নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৫

0
169

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

অপূর্ব উঠানে এসে দাড়িয়ে যায়। জাহানারা, মনি ও মল্লিকা বাড়ির উঠানে প্রখর রোদে মেলে দেওয়া ধানে বিচরণ করছে। অনিতাই শুধু রান্নার দিকটা দেখছেন। চেয়ারম্যান বাড়ির বলে কথা, উঠান আর ধান দুটোই পর্যাপ্ত রয়েছে। ছেলেমেয়ে মৃধা বাড়ি থেকে ফিরে গৃহে প্রবেশ করেছে অপূর্ব ব্যতিত। চাচিদের উঠানে দেখে সেও অগ্ৰসর গেল সেদিক। জুতা খুলে শূন্য পায়ে ধানের ভেতরে হাঁটতে লাগল। বিদেশে বসবাসরত অবস্থা ধান বইয়ের পাতায় বা ভিডিয়ো-তেই অবরুদ্ধ ছিল, এই প্রথম স্পর্শের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে। আহ্লাদিত হয়ে সমস্ত ধানে বিচরণ করল। জাহানারা উৎকণ্ঠার সাথে বললেন, “অপু তোকে ধান মেলতে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে বস। ধানের আলে তোর পা চুলকাবে বাবা।”

“কিচ্ছু হবে না চাচি। তোমরা ঘরে যাও, আমি একাই সব ধান মেলবো।” উলটা তালে বলে অপূর্ব।

মল্লিকা অনেকবার প্রচেষ্টা করেও অপূর্ব-কে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে অনিতাকে জানাতে গেলেন মল্লিকা। রান্না অসমাপ্ত রেখেই ছুটে‌ এলেন অনিতা। ধানের মধ্য থেকে অপূর্ব-কে টেনে এনে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “চাচিরা বারণ করছে না, ধানের ভেতরে না যেতে? তাদের কথা কেন শুনছিস না তুই? সিদ্ধ ধানের আল এখনো আলগা। পা চুলকাবে।”

“চুলকাবে না।” অপূর্ব অনুরাগশূন্য হয়ে বলে। “চুলকাবে না।” কথাটা যতটা জোরের দৃঢ়তার সাথে অপূর্ব বলেছে, কাজের বেলায় ততটা দৃঢ় থাকল না। বিকেলেই পা মৃদু ফুলে উঠল। চুলকানি কমছে না, বৈ বাড়ছে। অপূর্ব-র চিৎকারে আহসান বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। মোতাহার আহসান নিরুপায় হয়ে ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ ডাক পাঠালেন। বৈদ্য জরিবুটি দিয়ে গেছে, অপূর্ব তা পায়ে লাগাতে নারাজ। বালতি ভর্তি পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে সে, অথচ গ্ৰামের এই তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পরিধান করেছে উষ্ণ করার পোশাক।

অন্যদিকে ছাগলের জন্য ঘাস কে/টে স্তূপ করেছে আরু। খোপরে হাঁস মুরগি, গোয়ালে ছাগল রেখেছে। গাছ থেকে টাটকা খেজুরের রস নামিয়ে মায়ের জোরাজুরিতে আহসান বাড়িতে এসেছে আরু ও অয়ন। ভাইবোনেরা টিভিতে ‘হাতিম’ দেখছে। আজ শুক্রবার বলেই হাতিম চলছে বিটিভিতে। সপ্তাহে মাত্র একদিন। আরু এসে তুরের পাশে বসে হাতিম দেখায় মন দিয়েছে। পারুল অপূর্ব অবস্থা জিজ্ঞেস করলে অনিতা ঠাট্টা করে বললেন সব। আরু অট্টহাসি দিয়ে বলে, “এই সামান্য কারণে এই অবস্থা। মায়ের মা/রে/র ভয়ে আমি কত শিম ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম। রাতে মা খুঁজে যখন বলত, ‘আয় আরু মা/র/ব না।’ তখনই বের হতাম। উষ্ণ পানিতে গোসল করে সরিষার তেল দিতেই সব জ্বালা খতম।”

“ফুফি তোকে যা মা/রে তুই শিম ক্ষেতেই তো লুকাবি। তাছাড়া তোর হচ্ছে গন্ডারের চামড়া। শুধু শিম পাতার সাথে শরীর ঘেঁষা কেন, শিম পাতা যদি ঘঁষে ঘঁষে তোর শরীরে লাগাই। তবেও কিছু হবেনা।”

“আপনার মতো বিড়ালের চামড়া তো নয়। সবাই বলে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। এখন দেখি তার ছোট ভাই বিড়ালের গায়ে। আমার শরীর যদি আপনার মতো হতো, তাহলে খেজুর গাছ থেকে রস নামাতে পারতাম না। স্কুল থেকে ফিরে মাঠে সারাদিন কাজ করতে পারতাম না। আপনি যাই বলুন, সবাই বলে নারীরা ননীর পুতুল। এখন দেখছি পুরুষেরাও ননীর পুতুল।”

“গাছে ধান না হয়ে, চাল হলে ভালো হতো। তাহলে অন্তত আমার এই অবস্থা হতো না।” অপূর্ব-র কণ্ঠে স্পষ্ট অভিযোগ ছিল।

“ঘোড়া এনে নিজেকে তো বহুত রাজকুমার পৃথ্বীরাজ মনে করেন। কোনো এক রাজার কারণেই চাল থেকে ধান হয়েছে।” আরুর ফিরতি তিসস্কারে অপূর্ব-র আসর জমে উঠল। উদ্দীপিত হয়ে বলে, “কীভাবে?”

“আমার দাদিজান বলেছে, এক রাজা অন্য রাজ্যে থেকে পেট পুড়ে ভোজন খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধান গাছ দেখেন। ঘোড়া থেকে নেমে ধান গাছ থেকে কয়েকটা ধান ছিঁড়ে মুখে দেয়। সেই দুঃখে ধান আল্লাহর কাছে আবেদন করে, তার উপরে সাত প্রলেপ দেওয়া হোক। যাতে কেউ অপ্রয়োজনে খেতে না পারে। অবশ্য আমি ধানের তুস/চিড়ে খুলে কত খাই। হি! হি! হি!” বলে মনমাতানো হাসি উপহার দেয় আরু

ভেংচি দিয়ে বলেই আরু রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ভরা কলসির পানি পাতিলে নিয়ে আগুন ধরালো উনুনে। পানি ফুটন্ত গরমে টগবগ করে উঠতেই পাতা দেওয়ার সমাপ্তি ঘটালো আরু। অতঃপর লুচমি দিয়ে উত্তপ্ত পাতিল নিয়ে অপূর্ব ভিজিয়ে রাখা ঠান্ডা পানির বালতি ঢেলে দিল। অপূর্ব চমকিত হয়ে পা সরানো প্রয়াস করতেই
দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল আরু। পাতিল ফেলে অপূর্ব-র পা-জোড়া উষ্ণ পানিতে চেপে ধরে রাখল। অধৈর্য হয়ে অপূর্ব চড়া গলায় বলে, “আরু পা ছাড় বলছি। দ্রুত পা ছাড়।”

“আপনার কী মনে হয় অপূর্ব ভাই, আমি পা ছাড়ব? আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার শরীরে নিশ্চয়ই আমার থেকে বেশি শক্তি। পারলে আরুর থেকে ছাড়িয়ে নিন।” বলতে বলতে আরু লুফা দিয়ে অপূর্ব পা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে পারল। অপূর্ব হাজার চেয়েও আরুর হাত থেকে নিজের ব্যথায় আক্রান্ত পা সরাতে পারল না। দাঁত খিঁচে আরুর নি/র্যা/ত/ন সহ্য করছে। উপস্থিত সবাই মিটমিট করে হেসে চলেছে। অনিতা জরিবুটি নিয়ে এসে বলে, “আরু এটাও একটু দিয়ে দে।”

অপূর্ব-র প্রথমে ভালো না লাগলেও পরে লাগে। ঠান্ডা হ্রাস পাচ্ছে যে। হাতের কাজ শেষ করে খেজুরের রস গ্লাসে ঢেলে নিয়ে এলো আরু। অপূর্ব-র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা খেলে ঠান্ডা কমে যাবে। খেয়ে নিন।”

“বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক্-বলা তিস্তা দিদি কই?”

পূর্ণিমার থালার মতো চাঁদের আড়াল থেকে বাঁচতে তিস্তা ও সুজন বাঁশঝাড়ের সাহায্য নিয়েছে। বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে মাটির দিকে চেয়ে আছে তিস্তা। সুজন অনবরত তিস্তার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কানে হাত দিয়ে বলে, “তিস্তা আপনি কিন্তু অহেতুক রাগ করে আছেন। আপনি ভালোভাবেই জানেন, আমার বাবা নেই। আমি ছাড়া মায়ের কেউ নেই। আমাকে যেতেই হতো।”

তিস্তার নয়ন অশ্রুতে পরিপূর্ণ হলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আপনি সবসময় এমন করেন। আমি কি একবারও বলেছি, আপনার মায়ের কাছে যাবেন না‌? আপনি কেন‌ আমাকে বলে গেলেন না। জানেন, আপনার জন্য কত অপেক্ষা করেছি। সারাদিন পর রাতে জানি, আপনি বাড়িতে গেছেন।”

“এটা নতুন কী, প্রতি বৃহস্পতিবার আমি বাড়িতে যাই শুক্রবার সন্ধ্যায় ফিরে আসি। গতকাল যাওয়ার সময় আপনাকে দেখিনি, তাই বলে যেতে পারিনি। স্যরি।” বলেই তিস্তায় হাত ধরল সুজন। অভিমানে হাত ছাড়িয়ে নিল তিস্তা। সুজন স্থির থাকল না, এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার ব্যক্তিগত নদী তিস্তা। তুমি সেই তিস্তা নদী, এই সুজন মাঝি যেখানে রোজ-রোজ নৌকা ভাসায়।”

তিস্তা মৃদু হাসল। হাতের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা চিঠিটা অতি সাবধানে সুজনের হাতে গুঁজে দিয়ে ছুটল।
আরু বালতির পানি ফেলে দিতে এসেছে। ভরা বালতি সমেত দাঁড়িয়ে লজিং মাস্টার সুজন ও তিস্তার কথা শুনেছে। তিস্তা কাছাকাছি আসতেই পানিগুলো ফেলে দিল। খানিক চমকিত হয়ে তিস্তা তাকিয়ে বলে, “ওদিকে ফেলতে পারলি না, একটু‌ হলেই তো ভিজে যেতাম।”

“তুমি তো বাঁশ বাগানে ছিলে। এমনভাবে দৌড়ে চলে আসলে ভাবলাম, সাম্পান ওয়ালা তোমাকে লড়ানি দিয়েছে।” আরু দুষ্টুমি করে বলে। ব্রীড়ানত হয়ে তিস্তা বলে, “আরু তুই কিন্তু কাউকে কিছু বলবি না।”

“তা বলব না, কিন্তু এত সহজে তোমার মেনে নেওয়া উচিত হয়নি। ছেলেদের একটু নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়াতে হয়, জানো না বুঝি? নাহলে আবার সুযোগ পেয়ে মাথায় উঠে বাঁদরের মতো নাচবে।” ভাব নিয়ে বলে আরু। তিস্তা গাল টেনে চলে যেতে যেতে বলে, “পাকা বুড়ি একটা।”

তিস্তাকে একটু খেপাতে আরু বলে,
“ওরে সাম্পান ওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা।
তুই আমারে, তুই আমারে
করলি দিওয়ানা-রে, সাম্পানওয়ালা।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে