প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৫

0
417

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৫)

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আরহাম। আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। হুট করে এতকিছু হয়ে যাবে কেউই ভাবেনি। প্রিয়তার এমন অবস্থা আরহামকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে।

প্রিয়তাকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ডেকেছে প্রহর। কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছে কিছুটা। পা মনে হয় মচকে গেছে। গড়িয়ে পরে যাওয়ার কারণে ব্যথা কম পায়নি তা
বুঝেছে প্রহর। নিধি আর মিসেস নাবিলাকে ডেকে এনেছে প্রিয়তার ঘরে। দুজন দুশ্চিন্তায় হাঁসফাঁস করছে। কয়েকদিন হলো এসেছে। এর মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। এভাবে চললে ছোট্ট আরহামের কি হবে?

ডাক্তার আসল আধঘন্টা পরে। তুলোতে ঔষধ দিয়ে কপালের আশপাশ পরিষ্কার করে দিল। ক্ষত বেশি হলে ব্যান্ডেজ করতে হতো, কিন্তু ক্ষত অত বড় নয় বলে ওয়ানটাইম লাগিয়ে দিল। সাথে দিল চার রকমের বড় বড় ঔষধ। ঔষধের মূল্য পরিশোধ করলো প্রহর। আরহামের কথায় প্রিয়তার কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি তার। সামান্য এই কথায় এত কষ্ট পাওয়ার কি আছে? নাকি সবই ভনিতা? অসহায়ত্বের প্রমান?

প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হলো। চোখ এমনিতেই বন্ধ করে রেখেছিল সে। কেন যেন চোখ খুলতেও প্রচণ্ড অলসতা অনুভব করছিল। চোখ খুলে ঘর ভরতি মানুষ দেখে অবাক হলো প্রিয়তা। পাশের রুমের বয়স্ক আঙ্কেল আন্টি, নিচের ফ্ল্যাটের ভাই-ভাবি, মিসেস নাবিলা সহ অনেকেই উপস্থিত প্রিয়তার ঘরে। সকলের চোখে মুখে চিন্তার রেশ। সকলের সাথে তেমন পরিচয় নেই প্রিয়তার, কথাও হয়নি অনেকের সাথেই। তবুও সবার আগমনে মুচকি হেসে ফেলল প্রিয়তা। মিসেস নাবিলা এগিয়ে এলেন প্রিয়তার কাছে। খাট নেই বিধায় প্রিয়তার পাশে তোষকের উপরেই বসে পড়লেন। প্রিয়তাকে একটু ভালো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” এখন ঠিক আছো? কিভাবে পড়লে বলো তো?

এতটুকু মায়া মিশ্রিত কন্ঠে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। আহ্লাদে গলে যেতে ইচ্ছে হলো। না বলা কথা বলতে ইচ্ছে হলো। প্রিয়তার ঠোঁট ভেঙে কান্না পেল তখনই। আজকাল তার যেন কি হয়েছে। কথায় কথায় ভ্যা ভ্যাঁ করে কান্না করতে ইচ্ছে করে। কেউ বকলে কাঁদতে ইচ্ছে করে আবার কেউ ভালোবাসলেও কাঁদতে ইচ্ছে করে। এত চোখের পানি কবে থেকে হলো প্রিয়তার? কই আগে তো এত দুর্বল ছিল না সে? কেন এত কষ্টের প্রভাব তার হৃদয়ের অলিগলিতে মিশে গেল। এইযে নাবিলা আন্টি এগিয়ে এলো, এইযে একটু দরদ আর সহানুভূতি দেখাল, এতেই প্রিয়তার কান্না পাচ্ছে। সমস্ত ভালোবাসা উগরে দিতে মন চাইছে। এই বেহায়া মনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে প্রিয়তা।

” ঠিক আছি আন্টি।

” দেখেশুনে চলবে না? কত বড় বিপদ হতে পারতো জানো? প্রহর যদি ঠিক সময়ে না দেখতো কি হতো?

” প্রহর?

” হ্যাঁ প্রহর-ই তো আমাদের ডেকে এনেছে। ডাক্তার নিয়ে এসেছে।

” প্রহর কে আন্টি?

” আমার ছেলে প্রহর। পরিচিত হওনি ওর সাথে? একসাথে এলে নামটাও জানলে না?

” আপনার ছেলে তো আজওয়াদ। আজওয়াদ ভাইয়া। আপনার আরো ছেলে আছে?

” হায়রে! আমার একটাই ছেলে। আজওয়াদ আমার ছেলের ভালো নাম। ডাক নাম প্রহর। কর্মক্ষেত্রে সবাই আজওয়াদ বলে ডাকে। আর চেনা সবাই প্রহর বলে।

” ওওউ

” আজকে আর রান্নাবান্না করতে হবে না তোমাকে। আরহাম আর তুমি আমার ঘরেই খাবে।

প্রিয়তা হাসল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর। ছেলেটার মুখে গম্ভীরতা বিদ্যমান। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। আরো সকলেই প্রিয়তার সাথে টুকটাক গল্প করতে ব্যস্ত হলো। সকলের সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল প্রিয়তার। সবাইকে খুব আপন বলে মনে হলো। সাথে দীর্ঘশ্বাস ও ফেলল প্রিয়তা। জীবনটা কেমন অন্যরকম। এই আনন্দ, এই কান্না।

___________________

ল্যাপটপে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়া হয়েছে তানিয়াকে। বিছানায় পা তুলে বসে সেইসব সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে আছে সে। টাইপিং এর খটখট শব্দই শোনা যাচ্ছে অবিরত। সাথে ঝিনঝিন করে বেজে উঠছে তানিয়ার হলদে রেশমি চুড়ি। তানিয়ার সামনেই আধ শোয়া অবস্থায় বসে আছে ইহান। সেও তানিয়াকে তথ্য পেতে সহায়তা করছে। তানিয়া একটু পর পর ঠোঁট নারাচ্ছে, গালে হাত দিয়ে ভাবছে, ঠোঁট কামড়ে চিন্তার অবসান ঘটাচ্ছে। ইহান সবটাই পর্যবেক্ষণ করলো। ঘড়িতে সময় দেখে নিল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল ইহান। তানিয়া চোখ তুলে দেখেও কিছু বললো না। ইহান ঘরে ফিরলো পাক্কা বিশ মিনিট পর। তার হাতে লাল রঙের ছোট বাটি। তানিয়ার সামনে বাটিটা রাখল ইহান। বাটির মধ্যে কাঁটা চামচ রয়েছে। তানিয়া তাকিয়ে দেখল না সেসব। কাজে মশগুল হয়ে আছে বিধায় ইহানকেও খেয়াল করলো না। ইহান আবার আগের জায়গায় বসল। বললো,

” খেয়ে নাও। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আমার বাসায় এলে।

” প্রথম বার তো নয় স্যার। মুচকি হেসে ল্যাপটপে খটখট আওয়াজ করতে করতে কথাটা বললো তানিয়া।

ইহান চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। তানিয়া এইবার ঠিকমতো তাকাল ইহানের দিকে। লোকটাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। মাঝে মাঝে তানিয়ার মনে হয় ইহান মানুষটা পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক। হাফ হাতার জলপাই রঙের গেঞ্জিটাতে অমায়িক লাগছে তাকে। নরম, শান্ত মনে হচ্ছে। অথচ এই লোকটা কতটা গম্ভীর, কতটা বদমেজাজি তা তার সাথে না মিশলে বোঝাই যাবে না। তানিয়ার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। ইহানকে কেমন অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে। অসস্তি নিয়ে সে বলে উঠল,

” খাবো না স্যার। আমি খেয়েই এসেছি।

” আমি নিজে বানিয়ে এনেছি। টেস্ট করে দেখো।

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি অজুহাত দেওয়া উচিত তা বুঝতে পারল না তানিয়া। বাটি থেকে চামচ তুলে চামচের সাথে নুডুলস পেঁচিয়ে মুখে তুলে নিল। নিঃসন্দেহে ইহান স্যারের রান্নার হাত ভালো। বরাবর নিজের রান্না নিজেই করে ইহান। ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখার কাজটাও নিজেই করে। চাইলেই বাড়িতে কাজের লোক রাখতে পারতো ইহান। কিন্তু ভিন্ন চিন্তাভাবনার কারণে এসবে আগ্রহী নয় সে। নিজের সব কাজ নিজেই করতে পছন্দ করে লোকটা।

তানিয়া খেতে আরম্ভ করলো। কিছুটা নুডুলস খাওয়ার পর ইহান বলে উঠলো,

” পুরোটা খেয়ো না। আমার জন্যেও রেখো।

লজ্জা অসস্তি সব দলা পাকিয়ে গেল তানিয়ার। এতটা লজ্জার মুখে পরতে হবে কখনো ভাবেনি মেয়েটা। ভদ্রতা দেখিয়ে সে নিজেই অনেকটা নুডুলস রেখে দিতো। এই ভাবে বলার কি দরকার স্যারের? সে কি সবসময় খাই খাই করে? নাকি সে খেতে চেয়েছে নিজে খেতে? নিজেই বানিয়ে আনলো, আবার কথাও নিজেই শোনাচ্ছে? লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে বসে রইল তানিয়া। ঘন কালো চুলের উপর বিরক্তি দেখিয়ে হাত খোপা করে নিল। দ্রুত অফিশিয়াল কাজগুলো করতে লাগল। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতেই বলে উঠলো,

” আমি বাড়ি যাবো।

” আটকে রেখেছি আমি? যাও

তানিয়া চশমা ঠিক করলো। ব্যাগে কাগজপত্র নিয়ে নিল। বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই দেখল ইহান ও তার সাথেই বের হচ্ছে। ইহান এগিয়ে এলো তানিয়ার পিছু পিছু। সদর দরজার সামনে এলে তানিয়াকে দাঁড় করিয়ে স্ট্যান্ড এ গেল। ওখান থেকে অটো এনে ভাড়া মিটিয়ে তানিয়াকে উঠিয়ে দিল খুব দায়িত্বের সাথে। সবটাই ইহান করলো গাম্ভীর্য বজায় রেখে। তানিয়ার সাথে বাকি আর কথা হলো না। তানিয়া অটোতে উঠে ভদ্রতাসূচক বললো,

” যাই স্যার।

ইহান গাঢ় চোখে তাকিয়ে রইল। দু হাত পকেটে রেখে একধ্যানে তাকিয়ে রইল কয়েকপল। অতঃপর একটু হেসে বললো,

” যাই না, বলো আসি।

তানিয়া চলে গেল। কিছুদূর যেতেই মাথা বের করে পিছু ফিরে ইহানকে দেখল। ইহান যতক্ষণ অটোটাকে দেখা যায় ততক্ষণ দেখেই গেল। আচানক বক্ষপিঞ্জরে কেমন তিক্ততা তৈরী হলো। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হলো। অনেক ভাবনা ভাবতে ইচ্ছে হলো। দ্বিধার এই শহরে দ্বিধাহীন হতে ইচ্ছে করলো। আকাশের পানে চাইল ইহান। মুচকি হেসে গুনগুনিয়ে শান্ত;সুরেলা স্বরে গাইল,

_কোনো যে তোকে পাহারা , পাহারা দিল মন
কেন যে এত সাহারা , সাহারা সারাদিন !
কেন যে তোকে পাইনা পাইনা মনে হয় — সারাটা দিন।

______________________

ফার্স্ট ডে এট টিউশন প্রিয়তার বেশ ভালোই কাটল। কুসুম নামের মেয়েটা এই বয়সেই বেশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। প্রিয়তা যাওয়ার সাথে সাথেই বেশ আয়োজন করে আতিথেয়তা করেছে। অতঃপর নিজেই বই খুলে যা যা পড়তে পারে না বা বোঝেনি তাই তাই প্রিয়তার সম্মুখে এগিয়ে দিয়েছে। কুসুমের একটা ছোট বোন ও আছে। মেয়েটার নাম কোয়েল। ভারী মিষ্টি ওই ছোট মেয়েটা। যতটা সময় ছিল ততটা সময়ই প্রিয়তার সাথে গল্পে মশগুল হয়ে ছিল। কুসুমের মা গার্মেন্টসে কাজ করে। কুসুমের বাবা ছোটখাটো একটা চাকরি করে। বাড়িতে এই দু বোনই থাকে। সকালে নাকি কুসুমের মা রান্না করে রেখে যায়। দুবোন একসাথে খায় আর পড়াশোনা করে। বিকেলে মাঠে বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করে, ঘুরে বেড়ায়। এসবই তাদের নিত্যদিনের রুটিং।

প্রিয়তার শরীর ভালো নেই। ব্যথায় রাতে সামান্য জ্বর এসেছিল। মুখে রুচি নেই। মাথায় ক্ষত স্থানের ব্যথাটা এখনো রয়েছেই। পা এক বিশেষ পদ্ধতিতে ঠিক করে নিয়েছে প্রিয়তা। একবার ওর বান্ধবী নয়নার এভাবে পা মচকে গিয়েছিল। সেসময় নয়নার স্বামী নয়নার পা ধরে বাঁকিয়ে দিয়েছিল। সাথে সাথেই নয়নার পা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। প্রিয়তা অতটা ধৈর্যশীল কিংবা সহ্য ক্ষমতাবান নয় তবে নিজের খেয়াল তাকে নিজেকেই রাখতে হচ্ছে। ব্যথা নিয়েও পা সোজা করেছে সে। যে দিকটি মচকেছে তার বিপরীত দিকে জোরে চাপ প্রয়োগ করে সোজা করেছে পা। গুগোল থেকে ধারণা নিয়েছে এ বিষয়ে। এরপর ব্যথার কারণে কেঁদেছে অনেকটা সময় ধরে। পায়ে তেল মালিশ করে দিয়েছে আরহাম। নরম,কচি হাতে বোনের সেবা করেছে ছেলেটা।

প্রিয়তা যখন কুসুমদের বাড়ি থেকে বের হলো তখন বিকেল হয়ে আসছে। আকাশ অতিরিক্ত মেঘলা। বৃষ্টি পরবে বোঝা যাচ্ছে। প্রিয়তা কুসুমদের বাড়ি ছেড়ে ব্যাচ পড়ানোর উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টারে গেল। রায়হান স্যার ওখানে যেতে বলেছে প্রিয়তাকে। কোচিং সেন্টারে একটা ব্যাচ পড়াতে হবে প্রিয়তার। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা পাবে। শরীর ক্লান্ত, অবসন্ন থাকলেও প্রিয়তা সঠিক সময়ে কোচিং সেন্টারে পৌঁছাল। প্রথম দিনই দেরি করা যাবে না। আরহামকে নিধির সাথে রেখে এসেছে সে। নিধিকে বলে এসেছে আরহামকে একটু পর পর ঘরে এসে দেখে গেলেই হবে। কিন্তু প্রিয়তা জানে নিধি তা করবে না। আরহামকে মেয়েটা নিজের কাছেই রাখবে সর্বক্ষণ। নাবিলা আন্টি বারবার টিউশনিতে আসতে না করেছিলেন প্রিয়তাকে। কিন্তু কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে বড্ড খারাপ লাগতো প্রিয়তার। প্রথম দিনই এভাবে অজুহাত দিয়ে ঘরে বসে থাকা উচিত নয়। প্রিয়তার জন্যে এই অজুহাত দেওয়া আরো নিষেধ। তার নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ঘর ভাড়া, খাওয়া-পরার খরচ মেটাতে হবে। কয়েকদিন পর আরহামকে ভর্তি করতে হবে স্কুলে। তখন খরচ আরো বাড়বে। এই কয় টাকায় কি হবে ভেবেই দুশ্চিন্তায় মাথা ভার লাগল প্রিয়তার। আঘাতের স্থানগুলোতে কেমন চিনচিন শীতল ব্যথা বয়ে গেল।

ব্যাচ পড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে নেমেছে। ক্ষুধায় পেটের ভিতের থেকে উদ্ভট শব্দ বের হচ্ছে। পথে ভেবেছিল কিছু একটা কিনে খাবে। কিন্তু নিজের জন্য কিছু কেনার টাকা দিয়ে আরহামকে মজা কিনে দেওয়া যাবে ভেবে পানি খেয়েই পেট ভরিয়েছে প্রিয়তা। ও বাড়িতে কুসুম তাকে বিস্কিট খেতে দিয়েছিল। কিন্তু কোয়েল পাশে বসে থাকায় কিছুটা নিজে খেয়ে বাকিটা কোয়েলকে খাইয়ে দিয়েছে।

বাড়ি ফিরে আরহামকে পেল না ঘরে। প্রিয়তা আশাও করেছিল আরহামকে ঘরে পাবে না। আন্দাজ ঠিক হয়েছে। আরহাম বোধহয় বাড়িওয়ালী আন্টির ঘরেই আছে।
প্রিয়তা বাইরের জামাকাপড় রেখে সুতির ফ্রক পড়ল। বেঁধে রাখা ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে নিল। সকালে ডাল রান্না করেছিল। আরহাম ডাল দিয়ে চটকে ভাত মেখে দিলে ভালোই খায়। ফ্রিজ নেই বলে ডাল টক হবার ভয় থাকে। প্রিয়তা চটপট ডাল গরম করে নিল। পাতিলে থাকা নিচের অংশের ভাত কিছুটা পানি পানি হয়ে গেছে। ডাল দিয়ে খেলে আর খারাপ লাগবে না। প্রিয়তা একটু জীবন নিয়ে ভাবল। আরহামকে স্কুলে ভর্তি করাতে টাকা লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা আরহামের চাহিদাগুলো কিভাবে মেটাবে? আগামীকাল বাড়িওয়ালীর ননদের ছেলের এনগেইজমেন্ট। কাল জামা কেনার বায়না না করলেও পরেরদিন বিয়েতে পরার জন্য এটা ওটা আবদার করে বসবে। মুখের উপর না করার সাধ্য নেই প্রিয়তার। অপর দিকে জমানো টাকা দিয়ে পুরো একমাস চলতে হবে।

ডাল গরম করে প্রিয়তা মিসেস নাবিলার ফ্ল্যাটে যেতে উদ্যত হলো। দরজা খোলা ছিল বলে আর অনুমতি নিল না। তবে ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারল ভুল সময়ে এসেছে এখানে। বাড়ি ভরতি মানুষের সমাগম। প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ড্রয়িংরুম। একজন ব্যক্তি মই-য়ে উঠে দেওয়াল রং করছে। আরেকজন লোক অপর পাশের দেওয়ালে সুন্দর করে ফুল আঁকছেন। সবটা দেখিয়ে দিচ্ছে দু-তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। প্রিয়তা ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিধির ঘরে গেল। দরজা খানিক ভিড়িয়ে রাখা। প্রিয়তা হাতের উল্টোপিট দিয়ে দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে নিধি বললো,

” কে? ভিতরে আসো।

প্রিয়তা ওড়না ঠিক করে নিল। মাথা নিচু করে রইল। অসস্তিতে মরিমরি অবস্থা মেয়েটার। প্রিয়তার একটা নিজস্ব জগত ছিল। সেই জগতে আরহাম, তন্ময় আর দু একজন মানুষের বসবাস ছিল। এই মানুষ জন ব্যতিত অন্য কারো সাথে সেইভাবে মেলামেশা করা হয়নি প্রিয়তার। কলেজেও তেমন বন্ধু ছিল না তার। যারা ছিল তারা শুধু কলেজে গেলেই কুশল বিনিময় করতো,ব্যস। প্রিয়তা রেগে গেলে যার তার সাথে কথা বলতে ইসস্ত বোধ করে না কখনো। নরম স্বভাবের মেয়েরা সহজে রাগে না। আবার রেগে গেলে সেই রাগ ঝেরে ফেলা মুশকিল হয়ে পরে। নরম মেয়েরা কঠিন ভাবে রাগে, আর সেই রাগ কমাতে ঝক্কি পোহাতে হয়। প্রিয়তাও তেমন ধরনের মেয়ে। সহজে রাগে না কিন্তু রেগে গেলে আর হুশ থাকে না। এখন নিধির ঘরে কয়েকটি কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধা কাজ করছে প্রিয়তার। দরজা মেলল প্রিয়তা। একটা অপরিচিত মেয়ের কোলে বসে আছে আরহাম। মুচকি হাসল সে। নিধির উদ্দেশে বললো,

” আরহামকে দাও, নিয়ে যাই।

আরহাম প্রিয়তাকে দেখে হাসল। আরহামের পাশে একটা কাঁচের প্লেটে ফলমূল রাখা। সেখান থেকে একটা আপেলের টুকরো টুপ করে মুখে দিল আরহাম। বললো,

” আপু দেখো বিয়েতে কত্ত মজা হয়। সবাই কত্ত ভালো। তুমিও আসো না।

প্রিয়তা ভালো করে ঘরে চোখ বুলাল। নিধির আর প্রিয়তার বয়সী চারটা মেয়ে বিছানায় বসে আছে ফোন নিয়ে। সকলের গায়ে সুন্দর, আকর্ষণীয় পোশাক,। সাজসাজ ব্যাপার রয়েছে সকলের মাঝে। নিধি প্রিয়তাকে দেখে খুশি হলো। বিছানা থেকে উঠে প্রিয়তাকে ঘরে টেনে আনল। সকলের উদ্দেশে বললো,

” এই যে, এর কথাই বলছিলাম। এটাই প্রিয়া আপু। আরহামের বড় বোন।

প্রিয়তা সালাম দিল। নিধি পরিচয় করিয়ে দিল সবার সাথে। এরা নিধির কাজিন। নাবিলা আন্টির বড় বোনের মেয়ে দিশা আর পায়েল। ছোট বোনের এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুজনের নাম রায়ান আর মেঘনা। মিসেস নাবিলা ভাই বোনদের মধ্যে মেজো। অপরদিকে নিধির বাবারা এক ভাই দুই বোন। পিয়াস করিম সবার বড়। তার মেজো বোনের ছেলে-মেয়ে তানিশা, সাহিল। আর প্রহরের ছোট ফুপির একমাত্র ছেলে তিয়াশ। ড্রয়িংরুমে বাড়ির ছেলেরা সাহিল, তিয়াশ, রায়ান টুকটাক কাজ করছে। সবাইকে কাজকর্মদেখিয়ে দিচ্ছে। নিধির সাথে বসে আছে নিধির খালাতো, ফুপাতো বোন। সবাই একসাথে হয়ে আড্ডা জমিয়েছে দুপুর থেকে। এদের মধ্যে দিশা মেয়েটা বোনদের মধ্যে বড়। প্রিয়তাকে দেখে মিষ্টি হাসল সে। ফোনটা বিছানায় রেখে এগিয়ে আসল প্রিয়তার দিকে। বিস্ময় দৃষ্টি মেলে বললো,

” ও মাই গড! তুমি তো একদম পুতুলের মতো দেখতে। আরহামের মতোই কিউট। মনে হচ্ছে জীবন্ত পুতুল দেখছি।

প্রিয়তা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। রক্তিম হলো গাল। ওষ্ঠদ্বয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। মুচকি হেসে বললো,

” আপনারাও ভিষণ সুন্দর।

দিশার এমন কণ্ঠে ভ্রু কুচকে ফেলল মেঘনা। হেসে বললো,

” ও কি আমাদের মতো অলস নাকি? নিশ্চয় ক্রিমটিম মাখে, ফেসিয়াল করে। সুন্দর হবে না?

প্রিয়তা কি বলবে এখন? বলবে সে এসব কিছুই মাখে না? সৌন্দর্য নিয়ে কখনো ভাবেইনি সে? কথাটা বলা কি ঠিক হবে? সকলে ভাববে প্রিয়তা গর্ব করে বলছে এসব। কিংবা বিশ্বাস না ও করতে পারে। বিষয়টা অন্যরকম হবে। অনেকের মনে অনেক ভাবনা আসবে। প্রিয়তার এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। যে যা ভাবে ভাবুক। সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে তর্ক করা এক ধরনের অন্যায়। তার গায়ের রং ফর্সা। অনেকে ভাবতেই পারে এই সৌন্দর্য প্রসাধনীর কামাল। তাতে কি যায় আসে?

প্রিয়তা চুপ করে রইল। আরহামকে বললো,

” সন্ধ্যে হয়েছে অনেকক্ষণ। ঘরে আসোনি কেন? চলো যাই। ভাত খাবে।

আরহামের মুখ মলিন হয়ে এলো। এত মানুষের সাথে সে আগে কখনো মেশেনি। সবার এমন সুন্দর ব্যবহার দেখে ছেলেটা যে ব্যাপক খুশি হয়েছে তা ছেলেটার চঞ্চলতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তা আরহামকে বোঝালো সকালেই আঙটি বদল হবে। আর তখন দু ভাইবোনই আসবে। এখন বাড়িতে যারা রয়েছে তারা সকলে বাড়িরই লোক। বিয়ে আর গায়ে হলুদে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে সব ভারাটিয়াদের। আপাতত তারা মেহমান নয়। আরহাম আর প্রিয়তাকে বিশেষ ভাবে এনগেইজমেন্টেও দাওয়াত দিয়েছে নাবিলা আন্টি। কিন্তু এখনই ঘনঘন সে বসে থাকা নেহাতই অভদ্রতা।

প্রিয়তা ঘর থেকে বের হতেই মিসেস নাবিলার সাথে দেখা হলো তার। মিসেস নাবিলা দুজনকে দেখে হাসলেন। বললেন,

” টিউশন করিয়ে ফিরতে সন্ধ্যে হলো? এত ঝামেলা নিচ্ছো কেন? তোমার বাবা-মা টাকা পাঠাবে না?

এই প্রশ্নটা আগে কেন মাথায় আসেনি প্রিয়তার? সত্যিই তো! বাবা-মা যদি বিদেশ থাকে তাহলে যতই মেয়ে অবাধ্য হোক টাকা পাঠাবেই। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অবশ্যই পিতামাতার চিন্তা থাকবে। ওরা কি খাবে, কি পরবে এ নিয়ে ভাবনা থাকবে। প্রিয়তা এত কষ্ট করছে কেন এ নিয়ে প্রশ্ন তো সবাই তুলবেই। এত মিতব্যয়ী কেন তাতো জানতে চাইবে।

প্রিয়তা ভাবল সবটা আন্টিকে বলে দিতে। আরহামের সামনে এসব বলা উচিত হবে না। আরহামকে তাই ততক্ষণাৎ ঘরে পাঠিয়ে দিল প্রিয়তা। শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নিল জিভ দ্বারা। খুব ভেবে কিছু বলতে উদ্যত হতেই নাবিলা আন্টির ডাক পরলো। তড়িঘড়ি করে মিসেস নাবিলা রান্নাঘরে চলে গেলেন। প্রিয়তা সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। বুক থেকে ভারী বোঝা নেমে গেল মনে হলো। বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে প্রিয়তার। বুকে হাত দিয়ে শান্তিতে চোখ বুজল সে। আরেকটু হলেই আন্টি সব জেনে যেতেন। কেমন রিয়্যাক্ট করতেন তিনি? বাড়ি থেকে বের করে দিতেন? আরহামকে ঘরে পাঠিয়েছে মনে হলে বাড়ি ছাড়তে চাইল প্রিয়তা। কিন্তু বের হওয়া আর হলো না তার। পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠে ” এই মেয়ে” বলে ডেকে উঠল কেউ। প্রিয়তা থমকাল। পেছন ফিরে লোকটাকে দেখল। অপরিচিত ছেলের ডাক শুনে কপালে ভাঁজ পড়ল প্রিয়তার। দ্বিধা নিয়ে বললো,

” আমায় ডাকছেন?

” হ্যাঁ তোমাকেই। আগে পরিচিত হই দাঁড়াও।
ছেলেটি এগিয়ে এলো প্রিয়টার নিকট। পুনরায় বলে উঠলো,

” আমি সাহিল। ছেলেপক্ষের লোক। ছেলে আমার কাজিন হয়। তুমি বুঝি নাবিলা আন্টির বোনের মেয়ে? তাই-ই হবে। এছাড়া তো আর কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি।

প্রিয়তা থতমত খেল। কিছু বলার আগেই সাহিল সোফায় গিয়ে বসল। হেসে বলে উঠল,

” তোমার নাম পরে শুনবো। এখানে এসে বসো তো। এই বাড়ির সবগুলো মেয়ে অলস। কাজ করার ভয়ে ঘরে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। পরশু বিয়ে, অথচ কনে-কে লাগেজ ভরে কি কি পাঠাতে হবে এ নিয়ে কারো কোন চিন্তাই নেই। প্রহর ভাই তো চোর বাটপারদের ধরা ছাড়া আর কিছুতেই নেই। মেয়েদের সাজগোজে কি কি লাগে আমি কি করে বুঝবো? তুমি তো মেয়েই। সাজগোজের কি লাগবে আমায় বলো তো। আমি লিখে নেই ঝটপট।

প্রিয়তা অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। লোকটা না জেনে না শুনে একজনকে আদেশ করছে এভাবে? প্রিয়তা উচ্চবিত্ত পরিবারের হলেও সাজগোজে কখনো মন বসেনি তার। সবসময় শুনে এসেছে না সাজলেই প্রিয়তাকে বেশি সুন্দর লাগে। সাজলে প্রিয়তাকে মানায় না, বরং দেখতে অদ্ভুত লাগে। যেজন্য সাজগোজ থেকে দূরে থাকে প্রিয়তা। বলতে গেলে খুব একটা প্রয়োজন না পরলে সাজে না সে। ব্যাসিক ধারণা থাকলেও বিয়েতে সাজগোজের কি কি দিতে হয় এ নিয়ে ধারণা নেই প্রিয়তার। বিয়ের কনেকে পায়ের নখ সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে চুলের ফিতা অবধি কিনে পাঠিয়ে দিতে হয়। সবকিছুর নাম জানা নেই প্রিয়তার। কি একটা ফ্যাসাদে পরে গেল সে।

প্রিয়তা বোকা হাসল দাঁত কেলিয়ে। চোখের পলক ফেলল কয়েকবার। বললো,

” আমার এ বিষয়ে ধারণা নেই ভাইয়া। অন্য কাউকে খুঁজুন প্লিজ।

সাহিল ঠোঁট বাঁকিয়ে ত্যাছড়া হাসল। মিনমিন স্বরে বললো,

” ভয় পাচ্ছো? তোমার রুপের রহস্য জেনে যাবো ভাবছো? আমি জানি মেয়েরা রূপের রহস্য মরে গেলেও বলতে চায় না। ধারণা নেই বলে তুমি বোঝাতে চাইছো তুমি মেকআপ-টেকআপ ইউস করো না। রাইট? বুঝে গেছি। আরেহ বলে ফেলো। ফাউন্ডেশন আর কি কি যেন লাগে?

প্রিয়তা হা হয়ে থাকিয়ে রইল । লোকটার মাথা নষ্ট নাকি? কি সব আবোল তাবোল বলছে? রূপের রহস্য আবার কি? আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজের পছন্দে। এখানে রহস্য এলো কোথা থেকে? সব মেয়েই কি মেকআপ করে নাকি? আশ্চর্য। কতজনকে এমন দেখেছে লোকটা?

প্রিয়তা একটু রেগে গেল। বললো,

” পাবনার পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছেন তাইনা? চিল! আমি নিজ খরচে আপনাকে পাঠিয়ে দিবো।

চলবে?
লেখনীতে:#বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে