প্রিয়তার প্রহর পর্ব-১৮

0
471

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (১৮)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তা আর মিসেস নাবিলা দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। প্রিয়তার আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। সে জানতে চায় মিসেস নাবিলা তাকে কী বলতে চান? কেন কথাটা এত জরুরী?

মিসেস নাবিলা আমতা আমতা করছেন। বলবে বলবে করেও বলছেন না। প্রিয়তা ভারী শ্বাস ফেলল। শান্ত স্বরে বললো,

” আপনি আমাকে কি বলে চান বলে ফেলুন। আমার সামনে আপনি এমন অসস্তি বোধ করবেন না, এমন আমতা আমতা করবেন না। আমি এসবে লজ্জা পাই। আমার মনে হয় আমি আপনাকে কম্ফোর্ট দিতে পারছি না। সেজন্য আপনি দ্বিধা বোধ করছেন।

মিসেস নাবিলা প্রিয়তার কথা শুনলেন মনোযোগ দিয়ে। বললেন,

” আগামীকাল প্রহরের বাবা আসবে। ছেলে এত বড় একটা কেস সলভড করেছে ভেবে মানুষটা খুব আনন্দিত। আগামীকাল প্রহর আর ওর টিমকে সম্মাননা প্রদান করা হবে। সেখানে প্রহরের বাবা থাকতে চায় বলেই আসছে। আমার ছেলেকে আমি ভালোমতোই চিনি প্রিয়তা। ছেলেটা কখনো কোনো মেয়ের সাথে মেশে নি । আঠাশ বছরের জীবনে তুমি আর তানিয়া ছাড়া আর কারো সাথেই এত পরিচিত হয়নি প্রহর। তানিয়াকে নিয়ে আমার ভাবনা নেই। প্রহর মেয়েটাকে শুধু বন্ধুই ভাবে। কিন্তু তোমার প্রতি ওর ভাবনাচিন্তা ভিন্ন হতে পারে।

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। এইসব কি বলছেন আন্টি? কি বোঝাতে চাইছেন? প্রহরের সাথে তার পরিচয়টা অন্যভাবেই হয়েছিল। এত এত ঘটনা ঘটার পর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া স্বাভাবিক। হ্যাঁ মাঝে মাঝে প্রহরকে নিয়ে অন্য রকম চিন্তা আসে প্রিয়তার মাথায়। তাই বলে এতটা তো নিজেও কখনো ভাবেনি সে। প্রহরের আচার-আচরণেও কখনো সেরকম কিছু খুঁজে পায়নি প্রিয়তা। তাহলে কিসের ভিত্তিতে নাবিলা আন্টি এসব বলতে এসেছেন? ভাবতে বসলো প্রিয়তা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

” কি বলতে চাইছেন আন্টি?

” প্রহরের বাবা প্রহরের জন্য একটি মেয়েকে ঠিক করে রেখেছে। ওর বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে। ইংল্যান্ডে একসাথে বিজনেস করে প্রহরের বাবা আর লিরার বাবা। এবার দেশে আসার সময় মেয়েটাকে নিয়ে আসবে ও। বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেই আসছে। আমার ভয় হয়। প্রহরের যদি তোমার প্রতি কোনো অনুভূতি থাকে..

” আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন আন্টি। তেমন কিছুই নেই আমাদের মাঝে। আপনার চিন্তা করা বৃথা।

” কিন্তু হতে কতক্ষণ বলো? তোমাদের মাঝে সম্পর্ক হলেও আমার সমস্যা ছিল না। পিয়াস মানে প্রহরের বাবা কখনো এই সম্পর্ক মানবে না। আমার কেন যেন ভয় করছে। প্রহরের হাবভাব আমার ঠিক ঠেকছে না।

” আমি এখন কি করতে পারি? আমায় এসব বলার নিশ্চয় কারণ রয়েছে। কি সেই কারণ?

” সামনের মাসেই চলে যেও এ বাড়ি থেকে। আমি ভালো একটা বাসা ঠিক করে দিবো। আরহামকে আর তোমাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। ভবিষ্যতে যদি তোমাদের কোনরুপ সম্পর্ক হয়? তোমার কষ্ট পাও তা আমি চাই না।

” ঘর আমি নিজেই খুঁজে নিবো আন্টি। আপনি ভাববেন না। সামনের মাসেই আমরা চলে যাবো। এ কটা দিন থাকতে দিন আমাদেয। কেননা এই সময় তো কেউ ঘর ভাড়া দেয় না।

_________

আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠল প্রিয়তা। ভাত বসিয়ে চিংড়ি দিয়ে লাউয়ের তরকারি রান্না করল। আরহাম এই তরকারিটা খেতে পছন্দ করে। বেতন পেয়ে ছোট ছোট চিংড়ি মাছ এনেছিল সে। তন্ময়ের রুমমেট এই রান্নাটা প্রিয়তাকে বলে দিয়েছিল। বাইরে প্রচণ্ড কুয়াশা পরেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। শীত এখন অতটা নেই। আকাশে রোদের ছিটেফোঁটাও নেই। অন্ধকার অন্ধকার লাগছে পৃথিবীকে। প্রিয়তা রান্না করে পড়তে বসলো। সামনে বার্ষিক পরিক্ষা। টিচাররা প্রত্যেকবারের মতো এবারও প্রিয়তার ভালো রেজাল্ট আশা করছে। তারা তো জানে না প্রিয়তার পরিস্থিতি।

প্রিয়তা হেঁটে হেঁটে পড়তে লাগল। আরহামের ঘুম কাটল প্রিয়তার কণ্ঠ শুনে। গুনগুন করে পড়ছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে খাতায় লিখছে। আরহাম ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে খেতে বসল। প্রিয়তা খাবারটুকু বেড়ে দিয়ে আবার ও পড়তে লাগল। ফোনের রিংটোন বেজে উঠল প্রিয়তার। আননোং নাম্বারটা দেখে প্রিয়তা ফোনটা ধরল। সালাম দিল প্রথমেই বললো,

” কে বলছেন?

ওপাশের নারী কণ্ঠে মিষ্টি হেসে তানিয়া বলে উঠলো,

” আমি তানিয়া বলছি। চিনেছো?

” আপনি? কেমন আছেন? আমাকে ফোন দিলেন হঠাৎ? কিছু হয়েছে আপু?

তানিয়ার হাসির শব্দ শোনা গেল। শান্ত হয়ে তানিয়া বললো,

” আমি খুউউব ভালো আছি। তুমি আমাদের বাসায় আসবে প্রিয়তা? আরহামকে নিয়ে আসবে একটু?

অবাক হলো প্রিয়তা। তানিয়া ডাকছে কেন তাকে? বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো সে। সাবলীল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠল,

” আমি আপনাদের বাসায়? কেন আপু?

” আমার বাবার আজ বিয়ে। আমি চাইছি বাড়িটাকে সাজাতে। একটু খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে। ইহান আর প্রহর স্যার ও আসবে। আমি চাই তুমিও আসো। আরহাম খুব খুশি হবে। এসো না প্লিজ।

” না আপু, আপনারা আনন্দ করুন। আমার সামনে পরিক্ষা। বাসায় বসে প্রিপারেশন নিচ্ছি। আঙ্কেলের জন্য আমার শুভ কামনা থাকবে।

” শোনো, তুমি যদি না আসো আর কখনো তোমার সাথে কথা বলবো না। আমি তোমার বড় হই। বড়দের কথা শোনো। এক্ষুণি চলে আসবে আরহামকে নিয়ে। নইলে আমি রাগ করবো প্রিয়তা। আমার এমন একটা সুখের দিনে তোমাকে রাখতে চাইছি। আসবে প্লিজ। কিচ্ছু শুনতে চাই না।

কল কেটে দিল তানিয়া। দ্বিধায় নড়েচড়ে বসল প্রিয়তা। তানিয়ার সাথে তার সম্পর্ক অত মজবুত নয়। দেখা হলে কুশল বিনিময় ব্যতিত তেমন কোনো কথাও হয়নি। প্রহরের মুখে তানিয়ার বাবার বিয়ের সম্পর্কে একটু-আধটু শুনেছে প্রিয়তা। সেই বিয়েতে প্রিয়তাকে নিমন্ত্রণ জানানো হবে কখনো ভাবেনি সে। প্রিয়তা বসে পরল মেঝেতে বিছিয়ে রাখা বিছানায়। আরহাম ভাত মাখাতে মাখাতে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ছেলেটার গালে ঝোল লেগে আছে। তানিয়ার সাথে প্রিয়তার কথোপকথন শুনেছে আরহাম। ভাতের লোকমাটুকু মুখে নিয়ে ছেলেটা বলে উঠল,

” তানিয়া আপু আমাদের যেতে বলেছে আপু? চলো না যাই। আমাকে তোমার আগে দাওয়াত দিয়েছে। আমি বলেছি তোমাকে জানাতে। তোমার সাথে যাবো বলেছি।

প্রিয়তা কিছু বললো না। আরো কিছুক্ষণ পড়ে বইখাতা সব গুছিয়ে রাখল। তানিয়া ই-মেইলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। মেসেজ করে পুনরায় অনুরোধ করেছে। প্রিয়তা শান্ত ভঙ্গিতে আরহামের কাছে আসল। ভাইকে জড়িয়ে ধরলো বক্ষপিঞ্জরে। চুমু খেল অনবরত। আগলে নিলো বাহুডোরে। বললো,

” তুমি যাবে?

আরহাম খুশি হলো। উৎফুল্ল দেখাল তাকে। সন্দেহ নিয়ে বললো,

” তুমি যাবে?

আরহামের প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠল প্রিয়তা। আরহামের নরম, মশ্রীন গাল টেনে দিল। লাগেজ থেকে পার্পল কালারের একটি শার্ট বের করল। ফুল প্যান্ট পড়িয়ে শার্টের সাথে ইন করে দিল। নিজেও ম্যাচিং করে পার্পল রঙের ফ্রক পরল প্রিয়তা। হাতে চুরি পরল শখ করে। চোখে গাঢ় করে কাজল পরল। লিপবামের কারণে চিকচিক করে উঠল প্রিয়তার ওষ্ঠদ্বয়। সাদা পাথরের একটি নোজ পিন পরে নিল সে। মাথার সামনের কয়েকটি চুল নিয়ে ঢিলাঢালা ছোট্ট খোঁপা বেঁধে নিল। পেছনের চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে নিজেদের আয়নায় দেখল প্রিয়তা। আজ কতগুলো দিন পর এইভাবে সাজল প্রিয়তা। হুট করেই জীবনের রঙ গুলো কেমন গায়েব হয়ে গেল প্রিয়তার। সমাজের শত শত বাঁধার মধ্যে আটকে গেল মুহুর্তেই। আর নিজেকে রাঙাতে ইচ্ছে হলো না তার। আর নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পেল না প্রিয়তা। এখন এই সাজগোজ কেমন বিলাসীতা লাগে। ঘরে চাল কিনতে গিয়ে যে অবস্থা হয় তারপরে সাজগোজ করলে মানুষ তাকে কি বলবে?

প্রিয়তা ফোনটা নিয়ে আরহামকে সাথে করে বের হলো। বাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় ওঠার সময় প্রহরের মুখোমুখি হলো প্রিয়তা। প্রিয়তাকে দেখে দাঁড়াল প্রহর। সে এখন তানিয়ার বাড়িতেই যাচ্ছে। প্রিয়তাকে দেখে প্রহর থামল। মেয়েটাকে আজ অমায়িক লাগছে। অগোছালো থেকে বেরিয়ে এসে আজ প্রিয়তাকে অন্যরকম লাগছে। দু ভাইবোনকে পার্পল রঙে বেশ মানাচ্ছে। প্রহর আড়চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। চোখ বারবার মেয়েটাতে নিবদ্ধ হলো। ক্ষণিকের জন্য পৃথিবীর সমস্ত অলিগলি ভুলে যেতে চাইল। প্রহরের ধ্যান ভাঙল। হাসল সে। এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে। বললো,

” আপনি তানিয়ার বাসায় যাচ্ছেন?

প্রিয়তার গতকাল রাতে মিসেস নাবিলার বলা কথা মনে পরল। বিষাদে ছেয়ে গেল প্রিয়তার হৃদয়। কান্না পেল খুব। সামনের মানুষটার প্রতি ভিষণ রাগ হলো প্রিয়তার। তার জন্যই তো এতকিছু। কেন এখানে তাকে এনেছিল পুলিশম্যান? কোনো কথা না বলে শক্ত হয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে অটত স্যান্ডের দিকে পা বাড়াল প্রিয়তা। প্রিয়তার এহেন আচরণে অবাক হলো প্রহর। ডাকল পেছন থেকে। জিজ্ঞেস করলো,

” উত্তর দিলেন না।

প্রিয়তা দাঁড়াল না। হেঁটে যেতে যেতে গম্ভীর কণ্ঠেই উত্তর দিল,

” ওখানেই যাচ্ছি। আপনাকে বলতে যাবো কেন কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি? আপনি জিজ্ঞেস করছেন কেন?

প্রহরের বিস্ময় ধরতে পারল প্রিয়তা। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। প্রহর বলে উঠল,

” এভাবে কথা বলছেন কেন প্রিয়তা?

প্রিয়তা এবার থামল। পিছু ফিরে প্রহরকে পরখ করলো। দম ফেলল ভালো করে। স্বাভাবিক হয়ে বললো,

” কিভাবে কথা বলছি?

” ইগনোর কেন করতে চাইছেন?

” আমি আপনাকে ইগনোর করবো কেন? আর করলেও সমস্যা কোথায়?

” এই মুহর্তে আপনি বা আরহাম সেইভ না। বাড়িতে থাকলে ভালো হতো। তখন কি হয় বলা যায় না। আপনি চলুন আমার সাথে, আমিও তো তানিয়ার বাসায় যাচ্ছি। একসাথেই চলুন।

প্রিয়তার রাগ হলো। দ্রুত পায়ে প্রহরের নিকট এলো সে। চোখ দিয়ে ভষ্ম করে দিতে চাইল প্রহরকে। ওষ্ঠদ্বয় কামড়ে ধরল দাঁত দিয়ে। জিভ দ্বারা ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিল। প্রহরের চোখে চোখ রেখে তেজী স্বরে বললো,

” আর কত করুণা করবেন আমাদের? এভাবে আর কতদিন নিরাপত্তা দেবেন? এইবার এই করুণা করা বন্ধ করুন।

” আমি আপনাকে করুণা করছি? প্রিয়তার এহেন আচরণ স্বাভাবিক ঠেকছে না প্রহরের। প্রিয়তাকে কেমন অচেনা লাগছে তার। প্রচণ্ড উন্মাদনা নিয়ে প্রহর জিজ্ঞেস করল,

” করছেন না বলছেন? দৃঢ় জবাব প্রিয়তার।

” আমি আপনাদের ভালোবাসি প্রিয়তা। এজন্যে এত বার সাবধান করছি। পুলিশ হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। এখানে করুণা কোথা থেকে এলো?

” ভালোবাসেন? হাহ! আমরা আপনার জন্য দায়। শুধু আর শুধু মাত্র দায়। আর কিচ্ছু না। ঠিকই।

” এমন করছেন কেন প্রিয়তা? কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন? হঠাৎ কি হলো আপনার?

প্রিয়তা ভড়কাল, থতমত খেল। দিক দিশা বুঝে উঠল। সত্যিই তো! সে এমন টিনেজারদের মতো আচরণ করছে কেন? কেন এভাবে অনর্থক যা তা বলে যাচ্ছে? কেন নিজের চাহিদা প্রকাশ করছে? এগুলো কতন ধরনের পাগলামী? কি ভাববে এই পুলিশ? আর প্রিয়তার কেন মানতে কষ্ট হচ্ছে প্রহর যা করছে সবটাই দায়ের কারণে? কেন এত যন্ত্রণা হচ্ছে? কেন শুনতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তা করুণার পাত্রী নয়? তবে কি প্রহরের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি সজাগ হচ্ছে প্রিয়তার? দুর্বল হচ্ছে এই সৎ পুলিশ অফিসারের ব্যক্তিত্বে? আটকে যাচ্ছে মোহতে?

প্রিয়তা দুরত্ব বাড়াল। নিজেকে স্বাভাবিক করলো ততক্ষণাৎ। বললো,

” সরি সরি, আমার মাথা আসলে ঠিক নেই। জানি না কি বলেছি। সরি!

প্রিয়তা দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চাইল। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। হারিয়ে যাচ্ছে অতল গভীরে। প্রহরকে খুব কাছের ভাবতে ইচ্ছে করছে। এটা তো সম্ভব নয়। সমাজ মেনে নিবে না। প্রহরের বাবা মানবে না। এটা তো হতে পারে না। তবুও কেন প্রহরের পাশাপাশি থাকতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার? মন অন্য কিছু ভাবতে চাইছে কেন? প্রিয়তা আড়াল করতে চাইল নিজেকে। পা চালাল হন্তদন্ত হয়ে। পেছন থেকে প্রহর বলে উঠল,

“তুমি কি চাও দায় এড়িয়ে তোমাকে নিজের কর্তব্য বলে মনে করি? প্রিয়তা, তুমি কি আমার থেকে কিছু চাও? কিছু লুকাচ্ছো?

প্রিয়তার এ মুহুর্তে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। প্রহর কি সবটা আঁচ করতে পেরেছে? বুঝতে পেরেছে প্রিয়তার দ্বন্দ্ব? প্রিয়তা চোখ বুজল। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। নিজেকে খুব নির্লজ্জ মনে হলো এ মুহুর্তে। গতকাল নাবিলা আন্টির এত কথা শুনেও কেন যে প্রহরের সাথে কথা বলতে গেল সে? এ নিয়ে ভিষণ আফসোস হলো প্রিয়তার। দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আরহাম পিট পিট করে চেয়ে রইল শুধু। অটোতে উঠে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,

“প্রহর ভাইয়া তোমাকে তুমি করে ডাকল না?

____________

পুরো ঘর-বাড়ি গুছিয়েছে তানিয়া। একজন দায়িত্বশীল লেডি অফিসারের কাজ ব্যতিত বাড়ির কোনো কাজেই হাত লাগায় না তানিয়া। সব কাজ নিয়াজ একাই করেন। পুরো বাড়ির মেঝে চকচক করছে। বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজিয়েছে ড্রইংরুম। ইহান কাজীকে কল করে ড্রইংরুমে এসেছে। নিয়াজ লজ্জায় ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তার এহেন লজ্জাকে পাত্তা দিচ্ছে না তানিয়া। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে সকাল থেকে। বিকালে সম্মাননার জন্য থানায় যেতে হবে। তাই সকাল সকাল বাবার বিয়ে দিতে চাইছে তানিয়া। একটা কেক ও অর্ডার করেছে সে। আজকের দিনটা মনে রাখার এক জমজমাট আয়োজন করেছে মেয়েটা।

ইহান বেলুন ফুলাচ্ছে। অদ্ভুত একটা কাজ হলেও খুব মন দিয়ে কাজটা করছে ইহান। তানিয়া ইহানকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। ইহানের কথা অনুযায়ী বেলুন দিয়ে বাড়ি সাজানো বাচ্চাদের কাজ, তাদের মাথায় এই আইডিয়া প্রথমে আসঃ। তাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের ঘর সাজানো উচিত ইউনিক ফার্নিচার, ফ্লাওয়ার্স, লাইট দিয়ে।

প্রিয়তা সেসময় তানিয়ার বাড়িতে এলো। প্রহর একটু আগেই এসে সোফায় বসেছে। ক্লান্ত হয়ে বসেছে বোধহয়। তানিয়ার পরণে তখন সুতির ঢিলেঢালা কামিজ। গায়ে বড়সড় গামছা। চুল গুলো কাঠি দিয়ে বেঁধে রাখা। প্রিয়তার অসস্তি হলো। এত সেজেগুজে দাওয়াত খেতে এলো সে। অথচ বাড়ির মানুষ জনই সাজেনি। অবশ্য তানিয়া তা ভাবলো না মোটেও। প্রিয়তাকে এভাবে সুন্দর করে সেজে আসতে দেখে খুশিই হলো সে। কাছে এসে প্রিয়তার গাল ছুঁয়ে তানিয়া বললো,

” তোমাকে খুব মিষ্টি লাগছে প্রিয়তা। অপূর্ব লাগছে। চোখ ফেরাতেই পারছি না। তোমাকে দেখে কি যে খুশি হয়েছি। বলে বোঝাতে পারবো না।

প্রিয়তা বিনিময়ে হাসল। আরহাভের দিকে তাকিয়ে বললো,

” আপনার ভালোবাসার টানে আরহাম এসেছে। আর আরহামের বোন হিসেবে আমি এসেছি। এত ভালো একটা দিনে আমাদের কাছে টেনেছেন এর জন্য কৃতঞ্জতা।

তানিয়া হাসল। হাসল আরহাম ও। সবকিছু প্রায় প্রস্তুত। তাই তানিয়া ড্রেস চেঞ্জ করতে গেল। প্রিয়তা পুরো বাড়িটাতে নজর বুলাল। প্রিয়তাকে দেখে আরহাম হাসল। পাশে বসল প্রিয়তার। আরহামকে কোলে নিল। বললো,

” তুমি এলে তাহলে। তোমার উপর দিয়ে কি কি গেছে সবই বুঝি। ধৈর্য হারিও না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

” আপনারা থাকতে আমাদের আর কি হবে? আপনাদের সবার নিজের দায়িত্বের প্রতি এতটা গুরত্ব দেখে অমি সত্যিই অবাক হয়েছি। বর্তমানের পুলিশরা তো এমন নয়।

” এই শহরটাকে আমরা একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে চেয়েছি। অপরাধ করলে অপরাধীর যেন বুক কেঁপে উঠে সে ব্যবস্থা করতে চেয়েছি। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

” পুলিশম্যানের মুখে শুনলাম আপনি নাকি চলে যাচ্ছেন?

” ঠিক শুনেছো।

” কেন যাচ্ছেন?

তানিয়া বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তানিয়ার পরণে আকাশি রঙের জর্জেটের শাড়ি। শরীরের ভাজ অস্পষ্ট। চুলগুলো এখন খোলা। হাতে মুখে প্রসাধনীর চিহ্ন নেই। অঙ্গসমূহ তার ভেজা। গোসল করে সবে বেরিয়েছে সে। তানিয়ার এমন বেশভূষায় হা করে তাকিয়ে রইল ইহান। তৃষ্ণা পেল খুব। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। অন্তরে খচখচানি শুরু হলো। অপর পাশে চেয়ে রইল মাথা নত করে। আরহাম বেলুন দিয়ে খেলতে শুরু করল। প্রিয়তা বসেই রইল সোফায়। তানিয়া এসে গল্প জুড়লে তখনই কথা বলে প্রিয়তা।

বেশ কিছু সময় পর তাসলিমা খাতুন এলেন। সাথে উনার মা-বাবা। শাড়ি পরিহিত তাসলিমাকে দেখে যুবতি লাগল।নিয়াজ ও বেরিয়ে এলেন লজ্জা ভেঙে। সকলের সাথে কুশল বিনিময় হবার পর কাজী আসলেন ঘরে। বিনা দ্বিধায় বিয়ে পড়ালেন। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বাড়িতে আরো হৈ হুল্লোর শুরু হলো। পুলিশ ফোর্সের আরো কয়েকজন এসেছে। বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই নাচ, গান আরম্ভ করলো তারা। প্রিয়তা ছিল সেখানকার নিরব দর্শন। নিয়াজ আঙ্কেলের বিয়ে হওয়ায় প্রিয়তা খুশি হয়েছে। তানিয়ার মনোভাব ও পছন্দ হয়েছে। এত এত নোংরা মানুষের মাঝে কয়েকজন ভালো মানুষটাকে দেখে প্রিয়তার ভালো লাগল। আবার ঘাবড়েও গেল অনেকটা। এত ভালো তার সহ্য হবে তো? এত সুখ সইবে?

___________

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে