মরেও বাঁচার আর্তনাদ!- Mizanur Rahman

0
615

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগতা_আগষ্ট_২০২০
মরেও বাঁচার আর্তনাদ!

1/

সপ্তাহ খানেক হলো চাকুরীতে যোগ দিয়েছে রাফিন। সদ্য প্রায়ত প্রিয় মাকে হারিয়ে পুরা পরিবার শোকসন্তপ্ত। বাবা বয়োবৃদ্ধ ও কর্মে অক্ষম হওয়ায় পরিবারের আয়ের উৎস একমাত্র রাফিন।
এখনো স্মৃতিপটে ভেসে আসে মায়ের বেদনাবিধুর অসহায়ত্বের মৃত্যু।
রাফিনের মা কোনদিন কোন প্রার্থিত ব্যক্তিকে খালি হাতে ফেরত দেননি।
সমস্ত এলাকা জুড়ে চলছে শোকের মাতম।
আর বাবা ও এখন মৃত্যুশয্যায় কবর অভিযাত্রী । দান বাদন্যতায় প্রশংসা ছিল তুখোড়। মানবিকতার পরিচয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দান সদকা করতেন নিমিষেই । কিন্তু আজ জীবনইতির দ্বারপ্রান্তে চিকিৎসাহীন। সাজানো গোছানো পরিপাটি পরিবার এখন নিমেষেই বিধ্বস্ত প্রায়।

তাই রফিন পেট ও বাবার উন্নত চিকিৎসার তাগিতে বেশি রোজগারে মড়িয়া।
স্বল্প বেতনের চাকুরীতে পরিবার নড়বড়ে ও দুর্দশাগ্রস্ত। পাশের গ্রামের এক বন্ধু দেশে ফিরেছে এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় ।ইতালির ফাইব স্টার হোটেলে কর্মরত ছিল দীর্ঘদিন। প্রাণঘাতী ‘ করোনার’ প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে প্রাচ্যের দেশে দেশে। তাই বাধ্য হয়ে সকল ভিনদেশী শ্রমিকের ধরতে হলো বাড়ির পথ।
সাথে সাথে মৃত্যুর মিছিল ও হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ।
বন্ধুর কাছ থেকে কিছু সাহায্য পাওয়ার আশাটাও নিষ্ফলা হলো।

কালবিলম্ব না করে মাফস্বল ছেড়ে উঠতে হবে ইটপাথরের নন্দিত শহরে ।জীবিকার টানে সব বিলিয়ে টাকা আয় করতে হবে। বিদেশ ফেরত বন্ধু শহরে আসতে বাধা দিলেও কর্ণপাত করেনি রাফিন।
ভয়াল রূপ ধারণ করা মহামারী একদিন এশিয়ায়ও হানা দিয়ে নগর, বন্দর, আবদ্ধ করবে। সারা দেশ হবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

এসব তথ্য জানানো হলেও বাবার জীবন-মরনের সন্ধিক্ষণে চিকিৎসা টাকা উপার্জনের কথা ফেরাতে পারেনি শহরে আসা থেকে।

2/
যেমন কথা তেমন কাজ। চারদিন কাজ করতে না করতেই শুনতে হলো আশানুরূপ দুঃসংবাদ। ইতিমধ্যে ‘ করোনা ‘ ছো মেরেছে মাতৃভূমিকেও। প্রতিটি নিঃশ্বাসে জেগে ওঠে নতুন জীবনের গল্প ।অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে শুনতে হচ্ছে নাম-না-জানা ভয়ঙ্কর শব্দগুচ্ছ। অসহায়ত্বের নগ্ন হামলার মহড়া চলছে মানব সামানিয়ায়।
যে যাকে পারে -তাকে ভুলে পালাচ্ছে।
স্থির ও আপন গতিতে গন্ডিয়মান বিশ্বকে মুহূর্তেই মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে মহামারী করোনা।অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মক্ষেত্রও বন্ধ ঘোষণা হলো ।মানতে বড় কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু কি আর করার?
পিচ ঢালা এই সড়কে এখন গাড়িশূন্য। গ্রামে গিয়ে বাবার শুশ্রূষা করা অসম্ভব ।
মুহূর্তেই আমানিশা রাতের রূপ নিয়েছে পৃথিবীজুড়ে। সৌন্দর্য ও ভালবাসার প্রতীক মুসাফাতেও নিষেধাজ্ঞা । শরীর থেকে উপসর্গ বের হবে বলে দৌড়ে পালাচ্ছে সবাই।
যেন মানুষ সভ্যতায় মানুষত্বই দূর হয়ে যাচ্ছে। মেসে এক বেলা খেয়ে দুই বেলা অন্নহীন। সাহায্য ও মানবতার হাত বাড়ানোর বদলে পালাচ্ছে প্রাণের ভয়ে।
অন্যদিকে বাবার অবস্থা অবনতির দিকে। লকডাউনে মানবসভ্যতার ঢাকা শহর মৃত্যু প্রায়। তারপরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একবার রাস্তায় বের হয়েছিল কাজের তালাশে ।কাজ তো বাদ, বরং প্রশাসনের মুগুর পড়লো পিঠ পেচিয়ে।

কোনমতে বাসায় হাজির ।বাড়ি থেকে ফোনে জানতে পারলো বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। শত মাইল দূরে বাবার মৃত্যুরপীড়ায় রাফিন অস্থির। পাশে থাকলে হয়তো কিছুটা কষ্ট লাঘব হতো।
বড় পেরেশানি আর বে-কারারের মধ্যে রাত কাটছে।

ভোর রাতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো ।বুঝতে বাকি রইল না যে সংবাদটা বেদনার।
হ্যালো রাফিন!
তোর ইমারজেন্সি বাড়িতে আসতে হবে !
দেশের এমন লকডাউনে দূরপাল্লার গাড়ি বন্ধ। নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখে মাক্স লাগিয়ে শুরু হলো যাত্রা। ঘাটে ঘাটে পুলিশের জবাবদিহি আর শত বাধা পেরিয়ে এই পথ চলা। একপর্যায়ে ঢাকার বাহির দ্বারে আবদ্ধ রাফিন । পা জোড় আর ক্রন্দনে সিক্ত নয়নযুগল ।বাবার এমন খবর জানালেন মন গলেনি তাদের।

3/
আহ!
নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!
বাবাকে পাশে রেখে চির বিদায় দিতে পারলো না। এখন কি কাফন-দাফন থেকে মাহরুম হবে? বাবার কথা ভাবতেই অন্তরে বিয়োগের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
সকাল গড়িয়ে এখন দুপুর ।সাত ঘণ্টা যাবত একই স্থানে (পরাধীন) সাময়িক আটক। শেষতক পা জড়িয়ে বাবার নামে আবদার তুলল রাফিন ।ওর অপরাধ শুধু এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় স্থানান্তর।
করোনা থেকে বাঁচার আশায় আজ মানুষত্ব প্রায় বিলীন। হারকিসিমের
শর্তজুড়ে অবশেষে এলো মুক্তির পয়গাম ।কিন্তু রাফিন এখনো মানব সভ্যতায় অসহায়ত্ব কিঞ্চিৎ পরিমাণও পরিলক্ষিত করেনি ।
ওর বিপদে আশেপাশের চির চেনা মুখগুলো এভাবে মুখছিটকানো
সারা জীবন কাঁদাবে । করোনার এই মত্ত তান্ডব একদিন বিদায় নিবে- মাগার হেতু ভয়ানক সেই আচারণ আর কুদৃষ্টি সর্বদাই বরিত ললাটে ঝুলতে থাকবে।
রাফিন এখন মৃত্যু বাবার সামনে দাঁড়িনো!

শোকের সাগরে নোনা জলগুলো জমাট বেঁধে ক্ষোভের আকার ধারণ করেছে ।মারা গেছে প্রায় বার ঘণ্টা, এখনও গোসল হয়নি ।এলাকা জুড়ে চলছে গুজব রাফিনের বাবা মজিদ মিয়া নাকি করোনা ভাইরাসে ভাইরাসে মারা গেছে ।

একসময়ের দানবীয় ও সৎ মানুষকে দেখতে পর্যন্ত কেউ আসছে না ।মজিদ মিয়ার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও কেটে যাচ্ছে ছলচাতুরি দেখিয়ে ।
কে গোসল ,কাফন- দাফন ও জানাজার আঞ্জাম দিবে?

অন্যদিকে স্থানীয়দের হুমকি-ধমকিতে জিগার শুকিয়ে চৌচির। হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মজিদ মিয়া শরিরে করোনার কোনো উপসর্গই ছিলনা ।তারপর সমাজের একশ্রেনীর মানুষের এমন বৈষম্য রাফিনকে আধা মরা করে ছেড়েছে।

মহল্লার ছোট মসজিদের ইমাম মজিদ মিয়ার ঘনিষ্ঠ ছিল ।তাই তাকে অবহিত করা দরকার। কিন্তু রফিনকে তো বাড়ি থেকে বের হতে কঠিন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে । চার দেওয়ালে চলছে 144 ধারার লকডাউন।
কোনমতে ইমামকে খবর দিয়ে খুব সতর্কে বাবার গোসল শেষ। এভাবে এক স্তরের পর অন্য স্তরে পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় ভোগ।
গগনপানে হাতজোড় করে জানতে চায় এর ব্যাখ্যা বর্ণনা !
মসজিদের খাটও দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিল এলাকাবাসী।
ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে সব বাড়ির ভিতরে করতে হবে।

4/
রাফিনরাফিন ভেবেছিল জানাজায়
কিছু আত্মীয় ও শুভাকাঙ্খীরা উপস্থিত হবে। কিন্তু এখানেও ভাগ্যের থাবা পর্যবসিত হলো।

কি আর করার মাত্র চার জনকে নিয়ে জানাজা পড়তে হলো।
রাফিনের মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে সভ্য সমাজের এমন মানবতাবিরোধী বিষয়টি ।মানুষ কী এমন হতে পারে?
এমনভাবে ত্বরান্বিত করে দাফন দিয়ে প্রিয় বাবাকে চিরবিদায় জানালো। স্বল্প সময়ে বাবা-মা হারানো আর ইনসানের এমন অনৈতিকতার আচরণে রাফিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
তার বিপদে পাশে দাঁড়ানোর কেউ ছিলনা ।
এই মজিদ মিয়াই কিছুকাল আগে সমাজে মানবতার বীজ বুনিয়েছে।
এলাকাবাসীর মুখে মুখে ছিল মজিদ মিয়ার কৃপার গল্প।

রাতারাতি ভুলে গেলে সব কিচ্ছা কাহিনী। কিন্তু মজিদ মিয়ার তো কোন দোষ নেই।
তারপরও বাবার প্রতি সমাজের এমন কুদৃষ্টি সারা জীবন বেদনা হয়ে থাকবে রাফিনের হৃদয়ে।

ততক্ষণে বাড়ির ছাদে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে লাল বিপদ সংকেত ‘পতাকা’।
টানা চৌদ্দ দিন তাকে পড়ে থাকতে হবে এই আঙ্গিনায় ।গুনিয়ে নিতে হবে দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে।

অথচ পেটের ক্ষুধায় চুপসে যাওয়া রাফিনের খাবার – দাবারের খরচ নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই ।বরং ওকে রেখে দূরত্ব অবলম্বন করাটাই এখন বড় কাজ। এ যেন শোকের মাতামে লবন ছিটানোর নামান্তর।

5/
অনেকে কথা বলতেও সাহস করছে না ।তবে ও জানে ,এই আত্মঘাতী করোনা একদিন বিদায় নিবে ।কিন্তু রাফিন ও মজিদ মিয়ার ব্যাপারে এমন ক্ষুদ্ধ আচরণ বাকী হারাতে পীড়া দিবে।

রাফিনের বুকে কলিজা ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে এই সর্বপ্লাবী ব্যথায়।
অবিশ্বাস্য তোলপাড় মনে হচ্ছিল ‘মহাপ্রলয় ‘হয়ে ঢুকে যাচ্ছে শরীর মস্তিষ্ক জুড়ে। বুকের পাঁজর ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছিল এক অবর্ণনীয় অসহনীয় যন্ত্রণা ।মুহূর্তেই সবকিছু ভেঙেচুরে একাকার করে সমূলে উপরে নিয়ে যাচ্ছে রাফিনকে এক অসীম শূন্যতা ।

সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে যাওয়া করোনার বিদায়ে পৃথিবী একদিন সবুজ বসন্তে সাজবে। কিন্তু রাফিন আর পারবে না প্রিয় বাবাকে আদর যত্নে শেষ বিদায় জানাতে ।
কারণ এখন সে এখন ওপার জগতের অধিবাসী। আর রাফিনকে ভুলানো যাবে কী অসহায়ত্বের মালায় গাঁথা সমাজের মানুষের অস্তিত্ব গিলে অবর্ণনীয় ব্যবহার আর জীবন সংহারী আঘাতে বেচে যাওয়ার গল্প?

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে