পরিণতি পর্ব:৮

0
1199

পরিণতি পর্ব:৮
লেখক:জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

দেখতে দেখতে দুইটা বছর চলে যায়। আমার কোল আলো করে আসে মাহিনের কন্যা। মাহিনই মেয়ের নাম রেখেছিলো মেহজান। এই দুইটা বছর আমি মাহিনের চোখে যা দেখেছি তা শুধু আমার জন্য পাগলের মতো ভালোবাসা। মাহিন এই দুইটা বছর আমাকে নিজের জীবন দিয়ে আগলে রেখেছে। আমি অসুস্থ হলে আমার সেবা করে গেছে। যখন মেহজান আমার গর্ভে এলো তখন আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতো।
মাহিনের বুকে মাথা রাখলে আমার মনে হতো আমি স্বর্গে আছি। মাহিন তার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে পাগল করে দিয়েছিলো।
খুব ভালোভাবে দিন কাটছিলো আমাদের। মাহিন ব্যাংক থেকে প্রতিদিন সন্ধায় বাসায় এসেই, মেয়েকে কোলে নিয়ে, এক হাতে আমাকে বুকে টেনে নিতো।
একদিন ব্যাংক থেকে ফিরে, মাহিন একটা নীল শাড়ি নিয়ে বাসায় আসলো। আমাকে বললো,
-কাল ঘুড়তে যাবো এই শাড়িটা পড়ে বের হবে তুমি।
আমি তখন মেহজান কে খাওয়াচ্ছিলাম। শাড়িটাকে এক নজর দেখে মেহজান কে আবারো খাওয়াতে শুরু করলাম।
পরদিন সকালে নাস্তা করেই মাহিন আমাকে বললো, যাও তৈরী হয়ে নাও বের হবো তো আমরা। আমি জিঙ্গেস করলাম,কোথায় যাবো আমরা? মাহিন বললো,
-গেলেই দেখতে পাবে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে মেহজান কে জামা পড়ালাম। শাড়ি চেঞ্জ করবো, কিন্তু মেহজান কিছুতেই আমার কোল থেকে নামছিলো না। অনেক কষ্টে তাকে মাহিনের কোলে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নীল শাড়িটা পড়লাম। মেহজান কান্না করে আবার আমার কোলে চলে এলো। মেয়েটার জন্য একটু সাজতেও পারিনি। মাহিন আমাকে খাটে বসিয়ে দিলো। মেহজান কে কোলে নিয়ে আমি বসে রইলাম, আমার সামনে বসে মাহিন আমার কপালে একটা নীল টিপ দিয়ে দিলো। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে দিলো। তারপর চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে বললো, পার্ফেক্ট।
আমি মাহিনের গাল টেনে বললাম, ওরে আমার জামাইরে। এবার চলো।

তারপর বের হয়ে যাই দুজন। মাহিন গাড়ি ড্রাইভ করছিলো। আমি পাশের সিটে মেহনাজ কে কোলে নিয়ে বসে রইলাম।
-হ্যা মাহিন, এবার তো বলো কোথাই যাচ্ছি আমরা?
-তোমার মামার বাসাই যাচ্ছি। মা যেতে বলেছে।
আমি মুহুর্তে খুশি হয়ে গিয়ে বললাম,সত্যি!
মা কে অনেকদিন হলো দেখা হয় না।
-হুম কাল ফোন দিয়েছিলাম। মা বললো একদিন যেতে, নাতনিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তাই আর আমিও দেরি করলাম না। আজই যাচ্ছি।
আমার খুব ভালো লাগছিলো। নিজেকে নিয়ে আমার গর্ভ করে বলতে ইচ্ছে করছিলো, ভাগ্য করলে এমন হাজবেন্ড পাওয়া যায়।

একটু পরই মেহনাজ আবার কান্না শুরু করে। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা। মাহিন কে বললাম, একটা পানির বোতল কিনতে হবে সামনের কোন দোকান থেকে।মাহিন কিছুটা পথ গিয়ে এক সাইডে গাড়ি থামালো। রাস্তার ওপাশটাই একটা দোকান। মাহিন বললো,তোমরা গাড়িতেই বসো আমি পানি নিয়ে আসছি।
আমি মেহজান এর কান্না থামিয়ে ওকে কোলে নিয়ে দোল খাওয়াচ্ছিলাম। রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে দেখলাম মাহিন একটা পানির বোতলের সাথে কিছু চকলেটও কিনেছে। এই মানুষটা সব কিছুতেই আমার পছন্দের জিনিসগুলো নিতে ভুলবে না কখনো। মাহিন রাস্তা পার হয়ে আসছিলো আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম।
মুহুর্তে একটা বিকট শব্দে আমার হাসিটা মিলিয়ে গেলো।

ঠিক দুদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে। তাকিয়ে দেখি আমি হসপিটালের বেড এ শুয়ে আছি। পাশে আমার মা আর শ্বাশুড়ি বসা। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই মা আমাকে বলে, উঠিস না মা শুয়ে থাক।
আমি কথা বলার শক্তি পাচ্ছিলাম না। কোনভাবে বলি, মাহিন?
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। আমার আর বুঝতে কিছু বাকি থাকে না। স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকি আমি। চোখের কোণ বেয়ে পানি ঝরছিলো।

আরো দুদিন পর হসপিটাল থেকে ছাড়া হয় আমাকে। এ দুদিনে আমি একটা বারের জন্যও মেহজানের খোঁজ নেই নি। না কারোর সাথে কথা বলেছি। আমার জগৎ টাই যে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করতেই মাহিনের সেদিনের সে দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে থাকে।

সময়ের সাথে মানুষ সব কিছু ভুলে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।হয়তো কষ্ট হয় তবে বেঁচে থাকতে শিখে যায় সকলে।মানুষগুলো চলে গেলোও তাদের স্মৃতিগুলো ঠিকই রেখে যায়।মাহিন চলে যায় তবে তার স্মৃতি মোহনাকে বেধে রাখে। তাই মাহিনের স্মৃতিগুলো আকড়ে ধরে শ্বশুড় বাড়িতে মেয়েকে নিয়েই থাকা শুরু করি।

বীনা আহমেদের, মেয়েকে দেখলেই বুক চিড়ে এক দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসতো। কিছু বলতেন না। নিরবে মেয়ের জন্য কান্না করতেন। মোহনা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। মেহজান কে নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকে বাড়ির এক কোনায়। সংসারের কাজ করে। খুব কম বয়সে স্বামী মারা গেলে মেয়েদের আর শ্বশুড়বাড়িতে কোন জোড় থাকে না। না থাকে গলা উচু করে কথা বলার সাহস, না থাকে মাথা উচু করে বাঁচার অধিকার। খুব কম পরিবারে তারা সেই অধিকার টুকু পায়।
আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গিয়েছিলো শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলেছিলাম।

কিছুদিন ধরে আমি খেয়াল করছিলাম আমার দেবর রনি আমার দিকে কিভাবে যেন তাকায়। তবে আমি এটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো মেয়েকে নিয়ে থাকি। একদিন দুপুরে মেহজান কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কাপড় ভাজ করছিলাম এমন সময় রনি রুমে আমার ঢুকে এলো ।
আমি রনিকে দেখে একটু ঘাবড়ে যাই, কারণ আমার কাছে রনির ভাবভঙ্গি ইদানিং ভালো লাগছে না। রনি আমার রুমে ঢুকে বিছানায় মেহজানের পাশে বসে। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, -এ বয়সে স্বামী মারা গেলেও তুমি কিন্তু এখনো দেখতে ১৮ বছরের তরুনীর মতোই আছো। কথাটা বলে রনি আমার দিকে খুব বাজে ভাবে তাকায়।
আমার কাছে ব্যাপার টা অসহ্য লাগছিলো। আমি রনির সামনে গিয়ে রাগি গলায় বলি, এক্ষনি বের হয়ে যাও আমার রুম থেকে। ভুলে যেও না আমি সম্পর্কে তোমার ভাবি হই।
তখনি রনি আমার শাড়ির মাঝে কোমরে হাত রেখে বলে,রেগে যাচ্ছো কেনো আমি তো…
আমি রনি কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেহজান কে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে, সোজা শ্বাশুড়ির রুমে চলে যাই। গিয়ে সবটা শ্বাশুড়িকে বলি। তবে নিজের ছেলের নামে এমন কথা তিনি বিশ্বাস করেন নি। রনি কে ডাক দিয়ে জিঙ্গেস করলে, রনিও অস্বীকার যায়। তারপর আমার শ্বাশুড়ি বলে,
-ছিঃ ছিঃ বৌমা! আমার ছেলে মারা গেছে কিছুদিন হলো এর মাঝেই তুমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছো না? নিজের দেবরের দিকে হাত বাড়িয়েছো? আজ আমার ছেলেটা সহজ সরল বলে তোমার কুপ্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন উল্টো সাধু সাজতে আমার কাছে এসে এসব বলছো!

আমি মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনায় অবাক হয়ে যাই। ভাবতে থাকি আজ আমার শ্বাশুড়ি কিভাবে পাল্টে গেলো, আমাকে অবিশ্বাস করছেন তিনি।

আমি এতসব অপমান আর অপবাদ নিয়ে সেদিন মেহজানকে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম মায়ের কাছে। মামা বাড়িতে এসে সেদিন মাকে সব খুলে বলেছিলাম। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষন অঝোরে কেঁদেছিলাম।

সেখানে থেকেই আমি একটা চাকরী খুজছিলাম। মেহজানকে মায়ের কাছে রেখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে যেতাম। তখন বুঝেছিলাম বাবা ছাড়া, স্বামী ছাড়া একটা মেয়ে কত অসহায়। বাসে ট্রেনে যাতায়াত এর সময় কিছু লোক সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দিতো,সুযোগ পেলেই কুপ্রস্তাব দিতো।সমাজের মানুষের মুখে নানা ধরনের কথা। সব কিছু আমাকে শেষ করে দিচ্ছিলো। মাহিন কে বড্ড বেশি মিস করতাম।একসময় সেই শহরটাই আমার জন্য অসহ্য হয়ে গিয়েছিলো।মামার সাহায্য নিয়ে একটা চাকরী জোগার করি ঢাকায়। মা আর মেহজানকে নিয়ে চলে আসি এই শহরে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে