নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব–৬০ এবং শেষ পর্ব

0
151

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
অন্তিম প্রহর

মোতাহার আহসান নাতনিকে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন। অসুস্থতা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। পারুল দূর থেকে নাতনিকে দুর্বল চোখে দেখে নিষ্প্রভ হয়ে যান। নিজের রক্ত মেয়েটির দেহে প্রবাহিত হলেও স্পর্শ করা অন্যায়, অপরাধ, ছুঁলে পাবেন কঠোর সাজা। তীব্র অভিলাষ হৃদমাঝারে ধামাচাপা দিয়ে আঁচলে অশ্রু মুছল। কাতর গলায় বলল, “চলো। আমাদের সংসারে ফিরে যাই।”
বিপরীত মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা না করেই ত্যাগ করে আহসান বাড়ি।‌ বাড়ির রাস্তায় উঠতে বিদ্যুৎ গতিতে ইমদাদ হোসেন যোগ দিলেন। শক্ত আঙুলের ভাঁজে পারুলের কোমল আঙুল ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “পারুল, আমাদের ভাগ্যের ওপরে মানুষের হাত নেই। মানুষ কখনো মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনা।”
“আর সময় কখনো মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না। আর মানুষ? নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে সাপের মতো ফোঁস করে উঠে।” প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে পারুল। এই কয়দিনে তার চোখের পানি সংগ্রহ করলে পুকুর ভরে যেত। কদমের পর কদম ফেলে মৃধা বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সময় বেশি লাগল না। জনশূন্য বাড়িটা এই চার দিনে ভীতিকর হয়ে উঠেছে।
ইমদাদ হোসেন শার্টের পকেট থেকে দুটো তাবিজ বের করে পেয়ারা গাছের ভিন্ন বাদে ঝুলালেন। পারুল ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে শীতল করছে মায়ের মন। চট করে ইমদাদের পাশে দৃষ্টি যেতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে সন্দিহান গলায় বলল, “কী করছ এখানে? এটা পেয়ারা গাছের সাথে বাঁধছ কেন?”

দুটো তাবিজ ঝুলিয়েছে গাছে, তারমধ্যে একটি আগের অন্যটি ফকির বাবা দিয়েছে। বলেছে দুটো একই ডালে ঝুলিয়ে রাখতে। স্বামীর আশাতীত কাজটির জবাব না পেয়ে ফের বলল, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে!”

“ফকির বাবার কাছে গিয়েছিলাম। কেউ আমাদের সংসার ভাঙনের জন্য এই তাবিজ এখানে ঝুলিয়েছ। গণনা করে বলেছে, তোমাকেও খাবারের মাধ্যমে কিছু খাইয়েছে। তাকে তো এত সহজে ছেড়ে দিতে পারিনা। তাই আমার এই ছোট্ট আয়োজন।” কথাটা বলে রোয়াকে উঠে ঘরের তালা খুলে ইমদাদ হোসেন। শোকাহত মাথায় ইমদাদের কথাটি পৌঁছাল না পারুলের। ফের প্রশ্ন করলেও উত্তর পেল না ইমদাদের কাছ থেকে। পেছনের বারান্দা থেকে কোদাল এলে দক্ষিণ দিকে পা বাড়িয়ে আবার ফেরত হলো। পারুলের হাত দুটো ধরে বললেন, “আমি আর শহরে ফিরে যাব না পারুল। গ্ৰামে ছোটোখাটো কাজ করে যা উপার্জন করব, তাতে আমাদের চলে যাবে।”

দুহাতে স্বামীর কলার মুঠো করে ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল পারুল। বিনিময়ে শার্টের ওপরের অংশ পারুলের অন্তরের মতো দুমড়ে মুচড়ে গেল। মাথাটা ইমদাদের বাঁপাশে রেখে বাঁধ ভাঙল পারুলের। টর্নেডোর মতো ইমদাদ হোসেনেও বুকে ভাঙন ধরল। স্ত্রীকে ঠিক সামলে নিবেন তিনি। বুঝতে দিবে না আঘাত।
__
পরপর দুটো রিকশা থামল দরজায়। অপূর্বকে দেখেই সম্মান জানাল প্রহরী। অপূর্ব মাথা দুলিয়ে ডাক্তার নিয়ে ভেতরে ঢুকল। তীব্র অসুস্থতার লোকটাকে মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখে ভারী চমকাল। মগবুল আলম ভুঁইয়া চিন্তিত হওয়ার ভান করে খানিক রঙ্গ করলেন, “অপূর্ব, রোগী কে?”

“আমিও তো তাই ভাবছি, রোগী কে? আমাকে কি মিথ্যা বলল?”

অনিতা ছেলে ও বৌমাকে দেখে প্রসন্ন হলেন। খুশি সকলে। অপূর্ব মাকে প্রশ্ন করল, “মা, বাবা কী অসুস্থ ছিল?”

অনিতা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করলেন। বাড়িতে ইমারজেন্সি রোগী দেখতে গিয়ে বোধ হয় এটাই প্রথম, রোগী খেলছে নাতনির সাথে।

“হ্যাঁ। একদম কথাই বলতে পারছিল না। নাতনিকে দেখে সে সুস্থ। তুই যখন ডাক্তার নিয়ে এসেছিস, একবার চেক করে রাখ।”

“হ্যাঁ স্যার একটু দেখুন।” অপূর্বর অনুরোধে মোতাহার আহসানকে চেক করে হতাশ হয়েই ফিরে গেলেন মগবুল সাহেব। কেবল প্রেসার বেড়েছিল। প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত খেতে ও চিন্তামুক্ত থাকতে বলেই বিদায় নিয়েছেন। অপূর্ব ও আরু অতিথিদের মতো ইতস্তত করছে বসতে। ক্ষণে ক্ষণে দুজনের মাঝে দৃষ্টি আদানপ্রদান করে ইঙ্গিতে আলোচনা করছে। এক পর্যায়ে অপূর্ব সহসা বলেই ফেলল, “মা, বাবা যখন এখন সুস্থ আছে। আমরা তবে আসি।”

হৃদয় ভাঙল সকলের, কেবল মোতাহার আহসান আগের ন্যায় হাসিখুশি। নাতনির সাথে খেলতে খেলতে বললেন, “দেখেশুনে যাস। আর কোনো প্রয়োজন হলে বলিস।” একটুকু বলে দম ফেলল। অপূর্ব পাখির কাছেপিঠে যেতেই মোতাহার আহসান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গমগম করে বললেন, “পাখির কাছে তোর কী? পাখি আমাদের সাথেই থাকবে। তোদের যেতে হলে যা। ও তোদের সাথে‌ আসেনি, তোদের সাথে যাবেও না।”

হোক বেপরোয়া, হোক ঠোঁটকাটা, কিন্তু বাবার আদেশের কাছে ভেজা বিড়াল অপূর্ব আহসান। এটা সম্মান! মল্লিকা একটা পান বানিয়ে এনে চম্পার হাতে দিল। তর্জনীর ডগায় চুন লাগিয়ে চম্পা বলল, “মেয়েকে ছেড়ে কত যেতে পারিস দেখি।”
“আমি এখানে থাকব না দাদি জান। এই বাড়িতে আমার, আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের কোনো মূল্য নেই।”
মোতাহার আহসান পাখিকে শেফালীর কোলে রেখে বিছানা ছাড়লেন। অনিতাকে বিছানার ময়লা পরিষ্কার করে বলে অপূর্বকে বললেন, “কে বলেছে তোকে? আমি তো বলিনি! তুই তো সব বুঝিস অপু। এটাও একটু বোঝ। ধর একদিকে তোর বোন তুর, অন্যদিকে পাখি। কোনদিকে পা বাড়াবি তুই? দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখে মা হয়। তারপরে বড়ো হয়। এক মুহুর্তের মাঝে যদি সে চলে যায়, কেমন লাগে মায়ের? আমার বুঝদার ছেলেটাও অবুঝ।”

বাবাকে অপূর্ব অসম্মান করবে না। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব অপূর্বর কাঁধে তুলে দিয়ে মোতাহার আহসান বললেন, “আজ থেকে তুই এই বাড়ির কর্তা, তুই চেয়ারম্যান হবি, তুই বাবাও হবি। দেখি আমার ছেলে কতটা দক্ষ।
চেয়ারম্যানকে হতে হবে শক্ত, হতে হবে নরম। সবার মনের কথা বুঝতে হবে। তুই তো মনোচিকিৎসক, আশা করি এটা তুই খুব ভালো পারবি।”

অপূর্ব এগিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল। দুই ফোঁটা অশ্রু চোখ থেকে ঝরার পাশাপাশি ঝরে পড়ল আবেগ। যেই পিতা মাতা দূরদেশে রেখে শিক্ষিত করেছে, তাদের ছেড়া যাওয়া উচিত হয়নি। মোতাহার আহসান অপূর্বকে বুকে জড়িয়ে কানে কানে বললেন, “তুই ঠিক, আমরা ভুল। পাশে থেকে ভুলগুলো শুধরে দিস বাবা। দূরে গিয়ে বাবাকে অপরাধী করিস না। যেই গ্ৰামে আমি চোখের মণি, যেখানে আজ আমি কয়লার খনি। আরেকটু হলে বোধ হয় বাবাকে আর এসে পেতিস না। পাখিকে পাঠিয়ে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলি।”

অপূর্ব চমৎকার হাসল। বাবাকে এবার পদ থেকে মুক্তি দিবে। পরিবার পরিজন ও গ্ৰাম নিপুণভাবে সামলে বাবার আধিপত্য বজায় রাখবে। বাবার থেকে সে কোনো অংশে কম নয়।

পরিশিষ্ট
সালটা এগিয়ে গেছে। গ্ৰামের রাস্তাটা পাকা হয়েছে এবার। আজ তার উদ্বোধন হবে। আহসান বাড়ির বাইরে তীব্র শোরগোল শোনা যাচ্ছে। গ্ৰামবাসীরা অপেক্ষা করছে অপূর্বকে নিয়ে যাওয়ার। অপূর্ব আলমারি খুঁজেও সঠিক পাঞ্জাবি পাচ্ছেনা। নিরুপায় হয়ে নিচতলায় নেমে আরুকে খুঁজতে লাগল। অসাবধানতায় ধাক্কা লাগল তিস্তার সাথে। সরি বলে মুখের দিকে তাকিয়ে চট করে বলল, “তোরা কখন এলি?”
“ওমা! এই প্রথম আমাদের গ্ৰামে পাকা রাস্তার উদ্বোধন হবে, আর আমরা দেখতে আসব না? শেফালীরাও আসছে। নে তৌফিককে ধর।”

তিস্তা তার ছেলেকে তুলে দিল অপূর্বর কোলে। মামা বলে আদরে মাখিয়ে দিল ভাগনেকে। অতঃপর হাঁক দিল আরুকে, “আরু দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি বের করে দে।”

আরু রান্নাঘর থেকে বিরক্তি নিয়ে বের হলেও তিস্তাদের দেখে মন ভালো হয়ে গেল। হাতের পায়েসের বাটিটা অপূর্বকে দিয়ে তিস্তায় সাথে ভালোবাসায় মেতে উঠল। অপূর্ব হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফের বলে, “লেট হয়ে যাচ্ছে আরুপাখি!”

“আপনার মনোমতো একটা পরলেই তো পারেন। তিস্তা আপুর সাথে একটু কথাও বলতে পারছি না। ধ্যাত!” বলতে বলতে আরু দোতলার দিকে পা রাখল। পিছু ফিরে রান্নাঘরে থাকা সুমিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভাবি, তিস্তা আপুদের পায়েস দিও। আমি চেয়ারম্যানের চেয়ারটা ভেঙে আসছি।”

আরুর কথা শুনে অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ল পরিবেশ। দ্রুত পায়ে উপরে এসে আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি বের করে বলল, “শুভ কাজে সাদাই ভালো। এটা পরুন।”

“এদিকে আমি তো কালো পরতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনে তুই আসার পর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ভালো মন্দের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।”

“ঢং!” আরু পা ফেলল। অপূর্ব আটকে দিল পথ। এক কদম এক কদম করে এগোতে শুরু করল। রসগোল্লার মতো চোখ করে আরু বলল, “সামনে থেকে সরুন। নিতে যাব।”

“চেয়ারম্যানের চেয়ার ভাঙবি না?” দুজনের দূরত্ব তখন শূন্যতায় পৌঁছেছে। অপূর্ব প্রেমপূর্ণ হয়ে উঠল। দুহাতে আরুর টকটকে গাল ধরে নাকে নাক ছুঁয়ে বলল, “চেয়ার তো ভাঙলি না। আমার তো উচিত, তোর রাগ ভাঙা। তা রাগ ভেঙেছে।”

মনের আকাশে তখন রাগ নামক বস্তুটা সরে ভালোবাসার রোদ উঠেছে। লজ্জায় মুখটা অপূর্বর বুকে গুঁজল। অপূর্ব ঝাঁঝে বলল, “ছিলাম এক মুডে। নামিয়ে দিল আরেক মুডে। আমি তো রোমান্স করতে চাইলাম, আর তুই বুকে লুকিয়ে পড়লি?”

“আমি মহান। মাত্র গোসল করেছেন। আপনাকে আর গোসল করাতে চাই না।” অপূর্বর গলা জড়িয়ে আরু বলল। অপূর্ব মুগ্ধতা মিশিয়ে এক গাল হাসল। অপূর্বর গালে টোল পড়ল। পুনরায় আরু বলল, “এই হাসিটা আমার দুর্বলতা, এই টোল আমার দুর্বলতা। গোটা আপনিই আমার দুর্বলতা।”

“জানি। একটা কথা বলব?”

“হুঁ!”

“ওরা সবাই রাস্তার উদ্বোধন দেখতে যাবে, তুমি যেও না প্লীজ?”

“কেন?”

“প্রয়াস আসবে সন্ধ্যায়। বাবা-মাকে ছাড়া কাউকে জানায়নি। আজ পাকা কথা হবে। অনেক আয়োজন করতে হবে। সবাই যদি যাই, তাহলে আয়োজন কে করবে?” অপূর্বর কথায় আরুর মুখের হাসিটা চওড়া হলো। মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রয়াসের সাথে যোগাযোগ করে। সেদিনের পর আরুর সাথেও তেমন কথা বলে না। আজকের পর আর অভিমান করে থাকতে পারবে না। তুরের বিয়ে হয়ে যাবে! অপূর্ব দুহাতে আরুকে আরেকটু জড়িয়ে ধরে বলল, “এত সুন্দর একটা সুখবর দেওয়া জন্য দুইটা পাপ্পি লাগবে। তাড়াতাড়ি দাও।”

বলেই চোখ বন্ধ রাখল অপূর্ব। পরপর দুগালে ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে ছুটে পালাল আরু। অপূর্ব গালে হাত দিয়ে প্রেমময় গলায় বলল, “আমার চণ্ডাবতী, লজ্জাবতী, রূপবতী, গুণবতী আর পদ্মাবতী।”

অপূর্ব তৈরি হয়ে সবাইকে নিয়ে বেরুল। পাখি ও তিহান দাদা অন্তঃপ্রাণ। বের হওয়ার আগে পাখিকে নিয়েই বের হয়ে তিনি। মেজো ভাই তৌফিককে কোলে নিয়েছে। শাহিনুজ্জামান শেফালীর দুই সন্তানকে কোলে নিয়েছে। তিহানকে কোলে নিয়েছে নিঃসন্তান ছোটো ভাই। স্ত্রীর মা হওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও ভাতিজি, ভাতিজা, ভাগনি দিয়েই শখ আহ্লাদ পূরণ করেছে। এবার নানি নাতনিও শখ ওদের সন্তান দিয়েই পূরণ করবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রচণ্ড ভিড়। এই প্রথম গ্ৰামের রাস্তার উদ্বোধন। তাঁবুর ভেতরে আহসান পরিবার বসে আছে। অপূর্ব উদ্বোধন শেষ করে তাঁবুর ভেতরে আসতে পাখি চেয়ার থেকে উঠে অপূর্বর কাছে ছুটে গেল। অপূর্ব খোশমেজাজে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, “পাখি মায়ের কী হয়েছে?”
“আমি একটু ওদিকে যাব? যাব আর আসব। এক জন আমাকে ডাকছে।”

মেয়ের কথায় অপূর্বর কপার চিন্তার ছাপ পড়ল। আগন্তুককে দেখার জন্য আগ্রহ ধামাচাপা দিতে অপারগ হলো অপূর্ব। পাখিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “যাও পাখি! উড়ে যাও।”

পাখি দিল ভোঁ দৌড়। অপূর্ব ধীরে ধীরে এগোল সেদিক। বেগুনী রঙের শাড়ি পরে পারুল দাঁড়িয়ে ছিল পাখির অপেক্ষায়। পাখি ছুটে এসে বলল, “এসেছি। বলো কী বলবে?”

পারুল কোলে নিল পাখিকে। বয়স তার পাঁচ বছর এগারো মাস আট দিন। বাবা মায়ের পর যদি কেউ বেশি আপন হয়, সেটা নানি। পারুল পরম আদরে পাখিকে আদর করে‌ চলেছে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে আমার কাছে এসো, এই নিঃসন্তান মায়ের কোলে তুমি একটু সুখ হয়ে এসো।”

পারুল কাঁদছে। পাখি সেই কান্না সহ্য করতে পারছে না। আলতো হাতে মুছে দিয়ে বলল, “কেঁদো না, আমার বাবা চেয়ারম্যান। বাবাকে তোমার কষ্টের কথা বলো। দেখবে, বাবা তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবে।”

“তোমার বাবা আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবে পাখি। তবে আমাকে সহ্য করতে পারবে না।” বলেই পাখিকে কোল থেকে নামাল। এতক্ষণে পাখির খোঁজ নিশ্চয়ই পড়েছে। যদি এক সাথে দেখে ফেলে, আর অপূর্ব যদি কড়া কথা বলেই ফেলে তখন? পারুলের এই ভয়টাই সত্যি হলো। অপূর্ব দেখে নিল দুজনকে। তবে আজ কোনো রাগ নেই, চোখে বিরাজমান রাজ্যের বিস্ময়। এ কি হাল হয়েছে পারুলের? চোখমুখের দিকে তাকানো যায় না! পাখি হারিয়ে গেলে আরু ও অপূর্বও কি এমন হাল হবে? না! পাখি কোথাও যাবে না! অপূর্ব তাকে যেতে দিবে না। অপূর্ব কোমল গলায় বলল, “পাখি এসো।”

পাখি এসে অপূর্বর আঙুলে আঙুল ঢুকিয়ে হাসল। অপূর্ব এগিয়ে যেতে যেতে কয়েকবার তাকাল সেদিক।
সন্ধ্যার দিকে প্রয়াস তার বাবা মাকে সাথে নিয়ে সম্বন্ধ নিয়ে এলো। তুর বিস্ময় কাটাতেই না। লজ্জায় সে আটখানা। তিস্তা, শেফালী সাজাচ্ছে তুরকে। মহিলারা কথা বলছে পাত্রপক্ষের সাথে। আরু ও সুমি রান্নাঘরে। খাবারের পর্ব শেষ হতেই তুরকে নেওয়ার ডাক পড়ল। শেষ পাতে পানের সাথে তুরকে নিতে এসে আরু বলল, “তুরকে আর সাজিও না তিস্তা আপু। নাহলে এখন দেখবে এক রকম, বিয়ের সময় দেখবে আরেক রকম। ভাববে বউ পালটে দিয়েছি।”

সুমি প্রতিবাদ করল, “একদম না! আমাদের তুর সবসময় সুন্দর।”

শেফালী রঙ্গ করে বলে, “তোর বাসর ঘরে যা হবে, আমাদের বলবি কিন্তু। নাহলে বাসর ঘরে ঢুকতেই দিব না।”

“তোর বাসরে কী হয়েছিল বলেছিস? আমার বাসরের কথা কেন বলব?”

“শোন, আমার বাসর ঘরে তেমন কিছুই হয়নি। আমি তিয়াস ভাইয়ের জন্য কেঁদেছি আর কালাচাঁন আরুর জন্য।”

“পরে তো রোমান্স ঠিকই হয়েছে। তখন বলতি। আবার বলিস না কখনোই অমন কিছু হয়নি। কিছু না হলে তোদের দুটো পোনা আসত না।” তুর অকপটে বলে ফেলল। শেফালী দুই সন্তানের জননী। দুটোই মেয়ে, মিষ্টি ও বৃষ্টি। অপূর্ব, তিয়াস, সুজন ও কালাচাঁন তখনই ভেতরে এলো। সবাইকে গল্প করতে দেখে বলল, “তাঁদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, আর তোরা বাসরের কথা ভাবছিস। পরে এইসব আলাপ করবি। তাড়াতাড়ি চল তুর।”

তুর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। হুট করে তার অপূর্ব ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যঙ্গ করল, “এখন এত কাঁদলে বিয়ের সময় কী করবি তুই? কান্না জমিয়ে রাখ, এক সাথে কাঁদিস।”

“মজা করছেন? আমি কিন্তু বড়ো হয়ে গেছি।”

“জানি! বিয়ে দিব এখন।”

“ক্ষমা করবেন ভাই।‌ প্রয়াসের জন্য আপনাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছি। ভুল বুঝেছি।”

“পা/গ/লি মেয়ে! আরুর সাথে বেশি খারাপ আচরণ করেছিস। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে সব মিটমাট করে নে।” অপূর্ব আদেশ দিল তুরকে। অপূর্বর আদেশ মেনে তুর হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল, “আরু সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি অনুতপ্ত। ক্ষমা করিস বোনটাকে। তোদের জন্যই আজ এত বড়ো একটা সারপ্রাইজ পেলাম।”

তুরের প্রতি আরুর কোনো অভিযোগ নেই। তবুও অভিনয় করে কঠোর গলায় বলল, “আমি তোর বড়ো ভাবি। পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।”

তুর পা ছোঁয়ার আগেই আরু ধরে ফেলল। তুরকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “সুখে থাক তোরা!”

এরমধ্যে চিৎকার শুনতে পেল সকলে। পাখির কান্না শুনে সবকিছু ফেলে রেখে বৈঠকখানায় ছুটে গেল আরু। পাখির পা থেকে রক্ত ঝরছে। কান্নায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আরু দ্রুত মেয়েকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দিল, “এই তো এসেছি মা, কিচ্ছু হয়নি। কীভাবে ব্যথা পেয়েছিস?”

মোতাহার আহসান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “কেউ একটু পানি নিয়ে আয় জলদি।”

অপূর্ব পানি এনে পাখির পা ভিজিয়ে রাখল। চম্পা পান চিবিয়ে পাখির ক্ষতস্থানে লাগিয়ে কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল। শাহিনুজ্জামান বললেন, “পাঁচটায় খেলতে খেলতে দরজার চিপায় পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বের করতেই রক্ত ঝরতে শুরু করল।”

পাখি হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আরু মেয়ের পিঠে চাপড় মে/রে দোলাতে দোলাতে বলল, “আপনারা কথা বলুন। আমি ওকে নিয়ে ঘরে যাই।”

“তুই ওকে আমার কাছে দে। বাইরে হেঁটে আসি।” মোতাহার আহসান হাত বাড়াতেই পাখি যেতে চাইল। আরু যেতে দিল না। দ্রুত পা ফেলে ওপরে যেতে যেতে বলল, “অতিথি এসেছে। আপনি পাত্রীর বাবা। আপনার থাকা জরুরি। আপনি এখানেই থাকুন।”

অপূর্বও আরুর পেছনে পেছনে গেল। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে মেয়েকে নিয়ে ঘরের ভেতরে হেঁটে শান্ত করার চেষ্টা করছে আরু। কিন্তু মেয়ে কি শান্ত হওয়ার? কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এখানটা না খুব ব্যথা করছে!”

আরু ফুঁ দিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করে। মেয়ের কান্নায় ভেতরটা বেরিয়ে আসার উপক্রম। অপূর্বর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “শান্তি পেয়েছেন আপনি? মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রাখতে পারতেন না? সারাদিন তো মহান কাজ করেন, বাড়ি থাকার সময়টুকু একটু মেয়ের দিকে নজর দিলে কী এমন ক্ষতি হয়!”

অপূর্বর পদ্মাবতী চণ্ডাবতী হয়ে আছে। তার কাছে টু শব্দটি করার স্পর্ধা অপূর্বর নেই। মাথাটা নত করে বলল, “অপু সরি। অনেক সরি। ভুল তো সংশোধন করা উচিত? চলো সংশোধন করে আসি।”
অপূর্ব আলমারি থেকে জামাকাপড় নামাতে মরিয়া হয়ে উঠল। ট্রাভেলিং ব্যাগ ভরতি করল তিন জনের জামাকাপড়ে। মেয়েকে শান্ত করতে করতে আরু বলল, “ওগুলো নামাচ্ছেন কেন? মাথা খারাপ করবেন না কিন্তু। এগুলো কিন্তু আর গোছাতে পারব না।”

অপূর্ব আরুর কথা শুনল না। নিজের মতো কাজ করে নিল। ব্যাগ ও পাখিকে নিয়ে নিচে নামতেই দেখল পাত্রপক্ষ বিদায় নিয়েছে। অপূর্ব কৌতূহল নিয়ে বলল, “কী পরিয়ে গেছে?”

তুর হাত দেখিয়ে অনামিকা আঙুলের দিকে ইশারা করল। সেখানে চকচক করছে স্বর্ণের আংটি। বাড়ির সবাই অপূর্বর ব্যাগ দেখে না চমকে পারল না। অনিতা প্রশ্ন করল, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”

“আমি জানি না মামুনি। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছে কে জানে?” খানিক বিরক্ত প্রকাশ করল আরু। অপূর্ব কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি মা, কতদিন হয়েছে যাই না। চেয়ারম্যান হিসেবে একটা দায়িত্ব আছে না?”

আরু থমকে গেল। চকচক করছে চোখের পাতা। অপূর্বর এই সিদ্ধান্ত সবাই কেবল সন্তুষ্ট নয়, আনন্দিত। চম্পা বললেন, “তুই সত্যি ওই বাড়িতে যাবি অপু?”

“এই তো যাচ্ছি।”

“তাহলে আমরা এখানে থেকে কী করব? চলো, আমরাও ফুফুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।” তিস্তা সবাইকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল। সবাই এতে মত দিল। মোতাহার আহসান বললেন, “মা মেয়ের এই মুহুর্তটার সাক্ষী হতে আমরাও যাব। কে কে যাবি?”

“আমি!” সবাই একসাথে। আরু হাসে। অপূর্বর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “আমরা আগে যাই?”

“যা!” মোতাহার আহসান অনুমতি দিল। আরু আগে আগে গেল। পাখি ঘুমিয়ে পড়েছে আরুর কোলে। রাত করে টাইসনকে বের করল অপূর্ব। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আরুর হাত ধরে টেনে তুলল। পাখিকে ঘুরিয়ে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “পাখি আমরা ঘোড়ায় চড়েছি।”

“সত্যি বাবাই! টগটগ করে ছুটবে এবার।” অপূর্বর আদেশ পেয়ে টাইসন ছুটতে লাগল নিজের পথে। এই সামান্য মুহুর্ত আরুর কাছে যুগ যুগকেও হার মানাবে। মৃধা বাড়ির সামনে এসে ঘোড়া থামল। সবকিছু আগের মতো রয়েছে। ঘোড়া আওয়াজ শুনে কান খাঁড়া হয়েছে ইমদাদ ও পারুলের। আরু চট করে ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে ভেতরে যেতে যেতে বলল, “ময়না, ময়না, ময়না।”

প্রত্যুত্তরে ময়না আরুপাখি আরুপাখি আরুপাখি বলে উড়ে এলো। কাঁধে বসে নিজের সুরে ডাকল। পারুল ও ইমদাদ ঘর থেকে নেমে এলো। আরুকে বাড়িতে দেখে দৃষ্টিভ্রম মনে করল। অপূর্ব ততক্ষণে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে চলে এসেছে। বিনীত সুরে সালাম দিল। দুজনেই সেই সালাম নিল। পারুল আবেগে ভেসে বলল, “তোরা সত্যি এসেছিস? এটা আমার স্বপ্ন নয়তো?”

“না! স্বপ্ন নয়! বাস্তব।” বলেই আরু ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের কোলে। পারুলের নিঃসন্তান তকমা ঘুচে গেল। অপূর্বও ইমদাদ হোসেনের সাথে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। পারুল অনুতপ্ত হয়ে বলল, “এক সন্তানকে হারিয়ে আমি উন্মাদ হয়েছিলাম। সব কষ্ট আমি তোর ওপর ঝেড়েছি। ক্ষমা করিস আরু।”

“মায়েরা হাজারো ভুল করতে পারে। তাদের ক্ষমা চাইতে হয়না। তখন তোমার ওপর আমার অনেক অভিমান ছিল তাই দূরে সরে গেছি। এখন আবার ফিরে এসেছি।” পারুলের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। অপূর্ব পাখিকে পারুলের কোলে তুলে দিয়ে বলল, “পাখিকে আর লুকিয়ে কোলে নিতে হবেনা।”

পারুলের কোলে উঠে পাখি প্রশ্ন করল, “এরা কারা বাবাই?”

“এরা তোমার মায়ের বাবা মা। মানে তোমার নানাজান আর নানিজান।” অপূর্ব উত্তর দেয়। দুজনের আদরে পাখি আজ অনেক খুশি। আরুর দৃষ্টি পড়ে ঝোপের দিকে। যেখানে শায়িত আছে অয়ন। আরু এক কদম এক কদম করে এগিয়ে যায় সেদিক। অপূর্ব ইমদাদের থেকে পাখিকে চেয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে পা ফেলে বলে, “সাত ভাই চম্পা নিবাস ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই এখানে আসছে। প্রস্তুতি নিন।”

পারুলের আনন্দ ধরে না। কতদিন পর আবার পরিচিত মুখগুলোর দেখা পাবে। কী করে আপ্যায়ন করবে ভেবে পায় না।

আরু সবার প্রথমে সালাম দিয়ে ভাইয়ের খবর নিল, দোয়া দরুদ পড়ল। তারপরে মোনাজাত ধরে ভাইয়ের রুহের মাগফিরাত কামনা করল। আরুর দৃষ্টি গেল কিছুটা দূরে। সেখানে নতুন একটা কবর। যেটা তার দাদিজানের। মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। ইমদাদ হোসেন গাছে তাবিজ বাঁধার পর থেকে তার অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে লাগল। এক সময় রক্ত বমি করতে লাগল‌, তার কিছুদিন পর বিছানা থেকে উঠতেই পারল না। মায়ের এই অবস্থা দেখে ইমদাদ হোসেন সব বুঝে গেলেন যে, তার সংসার ভাঙনের পেছনে তার মা জড়িত। গাছ থেকে তাবিজ খুলে দিলেন। এরপর? এরপর সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মা/রা গেলেন।
আরু পাখিকে বলল, “এই হচ্ছে তোমার মামার করব। যেদিন তুমি চোখ খুলে এই পৃথিবী দেখছ, সেদিন সে চোখ বুজেছে।”

“আর চোখ মেলেনি?”

“না! সে ওখানে শুনে আছে।

“আমার সাথে দেখা করবে না?”

“না।”

পাখির মন খারাপ হলো। তখনই বাড়ির ভেতর থেকে শোরগোল শোনা গেল। সবাই চলে এসেছে যে! আরু সেদিকে পা বাড়াল। তখনও আরুর কাঁধ জুড়ে আছে ময়না পাখি। দখিনা হাওয়াতে উড়ে গেল ঘোমটা। অপূর্ব পেছন থেকে তার পদ্মাবতীকে দেখতে দেখতে ছন্দ মিলাল,

দিঘির মাঝে ফুটেছে পদ্ম,
নীল তার রং।
ঘন কালো কেশ কেড়েছে আমার চোখের ত্রাস, তন্দ্রা, গ্লানি!
নূপুরের ঝুনঝুনিতে পুলকিত হলো, হৃদয়খানি।
সে যে আমার নীলপদ্ম!
জানতাম তুই আসবি।
তুই আসবি বলেই, নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে।

[সমাপ্ত]
পাখি ও তার দাদার বন্ডিং + তুর ও প্রয়াসের বিয়ে নিয়ে একটা সারপ্রাইজ পর্ব লিখব সময় করে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে