দুই পথের পথিক পর্ব-১১+১২

0
118

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১১
#বর্ষা
নৌশিনের প্রতি কুহেলিকার ক্ষিপ্রতার কথা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাড়িতে।নটাংকিতে নটাংকি করে বাড়ি মাথায় তুলেছে।অর্ধেক কথাই বলেছে। আদরের দুলালীকে মারায় রোশান শেখ ক্ষেপেছেন।কাউকে না জানিয়েই পুলিশে খবর দিয়েছেন।

পুলিশ আসতে না আসতেই বাড়ি মাথায় তুলেছে পুরো পরিবার। জুনায়েদ ক্ষেপেছে রোশান শেখের ওপর।তবে পুলিশের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।একেতো লাশ দ্রুত দাফন নিয়ে ঝামেলা করছে পুলিশ।তার ওপর আবার কুহেলিকা নাকি আগের থেকে জিডি করেই রেখেছে।রোশান শেখ তবুও দমে যাওয়ার মানুষ না।যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলে ওঠেন,

—স্যার স্যার দেখুন এই মেয়ে যদি খুন নাই করতো তাহলে জিডি কেন করলো?সে কিভাবেই বা জানলো আমরা তাকে আরোপী ভাববো!পয়েন্ট আছে না বলুন বলুন।

—আদৌ আপনি বুঝতে পারছেন তো আপনি কি বলছেন?

ইন্সপেক্টর আতিউরের কথায় রোশান শেখ হিসাব মিলাতে শুরু করেন।না, কিছু তো ভুল বলেছেন বলে মনে হচ্ছে না।আবারো ইন্সপেক্টরের দিকে তাকান। এবার ইন্সপেক্টর আতিউর ওনাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যায় জুনায়েদের কাছে।বলে ওঠেন,

—মিষ্টার জুনায়েদ শহরে আপনার ভালোই নামডাক আছে।কোনো দূরাত্মীয়ের কবলে পড়ে যেন তা হারাতে না হয় খেয়াল রাখুন।

ইন্সপেক্টর আতিউরকে নিয়ে জুনায়েদ বাইরের দিকে যেতে যেতে কথা বলে।বার দুয়েক ধমকে ওঠেন আতিউর।রাগ দেখিয়ে কনস্টেবলদের নিয়ে চলে যান।তবে যাওয়ার পূর্বে জুনায়েদের ঘোর বিপদের সংকেতও দিয়ে যান।যেন তিনি সবই জানেন তবে তা কাউকে জানাতে পারবেন না।

****

ভোরবেলা কুহেলিকা ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।ফোনটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে তীক্ষ্ণ চোখে।ফোনটা বেজে ওঠে।নাহিন ফোন করেছে।কুহেলিকা কল রিসিভ করতেই নাহিন বলে ওঠে,

—কুহু আমার ভিসা হচ্ছে না কোনো এক কারণে।কিভাবে আসবো আমি?

—আরে তুমি চিন্তা করো না।আমি এদিকটা সামলে নিবো।

—তোমার পরিবার যে..

—তাদের নিয়ে চিন্তা করো। বরং আমায় নিয়ে চিন্তা করো তুমি।

—তোমায় নিয়েই তো করছি।

—আচ্ছা‌ শুনো..আমার ছোটবেলার বন্ধু মিফতি।ওর সাথেই এখন কাজ করবো একসাথে।

—আমায় বলছো কেন?

—বললাম যদি আবার কোনো কুটনী মহিলা তোমায় আমাদের একসাথে কার ছবি পাঠিয়ে বলে যে আমি পরকিয়ায় লিপ্ত তাই।

—আমি বুঝি তোমায় বিশ্বাস করি না?

—স্বামী আর স্ত্রী কেউই শয়তানের প্ররোচনায় পড়লে নিজেদের সঙ্গীকে ভুল বুঝতে পারে।তাই তোমায় আগেই জানিয়ে রাখলাম।

—আচ্ছা শোনো মিটিং এ যাবো। জরুরি মিটিং আই.টি কোম্পানির সিইও তুহাউয়ের সাথে। সাবধানে থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।

—তুমিও। আল্লাহ হাফেজ।

কুহেলিকা কল কেটে দীর্ঘ শ্বাস নিজের মাঝে নেয়।এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না তার‌।নাহিনের কাছেও কতশত বিষয় লুকাতে হচ্ছে তাকে।নাহিনকে কবে সব বলতে পারবে সে,আদৌ বলতে পারা অব্দি তাকে বাঁচতে দিবে নাকি আগেই কারো হাতে মারা পড়বে সে কিছুই জানে না সে!

আজকে সূর্য এখনো উঠছে না দেখে কুহেলিকা সময় দেখে।সূর্য উঠে যাওয়ার কথা এতোক্ষণে।হয়তো আজকের আকাশটা এমন মেঘলাই থাকবে।সময়টা অত্যন্ত সুন্দর লাগছে তার।এপাশটায় যেহেতু গাছগাছড়া বেশ ভালোই তাই সকালের সজীব অক্সিজেন তাকে সতেজতা প্রদান করছে।

—কি করছো এখানে?

সাফিনের কন্ঠ পিছনে না ফিরেও বেশ ভালো বুঝতে পারে কুহেলিকার।উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা।কুহেলিকা বেরিয়ে যেতে নেয় উল্টো দিক দিয়ে।পথ আগলে দাঁড়ায়।

—জবাব না দিয়ে চলে যাচ্ছো?

কুহেলিকা ত্যাড়ামি করে। বিরক্ত নিয়ে বলে ওঠে,
—না দাঁড়িয়ে আছি।

সাফিন রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—ত্যাড়া জবাব দিচ্ছো কেন?

কুহেলিকা ত্যাড়ামি বরকরার রেখে বলে ওঠে,
—ইচ্ছে হইছে।

সাফিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চায়,
—আমার সিনানের খুনি কে?

কুহেলিকা যেন কিছুই জানে না এমন করে জিজ্ঞেস করে,
—সিনানের খুন হয়েছে?

সাফিন কনফিডেন্স নিয়ে বলে ওঠে,
—আমার থেকে ভালো তুমি জানো।

কুহেলিকা সব এড়িয়ে বলে ওঠে,
—আমি কিছুই জানি না।পথ ছাড়ুন আমার।

সাফিন রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,
—পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।আমি সব সহ্য করতে পারি,তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারি তবে নিজের ছেলের খুনিকে খোলা ঘুরতে দিতে পারবো না।

কুহেলিকা আরো রাগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
—তা আবার আপনিও খুনি নন তো?

সাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
—খারাপ মানুষ হতে পারি খারাপ পিতা নই আমি!

****

তানজিল আহমেদ পেনড্রাইভ হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছেন। চট্টগ্রামে প্রবেশ করার দিনকয়েকের মাঝেই অধিকাংশ প্রমাণ জোগাড়ে সক্ষম হয়েছেন।তবে এই প্রমাণগুলো যদি মেয়েটার সামনে যায় তাহলে ভেতর থেকে যে খুকলা হয়ে যাবে সে!সামান্য অনুভূতিগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।তবে প্রমাণ তো সামনে আনতেই হবে। কিন্তু আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন তাতে।

তানজিল আহমেদ কফি খাচ্ছিলেন রেস্তোরাঁয় বসে।কুহেলিকা মুখ ঢেকে অতি গোপনে প্রবেশ করে। প্রাইভেসি রক্ষার্থে কেবিনের মতো অংশ।কুহেলিকা প্রবেশ করেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে।’আব্বু’বলে কেঁদে দেয়।

—আম্মু তুমি আমার স্ট্রংগেস্ট বাচ্চা হয়েও কাঁদছো?এটা কিন্তু মানায় না কুহেলিকা চৌধুরীর সাথে!

—আব্বু কতগুলো বছর পর আবারো দেখা,তোমাকে ছুঁতে পারার সুযোগ হলো।

—তোমার আশেপাশে না থাকলেও তোমার মাঝেই ছিলাম আমি।আমার বাচ্চাটার কাছে আমার অনেক সরি যে জমানো।রাখতে পারিনি তার খেয়াল আমি।

কুহেলিকা তানজিল চৌধুরীর চোখ মুছে দেয়। চৌধুরী বংশের পরিচয় লুকাতেই আহমেদের ব্যবহার। অবশ্য সাংবাদিকতা পেশায় তাকে সবাই ‘আহমেদ’ নামেই চেনে। পুরো পঁচিশ বছরের তৃষ্ণা বাপ-মেয়ের।সেই আতংক,ঘটনা এমনভাবেই তাদের দূরত্ব বানালো যে চাইলেও কেউ কারো কাছে যাওয়ার উপায় ছিলো না।

বাবার কোলে মাথা এলিয়ে রাখা কুহেলিকা।এই বুকের সন্ধান যে তার বহুদিনের।তবে বিধাতা তাহলে মুখ তুলে চাইলেন।কুহেলিকাকে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো শক্ত মস্তিষ্কের,তার প্রতি কোমল হৃদয় নিয়ে চলা ব্যক্তিকে পাঠালেন।

—আব্বু সে রাতে কি হয়েছিলো?

—তোমার দাদাজানের ডাইরিতে পাওনি?

—শুধু তোমার নাম্বার আর কিছু কথা লেখা ছিলো।তাও বড্ড সতর্কতাসহিত।কাগজ যদি আগুনে না ধরতাম তাহলে হয়তো আমি কিছুই জানতে পারতাম না।

—আচ্ছা শোনো তাহলে, ঘটনা শুরু হয় সেখান থেকে…
দিনটা খুবই মিষ্টালো।চেরি ফুল ফুটতে শুরু করেছে। অসম্ভব সুন্দর এক ঋতুতে আমরা কোরিয়া ছিলাম।তখন আমি সাংবাদিক পেশাকে ধ্যান,জ্ঞান সব ধরে বসেছিলাম‌।তুমি তখন ছয়মাস কি সাত মাসের।তোমার মা ডায়ানা রাশিয়ান কন্যা।বাবা মেনে নেয়নি আমাদের।তবে তুমি হওয়ার সংবাদে কি করে যেন সব বদলে গেলো।বাবা আসলো,কায়েস ভাই, কাসেম ভাই সবাই আসলো। আমাদের মেনে নিলো। কিন্তু সমস্যা যে এখানেই শুরু হবে তা কে জানতো!

বাবা চাইতে লাগলেন আমি যেন দেশে ফিরে ব্যবসায় হাত দেই।বাবার একমাত্র ছেলে বলে কথা। তখনো আমি এবিষয়ে জানতাম না।বাবা মির্জাদের সম্পত্তি ভাইদের বুঝিয়ে দিলেন।বেশ ভালো সম্পত্তিই তাদের কৌঠায় গেল।আমি পেলাম বাবার সব সম্পত্তি।তবে তা এমনভাবে যে পঁচিশে পা দিলেই তুমি মালিক হবে সম্পত্তির।

—আচ্ছা আব্বু কেউ তো জানে না কোহিনুর চৌধুরীর ছোট ছেলের ব্যাপারে।এমনটা কেন?

—সবুর করো বাচ্চা।সবই বলবো আজ তোমাকে।যখন আমি বাচ্চা কিংবা বছর সাত/আটের তখন তোমার দাদিজাকে খুন করে ফেলা হয়।বাড়িতে মেয়ে বলতে ছিলো কাসফিয়া আপু।বিয়ের কথা চলছে তারও কেননা সন্তানের জীবন বাঁচানো জরুরি তখন।তবে হঠাৎ একদিন দেখলাম আপু পালিয়ে গেল।বাবা পুরোপুরি মুর্ছে গেলেন।একেকজন যখন একেক কথা বলতে ব্যস্ত বাবার শান্ত মস্তিষ্কে তখন আমি নামক কেমিক্যাল চলিত।পাঠিয়ে দেওয়া হলো লন্ডনে।বোর্ডিং স্কুলে।দেশে আমার সবকিছু মুছে ফেলা হলো। সুরক্ষিত করতে গিয়ে বাবা আমায় একেবারে খাদে ফেললেন।না পারি কারো সাথে কথা বলতে আর না পারি পড়াশোনায় ভালো করতে।সময়ের সাথে সাথে আমিও বড় হয়ে থাকি তবে পরিবারের বিহীন।আব্বুও খুব একটা ফোন করতো না।তবে বছরে কিংবা ছয়মাসে একবার জাস্ট চোখের দেখা দিয়ে আসতো।ইচ্ছে করতো আটকে রাখি।পারতাম না।আর না পারতাম দেশে আসতে।বারণ ছিলো যে।

—আব্বু আম্মু,দাদুকে কারা মেরেছে? তাদের হত্যা কারী কারা?

—আমি‌ এখনো সব প্রমাণ জোগাড় করতে পারিনি।যা পেরেছি তাও কম না।তবুও উপযুক্ত শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড কিংবা সারাজীবন কারাদণ্ডে রাখতে আমার আরো কিছু প্রমাণের বাকি আছে তাই যখন তা সংগ্রহে নেওয়া হবে তখনই তোমায় তাদের সম্পর্কে জানাবো।

—আব্বু আমি আম্মুকে দেখতে চাই।

কুহেলিকার মিনতিতে যেন থমকে রয় তানজিল চৌধুরী ওরফে সাংবাদিক আহমেদ।মোবাইল বের করে মেয়ের হাতে দেয়। মোবাইলের ওয়াল পেপারেই আছে তানজিল চৌধুরী,ডায়ানা ফ্রিংকেল এবং কুহেলিকা।কি মিষ্টি দেখতে তার মা!কুহেলিকা চমকায় তবে বুঝতে পারে কেন তার চোখ নীলচে।কারণটা তার মা। কেননা ডায়ানা ফ্রিংকেলের চোখ জোড়াও নীলচে।তবে চুলগুলো হালকা গোল্ডেন আর হালকা কালো।তবে অত্যন্ত সুন্দরী এক রমনী ছিলো ডায়ানা ফ্রিংকেল।কুহেলিকা মোবাইল জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। তানজিল চৌধুরী মেয়ের কান্না দেখে।ইশ,মনে হচ্ছে এইতো দিনকয়েক আগের ঘটনা। ছোট্ট কুহু মায়ের কোলে যেতে কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতেই কুহু বলে ওঠে,

—আব্বু আমাদের পরিবারের শেষ হলো কিভাবে?

—তখন তোমার এক বছর হতে দুইদিন বাকি।আমরা দেশে ফিরবো।কায়েস ভাইয়ের স্ত্রী তখন নয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা।তাই তারা আসতে পারবে না।সব গোছগাছ কমপ্লিট।তোমার আন্ট তোমায় নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়েছিলো।আমিও জবে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম।ঠিক তখনই কয়েকজন মুখোশধারী আক্রমণ করে। গোলাগুলি করতে থাকে।আমি কোনো মতে বাঁচতে পারলেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ওদের কয়েকজন লোকসহ তোমার মাও মারা যায়। তুমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাও যা আমার জানতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। সিংহের গুহায় গিয়েই বড় হতে থাকো তুমি।তবে আল্লাহর শুকরিয়ায় তুমি জাহিদের সাথে বিয়ের পূর্বেই পালিয়ে আসো।আমাকে ফোন দেও।নয়তো আমি যে আর তাদের শাস্তি পাওয়াতে পারতাম না…

চলবে কি?

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১২
#বর্ষা
কুহেলিকা দাঁতে দাঁত চেপে কথা গিলছে রুমানা আফরোজের।এই মহিলা এজীবনে বদলাবেন বলে মনে হচ্ছে না কুহেলিকার।রুবেলের কথায় খেপেছেন।রুবেলকে নাকি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে কুহেলিকা।কেন সে বলবে এই নিয়ে যত সব ঢং শুরু হয়েছে।

—কুহেলিকা তোমার সাহস কি করে হয় রুবেলকে বেরিয়ে যেতে বলার?

কুহেলিকা জবাব দেওয়ার পরিবর্তে যেন চারপাশ দেখেই বেশ মজা পায়।রুমানা আফরোজ আরো খেপে ওঠে।কুহেলিকার হাত শক্ত করে ধরে সামনের দিকে ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে,

—বেয়াদব হয়েছো?মায়ের সাথে কেরকম আচরণ করতে হয় শিখনি!

কুহেলিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর কিছু না ভেবেই বলে দেয়,

—আপনি তো আমার মা’ই নন।

কুহেলিকা চলে আসে সেখান থেকে।রুমানা আফরোজ শীতল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। হঠাৎ যেন থমকে যেতে চায় হৃদয়। আচ্ছা কাউকে অত্যাধিক বকাবাজি করলেও কি তার মায়ায় পড়া যায়!হয়তো যায়।কুহেলিকা চলে যেতেই রুমানা আফরোজ ধপ করে সোফায় বসে পড়েন।রুবেল ছুটে এসে বলে,

—দেখেছো ফুফু কত বেয়াদব হয়েছে এই মেয়ে।আমি তো ভেবেছিলাম ও আরো ভালো হয়েছে।এখন দেখছি আস্তো এক বেয়াদবে রুপান্তরিত হয়েছে‌।

—এখন আমাকে একা ছেড়ে দে।তোর সাথে পরে কথা বলবো রুবেল।

রুবেল ড্রয়িংরুম থেকে গেস্ট রুমে চলে যায়।রুমানা আফরোজও সোফা ছেড়ে নিজের রুমে এসে কাঁদতে থাকেন।ভাবতে থাকেন কি দোষ তার যে সে আজ মৃত সন্তানের মাতা।আর যে আছে সেও যে ভুল বুঝে বড্ড দূরে।কোথায় সে তাও যে অজানা।কায়েস মির্জাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন,

—ওই শুনছো আমার না আর ভালো লাগছে না।যার কেউ নই তার বাড়িতে বেহায়ার মতো পড়ে থাকার মানে হয়!

কায়েস মির্জা চমকান স্ত্রীর কথায়।তিনি নিজেকে শক্ত রেখে স্ত্রীকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলে ওঠেন,

—সন্তানহারা আমরা।এখন যেই মেয়েটা আমাদের আম্মু,আব্বু চেনে তাকে ফেলে চলে যেতে কি পারবো? কায়ফার মৃত্যুর পর সন্তানের গন্ধ যে ওর থেকেই পাই এখন।

—কিন্তু ও‌ যে আমাদের বায়োলজিক্যাল সন্তান না এটা তুমিও জানো,আমিও জানি আর..

—আর?

—আর কুহেলিকাও জানে।

—তুমি কিভাবে জানলে?

—আজ যখন বকাঝকা করছিলাম তখন আমাকে বলেছে যে আমি ওর মা নই।

—কুহেলিকা জানে না।জানলে ধ্বংস হয়ে যেতো মেয়েটা।তোমার কর্কষ ব্যবহারে কষ্ট থেকে বলেছে।এখন একটু আদর সোহাগ করো।ওকে হারালে কিন্তু আমরা সন্তানের ভালোবাসার জন্য কুঁড়ে কুঁড়ে মরবো।

—কিভাবে ভালোবাসবো বলো ও কারণেই তো তোমরা কোনো সম্পত্তি পেলে না..

—আমি এতোদিন বুঝিনি।সিনানের মৃত্যু্র পর বুঝেছি।আমরা সম্পত্তি রাখি আমাদের সন্তানের জন্য।তবে আমরা মরার কয়েকদিন বাদেই যদি সন্তান মরে যায় তাহলে সে সম্পত্তি অন্যকারো কাছে চলে যাবে। তাহলে লাভ কি এ নিয়ে?

রুমানা আফরোজ আর কিছুই বলেন না।চুপটি মেরে বিছানায় গিয়ে বসেন। প্রেশারের ঔষধ খেয়ে নেন।সাথে মাথা ব্যথারও একটা ঔষধ খান।অসহ্য ব্যথা করছে!তবে তা মাথায় নয় মনে।এ ব্যথা শারীরিক ব্যথার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং মানসিক ব্যথা।

****

কুহেলিকার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। মুঠোফোনে মায়ের ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তা‌।নিরব অশ্রু বিসর্জন। অভিযোগ করে বলা,

”মা কেন বাঁচলে না তুমি? তুমি যদি বেঁচে থাকতে তাহলে কি কেউ তোমার কুহুর সাথে এমন করতে পারতো!ও মা,মা কেন বাঁচলে না তুমি?”

বুঝদার কুহেলিকার মুখে অবুঝদারী কথাবার্তা।কুহেলিকা জানে মৃত্যু তো আসে আল্লাহর তরফ থেকে শুধু মানুষের নাক গলানো তা আসে কিছুদিন আগে।তবে তাও নির্ধারিতওই থাকে যে।কুহেলিকা মনকে শান্ত করতে ব্যর্থ।তারও যে চাই বাবা-মায়ের ভালোবাসা।

কুহেলিকার ফোন বেজে ওঠে।নাহিনের ফোন।কুহেলিকা মুচকি হাসে।মনে প্রশ্ন জাগে ছেলেটা কেমন করে প্রতিবার ওর মন খারাপের সময়ই ওকে স্মরণ করায় যে ও একা নয়!কুহেলিকা ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফোন রিসিভ করে।

—এতো দেরি কেন কোথায় ছিলে?

—ওয়াসরুমে।

—চোখমুখ ফোলা ফোলা কেন কুহু? তুমি কেদেছো?কেউ কিছু বলেছে তোমায়,কে বলেছে?

নাহিন উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করতে থাকে।কুহেলিকা মুচকি হেসে বলে ওঠে,

—জানো নাহিন এই পরিবার আমার কেউই হয় না।দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক আমাদের।

নাহিন চুপ করে শোনে।তার চোখে যেন লুকিয়ে আছে হাজারো কথা।বলতে চায় তবে কোথাও একটা আটকে যায়।তবুও যেন আজ শত বাঁধা অতিক্রম করে বলে ওঠে,

—কুহু তুমি যাদের কবর আমার বাবা-মায়ের বলে জানো তারা আসলে আমার আংকেল আন্টি।আমি বহুবছর পূর্বে আমার বাড়ি ছেড়ে ছিলাম‌। অবশ্য ফিরেও গিয়েছিলাম সেখানে।তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় কি জানো আমি তাদের কষ্টে একটুও দুঃখ পাইনি। কেননা তারা মানুষ হিসেবে আমার চোখে নিকৃষ্ট।

কুহেলিকা অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো।নাহিনের কথায় একদম চোখ বরাবর চায় সে নাহিনের।ছেলেটার মধ্যেও তাহলে লুকিয়ে আছে হাহাকার।কই নাহিন তো কখনো উদাস থাকে না! নাহিন আবারো বলে ওঠে,

—তুমি ভাবতে পারো যে ছেলের মাঝে উদাসীনতা নেই তার মাঝে এতো বড় সত্য কিভাবে আছে?সত্যিই এ সত্য আছে আমার মাঝে কেননা আমি তাদের ঘৃণা করায় আমাকে কখনো উদাসীনতা গ্রাস করেনি।একটা বিষয় আরো আছে যা আমি লুকিয়েই রাখতে আগ্রহী।তবে যখন দেখবো না আমিই সঠিক জান্তা তখন তোমার হাতে হাত রেখে বলবো সব কথা।

কুহেলিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্লান্ত সেই চোখের দিকে।কেমন ঘোলাটে দৃষ্টি ছেলেটার!আচ্ছা ও কি আবারো উল্টা পাল্টা কিছু খাচ্ছে?না,এমন কখনোই হবে না।হয়তো কাজের চাপে পড়ে খাওয়া দাওয়া করছে না নিয়মানুসারে।

****

তানজিল চৌধুরী মেয়ের ফোনে কল দিয়ে ব্যস্ত দেখে বুঝলেন মেয়ে তার স্বামীর সাথে হয়তো কথা বলতে ব্যস্ত।অন্যথায় যেকোনো মূল্যে কল রিসিভ হতো। বৃদ্ধকে হসপিটালে পৌঁছে বেরিয়ে আসার সময় পথে আগলে দাঁড়ায় মাঝবয়সী রমনী।মুখ তুলে তাকিয়ে অ হয়ে যায় তানজিল চৌধুরী।পালিয়েই তো থাকতে চেয়েছিলো।তবে এতো আগে কেন সামনে পড়লো!

—ভাই?

ডক্টর সফিয়ার ডাকে না দাঁড়িয়ে এগিয়ে যেতে নেয় তানজিল চৌধুরী।হাত শক্ত করে ধরে ফেলে সফিয়া।নাহিদ খানও সেখানেই দাঁড়িয়ে।অবাক হোন স্ত্রীকে পরপুরুষের হাত ধরতে দেখে।এগিয়ে এসে দাঁড়ান তানজিল চৌধুরীর সামনে।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যার মৃত্যু সংবাদ শুনলো পঁচিশ বছর পূর্বে তারই দেখা মিললো এই সময়ে!

—তানজিল?

নাহিদ খানের দিকে তাকায় তানজিল।রাগ ওঠে।এই লোকটাকেই নাকি সে বড় ভাইয়ের স্থান দিয়েছিলো যে তাদের কথা না ভেবেই পালিয়ে নিয়ে গেলো তার বোনকে। অবশ্য এই কারণে কৃতজ্ঞতাবোধও জন্মেছে তার মনে‌। কেননা তা না হলে হয়তো তারই মতো তার বোনের ওপরেও আক্রমণ হতো‌।মরে যেতে পারতো তার বোনটা।

—পথ ছেড়ে দাঁড়ান।আমি আপনাদের চিনি না।

ডক্টর সফিয়া কথা শোনেন না ভাইয়ের।টেনে নিয়ে আসেন ক্যাফেটেরিয়ায়।টেবিলে বসে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

—ভুল বুঝবি আমাকে এখনো?

—আমি বলছি তো আমি আপনাদের চিনি না।

—তা শালা বাবু আমায় কিভাবে ভুললে?

নাহিদ খানের কথায় খেপে যায় তানজিল চৌধুরী।ছোট থেকেই এই শালা শব্দটা বড্ড অপছন্দের তার কাছে।মনে হয় যেন কেউ গালি দিয়েছে তাকে।তেতে উঠে বলে,

—আমি কারো শালা নই।আর আপনি আমায় গালাগাল করতে পারেন না।

একজন সাংবাদিকের এই বিষয়টা খুবই হাস্যকর লাগতে পারে।তবে মানুষের দূর্বলতা থাকে।তবে তার ক্ষেত্রের দূর্বলতাটা খুবই হাস্যকর।ফলে নাহিদ খানও চিনে ফেলেন তার শালাকে।স্ত্রী কাসফিয়া চৌধুরী উরফে সফিয়ার ভাইকে চিনে ফেলেন তিনি।

—তা সফিয়া আর কিছু বলতে হবে তোমায়?বাচ্চা তো নিজেই বলে দিয়েছে কে সে!

—নাহিদ ভাই আমি বাচ্চা নই।বছর ঘুরতেই নানা হবো।আর তুমি আমায় বাচ্চা বলছো!

—তা আমাদের তানজিলের মেয়ে কেমন আছে?আর কোথায় সে?

নাহিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তানজিল।তবে খুব সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে যায় মেয়ের বিষয়টা।গোপন রাখতে বলে তার বেঁচে থাকার কথাটা। কাসফিয়া চৌধুরী কিংবা নাহিদ খানের স্ত্রী সফিয়া যাই বলি না কেন তিনি তাকিয়ে আছেন ভাইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে।যার মৃত্যু সংবাদে নিজেকে অপরাধী ভেবে কুঁড়ে কুঁড়ে মরছিলেন।আজ যেন সেখানে নতুন করে বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেলেন।তবে তার খটকা লাগছে,মনটা খচখচ করছে।কারো চেহারার সাথে মিলে যাচ্ছে তার ভাইয়ের চেহারা।তবে স্পষ্ট মনেও পড়ছে না।তবে এটা বুঝেছেন তার ভাই লুকিয়েছে তার ভাগ্নির বিষয়টা। কেন এর পেছনেও কি রয়েছে কোনো রহস্য?কে তার ভাগ্নি?দেখা কি হয়েছে তাদের নাকি….

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে