প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০৩

0
456

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৩)

আরহাম বাড়ি যাবে বলে কান্না করছে। বিষয়টা স্বাভাবিক হলেও প্রিয়তার মেজাজ খারাপ হবার উপক্রম। ও বাড়ি থেকে চলে আসার পর কেউ একটা কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেনি তারা কেমন আছে, কি খাচ্ছে? অথচ বাবা-মায়ের জন্য কান্না করতে করতে হেচকি উঠে গেছে আরহামের। এতই যখন ওদের জন্য মায়া তখন প্রিয়তার সাথে এলো কেন?

প্রিয়তা বিছানা গুছিয়ে, ঘর ঝাড়ু দিয়ে গ্যাসে ভাত বসাল। ঠান্ডা ভাত খাওয়ার অভ্যেস নেই আরহামের। তাই সকালে অল্প রান্না করছিল। প্রিয়তার কিছু বানাতে আলসেমি লাগছে। ও বাড়িতে কাজের লোক ছিল। কোন কাজই নিজে থেকে করতে হয়নি। বাবা-মা বাড়ি ফিরে যে যার মতো ঘরে চলে যেতো বলে মন খারাপ করে দু ভাইবোন ঘরেই বসে থাকতো। এখন বাইরে বেরিয়ে টিউশনি খুঁজতে হচ্ছে, রান্না করতে হচ্ছে,কতশত চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। জীবনের বাঁক এভাবে ঘুরে যাবে কখনো ভাবেনি প্রিয়তা। পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুহুর্তেই রাগ গলে গেল তার। মন খারাপের বার্তা এলো। গাল বেয়ে অঝরে পানি গড়াল। আরহাম তার মায়ের ভালোবাসা পাচ্ছে না। বাবার করুণার পাত্র হয়ে রয়েছে। এই ছেলেটার তো এমন জীবন পাওয়ার কথা ছিল না। আদরে আদরে বেড়ে ওঠার কথা ছিল ছেলেটার।

প্রিয়তা হাঁটু গেড়ে বসে রইল রান্নাঘরে। সময় চলে যাচ্ছে তরতর করে। এভাবে মুখ গুঁজে বসে থাকলে চলবে না। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল মুছে হাসিমুখে আরহামের কাছে এলো প্রিয়তা। কোলে নিল ছেলেটাকে। চুমু খেয়ে ভরিয়ে দিল ভাইয়ের ললাট। বললো,

” আম্মু তো ফোন দেয়নি ভাই। ওখানে গেলে তোমাকে ভালোভাবে থাকতে দেবে না। আমি তো আছি তোমার কাছে। ভয় পেয়ো না।

আরহাম পিটপিট করে চোখের পাতা কয়েকবার এক করলো। নাক টেনে চোখ মুছল। বললো,
” তুমি থাকো না। আমার ভাল্লাগে না একা। কোনো মানুষ নেই এখানে।

” আমি টিউশনি পেলে তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। ওখানে মানুষ থাকতে পারে। তুমি আমার সাথে থাকবে, যতটা সময় আমি বাইরে থাকি।

” আমার এখন নুডুলস খেতে ইচ্ছে করছে আপু। ভাত খাবো না। তরকারি মজা লাগে না

চিন্তায় পরল প্রিয়তা। ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সে। পেয়াজ মরিচ ছাড়া ডিম ভেজেছিল তাতে লবন হয়নি ভালোমতো। এক জায়গায় লবন বেশি হয়েছে আরেক জায়গায় লবণ হয়-ইনি। এখন তো ঘরে নুডুলস নেই। দোকানে গিয়ে আনতে হবে। এরপর আবার রান্না করার ও ধকল আছে। তবুও ভাইয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিল প্রিয়তা। মাথায় ওড়না চেপে বেরিয়ে আসল বাইরে। দোকান থেকে নুডুলস কিনল ভাইয়ের জন্য। অতঃপর আধঘন্টা ধরে রান্না করে নুডুলসের বাটি আরহামের সামনে দিল। খেতে গিয়ে কতশত গল্প করলো তারা। ফোনে কার্টুন দেখে বাকি সময়টুকু কাটাল। টিউশনির একটা ব্যবস্থা না করতে পারলে হচ্ছে না। আরহামের শখ, আহ্লাদ পূরণ করতে হবে। এমনকি আরহামকে পড়ানোর দায়িত্ব এখন প্রিয়তার। বাজারে কোনকিছুতে হাত দেওয়াই যায় না। সব সবজির ব্যাপক দাম। জমানো টাকা দিয়ে কতদিন চলবে?

____________________
সকলের মনে অনেক প্রশ্ন। প্রহর স্যার কেন এখন ডেকে এনেছেন? জানতে আগ্রহী সবাই। তানিয়ার নত মুখে অভিমান। কফির ফোঁটায় হাত জ্বলছে। লালচে একটা ভাব দেখা দিচ্ছে হাতে। এক্ষুণি মেডিসিন না নিলেই নয়। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছেড়ে উঠে যাওয়া যায় না। আবার বসে থাকতেও অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে একজনকে ডেকে বরফ আনতে বললো। এ অফিসের বাইরেই একটা দোকান আছে। বরফ থাকবে হয়তো।

প্রহরের সব কাজ শেষ হলো। আর তখনই পিছনের চৌষট্টি ইঞ্চির এলইডি টিভি অন হলো। সব পুলিশ অফিসার নড়েচড়ে বসল। সব মনোযোগ ঢেলে দিল প্রহরের কথায়। প্রহর রিমোট চেপে একটি ছবি বের করল। হাস্যজ্জল চেহারার এক মহিলার ছবি ভেসে উঠলো টিভিতে। সকলে আগ্রহী চোখে চেয়ে রইল। প্রহর বলতে শুরু করল,

আসসালামু ওয়ালাইকুম। আমার কথা মেনে এত সকালে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমি কিছু কথা বলবো, সকলেই মন দিয়ে শুনবে। মাথায় সেট করে নিবে সব। দ্বিতীয় বার যেন কথা রিপিট করতে না হয়।
পেছনে টিভির স্ক্রিনে যিনি আছেন তিনি ইতিশা নায়েমা। শি ইজ আ বিগ রাইটার ইন সিলেট। মেইবি উই অল নো হার। একসময় ইতিশা ম্যাম সাংবাদিক ছিলেন। “সিলেট দৈনিক সংবাদ”- এর একসময় পরিচিত মুখ ছিলেন। লেখালিখিটাকে পেশা হিসেবে নেবেন বলে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা এখন আর উনার পেশা নয়। ইতিশা নায়েমার একমাত্র ছেলে ইব্রাহিমের নিখোঁজের ঘটনা ইতিমধ্যেই শহরে ছড়িয়ে গিয়েছে। আমরা সকলেই এ কেসটা সম্পর্কে জানি। তিনি তার জীবনের তিক্ত ঘটনা বইয়ের পাতায় ছাপানোর সময় একটি পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন – ‘তার ছেলে ইব্রাহিম বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। ছেলেটা মানসিক ভারসাম্যহীন”। আর এখন সেই ছেলেটাকেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এক সপ্তাহ ধরে। প্রহর রিমোট চেপে ছবি বদলে ফেলল। একটা ছেলের ছবি ভেসে উঠল স্ক্রিনে। আবার বলতে শুরু করলো,

এখন তোমরা টিভিতে যেই ছেলেটিকে দেখছো এই সেই ইব্রাহিম। গত কয়েকদিন ধরে সে নিখোঁজ। যেহেতু ছেলেটা সুস্থ নয় তাই সকলের মতামত ইব্রাহিম হারিয়ে গেছে। এর পেছনে কারো কোন কোন ষড়যন্ত্র নেই। ইতিশা ম্যাম নিজে ঘটনাটি ঘটার পরদিন সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ইব্রাহিমের হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টা অসম্ভব। দশ বছরের ছেলেটা নিজ হাতে খেতে পারে না, হাত পা প্রায় অকেজো। একা কোথাও যেতে পারে না ইব্রাহিম। মায়ের সব কথাই শোনে। হারাবার মতো ছেলে ইব্রাহিম নয়। উক্ত কথার পরিপ্রেক্ষিতে সকলেই নিশ্চিত হয়েছিল ইব্রাহীমের নিখোঁজ হবার পেছনে কোন হাত আছে।
ইব্রাহিমের নিখোঁজের পর পু’লিশ ফোর্স বিষয়টা নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এই নিখোঁজ সংবাদের দু দিন পর আরেকটা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু নিখোঁজ। এর পরের দিন আরো একটি, এর পরের দিন আরো একটি। এভাবে গুনে গুনে ছয়জন বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে গত এক সপ্তায়। আর এরা প্রত্যেকেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু। কিছু মানুষের ধারণা এটা ছেলে’ধরা কেস। এই ধরনের বাচ্চাদের কিড’ন্যাপ করে কিডন্যা’পার-রা বাচ্চাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করে ব্যবসা করছে। এ কথা জানার পর ইতিশা ম্যাম বলেছেন ইব্রাহিমের সাথে হয়তো এমন কিছুই হয়েছে। কিন্তু তোমরা জানো কি এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে? এর পেছনেও জঘ’ণ্যতম সত্য রয়েছে।
গতকাল ইতিশা ম্যাম যখন বাড়ির বাইরে ছিলেন তখন আমি আর ইহান বেলকনির পাইপ বেয়ে লুকিয়ে ম্যামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ম্যামের বাড়ি আমরা সার্চ করেছি। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে ফিরে আসার পথে একটা ডায়েরি নজরে আসে ইহানের। ডায়েরি ঘেটে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। ডায়েরির মাঝ পৃষ্ঠায় শহরের নামকরা “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” কোম্পানির ওউনার জাফর আলীর ছবি পেয়েছি। আর ছবিটিতে লাল সাইন পেন দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেওয়া ছিল। ছবিটির নিচে গোটা অক্ষরে লেখা ছিল ” মুখোশ উন্মোচন”। কিন্তু এটুকু তথ্যে আমরা কিছুই বুঝিনি। কোন কিছুই জানতে পারিনি। তাই “ফুড অ্যান্ড কোল্ড” কোম্পানির এক কর্মচারীকে আমরা আটক করি। কয়েক ঘা দেওয়ার পর মুখ খুলেছে ছেলেটা। জাফর আলী নিজের কোম্পানিকে আরো উঁচু স্থানে নিতে, কাস্টমার বাড়াতে খাদ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন। কেক, বিস্কিট-এ হাইড্রোস নামক ক্যামিকাল ব্যবহার করে খাবারকে আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু করেন। খাদ্যে অধিক পরিমানে হাইড্রোস ব্যবহার মানুষকে মৃত্যুর দিতে ঠেলে দিতে পারে এ কথা জেনেও এমন কাজ করেন। এই বিষয়ে কোনোভাবে অবগত হন ইতিশা ম্যাম। কোম্পানির সব দুর্নীতির তথ্য নিয়ে নিজের বই লিখতে চেয়েছিলেন ম্যাম। তাই এর শাস্তিস্বরূপ ম্যামের ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

থমথমে পরিবেশ বিরাজমান হলো। সকলের চোখেমুখে পুরো ঘটনা জানার আগ্রহ। এতকিছু প্রহর বের করেছে কোন পুলিশকে না জানিয়েই। একজন জিজ্ঞেস করলো,

” স্যার, যদি ম্যামকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইব্রাহিমকে কিডন্যাপ করা হয়, তাহলে বাকি বাচ্চারা কেন নিখোঁজ হচ্ছে?

” ইতিশা ম্যাম ফেইমাস রাইটার। তার ছেলে নিখোঁজ এটা সবার কাছে একটি বিশেষ ঘটনা। এ নিয়ে তদন্ত করার জন্য উপরমহল থেকে চাপ দেওয়া হয়। জাফর আলী বুঝে গিয়েছে কেসটা নিয়ে অফিসাররা অনেক দুর যাবে। তাই নিজে যেন কোনোভাবে ধরা না পরে সেজন্য একটা পরিকল্পনা সাজিয়েছে। ইব্রাহিমের সাথে সাথে আরো বাচ্চাদের আটকে রেখেছে। যেন কেসটা অন্য দিকে ঘুরে যায়। সবাইকে বোঝানো হচ্ছে এই কাজটা করছে কোন এক দল। আমি শিওর ম্যামকে ব্ল্যাকমেইল করে লেখা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেও যখন ইব্রাহিমের খোঁজ পাওয়া যায়নি তখন বুঝে নিতে হবে ম্যাম অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। আর লেখালিখিও বন্ধ করেননি।
উপযুক্ত প্রমান জনগনের সামনে আনাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। আমি জানি তোমরা আমাকে বিশ্বাস করবে এবং পাশে থাকবে।

কথাগুলো সকলেই শুনল। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করল। প্রহর হাসল। কঠিন এক কেস পেয়েছে কয়েকদিন আগে। দুদিন আগেও কেসটা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন এই কেসের রহস্য তার কাছে খুব সহজ। শত্রুপক্ষের চাল ধরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে প্রহর। খুঁজে পেয়েছে বিখ্যাত লেখিকা ইতিশা নায়েমার ছেলের সন্ধান। আজ রাতে পুরো পুলিশ ফোর্সের শান্তির নিদ্রা আসবে চোখে।

_____________
প্রহরের কাজিনের বিয়ে কয়েকদিন বাদে। প্রহরের সবচেয়ে প্রিয় ফুপির ছেলের বিয়ে। বিয়েটা অনুষ্ঠিত হবে প্রহরদের বাসায়। প্রহরের বাবা পিয়াস করিমের দুটো বোন। ছোট বোনের ছেলে তিয়াশের বিয়ে। বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সকলকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন এসে পরবে দু একদিনের মধ্যেই। প্রহরের ব্যস্ততা কমলেই এনগেইজমেন্ট করে রাখবে বলে ভেবেছিলেন মিসেস নাবিলা। এখন প্রহরের ব্যস্ততা কম, তাই দেরি করার অবকাশ নেই। নতুন ভাড়াটিয়া প্রিয়তা আর আরহামকে শুধু জানানো বাকি। মিসেস নাবিলা সকালে একবার গিয়েছিলেন প্রিয়তার ঘরে। তখন ঘরে শুধু আরহাম ছিল। প্রিয়তা ঘরে ছিল না। আরহামকে বলে এসেছিল প্রিয়তাকে নিয়ে একবার যেন তাদের ঘরে আসে।

প্রিয়তা ভার্সিটি থেকে ফিরে আবারও বেরিয়েছিল বাইরে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিজ্ঞাপন বিলিয়ে এসেছে। দেয়ালে দেয়ালে টিউশনির সন্ধানে বিজ্ঞাপনের কাগজ লাগিয়ে এসেছে। এই বুদ্ধিটা প্রিয়তাকে শান্তশিষ্ট, ভদ্র ছেলে তন্ময় দিয়েছে। প্রিয়তার পাশে থেকে লেখা ফটোকপি করাসহ ঘুরে ঘুরে দেয়ালে আটকে দিয়েছে। বাড়িতে ফেরার পর প্রিয়তা ফোন ঘেটে ভাত আর শাক ভাজি রান্না করেছে। ফেসবুক নামক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আজকাল অন্যদের থেকে রেসিপি জানা যায় ছোট্ট একটি পোস্ট করার মাধ্যমে। রান্নার পরে যখন আরহামের মুখে বাড়িওয়ালা আন্টির তাদের বাড়ি যেতে বলার কথাটা শুনল তখন চিন্তা বেড়ে গেল প্রিয়তার। আন্টি কেন ডাকবে তাকে? প্রিয়তা কি কোন ভুল করেছে ?

দরজা আটকে আরহামকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো প্রিয়তা। সুতির কামিজ টা ঠিক করে নিল সে। আগে সবসময় দামি জামাকাপড় পড়তো প্রিয়তা। সুখী পরিবার না পেলেও আভিজাত্যে অভ্যস্থ ছিল প্রিয়তা। সুখ, সম্পদ পেলে কেউ আবার তা দূরে সরিয়ে রাখে? কিন্তু এখন অভ্যেস পরিবর্তনের সময় এসেছে। সাধারণ জীবনযাপনে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে ভেবেই ভারী শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। আরহামের এক আঙ্গুল ধরে হাসিমুখে প্রহরদের দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। কলিং বেল চাপলেই গৃহকর্মী দরজা খুললো। ভিতরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসল দুজন। কলিং বেলের শব্দে ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিধি। মেয়েটার বয়স প্রিয়তার চেয়ে একটু কমই হবে। নিধির মুখ প্রিয়তার খানিক পরিচিত। গতকাল সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় নিধির সাথে দেখা। প্রিয়তা জানতো না নিধি বাড়িওয়ালার মেয়ে। চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে ডেকে নিজের পরিচয় দেয় নিধি। নিধি যে খুব চঞ্চল তা তার অঙ্গভঙ্গি-ই বলে দেয়। প্রিয়তাকে নিজেদের ঘরে দেখে খুশি হলো নিধি। দৌড়ে এসে পাশে বসল। জিজ্ঞেস করলো,

” কেমন আছো প্রিয়তা আপু?

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তুমি কেমন আছো?

” আমি ফার্স্ট ক্লাস আছি। জানো এ বাড়িতে তোমাদের মতো আই মিন আমার সমবয়সী কেউ নেই। তুমি এসেছো বলে আমি কিন্তু খুব খুশি হয়েছি। তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবো এখন থেকে।

এতকিছুর মধ্যে একটা ভালো দিক খুঁজে পেল প্রিয়তা। আরহামকে দেখে রাখতে পারবে নিধি। সময়ে অসময়ে আড্ডা দিয়ে মনটাও ভালো হয়ে যাবে ভেবেই প্রিয়তার চোখ হাসল। জানতে পারলো মিসেস নাবিলা একটু বাজারে গেছেন। একটু পরেই চলে আসবেন। নিধির চঞ্চলতায় মুগ্ধ হলো প্রিয়তা। এটা ওটা নিয়ে আলোচনা করে লাগল। পাশ থেকে আরহাম উঠে গেছে তা খেয়ালে রইল না প্রিয়তার। ঘরগুলো ঘুরে দেখবে ভেবে নিধি মেয়েটাও অত পাত্তা দিল না।

প্রহর ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। গোসল করে বেরিয়েছে মাত্র। ভাইয়ের বিয়ের সব দায়িত্ব নিয়েছে প্রহর। বাড়িতেই কিছুদিন থাকবে ভেবেছে। গোসল করে বের হতেই নিজের ঘরে ছোট্ট একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু বাঁকা করল। ছেলেটা ভিষণ সুন্দর আর ছিমছাম দেহের অধিকারি। গাল দুটো ফোলা ফোলা বলে ছেলেটাকে দেখতেও আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু এ ঘরে ছেলেটার কি কাজ? কি চাইছে বাচ্চাটা? আরহামের পিছনে গিয়ে দু হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়াল প্রহর। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আরহাম তখন ঘরের শো পিস দেখতে ব্যস্ত। এ ঘরটার দরজা খোলা বলে ভিতরে ঢুকেছে সে। ভেবেছিল ঘরটা একনজর দেখেই চলে যাবে। কিন্তু ঘরে সুন্দর একটা খেলনা বাইক দেখে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরটির টেবিলে একটা সুন্দর চকচকে বাইক রাখা। বাইকটা আকারে অতি ক্ষুদ্র হলেও হুবহু সত্যিকারের বাইকের মতো। ঘর সাজিয়ে রাখার একটা আসবাবপত্র মাত্র। ও বাড়ি থেকে এ বাড়িতে আসার সময় আরহামের খেলনা গুলো আনা হয়নি। এই খেলনা বাইকটা আরহামের খুব পছন্দ হয়েছে।
আরহাম বাইকটা নেড়েচেড়ে দেখল। মেঝেতে বসে হাত দিয়ে চালিয়েও দেখল। অতঃপর কি ভেবে খেলনাটি টেবিলে রাখতে গিয়ে পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠ শুনে আঁতকে উঠল আরহাম। ছোট বাইকটা হাত থেকে ফসকে মেঝেতে পরল। ঝনঝন শব্দ হলো কিছুটা। বাইকের উপরিভাগ ভেঙে গেল নিমিষেই। ভয়ে হাত পা গুটিয়ে নিল আরহাম। কেঁপে উঠল ছেলেটার কায়া। করুণ চোখে তাকাল সুঠাম দেহের পুলিশের দিকে। আরহামের লোমকূপ দাঁড়িয়ে উঠল অজানা এক ভয়ে। আতঙ্কিত হয়ে মাথা নিচু করলো। মিনমিনিয়ে বললো,
” আমি ইচ্ছে করে করিনি। পড়ে গেল, ভেঙে গেল। আমি বুঝিনি।

গম্ভীর প্রহর আরহামের অভিব্যক্তির পরিবর্তন খুব সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। অনুতপ্ততায় দগ্ধ হয়ে আছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে ভয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসবে। ছেলেটার নাম যেন কি শুনেছিল? মনে পরছে না। প্রিয়তা নামের মেয়েটির ভাই এই ছেলেটা, তা প্রহর জানে। গতকাল প্রিয়তার কোলে দেখেছিল।
প্রহর তার গাম্ভীর্য খানিক ত্যাগ করলো। বিছানা থেকে শার্ট নিয়ে কোনভাবে গায়ে জড়িয়ে নিল। বোতাম গুলো আটকে নিতে নিতে বললো,

” এখানে কি করছো তুমি?

আরহাম তার মায়াময় মুখটা উঁচু করলো। ঠোঁট উল্টে কান্না করার ভঙ্গি করল। চিকচিক করে উঠল ছেলেটার চোখ। নাক কেমন লাল হয়ে গেল নিমিষেই। জড়তার কারণে কথা বলতেও দ্বিধায় পরল ছেলেটা। বললো,

” আমি ঘুরতে এসেছি। আন্টি বলেছিল আসতে। ওটা আমি ভাঙতে চাইনি।

” কিন্তু ভেঙে তো ফেললে ।

” তুমি না ডাকলে ভাঙতো না । পেছন থেকে ভূতের মতো ডাকলে কেন? দোষ তো আমার না।

প্রহর বিস্মিত হলো। একটু আগেই ছেলেটা কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল। কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। অথচ এখন কি কায়দা করে কথা বলছে। কি সুন্দর প্রহরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। ভাই বোন কি একই রকম নাকি? কেউ তো কারো চেয়ে কম নয়। এটুকু ছেলের কি সুন্দর সম্বোধন। প্রথম দেখায় এভাবে কেউ বলে?

” এই শো পিস টা কত দামী জানো? বললো প্রহর।

” জানবো না কেন? জানি তো। আমি আরেকটু বড় হলেই তোমাকে এমন বাইক কিনে দিবো। আর ঝামেলা করো না। আপু যদি জানে আমায় বকেছো তাহলে…

“কি করবে তোমার আপু?

এতক্ষণ যে সাহসী মনোভাব ছিল তা বদলে গেল। প্রহরকে হাতের ইশারায় নিচু হতে বললো। প্রহর শুনলো। একটু নিচু হতেই আরহাম কানে কানে বললো,

” আমার আপু কিন্তু ভূত। তোমাকে কামড়ে দেবে। আমায় বকলে ঘাড় মটকে দেবে।

কথাটুকু বলেই দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল আরহাম। প্রহর কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোন ভাই তার বোনকে ভূত বলে? পাগল কি এরা দুজন? নাকি প্রহর নিজে?

_______________

বিয়ের দাওয়াত পেয়ে খুশিতে আত্মহারা আরহাম। বিয়ে বাড়িতে হৈ হুল্লোর হবে ভাবতেই ছেলেটা হেসে উঠছে। প্রিয়তার এসবে মন নেই। প্রীতিলতা কিংবা আরিফ যতই খারাপ হোক, তারা তো প্রিয়তার আপনজন। রক্তের একটা টান আছে। এইভাবে থাকতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। সবকিছুতেই মন খারাপ হচ্ছে প্রিয়তার। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল তাই। মমতাময়ী মায়ের মুখ ভেসে উঠছে কল্পনায়। আগে কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল প্রিয়তার। হাসিখুশি থাকতো সবাই। প্রীতিলতা স্বাধীনচেতা মানুষ। সংসারের পাশাপাশি চাকরি করতে চাইতো। আরিফ কখনোই কোনকিছুতে বাঁধা দেয়নি। আর এ সুযোগ নিয়েই প্রীতিলতা কলিগের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। পাশাপাশি বসে গল্প করা, ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট, কাজের জন্য এখানে ওখানে একসাথে যাওয়া আসা করা সবটাই নিত্যদিনের রুটিং ছিল প্রীতিলতার। আরহামের জন্মের দু বছরের মাথায় ধরা পরে গেল প্রীতির অবৈধ সম্পর্ক। ঝগড়া বেড়ে গেল, দুরত্ব বেড়ে গেল, সম্পর্ক নষ্ট হলো। তারপর? তারপর আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না। কষ্টের কথা স্মরণ করলে কষ্ট বাড়ে, চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়ায়, বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। এসব আর ভাববে না প্রিয়তা। একবার ও না।

নিধির সাথে খেলাধুলা করে ঘরে ফিরল আরহাম। প্রিয়তা চলে এলেও আরহাম নিধির কথায় এতক্ষণ ও ঘরে ছিল। হাসিহাসি মুখে সে বোনের পাশে এসে দাঁড়াল। বললো,

” বিয়েতে আমি কি পরবো আপু? আমি কিন্তু খুব আনন্দ করবো।

প্রিয়তা মলিন হাসল। ভাইয়ের গাল আলতো চেপে বললো,
” তোমার তো জামাকাপড়ের অভাব নেই। যেকোন একটা পড়ে যেও।

” উহু, তুমি আমাকে নতুন শার্ট কিনে দিবে। ওগুলো আমি পরবো না। প্রমিস করো, কিনে দিবে।

নিদারুণ যন্ত্রণায় বুকটা কেঁপে উঠল প্রিয়তা। হাতে তেমন টাকা নেই। ঘরের টুকটাক জিনিসপত্র কিনে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বাকি যে টাকা আছে তা দিয়ে এখনো এক মাস চলতে হবে। আরহামকে জামাকাপড় কিনে দিলে সে টাকাটুকুও থাকবে না। ভাইকে কিভাবে বোঝাবে দুর্দশার কথা? বুঝবে আদৌ? কেন যেন মুখের উপর না বলতে পারল না প্রিয়তা। বললো,
” কিনে দিবো।

বিকেলে খেতে বসতেই একটা কল এলো আননোং নাম্বার থেকে। প্রথমে কলটা কেটে দিল প্রিয়তা। পরপর তিনবার কল দেয়ার পর ফোনটা ধরলো। নম্র স্বরে সালাম জানাল প্রিয়তা। ওপাশের নারী কণ্ঠে এক মহিলা বলে উঠল,

” হেই প্রিয়তা। হাউ আর ইউ? আমায় চিনেছো?

নিঃশ্বাস আটকে গেল প্রিয়তার। এই কণ্ঠ তার চেনা। আরিফ আগে এই মেয়েটার সাথে কথা বলতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো বান্ধবী। প্রিয়তা এই কণ্ঠ বহুবার শুনেছে। এই মহিলাটির প্রেমেই মজে আছে আরিফ। মহিলার নাম দীপা। তিনি ইন্ডিয়ান। কলকাতায় বসবাস করেন। হুট করে প্রিয়তাকে ফোন দিল কেন? নাম্বার-ই বা পেল কোথায়? কি চাইছে উনি? যা চেয়েছিলেন তা তো পেয়েছেন। প্রিয়তা আর আরহাম তো সরে এসেছে তাদের জীবন থেকে। এখন ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার কি প্রয়োজন? রাগে মুখ বিকৃত করলো প্রিয়তা। জ্বলে উঠল সর্বাঙ্গ। যথেষ্ট মার্জিত থাকতে চেষ্টা করলো। কণ্ঠ নামিয়ে বললো,

” আমায় কেন কল করেছেন? আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।

” রেগো না বেটা। শান্ত হও। ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার হবু সৎ মা।

” সৎ মা মাই ফুট। আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সো প্লিজ আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।

” আচ্ছা করবো না। একটু শুনে নাও আমার কথা।তোমার আম্মু যে বিয়ে করেছে তা কি তুমি জানো?

” কি বলছেন? বাজে বকবেন না।

” তোমার আম্মু আব্বুর ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর গতকাল তোমার আম্মু বিয়েও করে ফেলেছে। মায়ের বিয়েতে থাকতে পারোনি। কষ্ট হচ্ছে? বাবার বিয়েতে নিশ্চয়ই থাকবে? তোমায় নিমন্ত্রণ জানাতেই তো কল করলাম।

প্রিয়তা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলো। হাত পা অবশ হয়ে এলো তার। কখন যে টুপ করে চোখ থেকে তপ্ত নোনা পানি চিবুক বেয়ে গড়াল তা অনুমান করতে পারল না প্রিয়তা। সর্বাঙ্গে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। বক্ষদেশ কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথায় মুখ দিয়ে শ্বাস নিল প্রিয়তা। শব্দহীন কান্নার দাপটে নাক লাল হয়ে গেল। খট করে কল কেটে দিল প্রিয়তা। পাওয়ার বাটন চেপে ফোন অফ করে দিল। বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর তোলপাড় শুরু হলো প্রিয়তার। নাম না জানা ব্যথায় হাপিয়ে উঠল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি টুকু পেল না। এক স্থানে বসে রইল।এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন? বুকটা ভার হয়ে আসছে কেন?এটা তো হওয়ারই ছিল। তাহলে কেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে হৃদয়?
বোনের এমন অভিব্যক্তি দেখে আরহাম কাছে এসে বসল। পায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কি হলো আপু? কাঁদো কেন? আম্মু কল দিয়েছিল? যেতে বলেছে তাইনা? খুশিতে কাঁদছো?

প্রিয়তা ভেজা চোখে ভাইয়ের দিকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল আরহামের নরম গাল। জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝখানটায়। কিছুক্ষণ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। অতঃপর হুট করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল প্রিয়তা। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আরহামকে জড়িয়ে নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। খানিক উচ্চ স্বরে বললো,
” ভাই রে, আমরা এতিম হয়ে গেছি ভাই। আমাদের আর কেউ নেই। আম্মু চলে গেছে। তোর কথা ভাবেনি, আমার কথাও ভাবেনি। আমরা অনাথ হয়ে গেছি ভাই। আমাদের কেউ রইল না। আমরা কিভাবে থাকবো ভাই? কিভাবে বাঁচবো? আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি মরে যাবো ভাই। আমার কষ্ট হচ্ছে।

প্রিয়তার এমন কান্নায় আরহাম ও কেঁদে দিল। প্রিয়তাকে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখেনি আরহাম। বোনের এমন উন্মাদের মতো অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল সে। নিজের কান্না থামিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। বললো,

” তুমি কাঁদলে আমার কান্না পায় আপু। কেঁদো না। তোমাকে আইসক্রিম খাওয়াবো। আমার সাথে হাসো।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে