প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১৫

0
760

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__১৫

“চলুন না দর্শিনী আমরা দ্রুত বিয়ে করে ফেলি! আপনাকে ছাড়া থাকা নিত‍্যদিন মা’রাত্ম’ক রকমের ক’ষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে কতোটা এলোমেলো ছন্নছাড়া লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না দর্শিনী।”

আবিদের মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠস্বর প্রিয়দর্শিনীর কর্ণকুহরে পৌঁছনো মাত্রই দ্বিতীয়বার শিউরে উঠল। শরীরে ঠান্ডা শীতল বাতাস প্রবাহিত হলো। হঠাৎ কী হলো প্রিয়দর্শিনী ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।কেনো কান্না পাচ্ছে তার? আবিদের ভালোবাসাময় কন্ঠস্বর তাকে দূর্বল করে দিতে বিন্দুমাত্র সময় নেয়না। আবিদ কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় হয়ে দর্শিনীর কান্নার শব্দ শুনতে লাগল। আবিদ বি’স্ময়ের সঙ্গে নিশ্চুপ থাকল কিছুক্ষণ। আবিদের মনে হচ্ছে, দর্শিনীকে পরিবার পরিজনকে ছেড়ে আসতে হবে সেজন্য কাঁদছে। এজন্য প্রচন্ড শান্ত তী’ক্ষ্ম স্বরে বলে উঠল,

‘কাঁদবেন না দর্শিনী! বিশ্বাস করুণ বুকের বাঁপাশে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আপাতত আপনাকে বুকে জরিয়ে কান্না থামানোর কোন স্কোপ নেই দর্শিনী। তাই ফোন থেকেই বলছি কাঁদবেন না। আপনার চোখের পানি আমার কাছে আমার র’ক্তে’র চেয়েও মূল‍্যবান। আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে প্লীজ ক্ষ’মা করবেন। তবুও কান্না করবেন না আমি নিতে পারছিনা আপনার কান্না। মনে হচ্ছে বুকের বাঁপাশে র’ক্তক্ষ’রণ হচ্ছে।’

প্রিয়দর্শিনী আবিদের কথায় এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। আবিদ অ’শা’ন্ত বিচলিত হয়ে জিগ্যেস করল,

‘কাঁদছেন কেনো দর্শিনী? আমি কী ভুল কিছু বললাম?আপনি হয়তো ভাবছেন তাড়াতাড়ি বিয়ে হলে আপনার বাবা মার সঙ্গে দূরুত্ব তৈরি হবে! এমনটা মোটেও নয়।আপনি যখন ইচ্ছে নিজের বাসায় যেতে পারবেন সেই স্বাধীনতা আপনার থাকবে। কিন্তু বিয়ের পর আপনাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভিষণ ক’ষ্ট হবে। আমি বোধ হয় আপনার বিরহে খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবো। এজ‍ন‍্যই যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে চাই।’

প্রিয়দর্শিনী এখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। সে আবিদকে কিভাবে বোঝাবে এই কান্না শুধু পরিবার থেকে দূরে যাওয়ার জন‍্য নয়।এটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতি, যা বলে বোঝানো যাবেনা। আবিদের কথায় কেমন ভালোলাগা কাজ করছে তী’ব্র ভাবে! না চাইতেও তার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। আবিদকে জরিয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,

‘আমি শুধু আপনার। আমিও ক’ষ্ট পাচ্ছি আপনার জন‍্য, ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব! একবছর আগেই আপনাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি। আগে থেকে অনেক খুজেঁছিলাম কিন্তু পায়নি। আল্লাহ্ মনে হয় এতোদিনে আমার উপর স’ন্তু’ষ্ট হয়ে আপনাকে উপহার হিসাবে পাঠালো। আপনার জন‍্য কত রাত না ঘুমিয়ে প্রার্থনা করেছি। যেন আপনাকে আরেকটিবার দেখার সৌভাগ্য হয়। অবশেষে আপনাকে পেয়ে আমি সৌভাগ্যবতী হলাম। অদ্ভুত কারণে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না আপনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার জন‍্য ক’ষ্ট পান। কিন্তু দেখুন আমি সেই সৌভাগ‍্যবতী! তাই আপনি আমাকে ভালোবাসলেন। বিশ্বাস করুন আপনার থেকে দূরে আছি এজন্য নিজেরও ক’ষ্ট হচ্ছে। আপনার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে এখুনি আপনার কাছে ছুঁটে যাই। আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেখি। এটা আমার ভ্র’ম নাকি বাস্তব পরীক্ষা করি।’

আবিদ প্রিয়দর্শিনীর নিশব্দে কান্না দেখে বলে উঠল,

‘দর্শিনী! আল্লাহর ওয়াস্তে ওয়াদা করছি আপনি কান্না না থামালে আমি আপনার বাসায় চলে আসবো। সেটাও এক্ষুনি! কে কীভাবে নিবে আমার দেখার বিষয় নয়। আপনার কান্না থামাতে প্রয়োজনে সবার সামনে’ই জরিয়ে ধরবো। কিছুদিন পর আপনি মিসেস আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী হবেন। আপনি সশরীরে পুরোটাই আমার দর্শিনী!’

আবিদের উপরোক্ত কথা শেষ হলে প্রিয়দর্শিনী নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রিয়দর্শিনী একটু ভয় পায় সত্যি সত্যি আবিদ চলে আসলে?সবাইকে সে কী বলবে? তার পরিবার কী ভাববে?এমনিতেও আবিদ যা বলে তাই করে ছাড়ে। প্রিয়দর্শিনীর কানে আবিদের একটা কথা ঘুরেফিরে বেজে উঠছে, ”আপনি সশরীরে পুরোটাই আমার দর্শিনী!” প্রিয়দর্শিনী প্রচন্ড লজ্জায় মিইয়ে যায়। আবিদকে এখন এক্সাটলি ঠিক কোন ধরনের ব‍্যাক্তিত্বের বলা যাবে? রোমান্টিক নাকি অতীব রোমান্টিক?

***
রৌদ্রজ্জ্বল সুন্দর সকাল। প্রিয়দর্শিনী ফজরের নামাজ পড়ে শুয়েছিল আরো একবার ঘুমিয়ে বেলা করে উঠেছে। ঘুম থেকে উঠতে হঠাৎ তার মনে পড়ে কালকের কথা। কাল আবিদের কথায় প্রিয়দর্শিনী হুট করে কেঁদেছিল। ইশশ! মানুষটা কী ভাবলো। আজকে আবিদ তাকে নিতে আসবে। কথাটা মনে করা মাত্র তড়িঘড়ি করে প্রিয়দর্শিনী শাওয়ার নিতে চলে যায়। প্রিয়দর্শিনী শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সকালের মিষ্টি রোদ এসে তাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। প্রিয়দর্শিনী সুন্দর সকালটা উপভোগ করতে থাকে। মাঝে মাঝে মিষ্টি করে হেসে দেয়। মূলত কালকে আবিদের কথাগুলো ভেবেই হেসে উঠেছে। আহমেদ মুহতাসিম সকাল সকাল হাঁটতে বের হয়েছেন। প্রিয়দর্শিনী বেলকনি থেকে দাদুকে দেখে বলে উঠল,

‘দাদু? একটু সাবধানে। তুমি একা বের হয়েছ কেনো। দাঁড়াও আমি এক্ষুনি আসছি।’

আহমেদ মুহতাসিম মাথা উচু করে বেলকনিতে তাকিয়ে প্রিয়দর্শিনীকে দেখলেন। প্রিয়দর্শিনী আসছে দেখে গার্ডেনের বেঞ্চটায় আরাম করে বসলেন। প্রিয়দর্শিনী আসলে একসঙ্গে হাটঁবেন বা নানান গল্প জুড়ে দিবেন প্রিয় নাতনীর সঙ্গে।

***
সকাল সাড়ে দশটায় আবিদ আসে। প্রিয়দর্শিনী মসৃণ কটন কাপড়ের লাল টুকটুকে হালকা কাজ কড়া শাড়ি পড়ে তৈরি। শাড়ির সঙ্গে ম‍্যাচিং করে মেরুন কাজ করা ব্লাউজ। প্রিয়দর্শিনী সোজা মসৃণ হালকা বাদামি চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। হুরের মতো ফর্সা স্নিগ্ধ মুখ। সঙ্গে ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক। এতেই স্বর্গীয় অপ্সরা লাগছে ওকে। প্রিয়দর্শিনী সময় দেখে পার্সটা নিয়ে নিচে নামে। আবিদ সবার সঙ্গে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল। উজান, আশরাফ মুহতাসিম, আহমেদ মুহতাসিম সবাই আবিদের সঙ্গে টুকটাক কুশল বিনিময় করে। হঠাৎ আবিদের চোখ যায় সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকা অপ্সরার দিকে। আবিদ প্রিয়দর্শিনীকে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে অন‍্যদিকে ফিরে তাকায়। আবিদের বুকে ভিষণ ব‍্যাথা হচ্ছে। বুকের ভেতরে কেমন ঢিপঢিপ আওয়াজ শুরু করেছে। আবিদ বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে মিনমিন করে বলে,

‘ইয়া আল্লাহ্! আমাকে ধর্য‍্য দিন। আজকে আমি নিজে’ই নিজের বিপদ ডেকে আনলাম মনে হচ্ছে। কি দরকার ছিল লাল টুকটকে শাড়ি পড়তে বলার। এখন নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। কিভাবে সামলাবো এখন আমি। নাহ্! দর্শিনী আমাকে একেবারেই শেষ না করে থামবে না। কালকে বাগদান হয়ে গেলে বাবাকে বলতে হবে তাড়াতাড়ি বিয়ের ব‍্যবস্থা করতে। দর্শিনীকে এইরূপে দেখার পর একা থাকা অসম্ভব।অসম্ভব মানে আজন্ম অসম্ভব!’

প্রিয়দর্শিনী নিচে নামলে প্রিয়মা বেগম এগিয়ে আসে।মেয়ের জ’লন্ত আগুনের মতো রূপ দেখে প্রিয়মা বেগম চোখের কোণ থেকে কাজল এনে প্রিয়দর্শিনীর কানের পিছনে লাগিয়ে দেয়। বিনিময়ে প্রিয়দর্শিনী মিষ্টি করে হাসে।নিচে সবাই রয়েছে প্রজ্জ্বলিনী ছাড়া।আবিদ এসেছে দেখেই সে নিজের রুমে চলে গেছে। আবিদকে আটকাতে পারছেনা বলে’ই তার যত ক্ষো’ভ। নিচে থাকলে বোনের এমন ভ’য়ংক’র রূপ দেখে নিশ্চয় কোন অসুস্থতার বাহানায় আটকে দিতো। আবিদের উপর ক্ষো’ভে প্রজ্জ্বলিনী নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা। এজন্যই আবিদকে তার স’হ‍্য হয়না। প্রজ্জ্বলিনী বুঝতে পারে আবিদকে যতটা শা’ন্ত দেখায় ততটা সে একদম’ই না। আবিদের ভেতরে যে ভ’য়ংক’র আরেকটি সত্তা রয়েছে। প্রজ্জ্বলিনী সেটা ভালো মতো জানে।

সবাইকে বলে আবিদ প্রিয়দর্শিনীকে নিয়ে বের হয়। ওরা চলে গেলে আশরাফ মুহতাসিম নিশ্চি’ন্ত হয়ে সোফায় শরীর এলিয়ে দেয়। আহমেদ মুহতাসিম বিশ্রাম নিতে নিজের ঘরে চলে যায়। উজানও প্রজ্জ্বলিনীর কাছে রুমে চলে আসে। প্রিয়মা বেগম আহমেদ মুহতাসিমের পাশে বসে চিন্তিত সুরে বলেন,

‘মেয়েটার জন‍্য খুব ভয় হয় আমার। আপনার কী প্রিয়কে ওই বাড়িতে একা পাঠানো উচিত হলো?’

আশরাফ মুহতাসিম মৃদু হেসে বলে উঠলেন,

‘একা কোথায়? আমার মেয়ের হবু জামাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়েছি।
আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীকে যতটা চিনলাম ছেলেটা প্রিয়কে প্রচন্ড ভালোবাসে। ভালোবাসা বলছি কারণ আমি তাঁর যত্ন, ভালোবাসা পরোক্ষ করেছি। এবং আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে জামাই হিসাবে আবিদের জুড়ি মেলা ভার। তার মতো প্রিয়কে কেউ আগলে রাখতে পারবেনা। আমার বাবা একটা কথা বারবার বলেছে জানো?। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীই হবে আমার মেয়ের রক্ষক। আর আমি এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।’

প্রিয়মা বেগম স্বামীর কথায় একটু নিশ্চি’ন্ত হয়। তবুও পুরোপুরি আ’ত্মসন্তু’ষ্টি পেলো না। অথচ মেয়ে তার হবু শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, যেখানে তাকে বিয়ের পর থাকতে হবে। তবুও কেনো জানি মনে ভ’য় হয়। হয়তো জন্মদাত্রী মা বলে। মায়েরা তো সন্তানের জন‍্য চি’ন্তা করবে এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

***

আবিদ দর্শিনীর দিকে একবারো না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে চড়ে বসে। দর্শনী আবিদের এটেনশন পাওয়ার জন‍্য ছটফট করছে। যার জন‍্য এতোকিছু সেই মানুষটা তাকে ঘুরেও দেখলো না। প্রিয়দর্শিনীর অতি আবেগে এখন কান্না পাচ্ছে। আবিদ কেনো এমন করছে?একবারো জিগ্যেস পযর্ন্ত করলো না তাঁর দর্শিনী তাঁকে ছাড়া কেমন আছে। আবিদ কী কালকের ঘটনার ভুল মিনিং বের করল? এজন্যই বুঝি তাঁর দর্শিনীর উপর রেগে আছে? আবিদের গাড়ির হর্ণে প্রিয়দর্শিনীর হুস ফেরে। আবিদ তাকে গাড়িতে উঠে বসার জন‍্যই হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য মানুষটার কী হলো? তাকে আদুরে কন্ঠে গাড়িতে উঠতে বললে’ই পারতো। প্রিয়দর্শিনী গাড়িতে আবিদের পাশে বসে। সে মনে মনে ক’ষ্ট পেলেও আবিদের গমরঙা সু’দর্শন মুখ দেখে মুহুর্তে ক’ষ্ট ভুলে যায়। প্রিয়দর্শিনী আবিদের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছে, একটু কথা বলার আশায়। আবিদ দর্শিনীকে সিট-বেল্ট বাধঁতে বলে। এরমধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আবিদ অত্যন্ত দ’ক্ষতার সঙ্গে গাড়ি ড্রাইভ করছে। অন‍্যদিকে প্রিয়দর্শিনী ঠোঁট ফুলিয়ে নিজের মানুষটাকে দেখতে ব‍্যাস্ত। আজ কতোদিন পর আবিদকে দেখছে। দেখেও যেন শা’ন্তি হচ্ছে না। এতোদিন ফোনে কথা বলার সময় তো মানুষটা খুব স্বাভাবিক ছিল। হুট করে দর্শিনী কি ভুল করলো যে আবিদ এমন রু’ঢ় বিহেভ করছে।

আবিদ নিজেকে যথাসম্ভব ক’ঠোর দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাঁর দর্শিনী এমনটা হতে দিচ্ছে কখন?এইযে প্রেমপূর্ণ দৃ’ষ্টিতে আবিদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে কি জানে তার ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব কতো ক’ষ্ট করে নিজেকে সামলে রেখেছে? দর্শিনীর চোখে অ’শ্রুকণা জমতে শুরু করেছে। কখন বলে গড়িয়ে পড়বে। ভালোবাসার মানুষের থেকে এমন ইগনোর স’হ‍্য হয় না কেনো?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে