্শিনীকে আচঁল সহ নিজের দিকে টানছে। আবিদ যদি এই মুহুর্তে আচঁল না ছাড়ে দর্শিনী টানাটানি করে ছিঁড়ে ফেলবে। তাই বাধ‍্য হয়ে আবিদ আচঁলটা ছেড়ে দেয়। দর্শিনী ছাড়া পেতেই দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে হাঁপাতে থাকে। মুখে তার মিষ্টি হাসির আভ‍াস। দর্শিনী আদিবার রুমের সামনে এগোতে যাবে তখনই আসফির সঙ্গে ধাক্কা খায়। আসফি কপালে ব‍্যাথা পেয়েছে কিনা দেখতে টাচ করতে যাবে তার আগেই দর্শিনী ছিটকে দূরে সরে যায়। আসফি ব‍াঁকা হেসে দর্শিনীকে অপাদমস্তক পরোক্ষ করে দেখে। আসফির অসস্থিকর নজর এড়াতে দর্শিনী বিরক্ত হয়ে অন‍্যদিকে ফিরে। আসফি এগিয়ে এসে জিগ্যেস করে,

‘আস্তে দৌঁড়াবে তো। দেখি কোথায় ব‍্যাথা পেয়েছো?’___বলেই দর্শিনীর দিকে হাত বাড়ায়। দর্শিনী স্তব্দা খেয়ে যায় আসফির ব‍্যবহারে। এমন গায়ে পড়া স্বভাব তার একদম পছন্দ না।

তৎক্ষণাৎ আবিদ আসফির হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলে। দর্শিনী আবিদকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। আসফি ছেলেটা সত্যি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছিল। প্রথমদিন থেকে ছেলেটার নজর দর্শিনীর ভালো লাগেনা। কেমন ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে থাকতো। আবিদের কন্ঠে কঠোরতা। মৃদু রাগ দেখিয়ে আসফির উদ্দেশ্যে বলে,

‘দর্শিনীর ব‍্যাপারে তোর নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। নেক্সট টাইম উনার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করিস না।উনার থেকে দূরে থাকবি।’

দর্শিনী আবিদের দিকে মুগ্ধতার সহিত তাকিয়ে থাকে। আবিদের চোখে মুখে স্পষ্টত রাগ। হয়তো আসফি দর্শিনীর দিকে হাত বাড়িয়েছে বলে। মেয়েরা তো সারাজীবন এমন ছেলেই চায় যে সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে নিজের প্রিয়তমাকে রক্ষা করবে। প্রিয়তমার ঢাল হয়ে রবে। আসফি নিজের রাগটা হজম করে নেয়। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে পা বাড়ায়। আসফি চলে যেতেই আবিদ দর্শিনীর দিকে ফিরে মুখটা আলতো হাতে আজলা করে ধরে। তারপর জিগ্যেস করে,

‘ঠিক আছেন আপনি? কোথায় ব‍্যাথা পেয়েছেন?’

দর্শিনী আবিদের হাতে হাত ছুঁয়ে হেসে বলে,

‘কপালে তৎক্ষণাৎ ব‍্যাথা পেয়েছিলাম এখন নেই। আমি রুম থেকে বের হয়েছি আদিবা রুমে যাওয়ার জন‍্য। তখনই হঠাৎ আসফি ভাইয়ার সঙ্গে ধাক্কা লাগল। মনে হচ্ছে উনি রুমের বাহিরেই ছিল। ব‍্যাপারটা এতো দ্রুত হলো আমি বুঝতে পারিনি।’

আবিদ মনে মনে ক্রু’দ্ধ হলো। বেশ বুঝতে পারছে আসফি ইচ্ছে করে আবিদের রুমে নজর রেখেছিল। যা হলো সবটা ইচ্ছাকৃত। আবিদ দর্শিনীর কপালে হাত বুলিয়ে বলে,

‘আদিবাকে নিয়ে নিচে যান। আমি শাওয়ার নিয়ে এখুনি আসছি।’

দর্শিনী আবিদের কথায় আদিবার রুমে নক করে। আদিবা দরজা খুললে আবিদের কথামতো দুজনে নিচে নামে। আবিদ নিজের রুমে ফিরে আসে। আসফির উপর তার রাগ হচ্ছে বাড়িতে দর্শিনী আছে তাই সিনক্রিয়েট করতে চায়না নাহলে ক’ষে চড় মারা উচিত এমন যঘন‍্য পলেসির জন‍্য। ভাইয়ের রুমের নজর রাখা নিশ্চয় প্রশংসনীয় কাজ নয়। এখন মাথা ঠান্ডা করতে তাকে শাওয়ার নিতে হবে নাহলে রাগ কিছুতেই কমবে না।

_
ডাইনিং টেবিলে সবাই নাস্তা করছে। আবিদ একেবারে পরিপাটি হয়ে নিচে নামছে। দর্শিনীকে অনুসা বেগম নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। দর্শিনী আবিদকে সিঁড়িতে নামতে দেখে দিকবেদিক হারিয়ে তাকিয়ে রইল। আবিদের পড়নে কালো ব্লেজার,খয়েরী শার্ট,কালো প‍্যান্ট! ডান হাতে কালো কোট। গমরঙা ত্বকে খয়েরী কালো কম্বিনেশন। প্রচন্ড মানিয়েছে আবিদকে। তার বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ,জেল দিয়ে সেট করা চুল। দর্শিনী মনে মনে মাশ-আল্লাহ্ বলে ফেলল। আবিদ ডাইনিং বসতেই দর্শিনীর দিকে তাকালো মেয়েটা কী সুন্দর হবু শাশুড়ির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। অনুসা বেগম যখন যত্ন সহকারে পরোটা আর সুজির হালুয়া মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। ঠিক সেই মুহুর্তে দর্শিনীর হাসি মুখটা লক্ষ‍্য করে আবিদের বুকে ঢিপঢিপ শব্দ বাড়ছে। আবিদ নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। পুস্পিতা আরহানকে নাস্তা দিয়ে আবিদের জন‍্য ব্রকলি সুপ আর স‍্যালাড নিয়ে আসে। দর্শিনী খেতে খেতে অবাক হয়ে তাকায়। আবিদ সাস্থ্য সচেতন সকালবেলা ব্রকলি সুপ,স‍্যালাড, ডিম, দুধ, জ‍্যাম-পাউরুটি নিত‍্যদিনের খাবার। সকলে খাওয়া শেষ করে তৈরি হয়ে নেয়।পুস্পিতা,অনুসা বেগম,আদিবা,দর্শানী সবাই এক এক করে গাড়িতে উঠে বসেছে। আবিদের পাশের সিট ফাঁকা। আরহান রেডি হয়ে এসে পাশের সিটে বসে। আবিদ গাড়ি স্টার্ট দেয়। আরহান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে।এদিকে আবিদ ফ্রন্ট আয়নাতে দর্শিনীকে দেখতে ব‍্যাস্ত। মাঝে মাঝে দু’একবার ভাইয়ের কথায় জবাব দেয়। দর্শিনী আদিবা, পুস্পিতা, হবু শাশুড়ির সঙ্গে দু’একটা কথা বলছে। মাঝে মাঝে মন দিয়ে তাদের কথা শুনছে হাসছে। সে জানলোই না তার ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব তার সব রূপে মুগ্ধ হচ্ছে। চৌধুরী বাড়িতে শুধু আসফি আর শাহরিয়ার চৌধুরী থাকবেন। আসফিকে বলা হয়েছিল সবার সঙ্গে যেতে। সে রাগের বসে সরাসরি মানা করে দেয়। এখন অবশ‍্য আফসোস করছে। আসফি বেলকনি থেকে আবিদের গাড়ি বের হয়ে যেতে দেখল। আবিদকে অনেকদিন পর হাসিখুশি দেখল আসফি। এমনিতেই আবিদকে হাসিখুশি দেখলে তার শরীর জ্বলে। এখন তো আরো প্রিয়দর্শিনী আছে। প্রিয়দর্শিনীর সঙ্গে আবিদকে দেখলে তার রাগ উঠবে। এরচেয়ে দূরে থেকে প্লান করা যাক কীভাবে কী করে সবটা আটকানো যায়।

_

চৌধুরী পরিবারের সবাই ‘বিগ বাজারে’ এসেছে। অনুসা বেগম শপিংমলের সবচেয়ে বড় শাড়ির দোকান ‘জামদানি বিতানে’ গিয়ে শাড়ি দেখাতে বলেন। ‘জামদানি বিতানে’ সব রকমের দেশী বিদেশী শাড়ি, লেহেঙ্গা, সারারা পাওয়া যায়। দোকানের সবাই চৌধুরী পরিবারকে চেনে। অনুসা বেগম প্রায় কেনাকাটা এখান থেকেই করেন।আরহাম আর আবিদ দোকানের এক কোনায় সোফায় বসে আছে। বাকিরা সামনের সোফায় দেখা-শোনা করে বেশ কয়েকটি শাড়ি পছন্দ করলো। শিফনের নরম কয়েকটি শাড়ি কেনা শেষ। শেষে অনুসা বেগম দর্শিনীর জন‍্য বাসন্তী রঙের একটা জামদানি পছন্দ করলেন। দোকানে শাড়ি পড়াতে এক্সপার্ট একজন দর্শিনীর গায়ে শাড়ি মেলে ধরতে গেলে আবিদ উঠে দাঁড়ায়।

‘দাঁড়ান আমি করছি।’ ___বলে লোকটাকে সরিয়ে মেরুন রঙের একটা জামদানি দর্শিনীর গায়ে জড়িয়ে দেয়। বাসন্তী রঙের চেয়ে মেরুন রঙটা দর্শিনীকে বেশ মানিয়েছে। সবাই আবিদের পছন্দে মুগ্ধ হয়। আবার আবিদের এমন কান্ডের জন‍্য হাসাহাসি করতে ভুলেনি। দর্শিনীকে দেখে অনুসা বেগমের চোখ চিকচিক করে উঠে। ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,

‘বাহ্! এই রঙ প্রিয়কে প্রচন্ড মানিয়েছে।’

পুস্পিতা শাশুড়ির কথায় হ‍্যাঁ তে হ‍্যাঁ মিলিয়ে বলে,

‘তবে এটাই পড়িয়ে দেখান প্রিয়দর্শিনীকে।’

আবিদ দোকানে শাড়ি পড়ানো মহিলা এক্সপার্টদের খোঁজ করে। দোকানের একজন কর্মচারী হন্তদন্ত হয়ে একজন মহিলাকে ডেকে আনেন। চৌধুরী পরিবার হচ্ছে তাদের সবচেয়ে লাকি কাস্টোমার। তাদের জন‍্য বরাবর সুযোগ সুবিধা থাকেই। মহিলাটি এসে দর্শিনীর শাড়ির উপরে সুন্দর করে শাড়িটা পড়িয়ে দেখায়। দর্শিনী আবিদকে ইশারা করে ভালো লাগছে কিনা। আবিদ ঠোঁট মেলে পজেটিভ ইশারা করে। দর্শিনী আবিদের ইশারা পেয়ে অনুসা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,

‘আমার এটাই পছন্দ হয়েছে আন্টি।’

অনুসা বেগম পুস্পিতা সবাই সর্মথন করে। শাড়ির কেনাকাটা শেষে আবিদ ক্রেডিট কার্ডের মাধ‍্যমে বিল পে করে দেয়। দু’তিনঘন্টা সময় নিয়ে দর্শিনীরা ব‍্যাগ, সুজ থেকে শুরু করে সমস্ত কসমেটিক আইটেম কিনে ফেলেছে। সবার বাজার করা শেষ এখন শুধু জুয়েলারি আইটেম আছে। আবিদ আর আরহান হাঁপিয়ে গেছে প্রায়। তারা সবাইকে শপিংমলের রেস্টুরেন্টে আসতে বলে এগিয়ে যায়। সবাই কেনাকাটা করে সবেমাত্র রেস্টুরেন্টে বসতেই আবিদ সবার পছন্দের খাবার অর্ডার দেয়। টুকটাক খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই শপিংমলের দ্বিতীয় তলায় জুয়েলারির দোকানে যায়। এখানেই দর্শিনীর জন‍্য জুয়েলারি অর্ডার দিয়েছিল অনুসা বেগম।

#চলবে

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__১৯

‘নিহাল ভাইয়া আপনি এখানে কী করছেন?’

অদিবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময় পাশে থেকে দর্শিনীর আওয়াজ পেয়ে নিহাল চমকে তাকায়। হঠাৎ দর্শিনীকে লাল টুকটুকে শাড়িতে দেখে অগোচরে নিহাল মৃদু ঢোক গিলে নেয়। আগে থেকে এই রূপসী মেয়েটাকে তার ভিষণ পছন্দ ছিল। শাড়ি পড়া অবস্থায় প্রথম দেখছে। আজ অনেক আকষর্ণীয় লাগছে দর্শিনীকে। এদিকে আদিবা অবাক হয়ে দর্শিনী, নিহালকে পর্যবেক্ষণ করছে। আদিবা ভাবছে দর্শিনী কী চেনে এই লোকটিকে?কেমন অভদ্র ম‍্যানার্সহীন লোক যে সামান‍্য সরি বলতে পারেনা। অথচ মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে মন চায়। দর্শিনী উত্তর পাওয়ার আশায় দু’জনের দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনেই এতোক্ষণ তর্ক করে মুখে কুলুপ এটেঁ রয়েছে। দর্শিনী আবারো জিগ্যেস করলে আদিবা তী’ক্ষ্ম মেজাজে বলে,

‘দেখনা প্রিয় আপু! আমি কিডস’জোনের দিকে যাচ্ছিলাম এই লোকটা হঠাৎ ধাক্কা দিলো অথচ সরি বলার প্রয়োজন মনে করলো না। আমি সরি বলতে বললাম। উল্টে বলে কিনা আমি পুচকে মেয়ে আমার নাকি সরি বলা উচিত। কিছুদিন পর অষ্টাদশী হবো।এই অসভ‍্য লোকটা আমাকে পুচকে বলেছে। উনাকে দেখেই আমার মেয়েবাজ মনে হচ্ছে মেয়ে দেখে গায়ে পড়ার বাহানা সব।’

দর্শিনী গলা ঝেড়ে মৃদু কেশে উঠে। মেয়েবাজ?তার নিহাল ভাইয়া? দর্শিনী বুঝতে পারছে দু’জনের মধ‍্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নিহাল এতোক্ষণ আদিবাকে ভদ্রভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু হঠাৎ আদিবার এসব কথায় মেজাজ খুঁইয়ে ফেলে। মৃদু রাগ দেখিয়ে বলে,

‘এক্সকিউজমি মেয়েবাজ কে? আমার তাড়া ছিল। আমি তাড়াহুড়ো করে হাত ঘড়িতে তাকিয়ে ছিলাম আপনি ফোন দেখতে দেখতে আসছিলেন আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন। আপনার মতো পুচকে মেয়ের সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছে নেই আমার। আমি মেয়েবাজ নই আপনি ছেলেবাজ। অদ্ভুত মেয়ে!’

দর্শিনী পড়েছে মহা ঝামেলায়। আদিবা রেগে গিয়ে কিছু বলবে তার আগে দর্শিনী তাকে থামিয়ে দেয়। দর্শিনী আদিবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘আদিবা উনি ডা.নিহাল রায়হান। এতোদিন অস্ট্রেলিয়া তে ছিলেন। আমার কাজিন হয়। উনি আমাদের চেয়ে অনেক বড়। হয়তো ভুলে ধাক্কা লেগেছে। এতো রিয়াক্ট করার কিছু নেই। উনি কিন্তু সরি বলেছে তুমি প্লীজ রাগ করো না।’

আদিবা দর্শিনীর কথায় ভ্রুকুঁচকে নিহালের দিকে তাকায়। এই লোকটাকে কোনভাবে তার ডাক্তার মনে হচ্ছে না। কিন্তু লোকটাকে বিদেশী বললে ভুল হবেনা দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার ফলে হয়তো উনার চেহারাতে আলাদা শুভ্রতা রয়েছে। দর্শিনী নিহালের উদ্দেশ্যে বলে,

‘নিহাল ভাইয়া আদিবা আমার ছোট বোন সমতূল‍্য। বুঝতেই পারছেন ও অনেক ছোট।প্লীজ ওর কথায় রাগ করবেন না। আদিবা অনেক ভালো মেয়ে শুধু একটু রাগী। আপনি অচেনা তাই এমন ভাবে রিয়াক্ট করেছে।__ কথাটা দর্শিনী আদিবাকে আগলে ধরে বলে।

আদিবা এখনো নিহালকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। নিহাল আদিবার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে আবার ঘড়ির দিকে তাকায়। দেরী হচ্ছে তার। বিগবাজার হসপিটালের কাছে হওয়ায় সহকারী ডাক্তারদের
সঙ্গে শপিংমলের রেস্টুরেন্টে এসেছে। এখন সবাই তার জন‍্য হয়তো রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে। নিহাল দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘প্রিয় তুই এখানে কী করছিস আন্টি, প্রজ্জ্বল, আঙ্কেল এসেছে নাকি?

‘না ভাইয়া। আমি আসলে ____

কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই আবিদ আরহান এসে হাজির হয়। আবিদ নিহালের দিকে একবার তাকিয়ে দর্শিনী আর আদিবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘কী হয়েছে এখানে? উনি কে দর্শিনী?’

দর্শিনী আবিদকে দেখে জিগ্যেস করে,

‘আপনাদের দু’ভাইয়ের কেনাকাটা শেষ?এতদ্রুত?’

‘আপাতত শেষ। সবাই বাসায় রওনা দেবো এখন। বললেন নাতো উনি কে?’

দর্শিনী নিহালের দিকে একবার তাকিয়ে আবিদকে বলে,

‘ওহ্! উনি আমার কাজিন নিহাল ভাইয়া। ডা.নিহাল রায়হান। এখানে হুট করে দেখা হয়ে গেছে। এমনি জিগ্যেস করছিল কার সঙ্গে এসেছি? একা এসেছি কিনা?’___দর্শিনী সন্তপর্ণে আদিবা আর নিহালের তর্কাতর্কির বিষয়টি চেপে যায়। ততক্ষণে বাকি দু’জন হাত ভর্তি শপিং ব‍্যাগ নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসে।

নিহাল, আবিদ আর দর্শিনীর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আবিদকে সে চেনেনা ইভেন এদের কাউকেই চেনেনা। এদের সঙ্গে দর্শিনীর কী কাজ থাকতে পারে নিহাল বুঝতে পারছেনা। আবিদ দর্শিনীর কথায় নিহালের দিকে তাকায়। ভদ্রতা বজায় রাখতে হাতটা বাড়িয়ে বলে,

‘আমি আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। দর্শিনীর হবু বর।’

নিহাল স্তব্ধ হয়ে গেছে। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী দর্শিনীর হবু বর?সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। আবিদের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ফর্মালিটি মেইনটেন করতে হাতটা বাড়িয়ে বলে,

‘ডা.নিহাল রায়হান। দর্শিনীর খালাতো ভাই।’___ নিহালের হঠাৎ বুকে ব‍্যাথা হচ্ছে। এতোবছর পর যার জন‍্য আসলো তার বিয়ে হয়ে যাবে অথচ সে জানেনা। একমুহূর্তের জন‍্য নিহালের মনে হয় যা শুনলো সব যেন মিথ‍্যা হয়ে যায়। আবিদ মুচকি হেসে হ‍্যান্ডসেক করলো। যাওয়ার সময় দর্শিনী নিহালকে বাই বলে সবার সঙ্গে রওনা দেয়। নিহাল সবকিছু সঙ্গে ব‍্যাস্ততা ভুলে দর্শিনীদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। আদিবা অবশ‍্য দু’বার নিহালের দিকে তাকিয়েছে। নিহালকে আদিবার অদ্ভুত লেগেছে একবারো তাকালো না তার দিকে। দর্শিনীর হাতে অনেকগুলো শপিং ব‍্যাগ ছিল। আবিদ এবং দর্শিনী পাশাপাশি যাচ্ছে। আবিদ হঠাৎ দর্শিনীর হাত থেকে শপিং ব‍্যাগ নিয়ে নেয়। তারপর দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে যেতে থাকে। দূর থেকে নিহাল সবটাই লক্ষ‍্য করলো তার বুকে হঠাৎ র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমাদের প্রচন্ড কষ্ট দেয়। যা সহজে ভুলে যাওয়ার মতো না। নিহালের কাছে এই পুরো ঘটনাটা অপ্রত‍্যাশিত। নিহাল দেরী না করে সহকারী ডাক্তারদের কাছে ফিরে যায়। আজকে দ্রুত ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে। দর্শিনীর বিয়েটা যে করে হোক আঁটকাতে হবে। নিহাল আজকেই বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে আশরাফ মুহতাসিমের কাছে। সে তো একজন ভালো ডাক্তার নিশ্চয় আশরাফ মুহতাসিম রাজি হবেন তাকে ফিরিয়ে দেবে না। প্রয়োজনে পা ধরে ভিক্ষা চাইবে তবুও একবার চেষ্টা করতে তো দোষ নাই।
_
চৌধুরী পরিবারের সবাই সবে বাড়িতে ফিরেছে। সবাই ড্রয়িং রুমে এসির মধ‍্যে বসে আছে। প্রচন্ড গরম আজকে। ড্রয়িং রুমের সবগুলো এসি ছেড়েছে আবিদ। গরম একদমই সহ‍্য করতে পারেনা। দর্শিনী ও গরম সহ‍্য করতে পারেনা। গরমে মেয়েটার শুভ্র ত্বক যেন হালকা লালচে হয়ে উঠে। ব‍্যাস বিয়ের আগে আর কয়েক মুহুর্ত দর্শিনী চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে কাটাবে। আজকে প্রচুর কেনাকাটা করা হয়েছে। অনুসা বেগম দর্শিনীর জন‍্য যেগুলো কিনেছেন সবগুলো আলাদা
করে রেখেছেন। তিনি প্রিয়দর্শিনীর পরিবারের সব সদস্যদের জন‍্য কেনাকাটা করেছেন। আজকে আবিদ নিয়ে যাবে সব। শাহরিয়ার চৌধুরী হতবাক অবশ্য বাড়ির প্রত‍্যেক পুরুষ হতবাক। মেয়েদের কেনাকাটা করার প্রচুর ধৈর্য‍্য।পছন্দ নাহলে শপিংমলের দোকান গুলো বারবার ঘুরতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়না। অথচ ছেলেদের এতো ধৈর্য্য নেই। পছন্দ হলেও কী?না হলেও কী?ঐ একই দোকান থেকে কিনে নেয় সব। সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। আবিদ স্বাভাবিক ছুটির দিন হলে নিজের রুমে সময় কাটাতো। কিন্তু আজ দর্শিনী আছে সে নিজের রুমে যাওয়ার বদলে সোফায় বসে ফোন দেখতে থাকে। মূলত সে ফোন এবং দর্শিনী দু’জনের দিকেই নজর রেখেছে। নিহাল নামের লোকটির কথা আবিদকে ভাবাচ্ছে। লোকটির দৃষ্টি দর্শিনীর দিকে ছিল। যেই দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা ছিল। আবিদ এসবে তেমন পাত্তা দেয়না। কারণ দর্শিনী শুধু আবিদ শাহরিয়ারের সে জানে। তবুও অন‍্যকেউ দর্শিনীর প্রতি ভালোলাগার দৃষ্টিতে দেখুক এইটা আবিদ একদমই চায়না। আবিদ দর্শিনীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দেয়।মেয়েটা হেয়ার ব‍্যান্ড দিয়ে খোঁপা করে আছে সামনে অগোচরে কিছু চুল বেরিয়ে।দেখতে মা’রাত্মক লাগছে। আবিদের আবারো বউ বউ ফিলিংস আসছে। যদি সম্পর্কটা হালাল ভাবে পূর্ণতা পেয়ে থাকতো।তবে এতক্ষণে নিজের রুমে গিয়ে সাজিয়ে রাখতো। যা ইচ্ছে করতে পারতো। মেয়েটা এতো কেনো পোড়ায় তাকে? বিগত একবছর থেকে শান্তি দেয়নি। না চাইতেও আবিদের মনে পড়তো দর্শিনীকে। শেষে আবিদ তখন লোক লাগিয়ে খোঁজখবর রাখতো কখনো কলেজের সামনে সিভিল পোশাকে মাস্ক পড়ে একবার দেখার জন‍্য ছটফট করতো। কখন,কোথায় যায়?কোন কচিং? সব খোঁজ নিতো আবিদ। আগেও জিলাতে বেশ কয়েকবার গেছে আবিদ। আবিদ বহু আগে থেকে আশরাফ মুহতাসিমের সঙ্গে পরিচিত ছিল। এখন শুধু সম্পর্কটা হালালভাবে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষায়। আবিদের কাছে এই সময়টা দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
_
বিকেল পাঁচটা____
আবিদ গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দর্শিনীর জন‍্য অপেক্ষা করছে। দর্শিনীকে অনুসা বেগম ছাড়তে চাইছেন না। একদিনে মেয়েটার প্রতি মায়া পড়ে গেছে। পুস্পিতা আদিবা দু’জনে গিফট গুলো গাড়িতে রেখে দেয়। অনুসা বেগম দর্শিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। দর্শিনীর মনে হচ্ছে আজ এইবাড়িতে আরেকটা মাকে পেলো। যে মা এখানে তাকে সারাজীবন আগলে রাখবে। দর্শিনীকে আসতে দেখে আবিদ গাড়িতে উঠে বসে। আদিবা পুস্পিতা একে একে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরল। আদিবা ইমোশনাল হয়ে বলল,

‘কালকে সবাই মিলে যাচ্ছি তোমাদের বাসায়। কবে যে বিয়েটা হবে আমি অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি আমার ভাবী হয়ে আসো প্রিয় আপু। তোমাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগবে না এখন।’

দর্শিনী আদিবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে গাড়িতে উঠে আবিদের পাশে বসে। অনুসা বেগম আবিদকে আস্তে-ধীরে গাড়ি চালাতে বলেন। দর্শিনী সবাইকে সালাম করে আরো একবার বিদায় জানায়। আবিদের গাড়ি অদৃশ্য হওয়া পযর্ন্ত বেলকনি থেকে সবটা পরোক্ষ করেছে আসফি। হাতে তার স্পীড ক‍্যান। সে একটু একটু করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। দুনিয়ার সবকিছু তার বিষাক্ত লাগছে। সে মনে হয় প্রথম ব‍্যাক্তি যে ভাইয়ের উপর প্রচন্ড হিংসা করছে। কিন্তু উপায় কী আবিদ প্রতিবার তার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আসে। প্রথমে বাবা-মা, তারপর ফুপি, এখন প্রিয়দর্শিনী। কিন্তু আসফি চুপ থাকবেনা এবার। সে লড়ে যাবে যে করে হোক সর্বচ্চো চেষ্টা করবে প্রিয়দর্শিনীকে পাওয়ার জন‍্য। বাকিটা ভাগ‍‍্য!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে