নাপুরুষ পর্ব-০৩

0
986

#নাপুরুষ
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



রুপা কাঁদছিলো ঘরের দরজা বন্ধ করে। এই সময় লায়লা বেগম দরজার কাছে এসে দরজায় সামান্য টোকা দিয়ে বলে,’দরজাটা খুলো মা।’
রুপার ইচ্ছে করে না দরজা খুলতে।তার শুধু ইচ্ছে করে দরজা বন্ধ করেই কাঁদতে। কিন্তু দরজা বন্ধ করে থাকলে এটা বেয়াদবি হবে।শত হলেও সে এ বাড়ির নতুন পত্নী।
রুপা ট্রাওয়েল দিয়ে চোখ মুখ ভালো করে মুছলো।নাক টেনে ভালো করে পরিষ্কার করলো। তারপর গিয়ে দরজা খুললো।
দরজা খুলতেই দেখলো লায়লা বেগমের হাতে বাসন কোসন,পানি ভর্তি জগ,গ্লাস।ঘরের ভেতর এনে এইগুলো রাখতে রাখতে লায়লা বেগম বললো,’দুই মা মেয়ে মিলে এখানে খাবো। কেমন!’
রুপা উপর থেকে নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলো।
তারপর ওরা খেতে বসলো। রুপা খেতে পারছে না।গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে যেতে থাকে ভাতের দলা।মুখ ভেঙে কান্না এসে যেতে চায় তার।
লায়লা বেগম সব বুঝতে পারে।সে তখন নিজের খাবার রেখে রুপার প্লেটটা কাছে টেনে নেয়। তারপর ওর প্লেট থেকে ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে ছোট ছোট লোকমা করে রুপার মুখে তুলে দেয়।রুপা প্রথমে খেতে না চায়লেও পরে বাধ্য হয় খেতে।
রুপাকে খাওয়াতে খাওয়াতে লায়লা বেগম বলে,’শাম্মী, অপলার উপর রাগ করছো তুমি তাই না!’
রুপা কিছু বলে না।চুপ হয়ে ঝোল দিয়ে মাখানো ভাত গিলে।
লায়লা বেগম নিজেই আবার বলে।বলে,’আমার বড় মেয়ে আর ছোট মেয়ে দু’টাই পায়ছে তার বাপের ধাঁত। তাদের বাপ রাগী মানুষ।কথার সুন্দর্য নাই।অপলা শাম্মীরও কথার সুন্দর্য নাই।
তবে পৃথুল আর আমার মেজো মেয়ে সুফলা শান্ত শিষ্ঠ। এদের মন কোমল। আচরণ সুন্দর। মাটির মানুষ এরা মা।সুফলাই এখানে এসে বেশি থাকে।অপলা শাম্মী বছরে দুই ঈদে আসে শুধু। এছাড়া আসে না।ওরা কাল চলে যাবে। তোমার শ্বশুর তো আমেরিকা থাকে।সেও মাস খানেক পর চলে যাবে ওখানে। তখন তুমি আমি আর পৃথুল এই বাড়িতে।আর কেউ নাই। তোমার মতো করেই তুমি থাকতে পারবে। তোমার সংসার তুমি নিজেই সাজিয়ে নিতে পারবে। বাঁধা দেয়ায় কেউ থাকবে না।কথা শোনাবারও কেউ থাকবে না। তুমি ওদের প্রতি রাগ করে থেকো না। কেমন!’
রুপার এসব কথায় মন গলছে না। বরং রাগ পাচ্ছে।কেন রাগ পাচ্ছে সে জানে না। তবে সে শাশুড়ির কথায় বললো,’মা আমি কিছু মনে করিনি উনাদের কথায়।তারা আমার বড়।গুরুজন। গুরুজনের কথায় রাগ করতে নাই!’
লায়লা বেগম অপরিসীম খুশি হলো।
সে রুপার মাথায় বা হাতটা বুলিয়ে দিয়ে বললো,’লক্ষ্মী বউমা আমার! আল্লাহ তোমায় সু-সন্তান দান করুন।’
রুপার হাসি পেলো কথাটা শুনে। মনে মনে বললো, নিজের ছেলেটাকেই তো আঁচলে বেঁধে নিজের কাছে রেখে দেন।বউয়ের ছায়াটুকুও মাড়াতে দেন না। সন্তান কী এমনি এমনি আসবে পৃথিবীতে!

শাশুড়ির কথা সত্য ছিল। পরদিন সকালের খাবার খেয়ে অপলা আর শাম্মী বাচ্চা কাচ্চা সমেত বিদায় হলো।যাওয়ার সময় আরো একশোটা কথা শুনিয়ে গেল রুপাকে।উপদেশ দিয়ে গেল কয়েক হাজার।
রুপা ওদের সাথে মিষ্টি মুখ করেই কথা বললো যাওয়ার সময়। ওদের শান্তি কামনা করে জোরে সালামও দিলো। কিন্তু মনে মনে বললো, তোদের মতো দুই ডাইনির কপালে লাথি। অসভ্য ইতর কোথাকার!

বাড়িটা আজ অনেকটাই খালি খালি।পৃথুলের বাবাও বাড়িতে নাই। পাসপোর্ট নিয়ে কী এক ঝামেলা হয়েছে।এই কাজে তিনি ঢাকা গিয়েছেন। থাকবেন ওখানে দু তিনদিন। এখন বাড়িতে রুপা,সুফলা,সুফলার আড়াই বছরের মেয়ে মিম্মি , লায়লা বেগম আর পৃথুল।এ ছাড়া আর কেউ নেই।
রুপা এখন ঘুমোচ্ছে। দুপুর বেলায় তার ঘুমানোর অভ্যাস। এই সুযোগে সুফলা আর তার মা দুজন মিলে পৃথুলকে নিয়ে বসেছে আলাদা একটা ঘরে। সুফলা ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’পৃথুল,তুই নিজেই না রাজি হলে বিয়ের জন্য আর এখন তুই তোর ওয়াইফের কাছেই যাচ্ছিস না এটা কেমন কথা!ও কী ভাবছে বল তো!’
পৃথুল চুপ করে রইলো।কথা বললো না।
ওর মা লায়লা বেগম ওর একটা হাত ধরলো। তারপর অনুনয়ের গলায় বললো,’লক্ষ্মী বাবা আমার এমন করিস না আর!আজ থেকে ওর কাছে কাছে থাকিস কেমন! নয়তো মেয়েটা কষ্ট পাবে। সন্দেহ করবে তোকে!’
পৃথুল এবারও চুপ।
সুফলা এবার ওর মাকে বললো,’পৃথুল ঠিক মতো অষুধ খাচ্ছে তো মা?’
লায়লা বেগম বললেন,’কী জানি!ওই বড় দুইটা বোতলের অর্ধেকটাও এখনও শেষ হয়নি!’
সুফলা রাগ দেখিয়ে বললো,’তুমি জানো না ও আলসেমি করে? খেতে চায় না নিজ থেকে।তোমারে না বললাম নিজে এসে খাইয়ে দিতে সময় মতো।কী করো তুমি? সারাদিন অত কী কাজ তোমার যে ছেলে অষুধ খেলো কি না এই খবরটা পর্যন্ত রাখতে পারো না!’
লায়লা বেগম কথা বললো না।চুপ করে রইলো।
এবার সুফলা তার মাকে বললো,’ওই টাউটের বাচ্চারে একটা ফোন দেও!’
লায়লা বেগম চমকালো খানিক।
‘টাউটের বাচ্চা মানে?’
‘ওই যে তোমার বুজরুক পীর।ইকরামুদ্দিন পাগল না ছাগল নাম যে। ফোন দিয়ে হারামজাদারে বলো অষুধে তো কোন কাজ হচ্ছে না।আর বিয়ে করিয়েও কোন লাভ হলো না।টাকা যে পঁচিশ হাজার নিলো এই টাকাটা যেন এমনি এমনি দিয়ে যায়। নয়তো বদমাশটার কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’
সুফলা রাগে কথাগুলো বললো ‌।
লায়লা বেগম ভার স্থির কন্ঠে বললো,’ধর্মে কর্মে একটুও মন নাই।খোদার ভয় নাই মনে তোর! একজন কামেল মানুষরে এইসব কেউ বলে? এইভাবে গালি দেয়!’
সুফলা হাসে।বলে,’তোমার এই পীর সাব যদি কামেল হয় তাইলে ফিরাউনও কামেল ছিল।’
কথাটা বলে শব্দ করে হাসে সে।
লায়লা বেগম খুব কষ্ট পায় মনে মনে।সে ভাবে, তার একটা মেয়েও মানুষ হলো না। একটা ছেলেই ছিল তার। এই ছেলে মানুষ হলেও পুরুষ হলো না!কান্না এসে যায় লায়লা বেগমের।নাকের শেষ ভাগ লাল হয়ে উঠে। তবুও সে কাঁদে না। এমন অযোগ্য সন্তানের সামনে সে অসহায়ের মতো কাঁদতে চায় না।
.
রুপার কাছে ওর মা ফোন করেছিল।রুপা ফোন রিসিভ করলো না।কেন রিসিভ করবে সে ফোন! এই পৃথিবীতে তার কোন পিতা মাতা নেই।সে চির এতীম। চির অনাথ।
দু’দিন তিন দিন চলে গেল এ বাড়িতে। রুপার আর ভালো লাগছে না।ওর শাশুড়ি ওর সাথে সত্যি সত্যিই ভালো আচরণ করছে।সুফলাও ওকে সময় দিচ্ছে। সারাদিন ওর সাথে বসে বসে গল্প করেছে। তবুও রুপার ভালো লাগে না। এই চার পাঁচদিনে তার ঘরেই আসেনি পৃথুল।রুপার সন্দেহটা আরো বাড়ে।সে মুখ ফুটে এখানে কাউকে কিছু বলতেও পারে না কিছু।কার কাছে বলবে!
বিয়ের চতুর্থ দিন চলে যাওয়ার পর রাতে তার কাছে আসে তার শাশুড়ি।বলে,’কাল তোমায় নিয়ে তোমার বাবার বাড়িতে যাবো।পৃথুলও যাবে সাথে।’
রুপা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে। ভাবে ওখানে গেলেই সুযোগ হবে। শাশুড়ি গিয়ে তো আর ওখানে নিজের বাড়ির মতো ছেলেকে কোলে করে নিয়ে বসে থাকতে পারবে না।পৃথুল ওখানে গেলে সে পৃথুলকে নিজের কাছে নিবে।একান্তে কথা বলবে ওর সাথে। আসলে ওর কী সমস্যা তা জেনে ফেলতে পারবে তখন রুপা!
কিন্তু ওর শাশুড়ি এরপর আরেকটি কথাও বলে। সেই কথাটি রুপার মন ভেঙ্গে খানখান করে দেয়।ওর শাশুড়ি বলে—–

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে