নাপুরুষ পর্ব-০৯

0
941

#নাপুরুষ
#৯ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



লায়লা বেগম আজ খুব আনন্দিত। তার মুখ হাসি হাসি।সে জানে আজ তার চরম শত্রু বধ হবে!সে মুক্তি পাবে বিষাক্ত এক কালনাগিনীর হাত থেকে। তার কথা হলো, এই ছেলে যখন তাদের সামনে আসবে। আর ওসব কথা বলবে রুপাকে নিয়ে। তখন সে রুপার দু গালে দুটো চড় বসিয়ে দিবে। তারপর ওর মুখের উপর এক দলা থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বলবে,দূর হয়ে যা কাল নাগিনী।দূর হয়ে যা।দূরে গিয়ে নিজের মায়ের মাথা খা!

ওরা ঘর থেকে বেরিয়েছে।বারান্দার নামায় পার্কিং করে রাখা গাড়ির দিকে রুপা এগিয়ে যেতেই লায়লা বললো,’গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না মা।ড্রাইভার ছুটিতে আছে। ওর স্ত্রীর অসুখ।সে তার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে আছে।’
রুপা স্বাভাবিক ভাবেই বললো,’তাহলে কীভাবে যাবেন মা?’
‘রিক্সা করে। সমস্যা হবে তোমার?’
রুপা আনন্দ মাখা গলায় বললো,’না মা।একদম না।আমার রিক্সায় চড়তে খুব ভালো লাগে!’
লায়লা বেগম মৃদু হাসলো।আর মনে মনে বললো, আজকেই তোরে রিক্সায় জীবনের শেষ চড়ানোটা চড়াবো!
বাসার মেইন গেট পেরিয়ে সরু রাস্তা। এই রাস্তায় তেমন একটা রিক্সা পাওয়া যায় না। এই এলাকাটা ধনী মানুষের এলাকা। এই এলাকায় গরীবদের বসবাস নেই বললেই চলে।তাই কেউ আর রিক্সা ভ্যান কিংবা অটোতে চড়ে না। সবার নিজস্ব গাড়ি আছে।গাড়ি না থাকলে অন্তত মোটর বাইক হলেও আছে।
ওরা হাঁটছে।রুপা ভীষণ উৎফুল্ল।তার বড় ভালো লাগছে হাঁটতে।
লায়লা বেগম ওকে জিজ্ঞেস করলো,’কোনদিক দিয়ে যাবা?মদিনা মসজিদের সামনের রোড দিয়ে না মৃন্ময়ী পার্কের সামনে দিয়ে?’
রুপা বললো,’রিক্সা দিয়ে গেলে মৃন্ময়ী পার্কের সামনে দিয়ে যাওয়া ভালো। এদিকে খুব একটা বড় গাড়ি চলে না। ঝামেলা কম। রিক্সা দিয়ে সহজেই যাওয়া যাবে!’
লায়লা মনে মনে আবার বললো,ফকিরনীর ঝি তো এই জন্যই এইসব খুব ভালো বোঝে!রিক্সারে ভাবে হেলিকপ্টার! কোন রোডে গেলে আয় কেমন,ভাড়া কত বাঁচে সব বোঝে!
যাও। আজকে যাও।নষ্টামির স্বাদ তোমার মিটাবো!
মনে মনে নিজেই কথাগুলো আওড়িয়ে নিজেকেই শুনাতে লাগলো।এতেও আনন্দ আছে।সে আনন্দ উপভোগ করছে।

বড় রাস্তার কাছে এসে লায়লা বেগম রিক্সা ডাকলো।রিক্সা এলে চড়ে বসে বললো,’চলো।মৃন্ময়ী পার্কের সামনের রোড দিয়ে দেবনাথপুর যাবে।’
রিক্সাওয়ালা হেসে বললো,’জ্বে খালাম্মা।’
এর মাঝে কথা বলে উঠলো রুপা।সে তার শাশুড়িকে বললো,’মা ভাড়াটা ঠিক করে নিলে ভালো হতো।ভাড়া ঠিক না করে গেলে ওরা যা ইচ্ছে তাই চেয়ে বসে। অনেক সময় এমন হয় যে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে ডাবল চেয়ে বসে!’
লায়লা বেগমের এমন রাগ উঠলো! মনে মনে সে বললো,সব বিষয়েই ফকিরনীর ব্যবহারটা না দেখালে চলে না!
কিন্তু মুখ ফুটে বললো অন্য কথা।বললো,’বেশি চাইবে না মা।আর চাইলেই তো আমি দিয়ে দিবো না!’
রিক্সাওয়ালা ওদের শাশুড়ি পুত্রবধূর কথোপকথন শোনে হেসে বললো,’আফা,যা ভাড়া এরচে এক পয়সাও বেশি নিমো না।খাজা পীরের কীড়া!’
লায়লার রিক্সাওয়ালাকে পছন্দ হলো খুব।সেও খাজা পীরের ভক্ত। স্বামীকে না বলে একবার লুকিয়ে চুরিয়ে তার ছোট ভাই আমজাদকে নিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিল সে।খাজা পীরের মাজারে। উদ্দেশ্য ছিল পৃথুলের জন্য দোয়া করে আসা।পৃথুলের সমস্যাটা যেন দূর হয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস।মৃত খাজা পীর তার দোয়া শুনলো না। তবুও সে খুশি।খাজা পীরের মাজার জিয়ারত খামখেয়ালি বিষয় নয়।তাই রিক্সাওয়ালার এমন খাজাভক্তি তাকে মোহিত করে।সে মনে মনে ঠিক করে রিক্সা থেকে নেমে সে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়ার সাথে এক হাজার টাকা বকশিস দিবে।ওই বকশিশটা খাজা পীরের নামের বদৌলতে!

রিক্সা ছুটছে। ধীরে ধীরে। লায়লা বেগম ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে সময় দেখলো।একটা দশ।সে খুব খুশি। সবকিছুই সময়ানুযায়ী হচ্ছে।সে যেভাবে চেয়েছে ঠিক সেভাবেই। এখান থেকে মৃন্ময়ী পার্কের সামনে যেতে পনেরো বিশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।আরেকটু অপেক্ষা। শুধু আরেকটু সময়। এরপরই সেই আকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে।সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে আসতে তার আর তড় সয়ছে না।ভেতরটা কাঁপছে। নিঃশ্বাস গরম হয়ে আসছে!
সে তার পরিকল্পনার কথাগুলো মনে করতে লাগলো। আগে ভাগেই তারা একটা মৌখিক স্ক্রিপ্ট করে নিয়েছে।স্ক্রিপ্টটা সাজিয়েছে মিম্মির বাবা। অবশ্য এই স্ক্রিপ্ট মুখস্থ লায়লার।
স্ক্রিপ্টের থিমটা হলো-

ছেলেটা আসবে।এসেই বলবে,রিক্সা থামাও মামা।
রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামাবে।
তারপর ছেলেটা লায়লা বেগমকে সালাম দিবে। জিজ্ঞেস করবে,আন্টি, এই মেয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কী?
লায়লা বেগম বলবে,’তুমি কে? তোমার পরিচয় কী? তোমার কাছে এসব বলবো কেন?
ছেলেটা তখন হাসবে।জোর গলায়। তারপর সে বলবে,আন্টি,কী আর বলবো। দুঃখের কথা। আপনার পুত্রবধূ আমার পুরাতন প্রেমিকা। শুধু যে প্রেমিকা ছিলো তাই না।ওর সাথে আমার গোপনে বৈবাহিক সম্পর্কও ছিল।যদিও কাজী অফিসের কোন ডকুমেন্ট নাই। তবে আমার সাক্ষী আছে। মসজিদের এক ইমাম সাব বিয়া পড়াইছিলো! কিন্তু ভাগ্য আমার এতোই খারাপ যে রুপা আমারে ছেকা দিলো।আমারে রাইখা আপনার বড়লোক পুত্ররে বিয়ে করলো।আমারে তালাক পর্যন্ত দিলো না।আপনেই কন আন্টি।স্বামীরে তালাক না দিয়ে নতুন সংসার করার বিধান ধর্মে কিংবা বাঙাল সমাজে আছে কি না?
লায়লা বেগম এসব শুনে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওই ছেলেটার গালে দুই দুইটা শক্ত চড় বসিয়ে দিবে। ছেলে চড় খেয়ে বলবে,মারছেন আন্টি আরো মারেন। আপনি আমার মায়ের মতোন।মা তার সন্তানরে মারলে দোষ হয় না। কিন্তু আমি আপনার ভালো চাই। আমার কথা বিশ্বাস করেন। আপনি এই বেঈমান মেয়েরে বিশ্বাস কইরেন না!
লায়লা বেগম তখন রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলবে,এই বেয়াদবের বাচ্চা, আমার পুত্রবধূর নামে যা তা বলছিস। পুলিশ ডাকবো নাকি রে!
ওই ছেলেটি তখন বলবে ডাকুন।ডাকলে আমার লাভ।বউ সাথে নিয়ে একেবারে ঘরে যাবো।
লায়লা তখন বলবে, খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু!
ছেলেটি তখন তার মোবাইল ফোন বের করবে। তারপর ম্যাসেজ দেখাবে।ওই যে সুফলা রুপার ফোন থেকে ম্যাসেজটি করেছিল সেই ম্যাসেজ।ম্যাসেজ দেখিয়ে যে নম্বর থেকে ম্যাসেজ গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে ওই নম্বরে ফোন দিবে। ফোন নিশ্চয় তখন রুপার ব্যাগে থাকবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠবে।
এরপর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে লায়লার কাছে। স্বাভাবিক ভাবেই তখন লায়লা রুপার দু গালে দুটো করে চড় বসিয়ে দিবে। তারপর নাকে মুখে থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বলবে,যা।তোর আসল জামাইর সঙ্গে যা।বেশ্যা মেয়ে। অসভ্য কোথাকার! ছিঃ!তোর জন্য জাহান্নাম অপেক্ষা করছে।তুই জাহান্নামের আগুনে পোড়ে মরবি!
এই কাজের জন্য অবশ্য ওই ছেলেকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে।এটাই চুক্তি। লায়লা বেগমের কাছে এই দশ হাজার টাকা পান্তাভাত। বিদেশ বাড়িতে স্বামী থাকে এই অজুহাতে স্বামীর কাছ থেকে সে মাসে মাসে পঁচিশ হাজার টাকা করে জরিমানা নেয়। এই জরিমানা নেয়ার কারণ সে স্বামীর সোহাগ থেকে বঞ্ছিত। কিন্তু এবার সে ভয় পেয়েছে। খুব ভয় পেয়েছে।ভয় পাওয়ার কারণ হলো সে ভেবেছে, টাকার কুমিরটা বুঝি এবার ওর হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে!টাকার কুমিরটা এবার হয়ে যাচ্ছে রুপার। ওই অল্প বয়স্ক মাগীটার! ওই বেশ্যাটা তার নতুন যৌবনের রুপ দেখিয়ে তার স্বামীকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।ওই বেশ্যাটার উপর লানত পড়ুক!
লায়লা বেগম হাসলো। লুকিয়ে লুকিয়ে।মৃন্ময়ী পার্ক দেখা যায়। আরেকটু পরেই পার্কের গেইট। এক্ষুনি ঘটনা টা ঘটে যাবে।তার হাতেই মোবাইল ছিল। এখন ঠিক একটা আটাশ মিনিট বাজে।

রিক্সা পার্ক ছেড়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু ঘটনা ঘটছে না। কোন ছেলেই এসে বলছে না মামা রিক্সা থামাও।
লায়লা বেগমের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।রিক্সা প্রায় পার্ক ছেড়ে গেলো গেলো। তখন লায়লা বেগমই মুখ বিকৃত করে বললো,’এই ড্রাইভার রিক্সা থামাও!’
তারপর কঁকিয়ে উঠলো। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
রিক্সা থামলো।রুপা চমকে উঠে বললো,’মা কী হয়েছে আপনার?’
লায়লা বেগম মুখ বিকৃত করে রেখেই বললো,’পেটটা খুব ব্যথা করছে।রিক্সাটা থেমে থাকুক।চললে ঝাঁকুনিতে মনে হয় পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যাবে!’
সে ভাবলো এখানে অপেক্ষা করবে। ছেলেটার এখানে আসতে হয়তোবা কোন কারণে দেরি হচ্ছে।
আর তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ে ওদের।
মৃন্ময়ী পার্কের গেটের সামনে একটা ছেলেকে বেদরক মারপিট করছে মানুষ।যে যেভাবে পারে সেভাবেই মারছে।
লায়লা বেগমের খুব জানতে ইচ্ছে হলো কেন মারছে। ইচ্ছে হলো রুপারও জানার।
রিক্সাওয়ালা বললো,’খালা,দেইখা আসি গিয়া ঘটনা কী!’
বলেই সে দৌড়ে গেল। এবং প্রায় দশ মিনিট পর যখন পুলিশ এসে গেল।আর পুলিশ এসে ছেলেটাকে এরেস্ট করে নিয়ে গেল সাথে করে তখন ফিরে এলো রিক্সাওয়ালা।সে সব জেনে এসেছে।
লায়লা বেগম জিজ্ঞেস করলো,’ঘটনা কী?’
রিক্সাওয়ালা বললো,’মা তার মেয়েরে নিয়া রিক্সা কইরা মার্কেটে যাইতেছে। তখন পার্কের সামনে আইসা এক ছেলে রিক্সা থামাইতে কইলো।রিক্সা থামাইলে সেই ছেলে নাকি দাবি করছে মার সাথে রিক্সায় বসে থাকা মেয়েডা হের বউ।গোপন বউ। এরপর মোবাইল দিয়া কী নাকি দেখাইছে। কিন্তু এইডা ভুল। এই মেয়ের এই রম কোন নম্বর নাই।তহনই মাইর।মেয়ের মা গলা ছাইড়া ডাকলো,আমার মেয়েরে বাঁচান। মানুষ আইসা কোন কথাবার্তা ছাড়াই ছেলেরে জীবনের শেষ মাইরটাই মারলো। এরপর পুলিশ আসলো।আইসা অপহরণের চেষ্টা মামলায় এরেস্ট দেখাইলো।শুনছি মানিজ্জত মারার মামলাও দিবো! এই হইলো ঘটনা খালা!’
কথাগুলো শুনে লায়লা বেগমের পেট ব্যথা কমে প্রশ্রাবের বেগ হলো। মনে হচ্ছে এবার কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে! এমন হয়েছে ভয়ে।ব্যর্থতায়।সে ততোক্ষণে বোঝে গেছে ওই ছেলে রং নম্বর ডায়েল করেছে। শিকার চিনতে ভুল করে এবার নিজেই শিকার হয়ে গেছে।
সে যায়হোক।ওই কম জাতের বাচ্চা জাহান্নামে যাক।এতে তার কিছুই যায় আসে না। সমস্যা হলো এই বদ মেয়েটা বেঁচে গেছে এটাই। ওকে কীভাবে যে তার বাড়ি থেকে সরাবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না সে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে