প্রিয়তার প্রহর পর্ব-০২

0
476

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (২)

প্রিয়তা যখন নতুন বাড়িতে উঠল তখন সন্ধ্যে সাতটা বেজে আঠারো মিনিট। বৃষ্টি নেই বললেই চলে। তবে গাঢ়, ঠান্ডা বাতাসে শীতল হয়েছে ধরনী। বাড়িটির রং হালকা গোলাপী রঙের। তিন ভবন বিশিষ্ট বাড়িটাকে বোধহয় আরো বড় করতে চায় বাড়ির মালিক। আজওয়াদ বিশাল বড় গেটটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। সিঁড়ি ভেঙে তৃতীয় ভবনে উঠল তারা। আজওয়াদ নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে কলিং বেল চাপ। পর পর দু-বার বেল বাজাতেই এক অর্ধ বয়স্কা ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন। আজওয়াদ নামক ছেলেটাকে দেখে মৃদু হাসলেন। আজওয়াদের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা দেখা দিল। জুতো খুলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আজওয়াদ মহিলার উদ্দেশ্যে বললো,
” তুমি বলতে না ভাড়াটিয়া খুঁজতে? এই নাও ভাড়াটিয়া। যা প্রশ্ন আছে করে নাও।

প্রিয়তা এগিয়ে এল। মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে দেখে ব্যতিব্যস্ত হলেন । দরজার কাছ থেকে সরে প্রিয়তাকে ভেতরে ঢুকতে বললেন। সোফায় বসতে দিয়ে বাড়িতে কর্মরত মহিলাকে শরবত আনতে বললেন। প্রিয়তার বিষয়টা ভালো লাগল। বুঝতে পারল আজওয়াদ নামক পুলিশের মা হন এই মহিলা। আজওয়াদ লাগেজ রেখেই একটি ঘরে ঢুকেছে। প্রিয়তা সরাসরি বলে উঠল ” বাইরে ঘর ভাড়া দেওয়ার পোস্টার দেওয়া দেখে এসেছি। মাসিক ভাড়াটা যদি বলে দিতেন।

মহিলার পোশাক মার্জিত। খয়েরী রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে বসে আছে সামনে। চুলগুলো শক্ত করে খোঁপা করে রেখেছেন। প্রিয়তার প্রশ্নে মহিলা হাসলেন। বললেন, “এত বড় বাড়িতে থাকার মানুষের অভাব। এক তলা আর দু তলায় ভাড়াটিয়ারা থাকে। আমাদের কোন কিছুর অভাব নেই। তাই ভাড়া অত বেশি নেই না আমি। কিন্তু মাসের দশ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিয়ে দিতে হবে। এই ব্যাপারে কোন ছাড় নেই”।

” আমি শুধু আমার ভাইকে নিয়ে এখানে থাকবো। আশা করি এতে আপত্তি থাকবে না আপনার? অস্বস্তি নিয়ে কথাটা বলে উঠল প্রিয়তা।

মিসেস নাবিলা সহসা বিস্মিত হলেন। খানিক গম্ভীর হলেন মুহুর্তেই। বোঝা গেল একা একটা মেয়েকে ঘর ভাড়া দিতে নারাজ তিনি। চোখমুখ কুঁচকে মিসেস নাবিলা বলে উঠলেন ” তোমার মা-বাবা নেই? এখানে তো ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয় না।

” আমার ভাইটাই আমার পরিবার আন্টি। আমার আব্বু-আম্মু প্রবাসী। আমি ওদেশে যেতে চাই না বলেই এখানে রয়েছি। আম্মু চলে আসবে কয়েকমাস বাদেই।

প্রিয়তা মিথ্যে বলতে বাধ্য হলো। আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। পরিচয় পত্র দেখে প্রিয়তাকে একটি ঘর দেখিয়ে দিলেন মিসেস নাবিলা। নাবিলার স্বামী নিজেও প্রবাসী। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে এ বাড়িতে থাকেন তিনি। ছেলে আজওয়াদ আর মেয়ে নিধি তার প্রাণ। প্রিয়তাকে তেমন পছন্দ না হলেও ছেলে সাথে করে নিয়ে এসেছে বিধায় পরিবার ছাড়াও ঘর ভাড়া দিতে রাজি হয়েছেন তিনি। বেগড়বাই করলে না হয় অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

আরহাম গভীর ঘুমে। প্রিয়তা নতুন ঘরে প্রবেশ করেই আরহামকে মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে শুইয়ে দিল। প্রীতিলতা আর আরিফ দুজনেই ভালো আয় করতো বিধায় ভিষণ সচ্ছল জীবনযাপন করতো প্রিয়তা আর আরহাম। তুলোর ন্যায় নরম বিছানায় শুতে অভ্যস্থ হলেও সেই অভ্যেস পরিবর্তন করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে এখন। আরহামকে শুইয়ে দিয়ে প্রথমেই প্রিয়তা ব্যাগ থেকে তারকাটা বের করে মিসেস নাবিলার থেকে হাতুরি এনে দেওয়ালের দু জায়গায় তারকাটা বিধিয়ে দিল। অতঃপর একটা মোটা দড়ি দু তারকাটায় শক্ত করে বেঁধে নিল। লাগেজে থাকা জামাকাপড় সবগুলো গুছিয়ে দড়ির উপর রাখল, ঘরের আশপাশ ঝাড়ু দিল, পানি আর কাপড় দিয়ে ঘর ঝেড়ে মুছে নিল। এতটুকু কাজ করেতেই হাঁপিয়ে উঠল প্রিয়তা। পিঠে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। মেরুদণ্ড ভেঙে আসছে মনে হলো। ঢকঢক করে বোতলের পানি পান করল প্রিয়তা। আরহামের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ঢুকড়ে কেঁদে উঠল। এই ছেলেটা কিভাবে এত কষ্টে থাকবে? প্রিয়তা যদি টিউশনি না পায়? কিভাবে চলবে? কি খাবে? স্মরণ হতেই দুশ্চিন্তা ঝেঁকে বসল মস্তিষ্কে। মা-বাবা ছাড়া কেমন লাগবে তাদের? কেন এত কষ্ট পেতে হচ্ছে?

মুঠোফোন চট জলদি হাতে তুলল প্রিয়তা। তন্ময়কে মেসেজ দিল। ইতিমধ্যে ছেলেটা পঞ্চাশেরও বেশী বার কল করেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রাখার কারণে শুনতে পায়নি রিংটোন। প্রিয়তার মনটা আরো খারাপ হলো যখন দেখল প্রীতিলতা কিংবা আরিফের কোন কল আসেনি। ফোনের পাওয়ার বাটন চেপে বালিশের নিচে ফোনটা রেখে দিল সে। অসময়ে ঘুম পেল খুব। পেটে ক্ষুধা থাকতেও অলসতার জন্য রান্না বান্না করলো না প্রিয়তা। সকালে আবার টিউশনি খুঁজতে হবে ভেবেই ভারী শ্বাস ফেলল। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিল। আরহাম কেঁপে উঠল। ছেলেটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুমে আচ্ছন্ন হলো নিজেও।

______________
সকালে শোরগোলে ঘুম ভাঙল প্রিয়তার। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ছিল বলে তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পরল। আরহাম ঘুমোচ্ছে এখনো। রাতে উঠে একটু কান্না করেছিল ছেলেটা। দু ভাই বোন অনেকক্ষণ জেগে ছিল রাতে। তাই আরহামকে ঘুমোতে দেখে ডাকল না প্রিয়তা। এ এলাকাটা একটু ভ্রমণ করা দরকার। যে এলাকার সদস্য হয়ে থাকতে হবে সে এলাকা চিনে রাখা প্রয়োজন। পূর্বের রুটিং মাফিক প্রিয়তার মর্নিংওয়াক করতে ইচ্ছে হলো। চুলে শক্ত করে ঝুঁটি বেঁধে জুতো পরে নিল। হাতে তন্ময়ের দেওয়া ঘড়িটাও পরে নিল। আরহামের গালে চুমু খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সতেজ সকালে উৎফুল্ল হলো প্রিয়তার মন। বাড়ির আশপাশে থাকা বিশাল মাঠটা নজর কাড়ার মতো। ফুলের ঘ্রাণে জায়গাটা সতেজ লাগছে। আরহাম উঠে যাবে ভেবে পা চালাল প্রিয়তা। এসে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সহসা গোলাকার এক বস্তু পায়ে লাগায় হুট করে মাঠে হাঁটু ভেঙে বসে পরল প্রিয়তা। ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল মুখ দিয়ে। ঝিমঝিম করে উঠলো হাঁটুর খানিক নিচ অংশ। চোখ চিকচিক করে উঠল ব্যথার কারণে। প্রিয়তা পা চেপে অদূরে থাকা অনেকগুলো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের দেখতে পেল। একজন মেয়ে আর দুজন ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখল তার দিকে। পাশে পরে থাকা গোলাকার বস্তুটি ক্রিকেট বল। ব্যথা পাওয়ার উৎস এই বলটাই। দূর থেকে যারা আসছে তারাই যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা বুঝতে সমস্যা হলো না প্রিয়তার। রাগে নাকের পাশ ফুলে উঠল তার। বলটা হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। লোকগুলোর আসার অপেক্ষা করল খানিক্ষণ। ওদের এগিয়ে আসতে দেখে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে পরল। ভিষণ আশ্চর্য হলো যখন বাড়ির মালিকের ছেলে অর্থাৎ আজওয়াদ নামক ছেলেটির হাতে ব্যাট দেখতে পেল। চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়তা। রাগ বেড়ে গেল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে বলে উঠল,
” আপনার কি খেয়ে আর কাজ নেই? আমার সাথে কি শত্রুতা? এভাবে আমায় আঘাত করলেন কেন? ইচ্ছে করে করছেন তাইনা?

সামনে আজওয়াদের ডান পাশে থাকা মেয়েটির চোখে গোলাকার চশমা। পরনে দামি কুর্তি। লম্বা বেনুনী বাতাসে দুলছে। মেয়েটির বা পাশেই শ্যামবর্ণের আরেকটি ছেলে। নাম না জানা ছেলেটার পাশে আজওয়াদ ব্যাট মাটিতে ঠুকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। গরমে ঘাম ঝরছে সবার। গায়ের কাপড় ঘামে ভেজা । আজওয়াদ শর্ট হাতার টি শার্ট পরেছে। টাউজারের নিচের অংশ গুটিয়ে নিয়েছে। সুঠাম দেহের ছেলেটির মাঝে অনুতপ্ততার রেশ নেই। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। কারো মুখে কথা না দেখে সামনের মেয়েটি চিন্তিত কণ্ঠে প্রিয়তার বাহুতে আর হাতে হাত রাখল। কোমল কণ্ঠে বললো,
‘ তোমার লাগেনি তো আপু? আমরা বুঝতে পারিনি। বেশি ব্যথা পেয়েছো?

প্রিয়তা উপলব্ধি করলো মেয়েটার কণ্ঠ মিষ্টি আর সুন্দর। আরো মনে হলো মেয়েটি ভিষণ ভালো। কিন্তু রাগ থাকায় শান্ত হতে পারল না প্রিয়তা। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
” লেগেছে। খুব লেগেছে। মনে হচ্ছে পা ভেঙে গেছে। কিন্তু যে মেরেছে তার কোন ভ্রূক্ষেপ আছে? ইনি পুলিশ কিভাবে হলো বলুন তো?

আজওয়াদ বোধহয় বিরক্ত হলো কথাটা শুনে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে স্থির করলো। ব্যাট মাটি থেকে উঠিয়ে কাঁধে নিয়ে বললো,
” আমি ইচ্ছে করে আপনাকে উদ্দেশ্যে করে বলটা মারিনি। এটা নিছকই দুর্ঘটনা।

” চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি? আমি যাচ্ছি দেখেও বলটা মারলেন কেন? আপনি যদি এমন করেন বাকি সাধারণ জনগন কি করবে ? আমার পায়ে যে আমি ব্যথা পেলাম এর দায় কে নিবে? প্রচন্ড রাগান্বিত ভঙ্গিতে বললো প্রিয়তা।

” লিসেইন মিস, কেউ সহজে ইচ্ছে করে এভাবে ব্যাট দিয়ে বল গায়ে লাগাতে পারে না। বলটা যেইভাবে ছোঁড়া হয়েছিল আমি সেই ভাবেই পিটিয়েছি। এতদূরে বলটা যাবে কে জানতো?

প্রিয়তার রাগে ওষ্ঠাদ্বয় দাঁত দিয়ে চেপে ধরল। হাতে থাকা বলটায় চাপ প্রয়োগ করল। বললো,
” বেশ, আসুন আপনাকে মেরে দেখাই। দেখুন বল লাগানো যায় নাকি। চলুন ওখানে। কিভাবে বল পেটাতে হয় দেখাচ্ছি।

আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাটি বলে উঠল প্রিয়তা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বল নিয়ে এগিয়ে গেল খেলার জায়গাটিতে। আজওয়াদের পাশে থাকা নাম না জানা ছেলেটি মুখ খুলল এবার। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
‘ ইট ওয়াজ আ এক্সিডেন্ট। কেউ ইচ্ছে করে করেনি। উই আর রিয়েলি ভেইরি সরি।

প্রিয়তা থামল না। তিনটে লম্বা লাঠি তথা ক্রিকেট স্ট্যাম্প গুলোর সামনে গিয়ে আজওয়াদের কাছ থেকে ব্যাট নিয়ে খেলার জন্য দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে ব্যাটটা মাটিতে ঠুকল। আজওয়াদ এর দিকে তাকিয়ে বললো,

” আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম ওখানে গিয়ে দাঁড়ান। আর কেউ একজন বলিং করুক।

” আমি আপনার কথা শুনবো কেন? আমি তো বলেছি অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘটেছে সব। অবাক হয়ে বলে উঠল আজওয়াদ।

” শুনবেন না কেন? এমনিতেই বল ছুঁড়ে পা জখম করে ফেলছেন, আবার মুখ ফুটে সরি ও বলেননি। এখন আবার বলছেন আমার কথা কেন শুনবেন? এক্ষুণি ওখানে গিয়ে না দাঁড়ালে আপনার থানায় গিয়ে আপনারই নামে মামলা করে আসবো।

চশমা চোখের মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলল। হাত দিয়ে আড়াল করলো ঠোঁট। সকলের দৃষ্টি মেয়েটিতে নিবদ্ধ হলো। চশমা ঠেলে মেয়েটি প্রিয়তার দিকে চেয়ে বললো,
” তুমি তো দেখছি ভারী বুদ্ধিমতী। একদম ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছো।

অপর ছেলেটি গলা নামিয়ে আজওয়াদের উদ্দেশ্যে বললো,
” প্রহর, সরি বলে দে ভাই। কত মানুষ এখানে দেখেছিস?নিউজ পেপারে ছাপিয়ে দিবে এসব। ভুল তো তোরই তাইনা? শুধু শুধু মেয়েটাকে রাগিয়ে বলের বারি খাস না।

রাগাশ্রিত চোখে তাকাল আজওয়াদ। কপালের রগ ফুলে উঠল রাগে আর বিরক্তিতে। ভ্রু কুঁচকে ফেলল সে। আঙ্গুল দিয়ে কপালে স্লাইড করলো। বললো,

” এই মেয়ে বল ছুঁড়ে আমাকে কাবু করতে পারবে ভেবেছিস? বলের আঘাত আমার কাছে পিপড়ের কামড়ের মতো লাগবে। ফোট!

আবার প্রিয়তার দিকে চেয়ে বললো,
” আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি মিস। তাই সরি আমি বলবো না। যা ইচ্ছা করুন।

প্রিয়তার রাগে কান্না পেল। লোকটা এত পাষণ্ড কেন? এইভাবে তার ক্ষতি করেও অনুতপ্ত হচ্ছে না। প্রিয়তা জমে গেল। আশপাশে যারা আছে তারা সকলেই আজওয়াদের সমবয়সী। আরো কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। সকলের চোখে বিস্ময় উপচে পড়ছে। সকলের এরূপ দৃষ্টিতে অসস্তি হলো প্রিয়তার। কিন্তু ততক্ষণাৎ পিছন থেকে বাচ্চা কণ্ঠের ডাক শুনে রাগ মাটি হলো প্রিয়তার। আরহাম ছোট ছোট পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমেছে। ঘুমের রেশ নেই চোখেমুখে। ফর্সা শরীরে কালো শার্ট মানিয়েছে। বাচ্চাকে আনন্দিত দেখাচ্ছে ভিষণ। মিষ্টি আদুরে কণ্ঠে পুনরায় প্রিয়তাকে ডাকল ছেলেটা,

” আপু, তুমি এখানে কেন?

প্রিয়তা ব্যাটটা ফেলে আরহামের কাছে এসে থামল। ফিসফিস করে আরহামের কানে কানে বললো,
” ঘরে যাও ভাই। আমি এক্ষুণি আসছি। এসেই সবটা বলবো।

আরহাম বিনা বাক্যে স্থান ত্যাগ করলো। প্রিয়তা ফিরে এলো সবার মাঝে। সবার সাথে ভাব জমাতে চাইল সে। প্রথমেই চশমা পরা মেয়েটিকে বললো,
” আপনার নাম কি আপু? আপনি বেশ কিউট। আমার ভালো লেগেছে।

মেয়েটা মুচকি হাসল। বললো,
” আমি তানিয়া, তানিয়া শেখ। তুমি?
” প্রিয়তা,শুধু প্রিয়তা।
আজওয়াদ এর পাশের ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললো,
” আর আপনি?
” আমি ইহান। ইহান তালুকদার।

প্রিয়তা ব্যাটটা হাতে নিল। মুচকি হেসে আজওয়াদের সামনে এসে বললো,
” আর আপনার নাম?
‘ আমার নাম আপনার জানা। বিরক্ত হয়েই কথাটুকু বললো আজওয়াদ। পুনরায় বললো ‘ এখান থেকে গেলে খুশি হতাম। আপনি আমার ভ্যালুএবল টাইম ওয়েস্ট করছেন।

প্রিয়তা হাসল একটু। কাল দুপুর থেকে খায়নি বলে শরীরে শক্তি নেই। তবুও ব্যাট উঠিয়ে শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে আজওয়াদের পেশিবহুল বাহুতে প্রহার করলো। বিকট শব্দ হলো। মুহুর্তেই নিস্তব্ধ হলো পুরো জায়গা জুড়ে। বিস্ময়ে মস্তিষ্ক যেন অপ্রস্তুত হলো। এক দু সেকেন্ড করে আরো কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল। সকলের অবাক দৃষ্টিতে তটস্থ হলো প্রিয়তা। কালবিলম্ব না করে ব্যাট ফেলে পিছু ফিরে ছুট লাগাল। প্রিয়তার স্থান ত্যাগ করা দেখে সকলের হুঁশ ফিরল। পেছনে থাকা সকলেই ছুটে এলো আজওয়াদের কাছে। কতকজন প্রিয়তাকে ধরার জন্য উদ্যত হতেই তানিয়া ওদের থামিয়ে দিল। হাতের ইশারায় সকলকে শান্ত হতে বললো। প্রিয়তার হাসি পেল। ছুটতে ছুটতে খুব গর্বের সাথে হাসি মুখে বললো,

” আমার সাথে লাগতে আসবেন না পুলিশম্যান। আমাকে আঘাত করলে আক্রমণকারীকেও আঘাত পেতে হবে।

হুট করে এমন এক ঘটনা ঘটবে ভাবেনি কেউই। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল আজওয়াদ। ওষ্ঠাধর কিঞ্চিত ফাঁক করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বাহুতে হাত দিয়ে বললো,
” আশ্চর্য মেয়ে মানুষ। মনে হচ্ছে মশা কামড়েছে। মেয়েটা নিশ্চিত বোকা। প্রহার করার জন্য শক্তি, বুদ্ধি, দুটোই থাকতে হয়। পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধ জয় করা কিংবা বিজয়ী হওয়া যায় না।

ইহান ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তার অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করেছে এতক্ষণ। মেয়েটাকে স্বাভাবিক লাগছে না মোটেই। পুলিশ জেনেও প্রহরকে আঘাত করার সাহস কিভাবে পেল ভেবেই গা শিরশির করছে তার। আজওয়াদ ইশতিয়াক প্রহরকে কোনো মেয়ে এভাবে প্রহার করতে পারে?এতো অবিশ্বাস্য। মেয়েটার ভয় নেই? কি হতে পারে জানা নেই? প্রহরকে বিস্ময় নিয়ে সে বললো,
” মেয়েটা অদ্ভুত। আমার সন্দেহ হচ্ছে। গতকাল যার কথা বলেছিলি এটা তো সেই মেয়ে।

এগিয়ে এলো তানিয়া। চুলগুলোকে পিছনে ঠেলে একটু হেসে বললো, ” ডোন্ট ওয়ারি স্যার। মেয়েটা এখন থেকে আমাদের নজরবন্দি। ওর ঘড়িতে আমি জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস সেট করে দিয়েছি। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা ওর গতিবিধি, কথোপকথন শুনতে পারবো। মেয়েটা কোন ক্রাইমের সাথে এড থাকলে আমাদের ধরতে খুব একটা অসুবিধা হবে না”।

উক্ত কথার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু মুচকি হাসল প্রহর। আজ ছুটির দিনে সব বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটানোর জন্য ক্রিকেট খেলাটাকে বেছে নিয়েছিল। প্রিয়তা নামের মেয়েটা সব গোলমাল করে দিল। সন্দেহ তার ও হয়েছিল প্রথমবার প্রিয়তাকে দেখে। এখন তানিয়ার পদক্ষেপটা ভালো লেগেছে কিছুটা । ইহান এর- ও ভালো লেগেছে বিষয়টা। পুলিশে কর্মরত তানিয়া মেয়েটা কাজের প্রতি ভিষণ দায়িত্বশীল। দিনের প্রায় ষোল ঘন্টাই প্রহর আর ইহানের মতো নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখে। ইহান নিজেও তানিয়ার কাজে খুশি হলো। কিন্তু তা প্রকাশ না করে ভিন্ন ভঙ্গিতে রাগান্বিত স্বরে বললো,

” তানিয়া, ইউ আর ঠু মাচ। রিস্ক নিয়ে এটা করতে গেলে কেন? মেয়েটা যদি বুঝে যেত? ব্লান্ডার হতো জানো না? না বলে কেন কিছু করতে যাও ?

খানিক কেঁপে উঠল তানিয়া। চশমা ঠেলে ঠিক করে নিল নিজেকে। প্রহর স্যার আর ইহান স্যার দুজনকেই প্রচণ্ড সম্মান করে তানিয়া। দুজনেই তার উপরের পদে রয়েছে। প্রহরের চেয়ে ইহানকে বেশি ভয় হয় তার। প্রহর তবুও হাসে, ইহান তো সর্বক্ষণ বকতে থাকে। গম্ভীর প্রকৃতির দুটো মানুষ তানিয়ার চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই বোধহয় এত সংকোচ। ইহানের কথা শুনে আঘাত পেল তানিয়া। প্রশংসা করতে এত কিপ্টামি করার প্রয়োজন কি? সমস্যা কোথায় লোকটার?

__________

খোলা বিশাল তৃণভূমি। গাছের পাতায় রোদ খেলা করছে। গাছ থেকে ফুল ঝড়ে মাটিতে অবস্থান করছে। কোলাহল বাড়ছে ক্রমশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে পরিবেশটা আরো বেশি সুন্দর লাগছে। আশেপাশে তরুন তরুণীর মেলা বসেছে যেন। প্রায় মানুষের পিঠে কলেজ ব্যাগ। ক্যান্টিনের আশপাশে ভাজা পোড়ার গন্ধ বিদ্যমান। সেখানেও ভিড় করেছে শিক্ষার্থীরা। প্রিয়তার দিকে অজস্র প্রশ্ন ছুঁড়ে উত্তরের আশায় অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তন্ময়। ছেলেটার শার্টের হাতা দিয়ে কবজি অবধি ঢাকা। সাদা রঙের শার্টটার সব বোতাম পরিপাটি করে লাগানো। একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হলেও এই পরিচ্ছন্নতা কেউ বদলাতে পারবে না বলে মনে হয় প্রিয়তার। প্রিয়তার একদিনের এডভেনচার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তন্ময়। প্রিয়তাকে আজ ভার্সিটিতে দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে। তন্ময় শতাধিক প্রশ্ন করেছে প্রিয়তাকে। সব প্রশ্ন শুনে খানিক দম ফেলে হাস্যজ্জল মুখে প্রিয়তা বলে,

” ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। এখনও আব্বু কিংবা আম্মু কল করেনি। বুঝতে পারছিস তন্ময়? উনারা কত রিল্যাক্সড?

তন্ময় মাথা নিচু করে ফেলল। জগতের নিয়মনীতি তার অদ্ভুত লাগে। প্রিয়তার বিষয়টা আরো অদ্ভুত। প্রিয়তার মা প্রীতিলতা স্বামী থাকতেও একজনকে ভালোবাসে। এই পরকিয়া ধরে ফেলার পর আরিফ হোসাইন নিজেও বিদেশী একটা মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রিয়তার বাবা-মা দুজনেই সরকারি কর্মকর্তা। শিক্ষিত মানুষের এমন মুর্খের মতো আচরণ মানা যায়? কাকে বেশি দোষ দেওয়া উচিত এ নিয়েও প্রিয়তা মেয়েটা দ্বিধায় আছে। আরহামের একটা পরিবার দরকার ছিল। কিন্তু তা কি ছেলেটা পেয়েছে? শুধুমাত্র বাবার করুণা টুকুই ভাগ্যে জুটেছে ছেলেটার। গতকাল বিকেলে এখানকার এক বাজারে গিয়েছিল তন্ময় আর প্রিয়তা। টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছে রান্নাবান্নার জন্য। তন্ময়ের মেসে একটা ছেলে থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেটা রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম জব করে। ছেলেটার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী বাজার করে এনেছে। সকালে আরহামের জন্য পরোটা আর ডিম ভেজে এসেছে প্রিয়তা । ছেলেটা একা একা কি করছে কে জানে? তন্ময় ব্যাগ থেকে কিটক্যাট বের করে প্রিয়তার হাতে দিল। বললো,” আরহামকে রেখে এলি। থাকতে পারবে একা একা? কোন বাড়িতে উঠেছিস বললিও না। বললাম নিয়ে যেতে ও বাড়িতে, তাও গেলি না।

“নিবো না কেন? সময় হলে ঠিকই নিবো। ধৈর্য ধর। আগে সবটা গুছিয়ে নিই।

তন্ময় বলে উঠল,
” আমি তোর আর আরহামের সুন্দর একটা ভবিষ্যত দেখতে চাই। তোর সুখ আমার সাথে ভাগাভাগি করবি তো?
_______________________

কম্পিউটারের কিবোর্ডের খটখট আওয়াজে কান দুটো ঝাঁঝিয়ে যেচ্ছে তানিয়ার। সামনে থাকা বড় ডেস্কের চেয়ারে বসে আছে প্রহর। ফোনে কাউকে কিছু বলে যাচ্ছে অনবরত। তার পাশেই ইহান ল্যাপটপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু খুঁজছে। তানিয়ার আশেপাশে আবার ত্রিশের অধিক পুলিশ ফোর্স বসে আছে। সকলেই মনোযোগী চোখে তাকিয়ে আছে সামনে। এ নিয়ে তিনবার বড়সড় হাই তুললো তানিয়া। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরছে, অথচ সময় যেন যাচ্ছেই না। দু ঘন্টা ধরে একই জায়গায় বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছে সকলে। কেবল ইহান আর প্রহর নির্বিকার। একজন ল্যাপটপে তথ্য বের করছে, আরেকজন নিজের মাথায় ঘুরে বেড়ানো রহস্যগুলোকে সকলের সামনে উপস্থাপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোরের আলো কেবল কেটেছে। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আসছে। থাই গ্লাসের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুধাবন করা যায়। কিন্তু সেসবে মন দিতে পারছে না তানিয়া। পুলিশ হওয়ার দরুন কল্পনাগুলোকে কল্পনায় আটকে রাখতে হচ্ছে। প্রহর আর ইহানের টিমে আছে বলে ঘুমটুম বাদ দিয়েছে অনেক আগেই। এত দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারদের পাওয়া যায় না শহরে। এই দায়িত্বের কষাঘাতে কত বসন্ত পেরিয়ে গেল তানিয়ার। এ আফসোস কি যাবে কখনো?

আবার মুখে হাত দিয়ে হাই তুললো তানিয়া। ঘুম কাটাতে বাকি সবার মতো কফিতে চুমুক দেওয়ার সময় ইহানের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পরলো দুজনের। ইহান তানিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সামনে তাকাতেই ইহানের চোখে চোখ আটকে গেল তানিয়ার। মুহুর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামাল তানিয়া। গা শিরশির করে উঠল। কিবোর্ড হাত দিয়ে চেপে অসস্তি কমাতে চাইল, এদিক ওদিক থাকিয়ে নিজের চঞ্চলতা কমাতে চাইল। ইহানের তীক্ষ্ম দৃষ্টি তখনো তানিয়াতে নিবদ্ধ। তানিয়ার এহেন হাই তোলায় বিরক্ত হলো বোধহয়। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে ডাকল,

“তানিয়া!

তানিয়া চমকে তাকাল। আচানক এমন ডাকে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়াল। কম্পিত হাতে টেবিলে কফিটা রাখতে গিয়ে গরম কফির ফোঁটা ছিটকে হাতে এসে পড়ল। জ্বলে উঠলো হাতের মুঠো। দাঁতে দাত চেপে ব্যথা লুকানোর চেষ্টা করল। বক্ষজুড়ে অজানা ভয়ে ছেয়ে গেল। কণ্ঠে জড়তা নিয়ে বললো,
” জি.. জি স্যার। ব..বলুন।

” এটা ঘুমোনোর জায়গা নয়। ঘুম পেলে বাড়ি যাও। কাজের হেরফের হওয়া আমার পছন্দ নয়।

ইহানের এহেন বাক্যে তানিয়ার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। নম্র কণ্ঠ অগোছালো হয়ে আসল। শুকিয়ে এলো বক্ষদেশ। অপমানিত হলো খানিক। সকলের সামনে এমন উক্তি শুনে চোখ ফেটে পানি বের হতে চাইল। তানিয়া মোটেই দুর্বল নয়। বড়সড় খুনিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিনা দ্বিধায়। মৃ’ত্যুভয় কখনোই কাবু করতে পারেনি তাকে। এতসব তানিয়া শিখেছে প্রহর আর ইহানের থেকে। বলতে জড়তা নেই প্রহর আর ইহান দুজনেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার অধিকারি। তারা কতশত মামলা ডিশমিশ করেছে তা জানা নেই তানিয়ার। ইহানের কথা শেষে আগের ন্যায় বসে পরল চেয়ারে। অভিমান কেটে গেল একটু পরই। ইহান বা প্রহর কেউই কাজে গাফিলতি পছন্দ করে না। এমন বকা অহরহ খেতে হয় তাকে। তবুও নারীর নরম সত্তা মাঝেমাঝে অভিমানে বুঁদ হয়ে থাকে। কেউ বোঝে না সেই অভিমান, জানতেও চায় না।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে