নাপুরুষ পর্ব-০২

0
2216

#নাপুরুষ
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক


খাবার গরম করার কথা বলে রুপাকে কিচেনে নিয়ে যায় তার শাশুড়ি লায়লা বেগম। তারপর হাঁড়ি-পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখে।হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁত দিয়ে পান খেয়ে লাল করে রাখা জিভে কামড় দিয়ে বলে,’মাগো! সন্ধ্যা রাতে তো পোলাও ছিল।পোলাও তো এখন কেউ খাবে না। তাছাড়া গরমে পোলাওটা নষ্ট হওয়ার পথে।এক কাজ করো।চার পট চাল জ্বাল দিয়ে ফেলো।দশ মিনিটে ভাত হয়ে যাবে।আর ওই যে তরকারি আর ডালের পাতিল। ওগুলো গরম করে ফেলো।আমি আসছি কেমন।মাথাটা কী যে করছে!’
কথাটা বলে সামান্য কঁকিয়ে উঠলো লায়লা। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে গেল কিচেন থেকে।
শাশুড়ি চলে গেলে রুপা ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এবং খানিক শব্দ করেই বললো,’বজ্জাত মহিলা।’

রুপা আগে তরকারি আর ডালটা গরম করে নিয়েছে। তারপর ভাতের হাঁড়ি টা চুলোর উপর বসিয়ে দিয়ে ঘরে গেলো।ভাবলো এই সুযোগে ফ্রেস হয়ে নিবে।রাতে তো বিয়ের সাজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় ওদের সামনে যাবে কী করে!
ঘরে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে নতুন এক সেট কাপড় বের করে ট্রাওয়েলটা কাঁধে চেপে বাথরুমে ঢুকে পড়লো। বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হয়ে এসে খাটের উপর বসলো।চুলোর উপর যে সে ভাত বসিয়ে রেখে এসেছে এই কথা একেবারেই খেয়াল নাই বেচারির।ওর এখন মনে পড়ছে মার কথা।সে ফোনের স্ক্রীনে তাকালো বার কয়েক।ভাবলো মাকে একটা কল দিবে। কিন্তু দিতে গিয়েও সে কল দিলো না। তার খুব অভিমান হলো মার প্রতি।মার তো উচিৎ ছিল এই সময় তাকে একটা ফোন দেয়া। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা,কী রে সেহেরি খেতে উঠেছিস তোরা?কী রান্না করেছে তোর শাশুড়ি? ওখানে কেমন লাগছে রে তোর?মন খারাপ করিস না মা। দু’দিন পর তো জামাই তোকে নিয়ে আসবেই!
না তার মা এমন কিছু করলো না। ফোন দিলো না।
রুপার এখন এমন খারাপ লাগছে!তার মন বলছে এক্ষুনি দেশান্তর হয়ে যেতে।সে মনে মনে খুব অভিমান করে বলছে,এ জগতে আমার কেউ নাই।মা নাই বাবা নাই।কেউই নাই!
এসব ভাবতে ভাবতেই তার চোখে জল এলো।নাকে নেমে এলো স্বর্দি।সে নাক টেনে যেই না চোখ দুটো বা হাতের পিঠ দিয়ে মুছতে যাবে ঠিক তখন চেঁচামেচি শোনা গেল কিচেনের কাছে।গলাটা লায়লা বেগমের।
লায়লা বেগম চিৎকার করে বলছে,’পোইড়া গেছে সব পোইড়া ফেলাইছে।পোইড়া পোইড়া ছাই কইরা হয়ে গেছে!’
রুপার কানে কথাগুলো যেতেই তার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো।কী সর্বনাশের কথা!অনেক্ষণ আগেই তো সে চুলোতে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে রেখে এসেছে। এতোক্ষণে বোধহয় হাঁড়ি পোড়ে গিয়ে ঘরে আগুন ধরে গেছে।তার শাশুড়ি মা তো এটাই বলছে।ছাই হয়ে গেছে সব।পুড়ে গেছে সব।
রুপার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।সে বুঝতে পারছে না কীভাবে ওখানে যাবে! ওখানে গেলে শাশুড়ি তার সাথে কী রকম আচরণ করবে সে তাও জানে না। তবে তার সাথে যে ভালো আচরণ করবে না এটা সে জানে!
ওখানে এখন অনেক মানুষের গলা। রুপা ভয় পাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে সে দরজা খুলে কিচেনের সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলো ওরা কেউই এখানে নাই। ওদের গলার আওয়াজ অন্য কোন ঘর থেকে আসছে। এখানে শুধুমাত্র তার শাশুড়ি। ভেতরে নুইয়ে থেকে পাতিল থেকে গামলায় ভাত বাড়ছে। রুপা খেয়াল করলো।কিছুই পোড়েনি মনে হচ্ছে শুধু শুধু মহিলা চিৎকার করেছে। এই মহিলার স্বভাবটা এমন বদ কেন?রুপা বুঝতে পারছে না।
সে প্রায় রক্তশূন্য মুখে শাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,’মা, আমার ভুল হয়ে গেছে!’
লায়লা বেগম হাসি হাসি মুখে বললেন,’সমস্যা নাই মা। আমারই ভুল। তুমি নতুন মানুষ।জীবনে কাম কাজ করে অভ্যাস নাই। নতুন বেলা এই রকম হয়ই।এটা কোন বিষয় না।এক কাজ করো।হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে গিয়ে বসে পড়ো।আমি ভাত নিয়ে আসতেছি!’
রুপা তবুও দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে ‌। একা একা সে গিয়ে কোন ঘরের কোন টেবিলে বসবে?সে এ বাড়িতে শুধুমাত্র তার ঘর আর ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমটা চিনে।আর এখন চিনলো রান্না ঘরটা। নতুন করে চিনলো শাশুড়িকেও। এই মহিলাকে সে যতোটা চালাক ভেবেছিল এখন মনে হচ্ছে এরচেয়ে শতগুণ বেশি চালাক মহিলা। এই মহিলা ওকে নিজের বশে নেয়ার জন্য ওর মন গলানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু রুপাও সহজ না।সে অত সহজে গলবে না!
গামলায় ভাত নিয়ে ওর শাশুড়ি কিচেন থেকে বের হতে গিয়ে দেখে এখনও কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। লায়লা বেগম রুপাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই হাসলো। হেসে বললো,’তুমি এখনও যাওনি। ভালোই হলো। তুমি দেখি আমার শাশুড়ি মার মতো। আমি যখন রান্না ঘরে রান্না করতাম তখন তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন কেন জানো?’
রুপার মন চাচ্ছে না কেন বলতে। তবুও সে ভদ্রতা বজায় রাখতে বললো,’কেন?’
ওর শাশুড়ি হেসে বললো,’আমারে সাহায্য করতে। খুব নেক মহিলা ছিলেন আমার শাশুড়ি।আল্লাহ উনারে জান্নাত বাসী করুন। আমার শাশুড়ি সব সময় একটা কথা বলতেন।’একজনে লইলে কাম প্যাচের উপরে প্যাচ, ছোওনের আগেই দুইয়ের কাম আধাআধি শেষ!’
যায়হোক, এখন এইসব কথার সময় না।পরে তোমার সাথে আমার শাশুড়ির বিষয়ে গল্প করবো। এখন এক কাজ করো মা।ওই দেখো ডাল আর তরকারিটা বেড়ে রেখেছি। তুমি দুই হাতে দুইটা বাটি ধরে নিয়ে আসো।দুই শাশুড়ি বউমা মিলে আজকে মেহমানদারি করি।কী বলো!’
রুপা কিছু বললো না।আদব দেখানোর সুরত নিয়ে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি জড়িয়ে সে কিচেনে গেল এবং ডাল আর তরকারি ভর্তি বাটি দুটো দু হাতে ধরে নিয়ে ফিরে এলো।

রুপা ওর শাশুড়ির সাথে গিয়ে ও ঘরে দেখে, টেবিলের চারপাশে রাখা ছয়টি চেয়ার পরিপূর্ণ ।তার বসার আর কোন জায়গা নাই ‌।
রুপার কেমন লজ্জা লাগছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। টেবিলে পৃথুলও বসেছে। কিন্তু ও মাথা নিচু করে রেখেছে।যেন আপন মনে কী ভাবছে!
রুপার এবার সত্যি সত্যি খারাপ লাগছে।সে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কেউ বলছে না বসতে। ইচ্ছে করলে পৃথুলের বোনদের কেউ চেয়ার ছেড়ে উঠে এ বাড়ির নতুন বউটিকে বলতে পারে চেয়ারে বসতে। কিন্তু কেউ এটা করলো না। এমনকি পৃথুলের বাবাও না। ওর বাবাকে বরং দেখা যাচ্ছে মুখ ভার করে বসে আছে।যেন রুপাকে দেখে তার রাগ লাগছে।
রুপা তখনও ওদের থেকে খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে থেকে দু হাতের আঙুল নিয়ে খেলছে। এছাড়া আর কী করবে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে!
হঠাৎ সে শুনতে পেলো তার শাশুড়ির গলা। শাশুড়ি মা তখন ওদের পাতে ভাত সালুন তোলে দিচ্ছে।
লায়লা বেগম রুপাকে বললো,’মা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বোধহয় তোমার খারাপ লাগছে।ওরা খেয়ে নিক আগে। তারপর আমরা মা মেয়ে মিলে দুজন একসাথে খাবো। এখন তুমি তোমার ঘরে গিয়ে রেস্ট নেও।আমি তোমাকে ডেকে নিয়ে আসবো ওদের খাওয়া হলে।’
রুপা নিচু স্বরে বললো,’জ্বি আচ্ছা।’
তারপর সে ধীর পায়ে হেঁটে যেই না দরজাটা পাড় হবে ঠিক তখন পেছন থেকে ডেকে উঠলো পৃথুলের তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে বোন অপলা নাম সে।রুপা পেছন ফিরে তাকাতেই ও বললো,’তুমি জানি কোন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছো?’
রুপা বললো,’এস এস সি পাশ করেছি।’
অপলার মুখ কালচে হয়ে গেল।সে বড় আফশোসের গলায় বললো,’তোমার থেকে এরচেয়ে বেশিই বা কী আশা করবো বলো!’
রুপা বুঝতে পারেনি কিছুই।ওর কী ভুল হলো আবার এখানে? নাকি ভাত সামান্য পোড়ে গেছে বলে এসব বলছে!
রুপাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পৃথুলের ছোট বোন শাম্মী (বোনদের মাঝে সবার ছোট হলেও পৃথুলের বড় ও)বললো,’যাও ঘরে যাও। আরেকবার থেকে বাবার সামনে এলে সালাম দিয়ে আসবে।যাবার সময়ও সালাম দিয়ে যাবে।’
রুপা অতি কষ্টে উপর থেকে নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে ও ঘরের দরজা ছেড়ে চলে এলো নিজের ঘরে। তারপর ভেতরে এসে কোনমতে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে উপোড় হয়ে পড়ে গেল বিছানায়।তার ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছে।সে বালিশে মুখ চেপে ধরে ইচ্ছে মতো কাঁদছে। কাঁদার সময় একেকবার মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে যদি মরে যাওয়া যেতো! কিন্তু কী দূর্ভাগ্য। কাঁদতে কাঁদতে কেউ মরতে পারে না কখনো!
রুপা কাঁদতে কাঁদতে ভাবছে ওর কী এমন ভুল ছিলো যে ওকে সবার সামনে এভাবে অপমান করতে হলো! সালাম দেয়নি ভুলে অথবা বিষয়টা ওর মাথায় ছিল না এটা তো পরবর্তীতে আঁড়ালে ডেকেও সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা যেতো। কিন্তু এভাবে দু বোন মিলে তাকে অপমান করতে হয়।আর ওই হদারামটা নিচ দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সব গিলেছে।যেন খাওয়াটাই এখন তার একমাত্র কাজ।আর ওদিকে ঘরে যে একটা বউ এসেছে। সেই বউ তার নিজের। এদিকে তার কোন খেয়ালই নেই।বোকাও তো এসব পরখ করে সবকিছু বোঝে ফেলবে। রুপা তো আর বোকাসোকা মেয়ে না।সে ধারণা করেই নিলো,পৃথুলের হয়তোবা অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে।আর তার মা জোর করে তাকে বিয়ে করিয়েছে বলে সে এমন করছে। আর এটা না হলে সে সমকামী। সমকামীদের বিষয়ে শুনেছে সে তার ফুপাতো বোন মিতু আপুর কাছে। মিতু আপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে। মিতু আপু সে সহ তার সব কাজিনদের কাছে এক বিকেলে ওই বিষয়ে গল্প করছিলো।মিতু আপু বলছিলো, তার নাকি এক ছেলে বন্ধু আছে। রোহান নাম।ওই ছেলে বন্ধুটি সমকামী।
রুপা জীবনে প্রথম এই শব্দ শুনেছে।তাই সে জিজ্ঞেস করে ফেললো তখন।
সমকামী মানে কী আপু?
মিতু আপু ওকে বুঝিয়ে বললো বিষয়টা।বললো, পৃথিবীতে এমন কিছু ছেলে আছে যাদের মেয়েদের প্রতি কোন অনুভূতি নেই। ছেলেদের প্রতিই ওদের অনুভূতি, ওদের এট্রাকশান। পশ্চিমা কান্ট্রিগুলোতে ছেলেরা ছেলেদের বিয়ে করছে। এদের বলে গে।আর মেয়েরাও মেয়েদের বিয়ে করছে। মেয়েদের সাথে মেয়েরা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এদেরকে বলে লেসবিয়ান।
ওই কথাগুলো শুনে রুপা সেদিন ভেবেছিল এও কী সম্ভব? এমন হয় কী করে?
কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তার বরটা এমনই। সমকামী।
এছাড়া আর কী হবে!
নয়তো ওর কাছে এলো না কেন?
পৃথিবীতে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি মনে হয়। শুধু তার বেলায়ই কেন এমনটা ঘটলো!
রুপা কান্নারত অবস্থায়ই গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না
এখন সে কী করবে? কীভাবে বাকীটা জীবন ওর সাথে কাটাবে? রুপা কিছুই বুঝতে পারে না।
ওর কান্না আরো বাড়ে।মার প্রতি অভিমান হয়। মাকে আর এখন তার নিজের আপন মা বলে মনে হয় না। মনে হয় দূরের কেউ।সৎ মায়ের চেয়েও পাষাণ কেউ। যে ধনী আর বংশধর শশুরবাড়ি দেখেই বিয়ে দিয়ে দিলো নিজের সন্তানকে। একটাবার খোঁজ নিয়ে দেখলো না পর্যন্ত বিয়ের আগে এই ছেলের কোন সমস্যা আছে কি না। সমস্যা না থাকলে অত ধনী পরিবার তাদের মতো সামান্য পরিবার থেকে বিয়ে নিবে কেন? তাছাড়া ছেলেও অত সুন্দর। আমেরিকায় পড়াশোনা করেছে। এই ছেলে তাকে না দেখে তার সাথে কথা না বলে কীভাবে রাজি হয়ে গেল বিয়েতে।এসব আগে ভাগে রুপা ভেবেছিল ঠিক।মাকেও একটু আধটু বলেছিল ভয়ে ভয়ে। তখন তো মা তাকে রাগভরা মুখে ভয়ংকর নোংরা কথাটি বলেছিল। বলেছিল।’এমন করছিস যে তুই!কেন?কী সমস্যা তোর? তবে কী ধরে নিবো তোর পছন্দের অন্য কোন ছেলে আছে?’
রুপা মার এক কথায়ই স্তব্দ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মার বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ করা উচিৎ ছিল।এটা না করে সে ভুল করেছে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে