পরিণতি পর্ব -১

0
1957

পরিণতি পর্ব -১
লেখক: জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

মেহজান…?
মা তাড়াতড়ি বের হও তোমার স্কুলের দেড়ি হয়ে যাবে তো।
-আরেকটু মা
– আরেকটু না মা।হয়েছে তো এখন বের হও।
– আরেকটু, আসছি আম্মু।

৫ মিনিট হয়ে গেলো মেহজান ওয়াশরুমে ঢুকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দাত ব্রাশ করছে।এদিকে মোহনা মেয়েকে ডেকেই যাচ্ছে।মেহজানের বয়স পাঁচ বছর। এ বছর’ই তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে।অথচ এটুকু বয়সে নিজের টুকটাক কাজ গুলো সে নিজেই করে নেয়।দাঁত ব্রাশ করা, গোসল করা সব কিছুই নিজে করে। মাঝে মাঝে ড্রেস পড়ার সময় জামা টেনে টেনে পড়তে গিয়ে ব্যার্থ হয় সে, তারপর গিয়ে মায়ের সাহায্যে জামা পড়ে। তবে এ মেয়েকে ঘুম থেকে তুলতে গেলে মোহনার প্রচুর বেগ পেতে হয়।আজও তেমনটাই হয়েছে। সকালে মোহনা ৩০ মিনিট ধরে ডাকার পর মেহজান উঠে বিছানায় পা মেলিয়ে, বসেই ঘুমোনো শুরু করেছে। ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুলের, সামনে দিয়ে কাটা চুল গুলো চোখের উপর পরে আছে। ছিমছাম দেহের ফর্সা রঙের মেহনাজ। পা মেলিয়ে সোজা করে বসে মেয়েকে এভাবে ঘুমোতে দেখে মোহনা মেহজান কে কোলে তুলে নিলো, উঠে দাড়াবে এমন সময় মেহজান চোখমেলে বলা শুরু করে,
-এয়েয়েয়ে আমাকে তুমি আজও কোলে করে ওয়াশরুমে নিতে চেয়েছিলে! বলেই হাত পা ছুড়াছুড়ি করতে লাগলো।মোহনা মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই মেহজান সোজা হেটে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।মেয়ের এমন কান্ড দেখে মোহনা হেসে দেয়।
তারপর, মেহজানের স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে টিফিন বক্স, ওয়াটার পট ব্যাগে ঢুকিয়ে চেইন লাগিয়ে রেখে দিলো। একটু পর গিয়ে মেয়েকে ডাকা শুরু করে।

মেহজান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মোহনা তাকে স্কুলের জন্য রেডি করিয়ে দিয়ে নিজে তৈরী হতে যায়।
এদিকে মোহনার মা বীনা আহমেদ টেবিলে মেয়ে আর নাতনির জন্য খাবার দিয়ে দেয়।
বীনা আহমেদ মেহজান কে খাওয়াচ্ছিল মোহনা এসে কোন রকমে খেয়ে মেহজানকে নিয়ে বের হবে, তখন মেহনাজ বলে ওঠে,
– মা আমার টিফিন নাও নি তো।
– টিফিন নিয়েছি মা।ব্যাগে রাখা আছে স্কুলে গিয়ে দেখো।এখন দেড়ি হচ্ছে বের হও।
– না না না, তুমি আবার টিফিন বক্স নিজে ব্যাগে ঢুকালে কেনো ? ওইটা আমি ঢুকাবো।আমার কাজ আমি করতে পারি তো।আমি কত্তো বড় হয়েছি দেখো।এই বলে মেহজান নিজের মাথার কিছুটা উপরে হাত রাখলো।সে বোঝাতে চাইছে সে অনেক বড় হয়ে গেছে।

অন্য সময় হলে এ কথা নিয়ে মোহনা অনেক মজা করে হাসতো।মোহনা তার মেয়ের প্রতিটি ছোটখাট বিষয়ও অনেক আনন্দের সাথে নেয়।তবে এ মুহুর্তে মেহজানের স্কুলের সময় হয়ে গেছে।আট টায় ক্লাস শুরু হয় ওর। পাঁচ মিনিট আগেই স্কুল গেইট বন্ধ করে দেয়া হয়।মেহজান কে স্কুলে দিয়ে সেদিক থেকেই মোহনা অফিসে চলে যায়। নয়টা থেকে তার অফিস। তাই, এ সময়টুকুর জন্য আর বাসায় আসে না। অফিসে তাই একটু আগে আগেই চলে যায় মোহনা।সব স্টাফদের মাঝে মোহনাই সব সময় টাইম মেইন্টেন করে আর কাজের প্রতিও তার কোন অনীহা নেই। এ কারনে বসের কাছেও সে খুব পছন্দের একজন।

এখন দেড়ি করা যাবে না বলেই মোহনা বললো,
-কাল থেকে তুমি’ই ব্যাগে টিফিন বক্স ঢুকাবে মা এখন প্লিজ চলো দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আমাদের। এই বলে মোহনা মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে।ওরা বেড়িয়ে যাওয়ার পর বীনা আহমেদ দরজা টা লাগিয়ে দিলো। এখন সারাটা দিন তাকে বাসায় একা থাকতে হবে।সারা দিন বললে ভুল হবে, মেহজানের স্কুল বারোটায় ছুুটি হবে তখন তিনিই নাতনিকে আনতে যান।মোহনা একেবারে বিকেল চারটার দিকে বাসায় ফিরে।

মোহনা মেহজান কে নিয়ে একটা অটো করে স্কুলে চলে গেলো, স্কুলের গেইটের ভিতরে মেয়েকে ঢুকিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে চলে গেলো।
বিকেলে বাসায় ফিরে দেখে মেহজান ঘুমিয়ে আছে। ফ্রেস হয়ে খেয়ে রেস্ট নেয় কিছুক্ষন মোহনা,একটু পরই নাচের জন্য মেয়েরা চলে আসবে।মোহনা খুব ভালো নাচ করে। জীবনের চলার পথে যখন হুমরি খেয়ে পড়েছিল তখন একটা সাধারন মেয়ে তার মা ও মেয়েকে নিয়ে একা একটা শহরে অনেক যুদ্ধ করে বেঁচে আছে।যেখানে একটা ছেলের সংসারের ঘানি টানার কথা সেখানে সব দায়িত্ব মোহনার উপর।

নাচের ক্লাস শেষ হতে না হতেই এর মাঝে মেহজান উঠে পড়ে।বাচ্চা মেয়েটাও যেনো বোঝে তার মা তাদের জন্য কত কষ্ট করছে।মেহজান একটুও মাকে ডিস্টার্ব না করে উঠে নানুর কাছে চলে যায়। বীনা আহমেদ নাতনিকে ফ্রেস করে দিয়ে ছবির পুরোনো অ্যালবাম দেখছিলো।সংসারের পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই তার চোখ ভিজে গেলো ততোক্ষনে মোহনার নাচের ক্লাস করানো শেষ।রুমে এসে মা কে অ্যালবাম নিয়ে বসে কাঁদতে দেখে হাত থেকে অ্যালবামটা কেড়ে নিয়ে বললো,

‘মা তোমাকে না কতবার বলেছি এসব দেখবে না।আমাকে কখনো এসব দেখতে দেখেছো?
পুরোনো কিছুর সাথে আমাদের আর সম্পর্ক নেই তাই এসব দেখবে না।’ বলে আলমারিতে অ্যালবামটা ঢুকিয়ে রেখে দিলো।

রাতে মেহজান কে হোমওয়ার্ক গুলো করিয়ে স্কুলের পড়া শিখিয়ে সবাই এক সাথে খেতে বসেছে।বাসার রান্না সহ বেশির ভাগ কাজ গুলোই মোহনার মা করে রাখে। মেয়ে সংসারটা চালানোর জন্য সারাদিন পরিশ্রম করে। তাই বাসায় ফেরার পর মেয়েকে আর কিছু করতে দেন না তিনি।
খাওয়া শেষ করে মোহনা মেহজান কে ঘুম পারিয়ে দেয়, তারপর আলমারি থেকে অ্যালবাম টা বের করে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একটা ছবির উপর।ছবিটায় মোহনার হাজবেন্ড এর পাশে মোহনা দাড়িয়ে আর মোহনার কোলে ছোট্ট মেহজান।
মোহনার চোখের কোন বেয়ে একফোঁটা পানি ছবিটির উপর পরতেই মোহনা চোখ মুছে নিলো।ছবিটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলো।
মানুষ তার অতীত ভুলতে পারে না।কোন মানুষেরই সে ক্ষমতা নেই।যারা বলে অতীত ভুলে গেছে তারা ভুল বলে।আসলে তারা যে কাজটা করে তা হলো, নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করে ফেলে। ফলে, একটা সময় অতীতকে নিয়ে আর ভাবনা আসে না।মাঝে মাঝে অতীত মনে হলে সেগুলোকে আর গুরুত্ব দেয় না। ফলে, খারাপ লাগাটা দূর হয়ে যায়। এজন্য তাদের মনে হয় তারা তাদের অতীত ভুলে গেছে।
মোহনা ও তার আবেগকে কন্ট্রোল করে এগিয়ে গিয়েছে।বেঁচে আছে ছোট্ট একটা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।যাকে দেখলে তার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।

ছবিটা বুকে নিয়েই মোহনা বিছানায় ঘুমন্ত মেহজানের মুখের দিকে তাকালো।মেয়েটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মোহনা উঠে গিয়ে অ্যালবাম টা যায়গা মতো রেখে দিলো।তারপর মেহজানের পাশে এসে তাকে ধরে শুয়ে পরলো।চোখে এক রাশ স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে মোহনা।মেয়েটাকে বড় করতে হবে। ভালোভাবে মানুষ করতে হবে।মায়ের দায়িত্ব। সবকিছু একা সে পারবে তো? এসব ভাবনাই সারাক্ষন তাকে তাড়া করে বেড়ায়।মেয়েটাকে নিয়েই মোহনার সকল ভাবনা।মেহজানের মুখের দিকে তাকালেই তার বুকচিড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে।মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।ভয়ে আঁতকে থাকে সারাক্ষন। সে যে সব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে তার মেয়েকে সেগুলো সহ্য করতে হবে নাতো?এসব ভাবনা আসলেই মেহজান কে বুকে নিয়ে সে শক্ত করে ধরে রাখে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে