প্রিয়তার_প্রহর পর্ব-০৪

0
452

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৪ )

অফিসের কিছু ফাইল গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। প্রহর ছুটি নিলেও ইহান আর তানিয়াকে কাজ করে যেতে হচ্ছে। ফাইল কারেক্ট করতে গিয়েই মাথা ঝিমঝিম করছে তানিয়ার। পাশেই ল্যাপটপে মনোযোগী হয়ে বসে আছে ইহান। তীক্ষ্ম চোখ দুটির উপরে থাকা ললাট ভাঁজ হয়ে আছে। তানিয়া উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে করতে ফাইলের লেখা গুলো দেখতে লাগল। জুতোর খচখচ আওয়াজ কানে বাজল ইহানের। সেদিকে দিকে না তাকিয়েই বললো,

” শব্দ হচ্ছে তানিয়া। বসে কাজ করো। এভাবে পায়চারি করছো কেন?

তানিয়া বিরক্ত হলো। এত নিয়মকানুন ভালো লাগছে না তার। সব কাজ বসে বসে করার কি মানে? এক ধ্যানে বসে থাকতে থাকতে মেরুদণ্ডে ব্যথা হচ্ছে। এসব সে কি করে বোঝাবে? হাতের ব্যথাটাও আছে। ফোস্কা পরে গেছে। কখন বাড়ি ফিরবে কে জানে?

তানিয়া বিনুনি থেকে বেরিয়ে আসা দুষ্টু চুলগুলোকে কানে গুঁজে নিল। চশমা ঠেলে আবার ও আগের জায়গায় ধপ করে বসে পড়ল। অতঃপর ল্যাপটপ খুলে হেডফোন কানে লাগিয়ে নিল। প্রিয়তার সাথে থাকা ট্র্যাকিং ডিভাইসটার সাথে তানিয়ার হেডফোনের কানেকশন আছে। সিক্রেট এজেন্সির একজন কল করে বলেছিল প্রহরকে কিংবা ইহানকে কাবু করার জন্য শত্রুর দল একটা মেয়েকে পাঠাবে। নারীর ভালোবাসা দিয়ে কাবু করবে। বিচ্ছেদ ঘটিয়ে একদম নিস্তেজ করে দিবে প্রহর বা ইহানকে। সেই কথা অনুযায়ী হুট করেই প্রিয়তার আগমন ঘটল। প্রিয়তা মেয়েটা প্রহরের কাছে সাহায্য চাইল, বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করল। সবকিছুই কেমন মিলে গেল। তাই তো প্রিয়তাকে সন্দেহজনক লাগছে সবার।

হেডফোন কানে নিয়ে তানিয়া বুঝল প্রিয়তা কাঁদছে। ফোপানোর শব্দ স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মাঝে মাঝে বিলাপ করছে। নাক টানছে অনবরত। খানিক পর পর মৃদু স্বরে বলছে,

” আম্মু বিয়ে করে নিল। আব্বুও বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের কেউ রইল না। তোকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো? কি করবো?

তানিয়া কিছুক্ষণ হেডফোন কানে রাখল। কিছু ভাবতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। এরপর হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে কথাগুলোর উপর ভিত্তি করে একটা চিত্র এঁকে ফেলল কল্পনায়। প্রিয়তা আর আরহাম কাঁদছে, দুজনেই মিশে আছে একে অপরের সাথে। কি সুন্দর একটা দৃশ্য, কি মোহনীয়। চোখ মেলে ইহানের দিকে তাকিয়ে অসস্তি নিয়ে তানিয়া বললো,

” প্রিয়তা কোন ক্রাইমের সাথে এড থাকতে পারে না স্যার। মেয়েটা এত মিষ্টি আর মজার যে সন্দেহ-ই হয় না। আমার মনে হয় আমরা ভুল বুঝছি মেয়েটাকে।

ইহান হাসল। পাশে থাকা পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিল। বললো,
” কে ভালো আর কে নয় তা জানি না। সবাইকেই সন্দেহের খাতায় রাখতে হবে। কে কিভাবে পুলিশ ফোর্সের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তা বোঝা দায়।

তানিয়া একটু চুপ রইল। আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। শরীরটা ভালো লাগছে না মোটেই। বাড়িতে গিয়ে রান্নাবান্না করতে হবে। তানিয়ার মা তিশা মারা গেছে বছর কয়েক হয়েছে। একমাত্র বাবাকে নিয়েই তানিয়ার পরিবার। রোজ রাত করে বাড়ি ফিরলে তানিয়ার বাবা নিয়াজ শেখ রাগারাগি করেন। মেয়ের এই পেশা তার পছন্দ হলেও তিনি চাননি তানিয়া পুলিশে জয়েন করুক। মেয়ে ছোটখাটো একটা চাকরি করবে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে, টেনশন কম নিবে এসবই চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তানিয়ার রোজ কি পরিমানে ধকল যায় তা তিনি বোঝেন। তানিয়া ফোনটা ব্যাগে রাখল। গালে হাত দিয়ে উদাসীন কণ্ঠে বললো,

” বাড়ি কখন ফিরবো স্যার?

” তাড়া আছে তোমার?

” জি, একটু।

” চলো পৌছে দেই।

‘ লাগবে না স্যার। আমি একাই যেতে পারবো।

” বেশি কথা বলা আমার পছন্দ নয়। যা বলেছি তাই করো।

তানিয়া ব্যাগে ফাইল ভরে উঠে দাঁড়াল। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতে মুখে পানি দিয়ে বাইরে এলো। ইহান ফোন টিপতে ব্যস্ত। লম্বাটে দেহের গড়ন, শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী, সব মিলিয়ে ইহান একটু বেশিই সুন্দর। ফর্মাল ড্রেস-আপে আকর্ষণীয় লাগে ইহানকে। এই লোকটা যদি হেসে ওঠে তাহলে ভালো লাগবে না। তানিয়া সবসময় ইহান স্যারকে গম্ভীর দেখেছে। হুট করে ইহান যদি তার সামনে হেসে ফেলে তো ইহানকে একদম মানাবে না। বড্ড বেমানান লাগবে, কেমন অদ্ভুত লাগবে।

ইহান তাড়া দিল। গাড়িতে গিয়ে উঠল তানিয়া। সিট বেল্ট বেঁধে নিল। ইহান পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুদূর যেতেই গাড়িটি থামিয়ে দিল ইহান। তানিয়া অবাক হলো। কৌতুহলী কণ্ঠে বললো,

” থামলেন কেন?

” একটু থাকো। আসছি।

ইহান বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল তা বলার প্রয়োজন বোধ করলো না। কিছু সময় কাটতেই আবার ফিরে এলো। ছোট্ট একটা প্যাকেট তানিয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল তানিয়া। কি আছে এতে? প্যাকেটটা খুলেই বিস্মিত হলো। ঔষধের পাতা আর মলম জাতীয় ঔষধ রাখা। তানিয়ার এমন বিস্ময় দেখে ইহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

” হাতে ফোসকা পরে গেছে। বাড়ি গিয়ে মনে করে মেডিসিন নেবে।

” আপনি এসব করতে গেলেন কেন?

” আজ হাত পুড়েছে, কাল পা পুড়বে। এরপর দেখা যাবে অসুস্থতার বাহানায় থানায় আসা বন্ধ করে দিবে। এইসব অজুহাত তো চলবে না। কাজে ফাঁকি দেওয়া আমার পছন্দ নয়। এছাড়া টিমের মেম্বারদের দেখে রাখার দায়িত্ব ও তো আছে।

তানিয়ার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। তানিয়া কাজে ফাঁকি দেয় না। তবুও ইহান এমন করে বলে যে মনে হয় তানিয়া সবসময় অজুহাত দিয়ে কাজে আসে না। একটু ভালো করে বললেই হতো। এভাবে বলার কি খুব দরকার ছিল? কেন নিবে তার কেনা ঔষধ? তানিয়া গাড়ির গ্লাসের সামনে প্যাকেটটা রেখে দিল। মুচকি হেসে বললো,
” আমার ঘরে মেডিসিন আছে স্যার। এটা অফিসে রেখে দিবেন। অন্যদের কাজে লাগবে।

” নিতে বলেছি।

” ধন্যবাদ।

ইহান আর বাক্য ব্যয় করলো না। সোজা তানিয়াদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়ি থামাল। এর মধ্যে একটা কথোপকথন ও হয়নি তাদের মাঝে। গাড়ি থেকে নেমে তানিয়া ইহানকে ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়াল। ইহান নেমে এলো গাড়ি থেকে। তানিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর ঠান্ডা, নরম কণ্ঠে ডাকল।

‘তানিয়া।

এমন নরম কণ্ঠ তানিয়ার পরিচিত নয়। ডাক শুনেই ভড়কে গেল সে। দুদণ্ড সময় নিয়ে পিছু ফিরল। ইহানের চোখ তখন শীতল। গাম্ভীর্য নেই মুখে। পকেটে দু হাত রেখে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তানিয়া উত্তর নিল।

” জি?

কোন কথা বললো না ইহান। তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। অতঃপর কি যেন হলো ইহানের। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

” কিছু না।

” তাহলে ডাকলেন কেন?

” এমনি। বাড়ি যাও।

তানিয়ার রাগ হলো। কিছু বলবে বলে না বললে মেজাজ খারাপ হয় তার। উৎসুক হয়ে ওঠে কথাটা শোনার জন্য। কিন্তু ইহান যখন বলে দিয়েছে কিছু না, তখন বোমা হামলা চালালেও এই কথার পরিবর্তন হবে না। তানিয়া পা বাড়িয়ে চলে গেল। এই মানুষটার মতিগতি বোঝা আসলেই কষ্টকর। কেনই বা ডাকলো? কেনই বা এমন শান্ত হলো?

___________________

জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। এ যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়, বিভিন্ন চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। কাল কি হবে এই ভেবে কতশত মানুষ দুশ্চিন্তায় ভুগে। অথচ কাল আমরা না ও বেঁচে থাকতে পারি, সূর্যের আলো কাল আমাদের চোখে না-ও পৌঁছাতে পারে। অন্যায়,দুর্নীতির এই বাজারে সাধারণ মানুষের টিকে থাকা দুষ্কর।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেয়ালের তারকাটায় লাগিয়ে রাখা ছোট্ট আয়নায় নিজের মুখ দেখল প্রিয়তা। সারা রাত ঘুম হয়নি প্রিয়তার। চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। নাকের পাটা লাল রং ধারণ করেছে। মাথা ব্যথায় চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। আরহাম গতরাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। প্রিয়তা ঘুমোতে পারেনি। সারা রাত নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। মাঝরাতে একবার চোখ লেগে এসেছিল। কিন্তু স্বপ্নে মায়ের বিয়ে দেখে ঘুম ভেঙে গেছে। এই নিষ্ঠুর এক স্বপ্ন দেখে ভয়াবহ ভাবে কেঁদেছে প্রিয়তা। এখন আর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে না।

প্রিয়তা গোসল করে নিল দু ঘন্টা ধরে। বড় দেখে ফ্রক পড়ে নিল। গামছা দিয়ে চুল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসে চুলায় ডাল বসিয়ে দিল। আরহামকে উঠিয়ে দিয়ে দাঁত ব্রাশ করিয়ে ছাদে পাঠাল। রান্না হলেই বাচ্চাটাকে খেতে দেবে। নিধির সাথে খুব ভাব হয়েছে আরহামের। নাবিলা আন্টির সাথেও সময় কাটায় আরহাম। আন্টি আন্টি বলে কান ঝালাপালা করে দেয়। ছোট বাচ্চাটার প্রতি মিসেস নাবিলার কোন ক্ষোভ নেই। আরহামকে দেখলেই এটা ওটা খেতে বলেন। আরহাম সেসব খায় না। প্রিয়তাকে এসে প্রথমে জানায়।

পাতিলে রসুনের উপর ডাল ঢালতে গিয়ে ছিটকে গরম ডাল হাতে এসে পড়ল প্রিয়তার। ব্যথায় মুখ দিয়ে আহ্ শব্দটি উচ্চারণ করলো। তড়িঘড়ি ট্যাপ ছেড়ে পানির নিচে হাতটা ধরে রাখল। এই ব্যথায় প্রিয়তা কাঁদল না। এত কাঁদলে চলবে না। আরহাম এভাবে তাকে কাঁদতে দেখলে নিজেও কাঁদবে। প্রিয়তা আরেক চুলায় ভাত বসিয়ে চুল আঁচড়ে নিয়ে ফোন টিপতে লাগল। গতকাল প্রিয়তা রায়হান স্যারকে মেসেজ করেছিল। রায়হান মন্ডল প্রিয়তাদের ভার্সিটির একজন পুরোনো শিক্ষক। প্রিয়তাকে ভিষণ ভালোবাসেন তিনি। প্রিয়তার রেজাল্ট দেখেও খুব খুশি হন। প্রিয়তা স্যারকে বলে রেখেছিল কয়েকটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দিতে। স্যার কিছু লিখেছে কিনা তা দেখার জন্য অনলাইনে ঢুকতেই একটা কল এলো অচেনা নাম্বার থেকে। ধরবে না ধরবে না করেও কলটা ধরলো প্রিয়তা। সালাম জানাল মৃদু স্বরে। ওপাশে মধ্যবয়স্ক পুরুষ কণ্ঠে একজন সালামের উত্তর নিল। জিজ্ঞেস করল,

” আপনি কি প্রিয়তা হোসাইন বলছেন?

” জি আমি প্রিয়তা বলছি।

” টিউশনির বিজ্ঞাপন দেখে আমি কল করেছি।

প্রিয়তার চোখ মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। আনন্দের জোয়ার বইলো হৃদয়ে। খুশিতে নেচে উঠল প্রিয়তার প্রাণ। ততক্ষণাৎ উত্তর দিল।

‘ জি আঙ্কেল বলুন। কাকে, কখন, কোথায় পড়াতে যেতে হবে?

” আপনার রেজাল্ট দেখেই আমি আপনাকে আমার মেয়ের টিচার হিসেবে নিতে চাইছি। আমার মেয়ে কুসুম নাইনে পড়ে। ওকে কমার্সের গ্রুপিং সাবজেক্ট গুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।

” সমস্যা নেই আঙ্কেল। আমি পড়াতে পারবো।

” বেতনটা আগে বলে নেই। আপনার না পোষালে এসে তো লাভ হবে না। আমি দু হাজার দিতে পারবো। আপনি পড়াবেন?

দু হাজার টাকা অন্যদের কাছে কোন ব্যাপার-ই না। কিন্তু প্রিয়তার কাছে এই দু হাজার টাকাই বর্তমানে অনেক। কথায় আছে “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো”। এ দু হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়াই শোধ করা যাবে না। কিন্তু আরহামের কিছু কিছু চাহিদা এতে পূরণ হবে। যদিও স্টুডেন্টটার বাসা এখান থেকে অনেক দূর। হেঁটে গেলে বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় লাগবে। নইলে অটো ভাড়া লাগবে যেতে আসতে ত্রিশ টাকা। রোজ ত্রিশ টাকা ভাঙা সম্ভব নয়।

প্রিয়তা রাজি হলো। বললো,
” কাল থেকেই আমি পড়াতে যাবো।

কল কাটলো ওপাশের ভদ্রলোক। প্রিয়তা মেসেঞ্জারে গিয়ে স্যারের মেসেজ দেখল। একটা ব্যাচ আপাতত প্রিয়তাকে দিতে পারবেন তিনি। সময়ের স্বল্পতার কারণে রায়হান মন্ডল অনেক স্টুডেন্টদের ফিরিয়ে দেন। প্রিয়তাকে এক ব্যাচ ম্যানেজ করে দিতে অসুবিধা নেই উনার। লেখাটুকু পড়ে প্রিয়তার চোখ মুখের উজ্জলতা বাড়ল। আর দু একটা টিউশনি পেলে আরামে চলে যাবে তার। সুখের মুখ দেখার বড্ড তৃষ্ণা প্রিয়তার।

_____________________

আরহামকে খুঁজে পাচ্ছে না প্রিয়তা। ছেলেটার চুলগুলো আজ কেঁটে দিতে হবে। আরহামের চুলগুলো সুন্দর হলেও ভিষন পাতলা। বাচ্চাদের চুল যত কাটা হয় তত ভালো চুল গজায়। এইসব কাজ সাধারণত বাবা-মা করে থাকে। কিন্তু আরহামের মা-বাবা থেকেও নেই। তাই কাজগুলো এখন প্রিয়তাকেই করতে হবে। প্রিয়তা যখনই বলেছে “তোমার চুল কেটে দিবো”, তখন থেকেই আরহাম উধাও। কাল থেকে আর সময় পাবে না প্রিয়তা। সকালে ভার্সিটি যেতে হবে, দুপুরে দুটো টিউশনিতে যেতে হবে। এসে রান্নাবান্না করে নিজের পড়ালেখা কমপ্লিট করতে হবে। আজকের থেকে ভালো সময় আর পাওয়া যাবে না।

প্রিয়তা গোসল করার মগে পানি নিল। সাবান আর লেজার একসাথে রাখল। ভেজা চুলগুলোকে হালকা খোপা করে নিল প্রিয়তা। দুই ভ্র অবধি কাঁটা চুলগুলো আঁচড়ে নিল ভালো করে। হাতে ফোন নিয়ে অতঃপর আরহামকে ডাকতে বের হলো ঘর থেকে। আরহাম প্রায় সময় নিধির সাথে খেলা করে। ওখানে থাকবে ভেবে প্রিয়তা নাবিলা আন্টির ফ্ল্যাটে এলো। মিসেস নাবিলা তখন রান্নাবান্না করছিল। দরজা খোলা বলে প্রিয়তা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে দেখে হাসলেন। প্রিয়তা বললো,
” আরহামকে দেখেছেন আন্টি?

মিসেস নাবিলা প্রিয়তার দিকে তাকালেন। প্রথম যখন প্রিয়তার সাথে দেখা হয় তখন প্রিয়তাকে তার ভালো লাগেনি। কারণ প্রিয়তা মা-বাবা ছাড়া ঘর ভাড়া নিতে এসেছিল। এ শহরে ব্যাচেলর থাকতে আসা মেয়েগুলোকে একটা ভিন্ন নজরে দেখা হয়। অনেকে ভাবে মেয়েটা বাবা-মায়ের সাথে থাকতে আগ্রহী নয়, নিশ্চয়ই কোন কুকর্ম করে এসেছে, তাই বাড়িতে জায়গা হয়নি। অনেকে ব্যাচেলর মেয়েরা নেশাপানি করে, খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে। সে অনুযায়ী প্রথমে প্রিয়তাকে অত ভালো লাগেনি মিসেস নাবিলার। তবে প্রিয়তার নরম কণ্ঠ, ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, হাসিহাসি মুখ দেখে অতটা খারাপ বলে মনে হয়নি মেয়েটাকে। নিধির মুখে শুনেছে প্রিয়তা খুব মেধাবী ছাত্রী। টিউশনি করাতে চায়। সেক্ষেত্রে বলা যায় মেয়েটা শিক্ষিকা। তাই তো এখন আর গোমড়া মুখে কথা বলে না।

প্রিয়তার কথা শুনে তিনি বললেন,

” তোমার ভাই তো এসেছিল। চলে গেল একটু আগে। তোমার কাছে যায়নি?

” না। ভেবেছি আজ ওর চুল কেটে দিবো। সেজন্য এখন লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

” দেখো গিয়ে ছাদে খেলছে হয়তো। ওখানেই পাবে। কোথায় যাবে আর?

প্রিয়তা রান্নাঘর ছেড়ে পা বাড়াতে উদ্যত হলো। কি মনে করে পিছু ফিরে তাকাল মিসেস নাবিলার দিকে। এই মহিলার গা দিয়ে কেমন মা মা ঘ্রাণ বেরিয়ে আসে। কি সুন্দর কাজের লোক থাকতেও নিজের হাতে রান্না করে সন্তানদের মুখে তুলে দেয়। অথচ প্রিয়তার নিজের ভাগ্য দেখো, কোথায় গিয়ে ঠেকে গিয়েছে সে। নড়বার শক্তি নেই, এগুবার শক্তি নেই। কেমন একা, অসহায়। প্রিয়তা মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে বললো,

” ধন্যবাদ আন্টি।
মিসেস নাবিলা একটু হাসলেন। কৌতুহলী চোখ নিক্ষেপ করলেন। বললেন, “ধন্যবাদ? কেন? কিসের জন্য”?

” আরহামকে দেখে রাখার জন্য।

কথাটুকু শেষ করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় ভবনের ছাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। আশপাশে তাকাতেই আজওয়াদকে দেখে অপ্রস্তুত হলো প্রিয়তা। আরহামকে ডাকতে দ্বিধা হলো। মন চাইল চলে যেতে। কি করবে ভেবে পেল না প্রিয়তা। মন র মস্তিষ্কের লড়াই চললো কিছুক্ষণ। পরিশেষে মস্তিষ্কের কথায় সায় জানিয়ে ছাদে পা রাখল প্রিয়তা। ছাদে রোদ নেই। মৃদু বাতাস বইছে ক্ষণে ক্ষণে। আজওয়াদ একটা চেয়ারে বসে আছে। তার কোলেই বসে আছে আরহাম। বাতাসে আজওয়াদের চুল এলোমেলো হচ্ছে। চুলগুলোকে বারবার পিছু ঠেলে দিচ্ছে সে। আজওয়াদের গায়ে অফ হোয়াইট শার্ট। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে পুলিশটা নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত সুন্দর। আরহামের গায়ে কাপড় নেই। ঢিলেঢালা হাফ প্যান্ট পড়েছে। ফিনফিনে রোগা উদাম শরীরে কাতূকুতু দিচ্ছে আজওয়াদ। খিল খিল করে হেসে উঠছে আরহাম। এত সুন্দর একটা দৃশ্য মুঠোফোনে নজরবন্দি করলো প্রিয়তা। অতঃপর ছাদে পা বাড়িয়ে ডাকল আরহামকে।

” আরহাম। ঘরে চলো।

দুজনের নজর আবদ্ধ হলো প্রিয়তাতে। আজওয়াদ দৃষ্টি সরিয়ে নিল ততক্ষণাৎ। আরহাম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কোমল কণ্ঠে বললো,

” একটু পরে যাই আপু।

” একটু পরে না। এক্ষুণি। চুল কেটে দিবো বলেছিলাম না?

” আমি গেম খেলছি। একটু পর যাবো।

” তাহলে আমি সবকিছু এখানে নিয়ে আসি? বসে থাকো চুল কেটে দিবো।

” আমি চুল কাটবো না। আমাকে পচা দেখাবে।

” বড় হলে যেটুকু চুল আছে সেটুকুও ঝরে যাবে। তখন একদম টাক হয়ে যাবে। দেখতে আরো পচা লাগবে। যা বলছি শুনবে। দিন দিন অবাধ্য হচ্ছো আরহাম।

আরহাম ঠোঁট উল্টে পিছু তাকিয়ে আজওয়াদের দিকে দৃষ্টি দিল। চোখের ভাষায় বলতে চাইল প্রিয়তাকে তার হয়ে বোঝাতে। আজওয়াদ থতমত খেল বিষয়টা বুঝতে পেরে। হাত চালিয়ে চুলগুলো পিছু ঠেলে দিল। বললো,
” কেন জোর করছেন? অনুমতি ছাড়া ছেলেটার চুল কাটতে পারেন না আপনি।

” আমার ভাই, আমি কি করবো আর কি না করবো তা আপনার কথা শুনে করবো? ওর হয়ে সাফাই গাইতে আসবেন না।

আজওয়াদের রাগারাগি করার মুড নেই। ক্রোধটুকু গিলে ফেললো সে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। আরহামের কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হলো। ঠোঁট উল্টে কান্না করার ভঙ্গি করলো। অতঃপর একটা শক্ত কথা বলে উঠল। বললো,

” আব্বু ভালোবাসে না, আম্মু ভালোবাসে না। এখন আপুউ ভালোবাসে না। থাকবো না আমি। চলে যাবো।

মাত্র দু বাক্যের কথা। না বুঝেই বলেছে আরহাম। কথাটার গভীরতাও জানে না সে। কিন্তু এই কথাটিই বুকে গিয়ে লাগল প্রিয়তার। হু হু করে কেঁপে উঠল কিশোরীর কায়া। রাগান্বিত অবয়ব মুহুর্তেই পাল্টে গিয়ে চুপসে গেল। কষ্টে বুক ভার হলো। প্রিয়তা অনুধাবন করলো তার কান্না পাচ্ছে। খুব বাজে ভাবে কান্না পাচ্ছে। চোখের কার্নিশ পানিতে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। যেকোন সময় চোখ বেয়ে নেমে আসবে। প্রিয়তা অসস্তিতে পরলো। আজওয়াদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ মুছলেও দেখে ফেলবে। ছোট ভাইয়ের এই অভিমানী কথায় এত বড় মেয়ের কেঁদে ফেলার বিষয়টা আজওয়াদের কাছে নিশ্চয় হাস্যকর লাগবে? হেসে ফেলবে সে। লজ্জায় ফেলবে প্রিয়তাকে। না, কেঁদে দেওয়া যাবে না। স্থান ত্যাগ করতে হবে। প্রিয়তা পিছু ফিরে সরে আসতে চাইল। ঝাপসা চোখে পা ফেলতে গিয়ে ভুল জায়গায় পা ফেলল। আচমকা পা মচকে পড়ে গেল প্রিয়তা। গড়িয়ে গড়িয়ে দু সিঁড়িতে গিয়ে হাতের সাহায্য থেমে গেল। শরীরের ব্যথায় মা বলে চিৎকাল করলো প্রিয়তা। মাথায় আঘাত পেল। রক্ত বেয়ে পরল চোখের পাশ দিয়ে। পায়ের যন্ত্রণায় কেঁদে ফেললো মেয়েটা। সর্বস্ব শক্তি হারিয়ে ফেলল। নিদারুণ কষ্টে প্রিয়তার সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। তার সাথেই কেন বারবার এমন হচ্ছে? কেন এত এত ব্যথার সম্মুখীন হচ্ছে সে? তার কি দোষ? এত সহ্যক্ষমতা তো তার নেই। তবে কি এখানেই সবটা শেষ? আরহামকে কি সুস্থ জীবন দিতে পারবে না প্রিয়তা? ভাবতে পারল না প্রিয়তা। ঢুকড়ে কেঁদে উঠল।

ধপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে আরহাম আর আজওয়াদ এগিয়ে এলো। প্রিয়তাকে এভাবে পড়ে গিয়ে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হলো আজওয়াদ। আরহামকে নিয়ে ততক্ষণাৎ এগিয়ে এলো। প্রিয়তা নড়ছে না, শব্দ করছে না। নিস্তেজ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। প্রহর প্রিয়তার ডান হাতে চাপ প্রয়োগ করে ডাকল,

” প্রিয়! প্রিয়তা।

ওষ্ঠদ্বয় জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল প্রহর।প্রিয়তা জ্ঞান হারিয়েছে। আরহাম কেঁদে দিল শব্দ করে। ততক্ষণাৎ প্রিয়তাকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল আজওয়াদ। শত্রুকে রক্ষা করার মতো পরিস্থিতিতে ফেঁসে গেল নিমিষেই। এই মেয়েটাকে তো শুট করা উচিত। তা না করে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হচ্ছে প্রহর? ছিঃ! পুলিশ হয়ে শেষে কিনা অপরাধীকে সাহায্য করছে? উপরমহল জানলে আজওয়াদকে ফায়ার করে দিবে নিশ্চিত। যদিও মাত্র তিনজন ব্যতিত প্রিয়তার গোপনীয়তা কেউ জানে না। একটু আগেই প্রিয়তার উপর রেগে ছিল সে, ডাকতে দ্বিধা হচ্ছিল। এখন কিনা মেয়েটাকে কোলে করে ঘুরতে হচ্ছে? ইন্টারেস্টিং গেইম ইজ অন

_______________________
ঘুমের রেশ এখনত কাটেনি তানিয়ার। চোখ কচলে সামনে তাকাতেই থতমত খেল সে। আবির এখানে কি করছে এত সকালে? যতদূর মনে পরে কাল রাতে তানিয়া কল বা মেসেজ কোনটাই করেনি। হুট করে বাড়ি এসে পরল ছেলেটা?

বাধ্য হয়ে হাসল তানিয়া। এ কাজ নিয়াজের-ই হবে। আজ একটু ছুটি নিয়েছে তানিয়া। এই সুযোগে ছেলেটাকে তানিয়ার দ্বারে পাঠিয়েছে নিয়াজ। প্রচণ্ড রাগ হলেও কিছু বললো না তানিয়া। হেসে বললো,
” আপনি? এত সকালে?

” আশা করোনি?

ছেলেটার ভয়ঙ্কর দৃষ্টি বুঝতে পারল তানিয়া। গতকাল ফাইল চেক করতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আবির কল করলেও তা ধরতে পারেনি সে। ফোনটা বাধ্য হয়ে সাইলেন্ট করে রেখেছিল। নিয়াজ শেখ তার বন্ধুর ছেলে আবিরের সাথে তানিয়ার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন। তানিয়া এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় জানানোতে আবির সময় দিয়েছে তানিয়াকে। এ সম্পর্কের খাতিরে প্রায় সময় আবির এ বাড়িতে আসে। নিয়াজের সাথে গল্প করে। নিয়াজ চোখ বুজে বিশ্বাস কলে আবিরকে। আবিরের সাথে তানিয়ার বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন তিনি। দুজন যেন দুজনকে ভালোমতো চিনে নিতে পারে এজন্য দুজনকে মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বের হতে বলেন তিনি। বিয়ের আগে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ জানার অধিকার দুজনের আছে বলে মানেন নিয়াজ। কোন সমস্যা না থাকলে আগামী দু মাসের মধ্যেই দুজনের চার হাত এক করতে চান নিয়াজ। আবির দেখতে যেমন ভালো, তেমনই ভালো তার ব্যবহার। অন্যদিকে আবির একটা প্রাইভেট কোম্পানিরও ম্যানেজার। তানিয়াকে সবদিক দিয়েই সুখী রাখবে ছেলেটা। কিন্তু তানিয়ার পছন্দ নয় আবিরকে। কেন জানি খুব ছ্যাছড়া মনে হয় ছেলেটাকে। দুজন-দুজনার বিপরীত। তবুও তানিয়া বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে অকপটে। বাবা নিশ্চয় সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে।

তানিয়া চশমা পড়ে বিছানা ছাড়ল। চুলগুলোকে হাত খোপা করে নিল। বালিশ ঠিক করতে করতে বললো,

” আশা করবো না কেন? মাঝে মাঝেই তো আসেন।

” কাল রাতে আমার কল ধরো নি কেন?

” কাজ ছিল।

কাজের বাহানায় তানিয়া সবসময় আবিরের থেকে দূরে থাকে। এ বিষয়টা নিয়ে আবির বিরক্ত। চাকরি নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হয় একে অপরের সাথে। তানিয়ার এতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে নিজের মতো চলতে ব্যস্ত। কাল রাতে কল না ধরায় আবির রেগে আছে। এখন আবারও “কাজ” শব্দটি শুনে রেগে গেল সে।

” কি এমন কাজ ছিল যে কল ধরার সময় পাওনি?

” ফাইল চেক করছিলাম। ভুল ত্রুটি শুধরে দিচ্ছিলাম। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

” সবসময় কাজ নিয়ে পরে থাকলে আমাকে সময় দেবে কখন? তুমি বুঝতে পারছো না আমার সময় দরকার?

” নিজেকেই তো সময় দিতে পারি না। খানিক আফসোসের সুর তানিয়ার।

” তুমি কিন্তু দিন দিন অবাধ্য হয়ে যাচ্ছো তানিয়া। এমন করলে আমি তোমাকে চাকরি করতে এলাউ করবো না।

” মানে?

” মানে আমার কথা না শুনলে চাকরি করতে দেবো না। এই বা* – এর চাকরি করার কি দরকার? আমি কি কামাই করি না?

” মুখ সামলে কথা বলুন আবির। আমার পেশা নিয়ে আমি একটা বাজে কথাও শুনতে চাই না। ভাষা সংযত করুন।

আবির বুঝতে পারল বিষয়টা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। দুজনই সমান তালে রেগে যাচ্ছে। হয়তো বা বড়সড় ঝগড়া ও লাগতে পারে। দুজনের একজনকে শান্ত হতে হবে। তানিয়াকে ভালোবাসে সে। ঝগড়া করে সময় নষ্ট করতে চায় না। এছাড়া তানিয়া জেদি স্বভাবের মেয়ে। দুরত্ব বাড়লেও কোন যায় আসবে না মেয়েটার। তাই ঝগড়া করলে নিজেরই ক্ষতি। নিজেকেই কষ্ট পেতে হবে।

আবির ফোস করে জোরে শ্বাস টানল। বললো,
” ওকে ওকে, রিল্যাক্স। আ’ম সরি। আর বলবো না। রেগো না প্লিজ।

” হুহ। এত সকালে আসলেন। কোনো দরকার ছিল? শান্ত কণ্ঠেই বললো তানিয়া।

” হুহ দরকার তো আছেই। রেডি হয়ে নাও জলদি। বের হবো আমরা।

“মানে? কোথায় যাবো? বিস্ফোরিত কণ্ঠ তানিয়ার ।

” ভয় নেই। আঙ্কেলের কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছি। আজ সিলেটের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াবো। তোমায় মন ভরে দেখবো। লাঞ্চ করবো একসাথে। অ্যান্ড দেন বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে যাবো। আই মিন স্পেশাল টাইম স্পেন্ড করবো।

” এখনই?

” হ্যাঁ এখনই। তুমি রেডি হও। আমি বাইরে ওয়েট করছি।

আবির বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিরক্তিতে কাঁদতে ইচ্ছে হলো তানিয়ার। এতদিন পর ছুটি পেয়েছে। সারাদিন টিভি দেখবে, ফানি ভিডিও দেখবে, খাবে, ঘুমাবে চিল করবে তা নয়। সব আশা ভেঙে দিল আবির। এখন কিনা ঘুরে বেড়াতে হবে ওর সাথে? তার যে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার না গেলেও বাবার বকা শুনতে হবে। ধুরররর!

তানিয়া হলদে রঙের থ্রি পিস পড়ে নিল। হাত ভর্তি হলদে চুড়ি। চোখে গাঢ় করে কাজল নিল। গলায় চিকন চেইন পরল। যেতেই যখন হবে তখন সাজগোজ করলে ক্ষতি কি? ওড়না মাথায় নিয়ে ব্যাগ হাতে নিতেই ফোন বেজে উঠল তানিয়ার। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল ‘Ehan Sir” নামটা। তানিয়ার গলা শুকিয়ে গেল। ছুটির দিনে স্যার দিচ্ছে কেন? কিছু হলো না তো? তানিয়া ফোন ধরল।

” আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কাল যে ফাইল রি-চেইক করতে দিয়েছিলাম, করেছিলে?

” জি। করেছি।

” ওগুলো নিয়ে আমার বাসায় আসো।

” এখনই?

” ইটস ইমার্জেন্সি। লেইট করো না।

” আমি বের হচ্ছিলাম একটু। পরে যাই?

” খুব প্রয়োজন না হলে আমি তোমায় বলবো কেন? স্টুপিড।

” আঙ্কেল আন্টি গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে?

” না তো। কেন?

থতমত খেল তানিয়া। এর মানে স্যার ব্যতিত বাড়িতে এখন কেউ নেই। কিভাবে যাবে সে? অসস্তি হচ্ছে যে।

” বাসায় যেতে হবে?

” আমি যেতে পারলে আর তোমায় বলতাম না। কাজের প্রতি সিরিয়াস হও।

” আসছি স্যার।

ইহান কল কাটল। এতক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে গিয়েছিল তানিয়ার। এখন ভালো করে শ্বাস নিল। ইহানের আসতে পারবে না কথার মানে তানিয়া বোঝেনি। হয়তো স্যার বাসায় বিজি আছে। তানিয়া কোনদিকে যাবে এটা ভেবে দিশেহারা হলো। বাইরে আবির আর নিয়াজ অপেক্ষা করছে। ওদিকে ইহান তাড়া দিচ্ছে। আবিরের সাথে না গেলে বাবা বকবে, আর স্যারের কথা না শুনলে ইহান স্যার নিজেই বকবে।

তানিয়া বুদ্ধি আটল। মনে পড়ল প্রহর স্যারের গতকাল বলা কথা। ইতিশা ম্যামের বাড়িতে বেলকনির পাইপ বেয়ে ঘরে ঢুকেছিল ইহান স্যার আর প্রহর স্যার। তানিয়াও সেইভাবেই নিচে নামবে। পুলিশের ট্রেনিং নেওয়ার সময় অনেকবার অনেক স্থানে উঠতে-নামতে হয়েছে। এ পদ্ধতি কাজে লাগানো তানিয়ার কাছে কোন ব্যাপারই না। নিজের বুদ্ধি দেখে নিজেই গর্বিত হলো তানিয়া। আবিরের সাথে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই তার। কাজে গেলে নিজেরই ভালো লাগবে। বাড়ি ফিরে না হয় বাবাকে বোঝানো যাবে ।

ওড়না বেঁধে সিনেমাটিক স্টাইলে সাবধানে নিচে নামল তানিয়া। সাবধানে নামতে গিয়েও দেয়ালে বেড়ে ওঠা ফুল গাছের কাঁটায় হাত ছিলে গেল। জামায় শ্যাওলা লেগে গেল। হাতের চুড়ি গুলোও মটমট করে ভাঙল কয়েকটা। কোমর অবধি খুলে রাখা ঘন কেশ অগোছালো হয়ে গেল। চশমাতেও ধুলো লাগল কিছুটা। তবুও তানিয়া কোনরকম আওয়াজ না করে রাস্তা থেকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। মনে হচ্ছে পালিয়ে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে। আজ বাড়ি ফিরলে ঝড় বয়ে যাবে তার উপর।

____________

ইহানের বাড়ি ভবনবিশিষ্ট নয়। একদম খোলামেলা বাড়ি। চারপাশে গাছগাছালি। বিশাল বড় বারান্দা। অফ হোয়াইট রঙের দেয়ালগুলোতে চমৎকার অঙ্কন করা হয়েছে।

তানিয়া বিশাল গেট পাড় হয়ে বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। এ বাড়ির কলিং বেল নষ্ট। কোন এক আড্ডায় ইহান কথাটা বলেছিল। তানিয়া হাত দিয়ে দরজায় কয়েকবার টোকা দিল। দরজা ভিড়িয়ে রাখা। ভেতর থেকে আটকানো নেই বিধায় ঢুকে পরল বাড়িতে। ড্রয়িংরুমে মাঝারি আকারের টিভি। এখান থেকেই রান্নাঘর দেখা যাচ্ছে। ইহানের ব্যবহৃত পারফিউম এর ঘ্রাণ পুরো বাড়ি জুড়ে। ইহানের বাবা-মা থাকে শহরে। ইহানের ডিউটি এখানে বলে একাই থাকতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে উনারা আসেন এখানে ছেলেকে দেখতে। শহরে দুজনের কর্মক্ষেত্র আছে বিধায় ছেলের সাথে থাকতে পারেন না উনারা। তানিয়া ইহানের ঘরটা এর আগে দেখেছিল একবার। অনেকদিন আগের বাড়িটি এমন ছিল না। সেসময় প্রহর তানিয়ার সাথে ছিল।

তানিয়া নির্দিষ্ট কক্ষে ঢুকতে দোনামনা করছিল। দরজা খোলা থাকায় তানিয়াকে দেখল ইহান। গম্ভীর স্বরে বললো,

” এসো।

তানিয়া চশমা ঠিক করলো। নিজের অবস্থা দেখে অসস্তি হলো নিজেরই। এমন সেজেগুজে কখনো স্যারদের সামনে আসেনি সে। জামাকাপড়ের বেহাল দশা। মনে মনে ইহান কি ভাববে কে জানে? খানিক লজ্জা নিয়েই ভিতরে ঢুকল তানিয়া। ইহানের হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পেল। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় রয়েছে ইহান। তানিয়াকে দেখে উঠে বসে ভদ্রতা দেখাল না। সকালে একটা কেসের জন্য এলাকার বাইরে যেতে হয়েছিল। সেখানে একটা চোর ধরা পড়েছে। ইহান ফোর্স নিয়ে সেখানে গিয়ে চোরকে ধরতেই লোকটা তড়িঘড়ি করে নিজেকে বাঁচাতে ইহানের বাহুতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এরপর পালিয়ে যেতে নিতেই অন্যান্য পুলিশ ধরে ফেলে লোকটাকে। আর এখন জেলে বসে আছে লোকটা।

তানিয়া বিছানায় বসল। ব্যাগ থেকে নিঃশব্দে ফাইলগুলো বের করল। ইহানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কিভাবে কেটে গেল স্যার?

” চোর ধরতে গিয়ে। বাদ দাও। কিছু খাবে?

” জি না।

” খাইয়ে দিবে?

” কি?

” কিছু না।

তানিয়া স্পষ্ট শুনেছে ইহানের কথা। তবুও মনে হচ্ছে তার শোনায় ভুল। এটা কেন বলবে স্যার? তানিয়া লজ্জা পেল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করলো। গালে লাল আভা উৎপন্ন হলো। ঢিপঢিপ আওয়াজ হলো বুকে। কেঁপে উঠল সে। শীতল প্রবাহ হৃদয় জুড়ে দুলে উঠল।

চলবে?
লেখনীতে: #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে