নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫৮+৫৯

0
113

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৮

আকাশে চলছে মেঘের গর্জন। বিদ্যুৎ চমকানিতে বিরতি নেই। অদূরে বিদ্যুতের খুঁটির ওপর বাজ পড়তেই আলো শূন্য হলো ঘর। চৌকির ওপর অপূর্বর রানি ও রাজকন্যা শুয়ে আছে। অপূর্ব টিউবওয়েল চেপে গোসল করেছে। পরিধান করেছে ইরফানের ব্যবহৃত লুঙ্গি ও ফতুয়া। কলতলাল ভেতরে থাকাকালীন বিদ্যুৎ যাওয়াতে অপূর্ব দরজা খুঁজে পেল না। টিনের ওপর ধাক্কা দিয়ে ডাকে ইরফানকে, “ইরফান, আলো নিয়ে এদিকে আসো। আলোতেই আমি খুঁজে ঘরে যেতে পারব না, এখন তো অন্ধকার।”

কলতলা থেকে ঘরের দ্রুত অনেকটা। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে ইরফান কুপি ও ছাতা মাথা নিয়ে এলো কলতলায়। দরজার উপরে খানিক ফোকট ছিল বিধায়, আগমনের সাথে সাথে হলদে আলো পৌঁছে গেল ভেতরে। টিনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ইরফান বলল, “তাড়াতাড়ি বের হন স্যার, ঘরে দুইটা কুপি। একটা ভাবির কাছে রেখে অন্যটা নিয়ে এসেছি। আমার স্ত্রী অন্ধকারে রুটি বানাচ্ছে।”

লহমায় দরজা খুলে বের হলো অপূর্ব। এক হাতে ভেজা জামাকাপড়, অন্য হাতে সাবানের বক্স নিয়ে পা ফেলতেই ইরফান দ্রুতি কণ্ঠে বলল, “স্যার, এগুলো আপনি আমাকে দিন। আমি দড়িতে মেলে দিব। আপনি ছাতা আর কুপি ধরুন।”

হাত অদলবদল করে পালটে নিল জিনিসপত্র। অতঃপর এগিয়ে গেল ঘরের ভেতরে। অপূর্বকে ঘরে ভেতরে দিয়ে ইরফান চলে গেল রসুইঘরে। অপূর্ব গামছায় নিজের মাথা মুছে চৌকির সাথে মেলে দিয়ে আরুর পাশে বসল। পাখির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে বলল, “কখন ঘুমিয়েছে?”

“মাত্রই ঘুমিয়েছে।”

“মশা কামরাচ্ছে?”

“হাতপাখা দিয়ে গেছে। হাওয়া করছি। বৃষ্টির সময় সব মশা ঘরে চলে এসেছে। এমনিতেই শীতল আবহাওয়া। হাওয়া করলে পাখির ঠান্ডা লাগবে।”

“দেখি ইরফানকে বলে মশারির ব্যবস্থা করতে পারি কি-না। তুই পাখিকে দেখ।” বলেই অপূর্ব অগ্রসর হলো। আরুর মনে পড়ল তার ময়না পাখির কথা। অয়নের চিন্তায় পাখিদের খাবার দেওয়া হয়নি। উদ্বিগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই অপূর্ব এলো মশারি হাতে। সাথে এলো মিতা। পেরেকের সাথে মশারির কোনা লাগাতে লাগাতে বলল, “তোমার কিছু প্রয়োজন হয়ে আমাকে বলো আরু। বয়সে তুমি আমার ছোটো। নির্দ্বিধ আমাকে বলবে। লজ্জা পেয়ে আমার থেকে এড়িয়ে গেলে মেয়ে অসুস্থ হবে।”

“দুঃখিত বুবু। কিছু প্রয়োজন হলেই বলল আপনাকে।”

“মনে থাকে যেন। লজ্জা পেয়ো না। এখন তোমরা আমাদের কাছে আছো। তোমাদের বিপদ দেখার দায়িত্ব আমাদের।”
ততক্ষণে হাতের কাজ শেষ মিতার। মশারি চৌকির চারদিকে গুটিয়ে দিয়ে বলল, “রুটি বানিয়েছি। আরেকটু অপেক্ষা করো, নিয়ে আসছি।”

আরু লজ্জাবনত হয়ে বলল, “এই বৃষ্টির ভেতরে ঝামেলা কেন করতে গেলে বুবু?”

“বুবু বলে ডাকছ, আর তোমার জন্য এইটুকু করতে পারব না? এই সময়ে তোমার ভারি খাবার খাওয়া উচিত। বৃষ্টি না থাকলে তোমার ভাইকে দোকানে পাঠাতাম। যেহুতু বৃষ্টি তাই আটা দিয়ে রুটি করেছি। তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।” বলেই ছুটে গেল মিতা। আরু বিছানা থেকে একটু উত্তরে সেঁটে গেল। ঠান্ডা হাওয়া দেহে মেখে বলল, “একটু বাবাকে কল দিবেন? ময়নাদের আজ খাবার দেওয়া হয়নি। বাইরে খাঁচায় রেখেছে ওদের। কেন যে আপনি গতকাল ওদের বাড়িতে আনতে গেলেন!”

“কিন্তু ফোন আমি বন্ধ করে রেখেছি।”

“খুলে কল দিন। বৃষ্টিতে ভিজে ওদের ঠান্ডা লেগে যাবে। এখন আমিও নেই ওদের পাশে। কে যত্ন নিবে?” মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে আবদার করল আরু। সেই আবদার ফেলার সাধ্য অপূর্বর নেই। অপূর্বকে এত বড়ো গিফট ‘পাখি’ দিল! তার বিনিময়ে হলেও আরুর কথা রাখা উচিত অপূর্বর। টেবিলে ওপর থেকে নিজের মুঠোফোন হাতে নিয়ে চালু করল। অতঃপর ডায়াল করল ইমদাদ হোসেন মৃধার নাম্বারে। এই কলটির জন্যই বোধ হয় ইমদাদ হোসেন অপেক্ষায় ছিলেন। চকিতে কল রিসিভ হলো। বিরতিহীন বলে গেল, “অপূর্ব কোথায় তুই? আরু কোথায়? পাখি কেমন আছে? ওদের নিয়ে কোথায় চলে গেছিস তুই?”

“আমরা শহরে আছি এখন ফুফা। আরু ও পাখি দুজনেই সুস্থ আছে। বাড়ির পরিবেশ এখন কেমন?” অপূর্ব এপাশ থেকে বলল।

“রোয়াকে বসে আছি আমি। পারুলকে নিয়ে গেছে ভাইজান। তোরা কোথায় আছিস বল, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।”

“আমাদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। যার জন্য ফোন করেছি, ময়নারা বাইরে আছে‌। ওদের ভেতরে নিয়ে খাবার দিন।”
আরুর কথা শুনতেই ইমদাদ হোসেন পাখির খাঁচা নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। ভাঙা চাল দিলেন খাবার হিসেবে। সারাদিন পর খাবার পেতেই ক্ষুধার্ত পাখিরা দিশেহারা হয়ে খেতে লাগল। অতঃপর আশ্বস্ত করল অপূর্বকে, “ওদের খাবার দিয়েছি।” ফের কিছু বলার আগেই অপূর্ব লাইন বিচ্ছিন্ন করল। বন্ধ করে রাখল ফোন। ইমদাদ হোসেনের কল আর সংযোগ দিল না।
__
রুটি ও সবজি ভাজি রেঁধেছে মিতা। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। ঘরের মাঝামাঝি একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা। আরুর জন্য হাতে করে খাবার এনে মিতা বলল, “ভাই কি এখানে খাবেন? ড্রাইনিংয়ে আসুন।”

“না। এমনিতেই আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আপনি আরুর জন্য দুটো রুটি নিয়ে আসুন।” অপূর্বর জবাব শুনে আরু বলল, “আমিও খাব না। খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“আপনি আরুর কথা শুনবেন না। নিয়ে আসুন!” দৃঢ় গলায় অপূর্ব বলতেই মিতা চলে গেল। পরপর আরুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আজ তোর শরীরের উপর দিয়ে ধকল গেছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো না করলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। আগে খাওয়া তারপর সবকিছু।”

আরুর মুখে টু শব্দ নেই। মিতা খাবার বিছানার পাশের টেবিলের ওপর ঢাকা দিয়ে রেখে গেল। আরু বিছানা মধ্যে থেকে কিনারায় কোনোরকম বসল। অপূর্ব কাঠের চেয়ার টেনে বসে টেবিল ও আরুর কাছাকাছি। রুটি ছিঁ/ড়ে ভাজি মিশিয়ে আরুর মুখে তুলে দিয়ে বলল, “আমাদের পাখির জন্য একটু শক্ত হ আরু। একটু।”

আরুর চোখের বাঁধ ভাঙল। উপচে পড়ছে জল। ভাঙা গলায় বলল, “এমনটা কেন হলো? এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই যে।”

আরুকে হৃদমাঝারে নিয়ে অপূর্ব বলল, “তুই একজন মা, আরু। মায়েদের হতে হবে তুলার চেয়ে কোমল, আবার লোহার চেয়ে শক্ত। কাঁদিস না।”
__
শেষ রাতে আরুর চোখের পাতা একত্রিত হয়নি। বৃষ্টির ধারাও নেমে এসেছে শূন্যতায়। নেই মেঘ, নেই বজ্রপাত, নেই বিদ্যুৎ। এখনো জ্বলছে হলদে কৃত্রিম আলো। অপূর্ব ঘুমালেও ক্ষণে ক্ষণে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে।‌ আগামীকালের কাজের কথা মাথায় রেখে ঘুমাচ্ছে আবার আরুর কথা ভেবে উঠে যাচ্ছে। ভোরের আলোতে আংশিক অন্তরিক্ষ স্বচ্ছ হতেই কেঁদে উঠল পাখি। অপূর্ব ধরফরিয়ে উঠে বসে পাখির দিকে তাকায়। ক্লান্ত মুখমণ্ডল আরুর, ঘুমে কাঁদা সে। ডাক দেওয়ার স্পৃহা নেই তার। পাখিকে কোলে দিতেই লক্ষ করল, পটি করে দিয়েছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে পরিষ্কার করল। অতঃপর কোল নিয়ে একা একা কথা বলতে বলতে পার করে দিল বহু ক্ষণ।
অফিসে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতেই দরজার কড়া নেড়ে উঠল ইরফান। ফিসফিস করে বলল, “স্যার উঠেছেন? আজকে চেম্বারে যাবেন?”

“হ্যাঁ যাব।” প্রতুক্তি দেওয়ার সেই মুহুর্তে আরুর ঘুম ভাঙল। হাতিয়ে মেয়েকে না পেয়ে উঠে বসল। সন্ধান পেল বাবার কোলে মেয়েকে। হাত বাড়িয়ে কাছে চাইল মেয়েকে, “আমাকে ডাকতেন, কতক্ষণ পাখিকে কোলে নিয়ে ঘুরেছেন?”

“সারা রাত না, তবে অনেকক্ষণ।”
দরজা খুলে ইরফানকে যেতে বলল অপূর্ব।মুখ ধুতে যাওয়ার আগে আরুকে পর্যবেক্ষণ করল। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে নেমে এসেছে। ভালো কিছু পোশাক কেনার পাশাপাশি আসবাবপত্র কিনতে হবে। আজ না পারলেও আগামীকাল নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠবে। এবার থেকে পরিবারের বোঝা বইতে হবে তাকে।

চলবে ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৯

ইরফানদের টিনের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে পাকা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে অপূর্ব। পাকা বাড়ির চারদিক ইটের তৈরি হলেও ওপরে টিনের চাল। নিচটাও পাকা। অপূর্ব আরুকে নিয়ে সেই ভিলায় বসবাসের আগে টুকিটাকি জিনিস কিনে নিয়েছে। খাট কেনার ইচ্ছে থাকলেও অর্থের কারণে সম্ভব হয়নি। তবে তোশক, বালিশ ও কম্বল কিনেছে।
তিনটা দিন পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। আরুও আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। চেম্বারে যাওয়ার আগে সবকিছু গুছিয়ে গিয়েছিল অপূর্ব। তাই বাড়িতে ফিরে কষ্ট করতে হলো না তাকে। জামাকাপড়ের ব্যাগটা আরুকে দিয়ে নিজে নিল পাখিকে। তাদের জন্য অপেক্ষারত রিকশা। ইরফানের কাঁধে হাত রেখে অপূর্ব বলল, “বিপদের দিনে যেভাবে আমাদের উপকার করলে। তা আমি কখনো ভুলতে পারব না ইরফান।”

“সেভাবে কিছুই করলাম না।”

“আর কয়েকটা দিন থেকে নাহয় ঘর ভাড়া নিতেন।” মিতা বলল।

“যেহুতু আলাদা থাকতে হবে, তাই দেরি না করাই ভালো। আমি সব সামলে নিতে পারব।” কথাটা বলে মিতার সাথে গভীর আলিঙ্গনে ব্যস্ত হলো আরু। এই সাড়ে তিন দিনে মায়া জন্মে গেছে মিতার প্রতি। অতঃপর এগিয়ে গেল রিকশার দিকে। আরু হাত দিয়ে টা টা দিতেই অপূর্ব বলল, “আসি, তোমরা সুযোগ পেলেই চলে এসো।” পরপর রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মামা আস্তে আস্তে চলেন।”

অপূর্ব, আরু ও পাখি চলল তাদের গন্তব্যে। ভবিষ্যত বাসস্থানে, পরিবার ছেড়ে চলার লড়াই শুরু করতে। ভারি গলায় শ্বাস টেনে মিতা বলল, “আমার ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল। হঠাৎ করে এসে মায়া লাগিয়ে দিয়ে গেল।”

“কোনো কাজ না থাকলে তুমি ওদের কাছে চলে যেও। কাছেই! পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে। বাবু আর ব্যাগের জন্যই রিকশায় গেছে।” স্মিত হেসে মিতার হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়াল ইরফান। বাড়িতে ফিরলে পাখির কান্না বড্ড মিস করবে ইরফান।
__
খোলামেলা বাড়িটা, বাইরে রং না থাকলেও ভেতরের রং খসে বিশ্রী অবস্থা। বাড়িটার ভেতরে তিনটা ঘর। একটা ঘরে আরও একজন ভাড়াটে থাকলেও বাড়ি দুটো খালি ছিল এতদিন। অপূর্বের চলাফেরা শৌখিন। একটি ঘরে কি তাকে মানায়?
আরু দরজার ছিটকিনি খুলে দেখল, অপূর্ব ইতোমধ্যে জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখেছে। দেয়ালের সাথে ব্যাগটা ঠেস দিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকে ঘূর্ণন দিল আরু। আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, “অপূর্ব ভাই আপনি কি জানেন, এটা আমার সংসার?”

“এটা আমাদের সংসার।”

“তা বুঝলাম, খুব ক্ষুধা লেগেছে। খাবার রান্না করতে হবে?”

“বিরিয়ানি নিয়ে এসেছি। রাতে এগুলো খেয়ে পার করব। কাল শুক্রবার, কালকে বাজার করে নিয়ে আসব। তুই বস, আমি পানি নিয়ে আসি।” কথাটা বলে স্টিলের কলসটা নিয়ে বের হয়ে গেল অপূর্ব। ছোট পরিসরে কলতলা কিছুটা দূরে‌ অবস্থিত। টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া। দরজা খুলে পা রাখতেই পিছলে গেল পা। স্টিলের কলসটা মাটিতে পড়ে শব্দ তুলে চলে গেল বহুদূরে। দ্রুত টিন ধরে নিজেকে স্থির করল‌ অপূর্ব। জং ধরা টিনে খানিকটা কেটে গেল হাতের করতল। লক্ষ করল শেওলা জমে পিচ্চিল হয়ে আছে জায়গাটা। আরুর পড়ে যেতে সময় লাগবে না। কলতলা থেকে বের হয়ে একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে এলো অপূর্ব। এক পাশে থাকা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে শেওলা তোলার চেষ্টা করতে লাগল। তার এই কাজ শেষ হতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগল। ততক্ষণে ভিজে জবুথবু সে। কলসটা ধুয়ে পানি নিয়ে ঘরে গেল। সামনে রেখে বলল, “ব্যাগ থেকে আমার জামাকাপড়গুলো বের করে দে।”

“হ্যাঁ! দিচ্ছি। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনার গায়ে শেওলা আসল কীভাবে?”

“শেওলা জমে ছিল কলতলায়। পা পিছলে পড়ে গেছি। যদি পড়ে তোর দাঁত ভেঙে যায়, তাই পরিষ্কার করে এলাম। বেশিক্ষণ ভেজা থাকলে ঠান্ডা লাগবে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় দে।”

আরু জামাকাপড়ের ব্যাগ থেকে অপূর্বকে একটা ফতুয়া ও লুঙ্গি বের করে দিল। অপূর্ব ফের সেই পথেই পা বাড়াল। যেহুতু আর ফিরে যাচ্ছে না আহসান বাড়িতে, তাই নিজেদের ব্যবহারের উপযোগী পোশাক কিনে নিয়েছে। আরু বিরিয়ানিগুলো থালায় পরিবেশ করে অপেক্ষা করে অপূর্বর জন্য। মিনিট পাঁচ পর কাঁপতে কাঁপতে অপূর্ব এলো ঘরে। দরজা খোলার সাথে সাথে দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিল আরুর দেহ। গর্জন করল আকাশ। কৌতূহল নিয়ে আরু বলল, “বাইরের অবস্থা ভালো না। ইদানীং থেমে থেমে প্রচুর বৃষ্টি হয়।”

“সাগরে ঘুর্নিঝড় উঠেছে। সেই কারণেই বৃষ্টি হচ্ছে। আরও দুদিন এমন আবহাওয়া থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।”

“আচ্ছা, আমার যদি ডানা থাকতো। কতই না ভালো হতো। আমরা ডানায় ভর দিয়ে মধ্যাকর্ষণ শক্তির বাইরে চলে যেতাম। শীতের সময় চলে যেতাম সূর্যের কাছাকাছি। কী মজা হতো তাই না!”

“পাখি? তুই হচ্ছিস রূপবতী নারী। তোর মতো নারী আমি দেখিনি। যদি তুই পাখি হতিস, তাহলে তোর রূপে মুগ্ধ হয়ে শিকারিরা তোকে ধরে নিয়ে যেত। আমৃত্যু বন্দি থাকতি লোহার খাঁচায়।”

বৃষ্টিহীন প্রকৃতি। গাছের পাতায় দু এক ফোঁটা পানি জমে আছে। ভেজহীন রোদ উঁকি দিয়েছে আকাশে। পাখিকে কোলে নিয়ে পিঁড়িতে বসে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ রোদ শুষে নিচ্ছে মা মেয়ে। অপূর্ব বাজার করতে বের হয়েছে।
আরুদের পাশের ঘরেও আছে এক দম্পতি। বিয়ের ছয় বছর চলছে তাদের। দুজনেই কর্মজীবী। একটা মেয়ে আছে, তবে সে থাকে দাদির সাথে অজপাড়া গাঁয়ে। মেয়েটির নামও শেফালী। আরুকে রোদ পোহাতে দেখে এগিয়ে এসে বসল তাদের পাশে। পাখির চোয়াল ধরে আদুরে গলায় বলল, “মিষ্টি একটা মেয়ে। দেখতে অবিকল তোমার মতো হয়েছে।”
তোমার কোনো কাজ থাকলে ওকে আমার কাছে দিয়ে, করতে পারো।”

মেয়েটির কথায় আরু সন্তুষ্ট হলেও দ্বিরুক্তি করল। অপরিচিত একটা মেয়ের কাছে নিজের মেয়েকে রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা। আরুর না বলা বাক্য বুঝে নিল শেফালী নামের মেয়েটা। জোর করে পাখিকে আরুর কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “তুমি কাজ করো, আমি ওকে নিয়ে তোমার পাশে পাশে ঘুরব। ও হ্যাঁ! বলাই তো হয়নি। আমার নাম শেফালী।”

শেফালী নামটা শুনেই মেয়েটির প্রতি আরুর মনে সৃষ্টি হলো বিশ্বাস। এই নামটা যে তার অতি প্রিয়। পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আপনি ওকে কোলে নিয়ে পাঁচ মিনিট কষ্ট করে বসুন। আমি ঘরটা গুছিয়ে আসছি।”

বলেই চঞ্চল পায়ে ঘরে এলো আরু। ঘরের কাজ সেরে উঠতেই অপূর্ব বাজার নিয়ে ফিরল। বাজারের থলে বাইরে রেখে ঘরে এলো। আচমকা কেউ পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। খানিক ভরকে গিয়ে পিছু ফিরে অপূর্বর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে হ্রাস পেল ভীতি। ভেংচি দিয়ে বলল, “এত এত খুশি কেন?”

“বলছি, পাখিকে দেখলাম পাশের বাড়ির আপুর কোলে। এই সুযোগে হবে নাকি?” অপূর্বর ইঙ্গিত বুঝতে বেগ পেতে হলো না আরুর। নাক কুঁচকে বলল, “ছি! কী কথা! পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ নেই বলে আমার মনে ভালো নেই। এদিকে তিনি এক্কা দোক্কা খেলতে এসেছেন।”

“আমার মন ভালো। ফুফার সাথে দেখা হয়েছে বাজারে।”

“কখন?”

“অবশ্যই বাজারে গিয়েছিলাম তখন। অয়নের মিলাদের জন্য জিলাপি কিনতে এসেছিস। কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে।”

“আমার ভাইটা নেই, ভাবতেই পারিনা।”

আরুকে নিজের দিকে ফিরাল অপূর্ব। জড়িয়ে ধরে বলল,
“এত ভাবিস না। চল, রান্না করবি। আমি পাখিকে নিয়ে তোর পাশাপাশি ঘুরব।”

_
সময় দুইটা ছুঁইছুঁই। রোদ্দুর খাঁ খাঁ করছে গ্রামে। মোতাহার আহসান সহ বাকিরা নামাজ শেষে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। একদল মুসলিমও নামাজ শেষে জিলাপি হাতে নিয়ে বাড়িতে ফিরছে। অনেকটা দূরে যেতেই পেছন থেকে এক মুসলিম ডাকল, “চেয়ারম্যান সাহেব, দাঁড়ান।”

সবাই দাঁড়াল। নামাজ আদায় থেকে শুরু করে কিছুক্ষণ মোতাহার আহসানকে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। তবে সুযোগ হয়ে উঠেনি। কাছাকাছি এসে বলল, “ভাই, একটা কথা ছিল। আমার ছেলে বিয়ের পর বউয়ের কথা শুনে। আমার সাথে ও আমার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। তাই আমরা চাই আলাদা থাকতে। আমার ছেলে যাতে মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়। এই ব্যবস্থাটা করে দিতে পারবেন?”

“ছেলের থেকে আলাদা হবে কেন? আমি একবার তোমার ছেলের সাথে কথা বলে দেখি। ফের যদি ও দুর্ব্যবহার করে তাহলে তুমি আলাদা হয়ে যেও। ছেলের কাছে হাত পাততে হবে না। আমি তোমার নামে বয়স্ক ভাতার কার্ড বানিয়ে দিব। যে ছেলে তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে না, তার জিনিস না খাওয়াই ভালো।”

“আচ্ছা।”

আরেকজন মুসলিম যাচ্ছিল সেখান দিকে। ফিসফিস ও ব্যঙ্গ করে বলল, “চাচা, তুমি কার কাছে বিচার চাইছ? যে নিজেই তার ছেলে ও বৌমাকে তাচ্ছিল্য করেছে? তার ছেলেই তো আলাদা থাকে।”

অস্ফুট স্বরে বললেও শোনা গেল কণ্ঠস্বর। মোতাহার আহসান দ্বিরুক্তি না করে সবাইকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। হাত দিয়ে হাওয়া করতে করতে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল। রোয়াকে বসে বললেন, “কাল পর্যন্ত কেউ আমার সাথে এভাবে‌ কথা বলেনি। আজ সামনাসামনি বলছে। আমি বোধ হয় সত্যি বিচার করতে অক্ষম হয়ে গেছি।”

“ভাইজান, বাদ দাও তার কথা। একটু খুঁত পেল অমনি তার সারাজীবনের কাজ নিয়ে খোঁটা দিল।”

“আমি আর চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াব না। বয়সের কারণে সঠিক বিচার করতে ভুলে গেছি আমি। অপূর্বকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে লম্বা একটা বিরতি নিল।” মোতাহার আহসান বললেন। পরপর বললেন, “অনি, আমার জন্য এক গ্লাস তেঁতুল নিংড়ানো পানি নিয়ে এসো। প্রেসার বাড়ছে।”

মুহূর্তের মাঝে উদাসীন হলেন তিনি। তেঁতুল পানি আনার সময়টুকুও দিলেন না অনিতাকে। ঢলে পড়লেন বাবার বুকে। ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল তাকে। বিছানায় রেখে হাত পা ম্যাসাজ করতে লাগল। তেঁতুলের পানিটা খাইয়ে অনিতা বলল, “কী হলো হঠাৎ? ভালো মানুষটা নামাজ আদায় করতে গেলেন। কেউ একটু ডাক্তারকে খবর দাও।”

“একজন মানুষ ভাইজানকে বিচার নিয়ে খোঁটা দিয়েছে, সেটা‌ নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছেন।” ছোটো ভাই বলে।‌

মেজো ভাই ডাক্তারকে কল করতে গেলেন। ফ্যান ছাড়া থাকার পরেও ঘামছেন চেয়ারম্যান। পারুল বালতিতে করে পানি নিয়ে আসতেই অনিতা কেড়ে নিল তা। রাগান্বিত গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শান্তি হয়েছিস তুই? তাহলে ঘরে গিয়ে বসে থাক। আমার স্বামীর মাথায় তোকে পানি দিতে হবেনা।”

“এভাবে কেন বলছ ভাবি?”

“কীভাবে বলব তাহলে? নিজের সংসার তো শেষ, এবার আমার সংসারের দিকে তোর নজর পড়েছে। আমার নাতির বয়স পাঁচ দিন। অথচ আমি ওকে দেখতে পারিনি। তোরজন্য আমার ছেলে, বউ, নাতনি দূরে চলে গেছে। এই অবধি আমি ঠিক ছিলাম। তবে আজ? আজ যদি আমার স্বামীর কিছু হয়, তাহলে আমার থেকে খা/রা/প কেউ হবেনা।” আঙুল তুলে কথাটা বলে স্বামীর মাথায় যত্নে পানি দিতে লাগল অনিতা। পারুল ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিক। এই সবকিছুর জন্য আসলেই সে দায়ী। আজ যদি মোতাহার আহসানের কিছু হয়ে যায় বাবা মাকে মুখ দেখাতে পারবে না। এই সংসারটা তাকেই ঠিক করে দিতে হবে। তারপরে নিজের ভাঙা সংসারে ফিরে যাবে। টোনাটুনির সংসার হবে শুধু!

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৯ (বর্ধিতাংশ)

রান্নার কথা আরুর থাকলেও রান্না করছে অপূর্ব। বিদেশে থাকাকালীন রান্না করে খাইয়েছে নিজের নানা নানিকে। স্ত্রী সন্তানকে রান্না করে খাওয়ানো দায়িত্বের মধ্যে পরে। সলা চিংড়ি মাছে হলুদ মরিচ মিশিয়ে গরম তেলে দিয়ে অপূর্ব বলল, “আজ এমন রান্না করব একদম হাত চেটেপুটে খাবি।”

“আগে রান্না করুন, পরে দেখা যাবে।” পাখির বুকে চাপড় মেরে বলে আরু।

“এতটা তাচ্ছিল্য করিস না। অপূর্ব সবদিক থেকে পারফেক্ট। আগে সাঁতার জানতাম না, এখন সেটাও জানি।” আঁচ নামিয়ে লাউ কা/ট/তে বসল অপূর্ব। মনোযোগী হয়ে এক সমান কাটছে সবগুলো। দেখে মনে হয়, প্রতিটা মেপে মেপে সমান করছে। আরু মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বাহবা দিল প্রাণনাথকে। মুখে বলল, “কুঁচো চিংড়ি দিয়ে লাউ রান্না করলে মুখে লেগে থাকবে।”

“ডিম নিয়ে এসেছি। ডিম ভেঙে রান্না করব, দেখিস কত মজা লাগে। বনে জঙ্গলে বন্ধুদের নিয়ে আমি অনেকবার ঘুরতে গিয়েছি। এক জায়গায় তিন-চারবার গিয়েছি। ঘুরতে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে বিভিন্ন সবজির বীচ নিয়ে যেতাম। জঙ্গলের মাঝে পুঁতে দিতাম। পরেরবার সেখানে গেলে আমাদের আর খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হতো না। ডিম দিয়ে লাউ খাওয়া শিখেছি মূলত সেখান থেকেই। গাছে ধরা লাউ আর ঘুঘু পাখির ডিম।”

“ঘুঘুর পাখির ডিম কোথায় পেলেন?”

“যে গাছে পাখি ছিল তার পাশেই তাবু টানিয়েছি। তাই পাখিরা উড়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে দুটো ডিম নিয়ে লাউ দিয়ে খেয়েছি।”

“না বলে আপনি ওদের ডিম নিয়েছেন?”

“হ্যাঁ!”

“এখন যদি আপনার থেকে ওরা পাখিকে নিয়ে নেয়। তাহলে আপনার কেমন লাগবে?”

“তাহলে আমার ভারি অন্যায় হয়ে গেল। কী করে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি?”

“আর কখনো ওদের ডিম নিবেন না। ঠিক আছে?”

“মহারানির হুকুম বলে কথা। রাখতেই হয়।” মাথা দুলিয়ে অপূর্ব বলে। বিদ্রুপ মনে করে ভেংচি দিল আরু। তখনই তাদের দিকে এগিয়ে এলো তিন জন মানুষ। এক জন কাঙ্ক্ষিত হলেও দুই জন অনাকাঙ্ক্ষিত। আরু ও অপূর্ব নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিতে আদানপ্রদান করে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে তিন জনে। ইরফান হাসিমুখে বলল, “স্যার, এরা আপনাদের খোঁজ করছিল। তাই নিয়ে এলাম। তাদের চিনেন?”

ইমদাদ হোসেন ও পারুল চেনা হয়েও অপূর্বর কাছে বড্ড অচেনা। দৃষ্টি সরিয়ে বলল, “না। চিনি না। এদেরকে এখানে কেন এনেছ?”

পারুলের মুখ মলিন হয়ে গেল। অপূর্বর এই প্রতুক্তি অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে প্রত্যাশা করা দোষের ছিল না। অপূর্ব তো সেদিন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পাখির হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে পারুল এগিয়ে যেতেই আরুর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে নিল অপূর্ব। পারুল চুপসে গেল বেলুনের মতো। অবিকল ছোটো আরু। সৌজন্য হেসে বলল, “সন্তান হারা এক মায়ের আর্তনাদ তোরা বুঝিসনি। তবে এবার বুঝবি! কারণ তোদেরও সন্তান এসেছে।”

“আপনারা কেন এসেছেন?” অপূর্বর প্রশ্নে ইমদাদ হোসেন বলল, “তোরা বাড়ি ছেড়ে চলে এলি না শুধু, তোর বাবার সম্মান নষ্ট করে এলি। এখন কেউ তোর বাবাকে সম্মান করেনা। আজ নামাজ আদায় করে বাড়িতে ফেরার সময় এক বৃদ্ধ, তার ছেলের নামে নালিশ করেছে ভাইজানের কাছে। আরেকজন ব্যঙ্গ করে বলেছে যে নিজেদের বিচার করতে পারেনা, সে কীভাবে অন্যের বিচার করবে? আর সেটা শুনেই তোর বাবার‌ প্রেপার বেড়ে গেছে। বুকেও ব্যথা বেড়েছে। ভাবি তো পারুলের সাথে হিংস্র আচরণও করছে।”

“তাই আমি তোদের ওই বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। তোদের ওই বাড়িতে রেখে আমি নিজের ঠিকানায় চলে যাবে। নিজের সংসার তো শেষ হতে বসেছে। অন্যের সংসার কীভাবে ভাঙি।” পারুল বলে।

“বাবার এই অবস্থার জন্য একটু হলেও আমি দায়ী। তাই আহসান বাড়িতে আমি যাব। কিন্তু থাকব না। বাবা ঠিক হলেই চলে আসব।” কথাটা বলে উনুনের আগুন নিভিয়ে দিল অপূর্ব। রান্নার সরঞ্জামগুলো বয়ে ঘরে রেখে এলো। কড়ায় দুইটা তালা ঝুলিয়ে ফিরে এলো। আরুর থেকে পাখিকে কোলে নিয়ে বলল, “তোদের দুজনকে এখানে রেখে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। তোরা আমার সাথে যাবি, আবার আমার সাথেই আসবি।”

অপূর্ব ও আরুর পেছনে পেছনে ইমদাদ ও পারুল হাঁটা দিল। ইরফান বিদায় নিয়ে ঘরমুখো হলো। ভরদুপুর ও বন্ধের দিনের কারণে নির্জন পরিবেশ। তবে রাস্তায় উঠতেই দেখা মিলল কয়েকটা রিকশার। অপূর্ব হাতের ইশারায় রিকশাওয়ালাকে বার্তা পাঠাল। দৃষ্টিগোচরে বার্তা পৌঁছাতে হর্ন বাজাতে বাজাতে রিকশা এলো নিকটে। অপূর্ব স্বাভাবিক থেকে বলল, “চেয়ারম্যান বাড়ি যাব।” পরপর শ্বশুর শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা এই রিকশায় যান, আমরা আসছি।”

দ্বিরুক্তি না করে দুজনে রিকশায় চড়ল। খচখচে মন নিয়ে রিকশা গতিশীল হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে ইমদাদ হোসেন বলল, “আরু, ওকে একটু আমাদের সাথে নেই?”

চট করে উত্তরের আশায় আরু তাকাল অপূর্বর দিকে। অনুসরণ করে রিকশাওয়ালা সহ তিন জনেই তাকাল সেদিকে। অপূর্ব ইতস্তত নিয়ে বলল, “তোর বাবাকে চাইলে দিতেই পারিস। তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে সে যাতে অন্য কারো কোলে আমার সন্তানকে না দেয়।”

হাসল আরু। বাবার কোলে কাঁথা সহ মেয়েকে তুলে দিয়ে শান্তি পেল। রিকশাওয়ালা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অপূর্ব আরুকে সাথে নিয়ে অন্য রিকশার হদিস করার ফাঁকে ডায়াল করল হার্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মগবুল আলম ভূঁইয়াকে। অপূর্ব মনের ডাক্তার, বাবার পরীক্ষা করতে পারলেও চিকিৎসা দিতে পারবেনা। তাই ডাক্তার সাথে নিল।

আহসান বাড়িটা শান্ত হয়ে গেছে। এখানে বাচ্চারা আগের মতো ছেলেমানুষি করেনা। সবাই সংসার সামলাতে ব্যস্ত। বাড়ির দোরগোড়ায় রিকশা থামল। ইমদাদ হোসেন পাখিকে কোলে নিয়ে নামল রাস্তায়। পারুল তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত পাখির মুখে। এক হাতে নাতনিকে ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে টাকা বের করতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। নাতনিকে স্পর্শ করার লোভ সামলাতে না পেরে পারুল বলল, “আমার কাছে দিয়ে টাকা বের করো।”

“মাথা খা/রা/প আমার! ওরা পেছনে আসছে। তোমার কোলে পাখিকে দেখলে রেগে যাবে। যদি পারো, পকেট থেকে টাকা বের করে ওনাকে দাও।” ইমদাদ হোসেনের কথা পারুল মানল। ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই হোঁচট খেল কাঠের সাথে।
পরিষ্কার রাস্তায় শুকনো একটা কাঠ দেখাই যাচ্ছিল না। পাখির ঘুম ভাঙল। নিজেকে আগন্তুকের কোলে দেখে কান্না শুরু করল। ইমদাদ হোসেন দোলাতে দোলাতে বলেন, “পাখি, আমি তোমার নানাভাই। কাঁদে না সোনা।”

পাখি কেবল কাঁদছে। উদাসীন হলেন ইমদাদ। দোলাতে দোলাতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভিড় তখনও ছিল মোতাহার আহসানের ঘরে। পাখির কান্নার শব্দে তাকাল সেদিক। অনিতা স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাচ্চাকে কার থেকে ধরে আনলে? কাঁদছে কেন?”

“আরুর থেকে ধরে এনেছি।”

“পাখি?” চট করে বলেই অনিতা এগিয়ে গেল। প্রথমবার দর্শন করল নাতনিকে। চোখ থেকে পানি না পরলেও কাঁদতে কাঁদতে রক্তিম নাকের ডগা। কাঁথা সহ পাখিকে কোলে নিয়ে বলল, “সোনা পাখির কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছে কেন?”

‘তুর থেকে বুড়া বাবা’ – কেউ বাদ নেই পাখির কান্না থামাতে। তবুও মেয়েটা কাঁদছে। তিস্তা বলল, “আরু তো ছোটোবেলায় শান্তশিষ্ট ছিল। ওর মেয়ে এমন কাঁদুনে কীভাবে হলো? ফুফা আপনি ভুল করে অন্য কারো বাচ্চা নিয়ে আসেননি তো?”

শেফালী বলে, “দেখতে কিন্তু মা-শা-আল্লাহ।”

সুমি শেফালীর পেটে হালকা স্পর্শ করে বলল, “নয় মাস পর তোমারও হবে।”

মোতাহার আহসান আধশোয়া হয়ে বসে বললেন, “মেয়ে তার বাবার মতো হয়েছে। মা না কাঁদলেও বাবার কান্নায় কেউ ঘুমাতে পারেনি। ওকে আমার কোলে দাও। আমার শ্বশুরের মতো বুদ্ধি প্রয়োগ করে কান্না থামানো যায় কিনা দেখি!”

“ওমা! তুমি না অসুস্থ। উঠলে কেন?”

“নাতনি এসেছে। অসুস্থ থাকি কীভাবে। ওকে এদিকে দাও।” হাত বাড়ালেন মোতাহার আহসান। অনিতা কোলে দিলেও বিরতি দিল না কান্নার। অবশেষে শ্বশুরের বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন, “অপূর্বর আরুপাখি কোথায়?”

কান্না থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকাল পাখি। উপস্থিত সবাই হতবাক, বিস্মিত, চিন্তিত। এই ডাকেই কীভাবে থামল কান্না? পরক্ষণে পটি করে দিল কোলে। অবশেষে কান্না থামার কারণ খুঁজে পাওয়া গেল।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে