নীড় পর্ব-০৫

0
839

#নীড় #পঞ্চম_পর্ব

#সুহা

কিগো বৌ এমনে রাইতের সময় আঙিনায় বইয়া আসোস কে?আনিক বাবা কই? আর তুই কান্দোস কে?(চাচি)

চাচি তুমি হঠাৎ এহানে! ঘুম থিকা উঠলা কে। (নাইমা)

আরে আমি আর তোর চাচা তো উঠসি তাহাজ্জুতের নামাজ পড়বার লাইগা। উঠানের দিকে নজর পড়লো তো বাত্তি জ্বলতাসে দেইখা আইসি। এলা ক দেহি এত্ত রাইতে তুই এনে বই আসোস কে? (চাচি)

চাচি উনি হেই সকালে কামের লাইগা বাইর হইসে অহনো আহে নাই। ফোন দাও তুলতাসে না! উনি তো এত দেরি করে না সন্ধ্যার পরেই আইয়া পরে তো আইজ ……… চাচি হের কিছু হয় নাই তো? এমনিতেই সকালতে মনডা খালি কু ডাকতেসে। (নাইমা)

এত্ত ক্ষণ পার হইলো আর তুই এহন এডি কইতাসোস আমারে। আগে কস নাই কে? (চাচি)

চাচির ধমকে মুহূর্তেই নাইমার কান্নার বেগ পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। কী বলবে সে! পরিস্থিতিই এমন ছিলো তার কী করণীয় তাই সে ঠাওর করতে পারছিলো না। চাচি আপাতত তার দিকে ধ্যান দিলো না বরং চাচাকে ডেকে সব বললো। সব শুনার পরে চাচা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা প্রথমে অফিসে গিয়ে আনিকের খোঁজ নিবে অতঃপর দরকার পরলে পুলিশ এর কাছে যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতেই সদর দরজা দিয়ে আনিক প্রবেশ করে তার পিছু পিছুই অঙ্কিতাও আসে। সবাই আনিককে দেখে খুশি হলেও তার সাথে এক অপরিচিত রমণীকে দেখে বেশ অবাকই হয় বটে।

কিগো তোমরা এত রাত্রে এমন কইরা কই যাও? কিসু হইসে কী? (আনিক)

তুই এই কথা জিগাস? তোর কারণেই তো বের হইতেসিলাম। রাইত প্রায় শেষের দিকে এহন বাড়িত আইলি কে? বৌ কত টেনশন এ পইড়া গেসিলো, কানতেসিলো। এত রাইত হইলো কে তোর বাড়িত আইতে? (আনিক)

বলতেসি সব বলতেসি আগে ঘরে চলো সবাই, অনেক রাইত বাইরে না দাড়ায়ে ভিতরে বসি পরে কথা কই। (আনিক)

আনিকের কথায় সবাই সায় জানিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলো। নাইমা দ্রুত পানি নিয়ে আসলে আনিক আর অঙ্কিতা তা পান করে নিলো। আনিক কিছু বলবে তার পূর্বেই নাইমা বলে উঠে –

এইবার কও তোমার বাড়িতে আইতে এত দেরি হইলো কে? আর লগে উনি………

বাড়িতে প্রবেশের পর থেকেই নাইমার দৃষ্টি অঙ্কিতার দিকেই স্থির। এতক্ষন স্বামীর মুখ থেকে সব শুনবে বলে নীরব থাকলেও নিজের জানার কৌতূহল না দমাতে পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো। আনিক কিছু বলবে তার পূর্বেই অঙ্কিতা বেশ ঠাট্টার সুরেই বললো-

নারী মন সর্বদা স্বামীর শঙ্কায় শঙ্কিত না জানি স্বামী কখন হয়ে পরে পড়োনারীতে আসক্ত। (অঙ্কিতা)

কথাটি বলে হাসি হাসি মুখ নিয়ে অঙ্কিতা নাইমার দিকে তাকায়,বেচারির মুখটা ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেছে। আর বেচারি নাইমা! সে বেচারি তো বেকুব চলে গেসে। আসলেই স্বামীর সাথে অন্য মেয়েকে দেখে তার আত্মা কাঁপতেসে। কিন্ত এই মেয়ে কিভাবে জানলো তার মনে কী চলছে?

অঙ্কিতা নাইমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলে-

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আমি মানুষের মনের অবস্থা ধরে ফেলার বিদ্যা আছে আমার। তার উপর আপনার হাব ভাবে আপনার মনোভাব আমি কেন যেই কেউ ধরে ফেলতে পারবে।

নাইমা মুখে একটা বোকা বোকা হাসি ফুটিয়ে তুলে।বেচারি ধরা খেয়ে বেশ লজ্জায় পরে গেছে। এত সবের মাঝে মূল কথাটাই জানা হচ্ছে না তাই চাচা বলে উঠলো –

এডি তো হইবোই কিন্ত আগে আনিক এলা ক তুই এত রাইতে বাড়ি আইলি কে?

অতঃপর আনিক একদফা অঙ্কিতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ঘটনার আংশিক বর্ণনা করে। মারামারি আর বাবা-মায়ের অপমানের ঘটনটা সে প্রকাশ করেনি নাইমার কষ্টের কথা ভেবে এবং তার আত্মহত্যার বেপারটা অঙ্কিতাই বলতে মানা করেছে। বস্তুত অঙ্কিতা সম্পূর্ণ ঘটনা সম্পকেই অবগত, যাত্রার পুরোটা সময়ে আনিক অঙ্কিতাকে সব কিছুই খুলে বলেছে। সব শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে পরে,কী বলবে সেই মুখের ভাষা টুকুন খুজে পায় না।মানুষ কতোটা নিম্ন পর্যায়ে চলে গেলে নিজের আপন ভাই যে নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে তাকে লালন-পালন করলো তাকে এমন ঘৃনীত অপবাদে কলঙ্কিত করতে পারে। সব বলার পর আনিক মাথাটা একটু ঝাড়া দিলেই তার কপালের ব্যাণ্ডেজটা নাইমার দৃষ্টিতে পরে যায়। কাটা জায়গাটা বেশ উপরে হওয়ায় তাতে ওয়ান টাইম ব্যাণ্ডেজ করে তা অতি কৌশলে চুল দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলো আনিক। বেশ সফল হলেও শেষমেশ ধরা খেলোই। নাইমা দৌড়ে আনিকের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠে-

ওরা তোমারে মারসে না? ইশ অনেক ব্যাথা করতেসে? ওষুধ নিসো? আর তুমি বইসা আসো কেন আরাম করবা আসো।

নাইমার কথায় চাচা-চাচি ভালোভাবে খেয়াল করতেই তারাও দেখলো আনিকের মাথায় ব্যাণ্ডেজ। তারাও চিন্তিত হয়ে গেলো। কিন্ত কিছু বলবে তার পূর্বেই আনিক বলে –

আরে আরে শান্ত হও আমি ঠিক আসি। তেমন কিসু না খালি খালি টেনশন কইরো না তো,বসো তোমরা। আমি ঠিক আসি।

আজ তাহলে উঠি আনিক সাহেব ৭ দিন পর দেখা হচ্ছে আমার চেম্বারে। (অঙ্কিতা)

এত্ত রাত করে আপনে একা কেমনে.…. (আনিক)

এখন আর রাত নেই ঘড়িতে দেখুন ভোর ৫টা বাজে। আর একা চলার অভ্যাস আছে আমার টেনশন নিবেন না। আসি তাহলে নমস্কার। (অঙ্কিতা)

আচ্ছা চলেন অন্তত আপনের গাড়ি পর্যন্ত আপনারে পৌছায় দেই। (আনিক)

অঙ্কিতা মুচকি হেসে সবার থেকে বিদায় নিয়ে আনিকের সাথে বেরিয়ে পরে। অঙ্কিতা গাড়িতে উঠতে নিলে আনিক বলে উঠে-

আপনি আজকে আমারে এতগুলা উপকার করসেন যে আপনার কাসে আমি ঋণী হইয়া গেলাম। আপনার ঋণ কেমনে শোধ করমু তা জানা নাই আমার। যদিও আপনার উপকারের সামনে শুকরিয়া শব্দটা কিসুই না তারপরেও আপনারে অনেক শুকরিয়া।

যা করার, যা ভাবার সব সৃষ্টিকর্তা করেন আপনি আমি শুধু তার মর্জি মতো কাজ করি। সৃষ্টিকর্তার মর্জি ছিলো আপনাকে ভুল পথ থেকে ফেরত আনার তাই তিনি এনেছেন।আমি তো মাত্র একটি উসিলা, তাই শুকরিয়া করলে সৃষ্টিকর্তার করুন আমার না। আচ্ছা আজ আসি আর মনে আছে তো ৭ দিন পর আমার চেম্বারে আসবেন।

জি জি মনে আসে।(আনিক)

অঙ্কিতা হাসি মুখে গাড়িতে চড়ে বসলো। আর ভাবতে আসলেই পৃথিবীতে যদিও ৯৮ জন খারাপ মানুষ থাকে তো ২জন ভালো মানুষও আছে। আনিকের ভাবনার মাঝেই অঙ্কিতা জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললো –

আর হ্যা একা আসবেন না কিন্তু আপনার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন।

আনিক কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার পূর্বেই অঙ্কিতা পূর্ণরায় বলে ওঠে-

কোনো প্রশ্ন করবেন না যা বললাম তাই করবেন। (অঙ্কিতা)

অতঃপর অঙ্কিতা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলে আনিক ও পূর্ণরায় বাড়ির পথে রওনা দিলো।

আনিক ঘরে আসলেই চাচা-চাচি তাদের আপাতত আরাম করতেই বলে নিজেদের ঘরে চলে যায়। তারা চলে গেলে আনিক দরজার বন্ধ করে দেয়। পরপরই নাইমা আনিকে উদ্দেশ্য করে বলে-

তোমার মাথায় আঘাতটা আবিরই করসে তাই না?

আনিক পিছু ফিরে দেখে নাইমা অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আনিক সত্যটা বলতে চায় না কিন্ত কেন জানি আর মিথ্যাও বলতে পারছে না। চোখগুলো জ্বলছে কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে তার তাই কোনো প্রতিক্রিয়া না করে চুপচাপ বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। কিছু ক্ষেত্রে নীরবতাই সব প্রকাশ করে আনিকের জবাব টাও তার নীরবতা প্রকাশ করে দিয়েছে। নাইমা চুপচাপ আনিকের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো, এতক্ষন নিজেকে আটকে রাখলেও এখন আর পারলো না আনিক নাইমাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো সে। নাইমা টের পেলো ঠিকই কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না নীরবে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, কাদুক মন ভরে কাদুক নিজের ভেতরে কষ্টের পাহাড়টাকে ভেঙে চুরমার করে দিক!

ওই সন্ধ্যা হইয়া গেসে উঠবা না? এখন উইঠা যাও আবার রাত্রে ঘুমাইও, উঠো উঠো । (নাইমা)

সন্ধ্যা হইয়া গেসে?আর তুমি আমারে আগে ডাকো নাই কেন? (আনিক)

অনেক ধকল গেসে তোমার উপর আরামের দরকার ছিলো তাই ডাকি নাই। এলা উঠো কিছু খাইয়া লও। (নাইমা)

আনিক মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বেরিয়ে পরে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে। অতঃপর কোনোমতে একটু খাবার মুখে দিয়েই তৈরী হয়ে বের হতে লাগলে পথিমধ্যে চাচার সাথে দেখা হয় তার।

আরে আনিক বাবা কই যাস?(চাচা)

এইতো আগে যেই সাহেবের দলে দিনমজুরের কাম করতাম হের কাসেই যাইতেসি যদি আবার আমারে নিতো। নইলে এই ঢাকা শহরে কাম পাইতে যে বড়ই মুশকিল হইবো। (আনিক)

তা ঠিক কিন্ত আমি তোর লাইগা অন্য একটা কামের মাধ্যম এর কথা ভাবসিলাম। যদি তোর ভালো মনে হয় তো করিস।(চাচা)

কী কাজ? (আনিক)

আয় ঘরে বসে কথা বলি। (চাচা)

অতঃপর চাচা আর আনিক ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে।

মোড়ের মাথায় আলীর যেই কাপড়ের দোকান আসে ওটা ও বিক্রি করে দিতাসে। ভালোই বড় দোকান ঐটা আর এলাকার মধ্যে একটাই কাপড়ের দোকান তাই বিকিকিনি ও ভালোই হয়। কিন্তু গ্রামে বাড়ি করসে ঐখানেই চইলা যাইবো তাই এখানে আর কোনো কিছুই রাখবো না। গ্রামেই দোকান দিবো বইলা এখানে দ্রুত বিক্রি করবো বইলাই সস্তা দামেই দোকান ছাইড়া দিতেসে। দুই লাখ টাকায় দোকান বিক্রি করবো কইতাসে আমরা একটু চেষ্টা করলে হয়তো একটু কমেই ছাইড়া দিবো ।এহন দেখ তুই নিতে পারোস নি নইলে এই দোকান কমপক্ষে তিন লাখ তো হইবোই। (চাচা)

দাম তো কমই আসে কিন্তু আমার যা জমানো আসে তাতে লাখ এর মতো হইবো।আর বাকি এক লাখ টাকা কেমনে ….. (আনিক)

আমি আর তোর চাচী মিলা পঞ্চাশ হাজারের মতো জমাইসি তো দের লাখ তো হইয়াই গেলো।(চাচা)

এগুলা তুমি কী কও চাচা তোমাগো টাকা আমি কেমনে নিমু? না না আমি নিতে পারমু না। (আনিক)

কেন নিবিনা? তুই মনে কর আমার এই টাকাগুলা আমি তরে ধার দিতাসি। এই টাকার বদলে আজীবন এই বুড়া-বুড়িডারে নিজের লগে রাখবি। দরকার পড়লে একবেলা খাওয়াবি তাও রাখবি। এবার বল নিবিনা টাকা? (চাচা)

আনিকের চোখ ভিজে আসলো এত মায়া করে কেন এই মানুষগুলো তাকে ।সে হাসিমুখেই মাথা নাড়ালো যার অর্থ হ্যা। ততোক্ষনে চাচি আর নাইমাও এলে তাদেরকেও সব জানানো হলে তারা তাদের কিছু গহনা বের করলো যা বিক্রি করে ত্রিশ হাজারের মতো টাকা যোগান দেয়া সম্ভব। বাকিটা নাহয় ধার কিংবা লোন নিয়ে নিলো। যদিও আনিক সব সম্পদ একেবারেই ঝুকিতে ফেলতে চায় নি কিন্তু সবাই তাকে নানান বুঝ দিয়ে রাজি করলো।

অতঃপর আনিক রাজি হলেই তাকে নিয়ে চাচা বেরিয়ে পড়লো আলীর সাথে কথা বলতে। বহু কষ্টে আলিকে বুঝিয়ে দোকানের দাম একটু কমিয়ে নিলো তারা। এর পরের সময়গুলো যেন কাটতে লাগলো বিদ্যুৎ বেগে। দোকানটার রেজিস্ট্রেশনটা অনেক কষ্টে ২ দিনে সম্পন্ন করে নিলে। ধার দেনার মাধ্যমে ৩য় দিনেই দোকানে নতুন মাল তুলে ফেললো। অতঃপর তাদের নতুন ব্যবসা নতুন উদ্যোমে শুরু হলো। আনিকের দিন-রাত এক করে করা পরিশ্রম আর সততার ফলে প্রথম দিকেই সে গ্রাহকের মনে জায়গা করে নিতে লাগলো। এভাবেই কেটে গেল একটা সপ্তাহ, অতি ব্যস্ততায় অঙ্কিতার চেম্বারে যাওয়ার কথাটা আনিক নিতান্তই ভুলে বসলো। প্রায় দুই সপ্তাহ পর অঙ্কিতার কার্ডটা নজরে আসলে তার মনে পড়লো অঙ্কিতার চেম্বারে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাত হয়ে পড়ায় ঐদিন আর যেতে পারলো না পরের দিন সকালে চাচাকে একটু দোকানটা সামলাতে দিয়ে নাইমাকে নিয়ে ছুটলো অঙ্কিতার চেম্বারের উদ্দেশ্য।

চলবে………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে