নীড় পর্ব-০৬

0
818

#নীড় #ষষ্ঠ_পর্ব

#সুহা

৬ তলা বিল্ডিং এর ৪ তলায় নিজের কেবিনে বসে গভীর মনোযোগে একটি ফাইল পড়ছে অঙ্কিতা। হঠাৎই তার মনোযোগ ব্যাঘাত ঘটিয়ে দরজার কড়া নাড়লো কেউ। স্বাভাবিক ভাবেই তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো তবুও নিজেকে শান্ত রেখেই মিহি সুরে ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুককে ভিতরে আসার অনুমতি দিলো।

অঙ্কিতার অনুমতি পেতেই নাইমাকে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো আনিক। বেশ পরিপাটি এবং শীতল একটি পরিবেশ। আনিক আর নাইমা চারিদিকে একটু নজর বুলিয়ে সামনের দিকে যেখানে অঙ্কিতা বসে আছে সেখানে নজর স্থির করলো। অঙ্কিতাও
তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তাদেরকেও তার দিকে তাকাতে দেখেই অঙ্কিতা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-

আরে আনিক আর নাইমা যে আসুন আসুন বসুন।

অঙ্কিতার কথায় আনিক আর নাইমা টেবিলের বিপরীত পাশের চেয়ার এ বসতেই নজর পড়লো অঙ্কিতার টেবিলে রাখা নেমপ্লেটটিতে। এখানেও বেশ সুন্দর ও স্বচ্ছ লেখায় অঙ্কিতার নাম ও তার নিচে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লেখা। তাদের পর্যবেক্ষণ এর মাঝেই অঙ্কিতা বলে উঠে –

তা আজ হঠাৎ করে আমার সাথে দেখা করতে আসলেন? কোনো দরকার নাকি আমায় মনে পরে গেলো?

আপনে ভুইলা গেসেন? আপনিই না ঐদিন বলসিলেন আপনার সাথে ৭ দিন পর দেখা করতে?(আনিক)

উহু ভুলি নি,একদম মনে আছে। কিন্তু হয়েছে কী ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী ঐদিনের পর আজ ৭ম দিন নয় ২১তম দিন চলছে । (অঙ্কিতা)

অঙ্কিতার কথায় আনিক লজ্জা পেলো। ইশশ কী ভাবছেন অঙ্কিতা তার ব্যাপারে ! নিশ্চই ভাবছেন যে আনিক কেমন মানুষ কথার বড়খেলাপি করে। কী লজ্জার ব্যাপার!

আমি তেমন কিছুই ভাবছি না। আমি এমনিতেও জানতাম আপনি দেরি করেই আসবেন, কিন্তু তা যে একান্তই পরিস্থিতির চাপে তাও আমি জানি। (অঙ্কিতা)

আনিক হতবাক হয়ে বলে – আপনে জানতেন কিন্ত কেম……………………

আমি কিভাবে জানলাম আপাতত সেটা নিয়ে আলোচনা না করি। আপনাকে যেই কাজের ডেকেছিলাম তা মনে আছে তো?(অঙ্কিতা)

আনিক মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে সম্মতি জানালো।

অঙ্কিতা তার হাসিটা বজায় রেখেই বললো-

আর ইচ্ছা আছে আত্মহত্যা করার?

“আত্মহত্যা” শব্দটি শুনেই নাইমা কেঁপে উঠে। ডক্টর ম্যাডাম এটা কী বললো? কেন বললো? এতক্ষন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও এবার নাইমা প্রশ্ন করে উঠে –

আত্ম…… আত্মহত্যা মানে? এগুলা কী বলতেসেন আপনি? উনি আত্মহত্যা করবো কেন?

না না ও কিসু না বৌ। আমরা তো খালি………. (আনিক)

উহুম আনিক আজ না, ঐদিন লুকিয়েছিলেন আমি কিছুই বলি নি কারণ তখন তারা সত্যিটা জানলে তারা আপনাকে নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তায় ডুবে থাকতো। আর তখন আপনারা মানসিক পরিস্থিতি এমন ছিলো যে তাদের চিন্তাটাকেও আপনি দয়া মনে করতেন, নিজেকে আরও বেশি বোঝা মনে করতেন। তাই আমিও বলি নি কিন্তু এখন বলে দেয়া দরকার নাইমার অধিকার আছে সত্যিটা জানার।(অঙ্কিতা)

কেউ আমারে একটু খুইলা বলবো কী হইসে? আমি কিসুই বুঝতেসি না।(নাইমা)

আনিক কিছুটা ইতস্ত করছে সত্যিটা জানাতে। তাই অঙ্কিতাই ধীরে ধীরে সব সত্যি নাইমার সামনে তুলে ধরলে নাইমা বিস্ময়ে হতবাক। টলমলে নয়নে আনিকের দিকে তাকিয়ে আছে সে। লোকটা এত্ত ভয়ঙ্কর একটা কাজ করতে যাচ্ছিলো একটাবারও কী বুক কাঁপেনি লোকটার!

তুমি এই কাজ করার কথা ভাবলাও কেমনে? তুমি মনে করলাও কেমনে আমি তোমারে বোঝা ভাবমু? এই চিনলা তুমি আমারে? (নাইমা)

নাইমার এমন ব্যাথাতুর ও অভিমান কণ্ঠ শুনে আনিকের তীব্র অনুশোচনা হচ্ছে। কত বড় ভুল পদক্ষেপটাই না সে নিলো! সে নাইমাকে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না। কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি তার কন্ঠীনালীকে চেপে রেখেছে, তাই সে নতমস্তকে বসে রইলো।

দেখো নাইমা আনিককে বলে লাভ নেই ও যা করেছে একান্তই মানসিক চাপে পরে করেছে। আর মানুষ মানসিক চাপে পড়লে তার হিতাহিত জ্ঞান শুন্যের কোঠায় পৌঁছে যায় তাই সে ঠিক ভুল কিছুই বিবেচনা করতে পারেনা। আনিকেরও তাই হয়েছিলো ব্যার্থতার হতাশায় তার নিজেকে বোঝা মনে হয়েছিলো, তার মস্তিস্ক তে একটা বিষয় গেঁথে গিয়েছিলো যে তার মৃত্যুই তাকে এবং তার প্রিয় মানুষগুলোকে মুক্তি দিবে। আর এর থেকেই সে আত্মহত্যার পথে অগ্রসর হয়। যদিও এটা নিছকই তার মস্তিষ্কের গড়ানো পরিস্থিতি ছিলো। কিন্তু হ্যাঁ এখন আমি পূর্ণ নিশ্চয়তার বলতে পারি যে আনিকের ভুল ধারণা পরিপূর্ণভাবে মিটে গেছে। সেদিন রাতে আমার কথা আর আপনাদের তার প্রতি ব্যাকুলতা দেখেই প্রায় অর্ধেক ভুল ধারণা তার মস্তিস্ক থেকে মিটে গিয়েছিলো।বাকিটুকু এই কয়দিন পরিবারের কাছে থেকে তাদের সাথে প্রত্যেকটা মুহূর্ত কাটিয়ে পুরোপুরিভাবেই মিটেছে।এবং তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন আর টা সংশোধন করার পূর্ণ প্রচেষ্টাও চালাচ্ছেন।যার প্রমান হলো তিনি পূর্ণরায় নিজের ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করছেন। এমনকি নিজের পরিবারের জন্য পরিশ্রম করতে করতে সে পুরোনো ঘটনাও ভুলে গেসে তাই তো আমার সাথে দেখা করার কথা নিতান্তই ভুলে বসেছেন।(অঙ্কিতা)

অঙ্কিতার কথা শুনে নাইমা কিছুটা আস্বস্ত হলেও সে ভয়ঙ্কর রেগে আছে আনিকের উপর। অঙ্কিতা তা বুঝতে পেরে নানান ভাবে তাকে বুঝাতে লাগলো এক সময় নাইমাও বুজলো আসলেই আনিক যাই করেছে এখানে তাকে দোষ দেয়া যায় না। নাইমার রাগের পাহাড় গলাতে পেরে এক তৃপ্তির হাসি হাসে অঙ্কিতা। অতঃপর তারা তিনজন খোশগল্পে মত্ত হয়ে যায়। ঘন্টাখানেক পর নাইমা আর আনিক অঙ্কিতার থেকে বিদায় নেয় পা বাড়ায় নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্য। তখনি অঙ্কিতা বলে উঠে-

আগামী সোমবার আমি আপনাদের বাড়িতে বেড়াতে আসছি কিন্তু একটা সারপ্রাইজ আছে আপনাদের জন্য।

আনিক আর নাইমা হাসিমুখেই তাকে আসতে বলে। কিন্তু কী সারপ্রাইজ তা জানতে চাইলে অঙ্কিতা বলে না ওটা নাকি ঐদিনই বলবে তাই আনিক আর নাইমাও বেশি জোরাজুরি না করে অঙ্কিতার কথাতে সায় দিয়ে চলে যায়।যতটুকু পথ পর্যন্ত তাদের দেখা যায় অঙ্কিতা তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে।তারা চোখের আড়াল হতেই অঙ্কিতার হাস্যজল মুখটায় ছেয়ে যায় মলিনতার আভা। টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিজের বাদামি বর্ণের ডায়েরিটা বের করে, এটা তার ডায়েরি কম সঙ্গী বেশি। ১৫তম জন্মদিনে এটা ঠাম্মা থেকে উপহার পেয়েছিলো।তখন থেকেই তার সকল অনুভূতি এই ডায়েরিতে লিপিবিদ্ধ আছে। বেশ কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে সাদা পেজ বের করে তাতে নীল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো –

যে প্রণয়ে পায় পূর্ণতা সে যে বড়ই ভাগ্যবান! প্রণয় পূর্ণতা লেখা নেই যে আমার পড়া কপালে! প্রণয় যে আমার আটক ধর্মের দেয়ালে!

এতটুকু লিখেই ডায়েরি কে পূর্বের জায়গায় রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।মুহূর্তেই চোখের দুই ধার দিয়ে ধীর গতিতে নোনাজল গড়িয়ে পড়া শুরু করলো। যেই জলে লুকিয়ে আছে হাজারো যন্ত্রনা, প্রণয়ের অপূর্ণতার তীব্র বেদনা। কিন্তু আফসোস এই নোনাজল কিংবা রমণীর প্রণয়ের অপূর্ণতার বেদনা কারোর দৃষ্টিতেই পড়লো না।

তুমি কী আমার উপর অহনো রাইগা আসো বৌ? (আনিক)

হুম আসিতো, অনেক রাইগা আসি। অহন আমার রাগ ভাঙান। (নাইমা)

ও বৌ তুমি রাইগা থাইকো না গো আমার কষ্ট লাগে। তুমি কও কী করমু আমি।(আনিক)

উমম এক প্লেট ফুচকা কিংবা এক প্যাকেট ঝালমুড়ি খাওয়াইলে রাগ ছাড়ার ব্যাপারে ভাইবা দেখমুনে। (নাইমা)

আইচ্ছা চলো আইজ দুইডাই খাওয়ামু তোমারে। এবার রাগ ভাঙসে? (আনিক)

নাইমা খুশিতে আনিকের হাত জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেই আনিক তার রানীর মান ভাঙাতে নিয়ে যায় ফুচকাওয়ালার কাছে। কেটে যায় কিছু মুহূর্ত দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটিতে। প্রিয় মানুষটার মুখের এক চিলতে মিষ্টি হাসি আর একটু আনন্দ এটাই তো জীবনের সুখের মুহূর্ত।

চলবে …………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে