নিরন্তর অপরাজিত – সবুজ আহমেদ মিজান

0
849

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
নিরন্তর_অপরাজিত
সবুজ_আহমেদ_মিজান
.
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে কেরানির চাকরি পাওয়ার পর এমন করে কখনো ভেঙে পড়িনি আমি। আজকের সকালটা বুকের গভীরখাদে ডুবে যাওয়া স্মৃতিটাকে খুঁড়ে বের করে আমাকে যেন স্মৃতিভুক করে রেখেছে। আজ সকালে রনু চাচার মতো একজনকে স্কুলে দেখে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল বুকটা। অবিকল রনু চাচার মতোই দেখতে একজন মানুষ। যার আঙুলে নির্ভার আরেকটি ছেলের মুষ্টিযোগ দেখে আমি সেই ম্রিয়মাণ, নিষ্প্রাণ দিনগুলোতে কেমন করে যেন ডুব দিলাম! চোখের সামনে ভাসাভাসা হয়ে উঠল সেই উত্তাল অতীতগুলো।
.
রনু চাচা আমার নিজের চাচা নন। একই গ্রামে ছিল আমাদের আবাস। আমার বয়স যখন নয় বছর, তখন থেকেই রনু চাচার সাথে আমার মানিকজোড় সম্পর্ক। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। দুরন্ত বয়সের সেই স্মৃতির আখ্যানে আমি প্রতিদিন রনু চাচার আঙুল ধরে একসাথে স্কুলে যেতাম। স্কুল যাবার আগে কখনো তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন, কখনো আমি তাঁদের বাড়িতে যেতাম। আর স্কুল ছুটির সময়গুলোতে কখনো আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতাম, কখনো তিনি আমার জন্য। স্কুল ছুটির পর আমরা প্রায় প্রতিদিনই মাঠে খেলতে যেতাম। আবার মাঝেমধ্যে যেতাম না। তখন খেলাঘর খেলাঘর খেলায় নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। রুবিনা, আরিফা, মীনা, সোহাগসহ আমার অন্যান্য বন্ধু, বান্ধবীর সাথে রনু চাচাও ছিলেন। রনু চাচা আমাদের থেকে বয়সে বড় হলেও সুন্দরভাবে মিশে যেতেন আমাদের মাঝে। আমাদের খেলা দেখতে এসে নিজেও যোগ দিতেন খেলায়। পুতুল বিয়ে ছিল আমাদের ভীষণ প্রিয় খেলা। একজনের পুতুলের সাথে আরেকজনের পুতুলের বিয়ের আয়োজনে কখনোসখনো পিকনিকের আয়োজনও করতাম। যেখানে গীত হতো, নাচ হতো, হলুদবরণ, বধূবরণও হতো। তবে পুতুল বিয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে কখন যেন বর বউ খেলায় মশগুল হয়ে গেলাম সবাই। সেই খেলায় আরিফা হতো সোহাগের বউ আর মীনা হতো রনু চাচার বউ। রুবিনা সবাইকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে দিত। মীনাকে বউ সাজিয়ে রনু চাচার পাশে বসিয়ে রাখত। রনু চাচা মীনার চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তাকে বউ বউ বলে ডাকত আর মীনা লজ্জার মৌতাতে ওড়না দিয়ে মুখ ডেকে রাখতো। ‘বউ হতে হলে লজ্জাবতী হতে হয়।’ এমনটা রুবিনা বলত আমাদের। রুবিনার কথা অনুযায়ী মীনাও লজ্জালু চোখে রনু চাচার দিকে চোখ ঠিকরিয়ে রাখতো আর লাজুক হাসি দিত। রনু চাচার চোখেমুখে তখন কী যে ভালোবাসার নেশা উঁকি দিত মীনার জন্য! আমার ছোট্ট মনে তার বিশালতা ধরা পড়ত না। অবুঝ মনটা খেলার নিয়মমাফিকে সবকিছু এড়িয়ে যেত। মেতে থাকত অপরিণত জীবনের সংসার সংসার খেলায়। উত্তীর্ণ সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা চলতো খেলাঘর নামে ডাকা এই বর বউ খেলা।
.
এক ঘন কুয়াশার শীত রাতের কথা আমার ভীষণ মনে পড়ে। তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুতের আলো প্রবেশ করেনি। সন্ধ্যার পর প্রতিটি বাড়িতে হারিকেন কিংবা কুপির টিমটিমে আলো জ্বলে উঠত।
ডিসেম্বর মাস। বার্ষিক পরীক্ষার পর লেখাপড়াহীন শীতকালীন অবকাশ চলছিল সেই সময়। সন্ধ্যার পর সবেমাত্র আকাশকে ধূসর ছাউনিতে ঢেকে কুয়াশা পতনের শব্দ শুরু হয়েছে। শত্রুর তাড়া খাওয়া ভয়ার্ত শাবকের মতো শেয়ালগুলো পাশের ফসলি জমি থেকে হাঁক দিতে শুরু করেছে। জলের টলটলে আয়নায় অর্ধ চাঁদ দুলতে শুরু করেছে অবিশ্রান্ত সরোবরে। ঠিক সে সময়ে রনু চাচা কোথা থেকে ছুটে এসেছিল আমাদের ঘরে! তাঁকে উপস্থিত দেখে বললাম,
“চাচা তুমি এ বেলায়?”
“হ, যাইবি আমার লগে?”
“কই যামু?”
“গান হুনতে?”
“কিহের গান?”
“পাশের গাঁয়ে গানের আসর বইছে, এলাকার হগলে যাইতাছে… চল আমরাও যাই।”
“খাড়াও মা’রে কই।”
“আইচ্ছা কইয়া দ্যাখ।”
.
মায়ের অনুমতি নিয়ে রনু চাচার হাত ধরে কুয়াশার দীর্ঘ সারি পাড়ি দিয়ে আমি ছুটছিলাম গানবাড়িতে। গানবাড়িতে গিয়ে লোকসমাগমের এককোণায় আমরাও বসে পরলাম। রনু চাচা আমার হাত শক্ত করে ধরে সামনে তাকিয়ে আছে। সেখানে একেক পর এক পালাগান হচ্ছে। আয়নাবিবির পালাগান, রূপবানের পালাগান। পালাগান শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়ে গেল। একটু পরেই পুঁতিপাঠের আসর শুরু হবে। কিন্তু আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। সেখানেই ঢুলুঢুলু চোখে স্বপ্ন দেখছিলাম। দেখছিলাম, ‘রনু চাচার আঙুল ধরে গ্রামের পথ দিয়ে গানবাড়ির গান শুনতে যাচ্ছি। মীনাও যাচ্ছে আমাদের সাথে।’
রনু চাচার স্পর্শে চমকে উঠলাম। ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে জড়তাযুক্ত কণ্ঠে বললাম, “কী অইছে চাচা?”
“অনেক রাইত অইছে, চল বাইত যাই।”
“আইচ্ছা চলো।”
.
নির্ভীক রনু চাচার হাত ধরে গ্রামের সাদা কুয়াশার ধোঁয়াময় পথ পেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছি। কোথাও কেউ নেই। শিশিরস্নাত চাঁদকে তখন ছোট্ট শিশুর মতো ফুটফুটে লাগছিল। ধূধূ করা মাঠে ধূসর-সাদা শাড়ি পড়ে একটু একটু করে ঝরতেছিল কুয়াশারা। নিশিপোকা ঝিঁঝিঁ’র ডাকে অন্ধকারের কোলে রাত যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নীরব ভাষায়।
শীতকালে এত রাতে আমি কখনো বাইরে থাকিনি, সেটাই প্রথম। রনু চাচা আমার হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, “তোর ডর লাগতাছেনা সাজু?”
তাঁর কথা শুনে চট করে উত্তর দিলাম, “তুমি আছ না!”
“তর কি ঘুম পায়?”
“তখন পাইছিল, অহন আর নাই।”
“ঐ বাঁশঝাড়টা দ্যাখছোস?”
“হু…”
“যাইবি ঐহানে?”
“ঐহানে ডর লাগবো, যামু না।”
“ধুর পাগল, আমি আছি না, ডর কিহের, কাছে গিয়াই তোরে জাদু দেখামু!”
“হাচা! কী জাদু?”
কৌতুহলী মনে তাঁকে শুধাই আমি। একটু পরেই বাঁশঝাড়ের কাছে পৌঁছাই দুজনে। সেখানে ঝাঁকবাঁধা জোনাকির জ্বলা-নেভার লুকোচুরি খেলা চলছে। কোনোটা জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাচ্ছে, কোনোটা জ্বলতে জ্বলতে বাঁশঝাড় থেকে বেড়িয়ে পড়ছে আবার কোনোটা বাঁশপাতায় আলো বিছিয়ে দিয়ে শুয়ে আছে।
রনু চাচা আমাকে ঝাড়ের আরো ভেতরে নিয়ে গেলেন। চারদিকে গহীন অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু দুজন মানুষের নিঃশ্বাস টিপটিপ করে জ্বলছে জোনাকি পোকার মতো। আর কথা বলার সময় শীত শীত ধোঁয়া বের হচ্ছে মুখ থেকে। রনু চাচা আমার কানে ফিসফাস করে বললেন, “ডর লাগে তর?”
“না চাচা, তুমি আছ না লগে!”
“জোনাকি পোকা লইবি?”
“হুম দাও, বতলে ভইরা রাখুম।”
আমাকে কথা দিয়ে রনু চাচা জোনাকি ধরতে লাগলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, এত রাতে আমার জন্য তিনি জোনাকি শিকার করতে বের হয়েছেন। কিছুক্ষণ পর আমার হাতে একটা জোনাকি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “হাত মুঠো কর… আস্তে আস্তে… উইড়া যাইবো।”
আমি হাতের মুঠোয় নিতে নিতে ফাঁক পেয়ে ফাঁকি দিয়ে জ্বলতে-নিভতে জোনাকিটি উড়ে গেল। জোনাকি উড়ে যেতে দেখে রনু চাচা আফসোস করে বললেন, “তুই কিচুই পারস না! খাঁড়া আরেকটা ধইরা দেই।”
আমি নাখোশ ভাব দেখিয়ে বললাম, “লাগবো না রনু চাচা”
“আইচ্ছা থাইক। বাইত চল।”
.
বন্ধুত্বের ছক থেকেও রনু চাচা ছিল আমার পরমপ্রিয় বন্ধু। শুধু সম্পর্ক সূচক ডাকটাই ছিল আমাদের দূরত্ব। তদুপরি আমরা ছিলাম দুজন দুজনার অতি আপনজন। স্কুল চলাকালীন এক টিফিনের দুপুরে একজন সহপাঠীর সাথে আমার খুব মারামারি হয়েছিল। সে আমার শার্টের বোতাম টেনে ছিঁড়ে দিয়েছিল। সেই আক্ষেপে আমি খুব কেঁদেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ শোনাতে গিয়েছিলাম রনু চাচার কাছে। আমার কান্নামাখা চোখ দেখে তিনি তড়িৎ গতিতে ছুটে এসে সেই ছেলেকে ভীষণ পিটিয়েছিলেন। ঠোঁট ফাটিয়ে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু হয়েছিল ঐ ছেলের ঠোঁট থেকে। তখন রনু চাচা আমার বইগুলো কাঁধে নিয়ে আমার হাত ধরে ভোঁ-দৌড় দিয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে বলেছিলেন, “জোরে দৌড়া সাজু।” দম বন্ধ করা দৌড়ের ওপর আমরা বাড়িতে পৌঁছেছিলাম ঐদিন। তবে পরেরদিন এই অপরাধে রনু চাচাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল।
.
সোনার খাঁচার বন্দি করে রাখার মতো সুখের চাদর গায়ে জড়িয়ে অতিবাহিত হতে লাগল শৈশবের নিষ্পাপ দিনগুলো। রনু চাচাকে ছাড়া আমার প্রতিটি ক্ষণ যেন কল্পনার বাইরে মনে হতে লাগল সবসময়। কিন্তু আচমকা একদিন আমাদের সুখী গ্রামে যুদ্ধের সোরগোল পড়ে গেল। সবার মুখেমুখে কেবল যুদ্ধের সংবাদে, সংলাপে তোলপাড় হতে লাগল সারা গ্রাম। ভয়ে, শঙ্কায় সবাই কোণঠাসা পড়ে পড়ল। অনেকে নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে লাগল অন্য গ্রামে। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জোরেজোরে কাঁদতে শুরু করল। বাবাও লাঙল আর গরু দুটোর গায়ে হাত বুলিয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাতে লাগলেন। আমার মনে তখন অনেক অজানা প্রশ্নের উত্থানপতন চলছিল। যুদ্ধ কী, কেন যুদ্ধ হয়, কারা যুদ্ধ করে?… এমন অসীম প্রশ্নের আঘাতে আঘাতে মায়ের নির্জীব মুখটা দেখে আমিও কাঁদতে লাগলাম। দুদিন ধরে রুনু চাচাও বাড়িতে নেই। বেড়াতে গেছেন। রনু চাচার কাছে ছুটে গিয়ে তাঁকে যুদ্ধের কথা জানাতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। যুদ্ধ নিয়ে সাতসতের ভাবনায় রাতে ঘুম হলো না আমার।
পরদিন সকালে দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে নিতে রনু চাচাই ছুটে এলেন আমাদের বাড়িতে। মুখখানি ফ্যাকাসে করে বলতে লাগলেন, “আমাদের গাঁয়ে যুদ্ধ শুরু হইবো রে সাজু… আমি শুইনা আইলাম। পাকিস্তানিরা আমাদের দ্যাশটা কাইড়া নিতে আইবো রে। সাবদানে থাকিছ।”
আমি বুঝতে পারি না যুদ্ধ কী; তবুও ভীষণ ভয়ে আরও কাতর হয়ে গেলাম। যুদ্ধের কথা বলেই রনু চাচা আর বিলম্ব করলেন না। দৌড় দিতে লাগলেন তাঁদের বাড়ির দিকে। তাঁর ছুটে চলা পিঠ দেখে আমার দুচোখ জলে উতলে উঠল। চোখ মুছতে মুছতে আমি আমাদের খেলাঘরটার দিকে পা বাড়ালাম। পুতুল বিয়ে খেলার কথা ভেবে কাঁদতে লাগলাম অঝোরে। মা’ও চুলোয় জ্বাল দিতে দিতে আঁচলে মুখ ঢেকে গুমড়ে কাঁদতে লাগল।
সন্ধ্যা শুরুর আগে হাঁড়ি কড়াইয়ের আওয়াজে যে গ্রামটা মুখর ছিল প্রতিদিন। প্রদীপের আলোয় আলোয় যে গ্রামের প্রতিটি আঙিনা জ্বলজ্বল করে জ্বলত। সেদিন থেকে সেই গ্রামটা কেমন যেন কবরস্থানের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ আর কুপির আলো জ্বালিয়ে রাখে না ভয়ে। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হতেই সবাই আলো নিভিয়ে ঘরেঘরে জীবনের চিন্তায় মূর্ছা যেতে লাগল।
.
তারপর সত্যি সত্যি পাকিস্তানিরা একদিন গভীর রাতে আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়লো। চারদিক চিৎকার, মানুষের দিক্বিদিক ছোটাছুটির আওয়াজ আর আগুনের কুণ্ডলীতে উত্তাল হয়ে গেল নীরব গ্রামটি। বাবা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গরুগুলোকে গোয়াল থেকে ছেড়ে দিতে গেলেন। আমাকে বুকে আষ্টে মা ঢুকে পড়লো চৌকির তলে আর একনাগাড়ে কলেমা পড়তে লাগল। সাথে আমিও। কিছুক্ষণ পর আমাদের বাড়ির আঙিনায় একটা বিকট শব্দ হলো। শব্দটা কানে পড়তেই আমাকে চৌকির তলে রেখে মা ঘর থেকে বেরিয়েই “আল্লাহ গো…” বলে চিৎকার করে উঠল। তারপর আর কোনো কথা শোনা গেল না। আমার বুকটা দ্রুত বেগে দুরুদুরু করতে লাগল। ভীত মনে চৌকির তল থেকে বেরিয়ে আঙিনায় নজর পড়তেই আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বাবার বুক ভেদী রক্তের উপর মাথা রেখে মা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমি “মা আ আ আ…” বলে ডাক দিয়ে মায়ের পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মা’র শরীরটা ঝাঁকিয়ে কাঁদতে লাগলাম হাউমাউ করে। মা আর একটা কথাও বলল না। বাবার চোখদুটো খোলা। বুক থেকে তখনও ঝরঝর করে ঝরতেছিল তাজা রক্ত। আমি সেই রক্ত আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম আর নিঃশ্বাস ছেড়েছেড়ে কাঁদতে লাগলাম। আশেপাশের কোথাও তখন পাকিস্তানিদের বুট জুতার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। বাবা-মাকে আঙিনায় ফেলে রেখে আমি প্রাণপণে দৌড় দিতে শুরু করলাম। দৌড়ের মধ্যেই ভোর হয়ে গেল। হঠাৎ একটা গাছের নিচে গিয়ে প্রচণ্ড ভয়ে আঁতকে উঠলাম। সেখানে মীনার নগ্ন দেহ পড়ে আছে। উরুর নিচ থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল আর সে পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিল। আমি ওর কাছে গিয়ে মীনা মীনা বলে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু সে কোনো জবাব দিলো না। শুধু পানি পানি বলেই কাতরাতে কাতরাতে নিঃশ্বাসের কাছে হার মেনে নিলো। বেঁচে থাকার তাগিদে ওরও লাশ ফেলে আবারও দৌড় দিলাম আমি। মনেমনে রনু চাচাকেও খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও নেই রনু চাচা। প্রিয় গ্রামটির চেনাজানা রূপ একরাতেই রক্ত আর লাশের ভার কাঁধে নিয়ে যেন পাল্টে গেছে। আস্তানা হয়েছে পাষণ্ড পাকিস্তানিদের।
.“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
আহার-অনাহারে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ছুটতে ছুটতে চোখের সামনে গড়ানো অনেকগুলো মৃত্যু আমাকে শূন্য মানুষ বানিয়ে দিলো। মৃত্যু আর মৃত্যুর যুদ্ধ শেষে একদিন স্বাধীন হলো আমাদের প্রিয় দেশ। আমার ঠাঁই হলো বহুদূরের গ্রামের একটি বাড়িতে। সন্তানহারা সেই মা বাবা আমাকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিলেন। আমার নিজ ঠিকানার খবর জানতে চাইলেন। কিন্তু আমার ছলছল চোখদুটো তাঁদের নিরাশ করল, যখন তাঁরা জানলেন, পাকিস্তানিরা আমার বাবা-মার জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে। তারপর তাঁদেরই কাছে নিজ সন্তানের মতো স্নেহে আমি যাপন করতে লাগলাম নতুন আরেক জীবন। যুদ্ধের কিছুদিন পর আমি নতুন বাবাকে নিয়ে আমার নিজ গ্রামে গেলাম। গ্রামটা কেমন অদ্ভুত, অপরিচিত হয়ে গেছে। আমাকে গ্রামে দেখে যুদ্ধের পর বেঁচে থাকা মুখগুলো হুমড়ি খেয়ে ছুটে এলো আমার কাছে। অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একেকজন একেকটা প্রশ্ন করতে লাগল। আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। একছুটে গেলাম আমাদের ভিটেমাটিতে। ভিটেবাড়ির আঙিনাটা কেমন খাঁখাঁ করছে। ঘরগুলোর বেড়া খসে পড়ে আছে। আমার অতিপ্রিয় খেলাঘরটা এখনো ঠায় দাঁড়ানো। হুহু করে কেঁদে ওঠা মনটা নিয়ে সেটাতে একবার হাত বুলিয়ে বাবা মার লাশ দুটো আঙিনার যেখানে পড়ে ছিল সেই মাটি আঁকড়ে ধরে “ও মা ও বাবা” বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। সঙ্গেসঙ্গে বাবা মাটি থেকে তুলে আমাকে বুকে জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আমি পেছন ফিরে ফিরে দেখতে লাগলাম আঙিনাটাকে। পরে রনু চাচার খোঁজ করতে গেলাম তাঁদের বাড়িতে। কিন্তু তাঁর কোনো খোঁজ মিলল না।
.
গ্রাম থেকে ফেরার কদিন পর বাবা আমাকে একটি দিয়াশলাইয়ের ফ্যাক্টরিতে কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে দিনে ২ টাকা করে দিতো আমাকে। দুপুরে ১ টাকা দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে রাতে আমার নতুন মাকে বাকী ১ টাকা দিতাম আমি। মা ফ্যাক্টরিতে কাজের পাশাপাশি আমাকে একদিন একটি নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আরেক মায়ের কোলে নতুন জীবনের জায়গা পেয়ে আমি ভুলে গেলাম আমার সমস্ত বিভীষিকাময় অতীত। ভুলে গেলাম প্রাণপ্রিয় মা, বাবা, রনুচাচা আর সেই খেলাঘরকে।
সময়ের পথ ধরে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। আমার বিয়ে হলো। সন্তান হলো। সেই সাথে প্রাইমারি বিদ্যালয়ের ছোট্ট পদের কেরানির চাকরি। আমার নতুন জীবন দানকারী বাবা মারা গিয়েছেন প্রায় ৫ বছর হয়েছে। মা এখন শয্যাশায়ী। হাঁটা চলা করতে পারেন না। নিভুনিভু নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছেন পৃথিবীর বুকে। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকলে করুণ সেই দিনগুলো আমাকে ব্যথায় জর্জরিত করতে পারে না। আমি নিমিষেই ভুলে যাই আমার আরেক জীবনের কথা। ভুলে যাই, যে জীবন হারিয়েছে প্রিয় মা-বাবাকে। যে জীবন হারিয়েছে রনু চাচার মুষ্টিবদ্ধ আঙুল। যে জীবন হারিয়েছে রক্তনদীতে ভেসে যাওয়া নিষ্পাপ মনের খেলাঘর।
বেঁচে থাকার নির্মম আঘাতে জীবন কখনোই থেমে যায় না, হেরে যায় না। একমুঠো স্বপ্ন নিয়ে জীবনের দিকে তাকিয়েই জীবনটা বেঁচে থাকে সর্বদা। জীবনের চিরন্তন সংজ্ঞায় এই জীবনটা যেন নদীর মতোই প্রবহমান, নিরন্তর অপরাজিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে