দুই পথের পথিক পর্ব-১৩+১৪

0
126

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৩
#বর্ষা
অনেকদিন বাদে অফিসে গিয়ে মস্তিষ্কের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।কোনো কাজই যেন পছন্দসই লাগছে না কুহেলিকার। ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলোর জন্যই ইচ্ছে মতো ঝেড়ে চলেছে সবাইকে।কেউ কিছু বলতেও পারছে না কেননা তারা একেতো নিম্ন পদের কর্মচারী,তার ওপর আবার আশ্চর্য।যেই মেয়েটা হাসিখুশি ভাবেই তাদের কাজ বুঝিয়ে দিতো ভুল হলে সে নাকি এভাবে তাদেরকে অপমান করছে ভাবা যায়!

কেবিনে ফিরে মাথা এলিয়ে দেয় টেবিলে। নিষিদ্ধ দিনের শুরু আজ।এইদিন এলেই পেটের ব্যথা আর কোমরের ব্যথা এতোটা বেড়ে যায় যে বদমেজাজি ব্যবহার অনিচ্ছাতেই করে ফেলে।কুহেলিকা ঔষধ নিয়ে খেয়ে নেয়।খারাপ লাগছে ওর।পিয়নকে দিয়ে হট ওয়াটার ব্যাগ আনিয়ে পেট বরাবর রাখে।একটু রিলিভ পাচ্ছে সে।তবে খারাপ লাগাটা কমেনি এক শতাংশও।

—মে আই কাম ইন ম্যাম?

—ইয়েস কাম ইন।

দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজেই কুহেলিকা অনুমতি দেয়। নতুন ইন্টার্ন হিসেবে যোগদান করেছে জুলফিকার রাসেল।পালোয়ানের মতো দেখতে।ভয় পাবার মতোই মুখশ্রী তার।প্রথম দেখায় ভয় পেয়ে যায় কুহেলিকা।লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জুলফিকার ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়।

—ম্যাম ইজ এভরিথিং ওকে?

—হু আর ইউ?

—ম্যাম আমি নিউ ইন্টার্ন।

কুহেলিকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো চেয়ারে বসে।শান্ত ভঙ্গিমায় বলে ওঠে,

—হ্যা বলুন কোনো সমস্যা?

—ম্যাম ফাইলটা..

কুহেলিকা ফাইল নেয়। পর্যবেক্ষণ করে।অবাক হয় একজন ইন্টার্নকে বড় একটা প্রজেক্টের কাজ দেওয়া হয়েছে দেখে।আবার তার চেয়েও বেশি অবাক হয় নিখুঁত কাজ দেখে।যেন বহুদিনের অভিজ্ঞতা আছে এনার।তার চেয়েও বড় বিষয় এই লোককে দেখে কোন মতেই ইন্টার্ন মনে হচ্ছে না কুহেলিকার।জহুরি নজরে পরখ করে ফাইল সাইন করে দিয়ে দেয় কুহু। অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে যায় জুলফিকার।কুহেলিকা ফোন দেয় পিয়নকে।বলে ওঠে,

—আই নিড ইনফরমেশন এবাউট হিম।

কুহেলিকা ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়।আজ কান্না করতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো।পেটের ব্যথাটা হয়তো একটু কম লাগতো।কুহেলিকা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে কেবিনের মাঝে।ফোন আসায় দ্রুত এগিয়ে যায়। হসপিটাল থেকে ফোন। অপরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে,

—ইজ ইউ কুহেলিকা?

—ইয়েস আ’ম।

কুহেলিকা পরবর্তী যে কথা শোনে তাতে যেন পৃথিবী ঘুরে ওঠে।চেয়ারে বাজানো ব্লেজার নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। হসপিটাল টি প্লাজায় পৌঁছাতেই দেখা মেলে ডক্টর সফিয়ার সাথে অপরিচিত একজন নারীর। রিসেপশন থেকে জেনে এসেছে চারতলার তিন নাম্বার কেবিনে তার আব্বু।ডক্টর নাকি ফোন দিতে বলেছে।নাম্বার পাওয়ার বিষয়টা একবার ভাবলেও তা গভীর ভাবনায় রুপান্তরিত হয়না। লিফটের অপেক্ষায় না থেকে সিড়ি ভেঙেই ওপরে যায় সে।আর সামনেই তো ডক্টর সফিয়ারা ছিলো।

কুহেলিকা কেবিনে উঁকি দিয়ে দেখে কায়েস মির্জা সুয়ে আছে।থমকে যায় সে। অনুভূতিশূন্য ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে।আগে আব্বু ডাকতে এই মানুষটার প্রতি জন্মেছিলো অগাধ ভালোবাসা।তবে মানুষের অতীত সামনে আসলে ঘৃণার যে প্রলেপ পড়ে তা পড়েছে কুহেলিকার হৃদয়ে। ভালোবাসা আর নেই।তবে আছে তারা হৃদয়ে যেখানে শুধুই ঘৃণা তাদের প্রতি।ডক্টর সফিয়া এগিয়ে এসে বলেন,

—এইতো এসেছে কুহেলিকা।আমিই তোমার নাম্বার দিয়েছিলাম রিসেপশনে তোমায় ফোন দিতে।মিষ্টার কায়েস তো তোমার আব্বু তাই না?

কুহেলিকা কি বলবে ভেবে পায় না। কেবিনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অনুভূতিশূন্য মাথা ঝাঁকায়। অর্থাৎ সেই মিষ্টার কায়েসের মেয়ে।ডক্টর সফিয়া কিছু পরামর্শ দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।কুহেলিকা কেবিনে প্রবেশ করে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,

—রাস্তায় বের হয়ে কিভাবে হাঁটেন?আর গাড়ি থাকতে আপনাকে হাঁটতেই বলেছে কে?আজ মিসেস ফাইজা না বাঁচালে তো পরপারে পৌঁছে….

কুহেলিকার কথায় কায়েস মির্জা শীতল দৃষ্টিতে তাকায়।কথা থেমে যায় কুহেলিকার।ভেতরটা কেমন করে ওঠে।এই অনুভূতির মানে একেবারেই অচেনা কুহেলিকার।থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে।বাসায় ফোন দিতে চেয়েও দেয় না।বাইরে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। রিসেপশনে কথা বলে।কায়েস মির্জা ডিসচার্জ হলে তারপর নিজের গাড়িতেই বেরিয়ে পড়ে।

—আমার কারণে তোমার কাজের ক্ষতি হলো তাই না কুহু?

বাচ্চাদের মতো অভিমানী কন্ঠ শোনায়।কুহেলিকা তবুও ফিরে তাকায় না।কায়েস মির্জার কাছে কুহেলিকাকে পাথর বই আর কিছুই মনে হয় না।মেয়েটা পাথরে পরিণত হয়েছে।জীবনটা কি অদ্ভুত না!কয়েকবছর আগেও যেই মেয়েটা পিতার সান্মিধ্য পেতে আকুল থাকতো আজ সে মেয়েটাই কতো সুক্ষ্ণভাবে সবাইকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

****

নাহিন অফিসের করিডোরে দাঁড়িয়ে ভাবছে জীবনে সে কি পেলো আর কি খুইয়ে নিঃস্ব হলো।ভিসা রেডি করেছে বহু কষ্টে।আজ থেকে কুহেলিকার মতোই সেও নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করবে।যাদের ঘিরে ওর পরিবার তাদের দোষগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে। অনুতপ্ত করিয়ে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখবে।তবে তার পূর্বে উপযুক্ত শাস্তিতেও পাওয়াবে।আর ওর আংকেলের খুনিকেও যে তার উপযুক্ত শাস্তি পাওয়াতে হবে।

মিনিট পঞ্চাশের যাত্রায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে পিয়নের কাছে গাড়ি দিয়ে ঢুকে যায় এয়ারপোর্টে সে। হাঁসফাঁস করতে থাকে সে।ডক্টর জানিয়েছে জন্ডিসের লক্ষণ নাকি দেখা দিচ্ছে তার মাঝে।ঔষধ দিয়েছে।আর দিয়েছে একগাদা পরামর্শ,ডায়েট চার্ট।

নাহিন চোখ বন্ধ করে বসে থাকে চেয়ারে।বুকের ভেতরের ধুকপুকানি বেড়েই চলেছে।কেমন যেন লাগছে।ভেতরটা বারবার কেঁপে উঠছে সেই নির্মমতা সহ্য করার বিষয়টা মনে হতেই। সমাজের ভয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর কথা মনে হতেই রাস্তার কিট মনে হয় তার নিজেকে।কেন সে সেদিন বাধ্য হয়,ঘৃণা করে দেশ ছেড়েছিলো!তার তো উচিত ছিলো আইনের সাহায্য নেওয়া। অবশ্য তাদের সাহায্য নিলেই বা কি হতো! অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তাই যে অসৎ।বদনাম যে শোষিত-রই ছড়াতো।

নাহিন ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় কাঙ্খিত নাম্বারে।বহু বছর এই নাম্বারে কল দেওয়া হয় না।দশ বছরের বাচ্চা থাকতে বাড়ি ছেড়েছিলো সে।তখন হয়তো ভয়ে ছেড়েছিলো।তবে তা দীর্ঘত্ব অর্জন করেছিলো আরো কিছু বছর পরে। কেননা সে তখন বুঝদার হয়েছিলো। বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছিলো।

ফোন রিসিভ হয়।নাহিন কানে দেয় ফোন।ভাঙা গলা ভেসে আসে।ভেতরটা কেঁপে ওঠে ওর।চোখ দিয়ে একাকী গড়িয়ে পড়ে অশ্রুরা।কেন জানি বড্ড দমবন্ধকর লাগতে লাগে চারপাশটা।শব্দরা যেন অভিমানী হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় না।তবুও জোর করে বের হয় তারা।

”আম্মু”

শব্দটা যেন থমকে দেয় অপর পাশের মানুষটিকে।নিরব থাকার কিঞ্চিত সময়ের মাঝেই শোনা যায় অপরপাশের ব্যক্তিটির কান্নারত কন্ঠ।ভাঙা গলায় কানতে কানতে বলে ওঠে,

—আব্বা তুই কই?ও আব্বা আয় না।আমার না তোর জন্য কষ্ট লাগে।মনে হয় বেশিদিন আর বাচমু না..

—আম্মু!

—আব্বা জানিস ওরা না আমায় খেতে দেয় না।তোর বাবাও আমারে আর ভালোবাসে না।খালি বকে।

আবারো কাঁদতে থাকেন অপরপাশের মহিলাটি।নাহিনও কাঁদতে থাকে এপাশ থেকে।ও ইতিমধ্যে জানতে পেরেছে ওর মা মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছে।কেমন ছন্নছাড়া জীবনটা অতিবাহিত করছে।ওর বৃদ্ধ বাবা আর কতদিক দেখবে।যাদের জন্য জীবনটা শেষ করতে নিয়েছিলো তারা আজ তাদের সাথে থেকেও পাশে নেই। খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করেনা!

—আম্মু তুমি চিন্তা করো না আমি আসবো।আমি আগামী কালই তোমার কাছে থাকবো।(নাহিন)

—হ বাপ তুই আয়।আমারে তোর কাছে নিয়ে চল।আমার না আর ভালো লাগে না।সবাই বকে।(অচেনা মহিলা)

—আমি এসে সবাইকে বকে দিবো।কেউ আর তোমায় বকার সাহস পাবে না দেখো!(নাহিন)

—তাড়াতাড়ি আয় বাপ।(অচেনা মহিলা)

”নাসরিন আমার ফোনে তুমি কার সাথে কথা বলছো?”

নাহিন বেশ শুনতে পায় ফোনের অপাশ থেকে আসা পুরুষালী কন্ঠস্বর। ভেতরটায় গম্ভীরতা ছেয়ে যায়।এতোদিন ঘৃণা পুষে রাখতে পারলেও এখন যে আর তা পুষে রাখা সম্ভব না।ওরই জন্মদাতা পিতার কন্ঠ ভেসে এসেছে।একসময় যেই লোকটা নিজের মেয়ের সাথে ঘটা অন্যায়ের কথা চিন্তা না করে ভাইয়ের ছেলেদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করেছিলো আজ তারা কোথায়!প্রশ্ন জাগে নাহিনের মনে।

—হ্যালো,হ্যালো কে বলছেন?

নাহিন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয়,

—আমি,আমি নাহিন মুনতাসির।

—নাহিন!

ওপাশের মানুষটা যে বেশ অনেকক্ষণ থমকে থাকবে তা জানে নাহিন।কল কেটে দেয়।প্রেয়সীকে এখনই জানাতে চায় না এসব। তার প্রেয়সী তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে।যদি জানতে পারে নাহিন একসময় আপোষ করেছিলো তাকে যদি ছেড়ে যায়!এই ভয়ে আর বলা হয়নি।তবে নাহিন হয়তো এতসবের মাঝে ভুলে গেছে তার প্রেয়সীর বলা কথা।কুহেলিকা বলেছিলো,
”আমাদের হিতে সবসময় পরিস্থিতি থাকে না।কখনো কখনো প্রতিবাদীদেরও আপোষ করতে হয়। নয়তো অন্যায়কারীদের শাস্তি দেওয়ার পূর্বেই মূর্ছে যেতে হয়।তাই কিঞ্চিত সময়ের জন্য আপোষ করে ভবিষ্যতে অন্যায়কারীদেরকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি পাওয়ানোই উত্তম মনে হয় আমার কাছে।”

চলবে কি?

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৪
#বর্ষা
পুরুষ মানুষ নাকি সহজে কাঁদে না।এমনটাই প্রচলিত ধারণা এবং সত্য বলেই‌ গ্রাহ্য।নাহিন কাঁদছে ওর আম্মাকে ধরে কাঁদছে।যেন বহুদিনের একাকীত্ব মনে করে, চারপাশের মানুষদের অগ্রাহ্য করে মনের অনুভূতি সব উগলে দিচ্ছে।মা আর সন্তানের সম্পর্ক তো এমনই হয় তবে শতাংশ হিসেবে খুবই কম।হয়তো কারো মা নেই,নয়তো কেউ মায়ের সাথে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ করতেই পারেনি‌। কিছুক্ষেত্রে মা’কে ভয় পাওয়াটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ,ঠিক তেমনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়ের সাথে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া চাই।

নাহিন মেঝেতে বসে সোফায় বসা মায়ের ক্রোড়ে মাথা নামিয়ে কাঁদছে।দূর থেকে বাড়ির মানুষেরা আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে দেখলেও যে কিঞ্চিত বিরক্ত তাও পরিদর্শিত।নাহিন যে পরিচয় দেয়নি তাদের।এসেই সামনে মা’কে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

—আব্বা আর কাদিস না। তুই কাঁদলে যে আমারও কষ্ট হয়।অনেক কষ্ট হয়।

নাসরিন সুলতানা বুকে আঙুল দেখিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠেন। সন্তানের কান্না যে তার সহ্য হচ্ছে না।নাহিনের চোখ জোড়া দেখেই যে বুঝে ফেলেছেন এই তার সেই ছোট পাগল ছেলেটা।নাহিন দ্রুত চোখ মুছে মৃদু হাসার মিথ্যে চেষ্টা করে বলে ওঠে,

—আম্মু দেখো আমি আর কাঁদছি না।তুমি কষ্ট পেয়ো না।

নাহিনের এমন কথায় মুখ বাকায় দূরে দাঁড়ানো ফাতেমা বেগম।একেমন বাচ্চাপনা!মস্তিষ্কের বিকাশ কি ঘটেনি? ফাতেমা বেগম এবাড়ির বড় ছেলে রাব্বি মুনতাসিরের স্ত্রী।যৌথ পরিবারে বড় বউ হওয়ার স্বার্থে সবার ওপরেই রোপ জমান তিনি।ছোট বউ কানিজ আক্তার দেখতে গোলগাল চেহারার মাঝবয়সী বিধবা মহিলা।দুই সন্তান নিয়েই বেঁচে আছেন।আর জীবন অতিবাহিত করছেন স্বামীর শেয়ারে যে টাকা পায় তা দিয়ে। এদের সবার জীবনেরই রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প।এখন শুধু বাড়ির বউরাই বাসায়।স্বামী ,ছেলেপুলে আর মেয়েরা বাসায় নেই।

—আআআআআআ

নাহিন উপরে তাকায়। বোকাসোকা ছোটোখাটো একটা মেয়ে।তবে তার দিকে এভাবে কেন চিৎকার করলো মাথায় এলো না। অবশ্য চেহারাটা অস্পষ্ট।মেয়েটা আস্তে আস্তে নাহিনের দিকে এগিয়ে আসতেই নাহিনের মুখ অনুভূতিশূন্য হয়ে দাঁড়ায়।জিনিয়া তো নাহিনকে দেখেই চিনে নিয়েছে।অবশ্য চিনে ফেলারই কথা। কর্পোরেট জগতে উন্নতি করতে চায় আর নাহিনকে চেনে না খুব কমই আছে।

—নাহিন মুনতাসির?নাহিন মুনতাসির স্যার আপনি আপনি আমাদের বাসায়।হাউ লাকি আই আ’ম। দাঁড়িয়ে কেন বসুন।

কথার তালগোল পাকিয়ে ফেলে জিনিয়া।মেয়ের মুখে নাহিন মুনতাসির নাম শুনে ফাতেমা বেগমের হাত কেঁপে ওঠে।হাতে থাকা খুন্তি সঃশব্দে হুমড়ি খায় নিচে।তার চোখে ভেসে ওঠে বছর বারোর ছেলের বলে যাওয়া কথাগুলো।

—আমি পাই টু পাই হিসেব নিবো।আমি যদি ফিরি কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবো।সবার পাপের ঘরা পূর্ণ হওয়ার পরই ফিরবো। সবাইকে শাস্তি পাওয়াবো তাদের কর্মের।

তাও একুশ বছর পূর্বে বলা কথাগুলো!কারো দেওয়া হুমকি এতো গভীরভাবে মনে থাকে!না থাকলেও থাকতে বাধ্য করেছে সেই লালাভ চোখ জোড়া।জিনিয়াকে টেনে নিয়ে আসে ফাতেমা বেগম।বড্ড আদরের মেয়ে। কিছুতেই ঘেঁসতে দেওয়া যাবে না ওর সাথে।যদি একই ভাবে প্রতিশোধ নেয়!নাহিন বিষয়টা বোঝে,হাসে।

জিনিয়া রেগে যায় মায়ের ওপর।এতো বছরের স্বপ্ন তার যার সাথে দেখা করার তার সাথে সামনাসামনি পরেও নাকি কথা বলার সময় এতো বাঁধা সহ্য হয়!জিনিয়া রাগ দেখিয়ে বলে,

—মা সরো তো।আমি স্যারের সাথে কথা বলবো।

—থাপ্পরে তোমার গাল লাল করে দিবো।ভুলে ওর আশেপাশে যেন তোমায় না দেখি।নাহিন মুনতাসির তোমার মেজ চাচার ছেলে।পালিয়ে গিয়েছিল যে সে।ওর থেকে দূরে থাকবে।

মায়ের কথায় যেন লাফিয়ে ওঠে জিনিয়া।মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নাহিনের কাছে ছুটে এসে হাত ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে,

—আপনি সত্যি আমার কাজিন ভাই!আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।আপনি আপনাকে ভাইয়া বলেই ডাকবো কিন্তু।

নাহিন ফাতেমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বাঁকা চোখে বাঁকা হাসে। ফাতেমা বেগম ভয়ে জর্জরিত হয়ে যায়।মেয়েকে টেনে নেওয়ার শক্তি তার মাঝে নেই।বয়স হয়েছে।তাই দ্রুত ড্রয়িংরুম থেকে ছুটে রান্না ঘরে যায়।গ্যাসের চুলা অফ করে সাইডে রাখা মোবাইল হাতে তুলে নেয়। কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে কল দিয়ে বলে ওঠে,

—ওই তোরা কই?এতো কি সারাদিন বাইরে টইটই করছ!বাসায় আয় নাহিন আইছি।আর তোদের বোন চিপকে আছে ওর সাথে।

অপাশ থেকে ভেসে আসে গালাগালিজের শব্দ। ফাতেমা বেগম ক্রুড় হাসি হাসেন।ভেবে নেন জিতে গেছেন।তবে বাইরে এসে যেন আরো বড় ঝটকা খান।যেই মেয়েকে দিয়ে তিনি কুটোটিও করান না সেই মেয়েকে দিয়ে নাহিন জুতা খুলাচ্ছে।চিৎকার করে বলে ওঠেন,

—এই ছেলে তোমার সাহস কি করে হলো আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে দিয়ে নিজের জুতা খুলানোর!

—ওফ কাকি তুমিও না কত ভুলো মনা।এই বাড়িটা যে তোমার একার না। আমাদেরও সমান শেয়ার আছে।আর আমি দাঁড়িয়ে নই বসে জুতা খুলাচ্ছি।বনুউউ তোর সমস্যা আছে?

—না,ভাইয়া।আমি তো খুলে দিচ্ছি।

নাহিন জ্বালিয়ে মারতে চাইছে যেন।জিনিয়াকে দিয়ে জুতা খুলিয়ে পানি আনাচ্ছে ফ্রিজ থেকে আবার খাবার জিনিস দিতে বলেছে।একেবারে যেন ওর কত কাছের বোন তেমন অধিকার দেখাচ্ছে।আবার কাজের বুয়ার কাজও যে করাচ্ছে তাও বলা যায়। নাহিন এতোটুকু বুঝেছে এই মেয়ে বড্ড সহজ-সরল।নয়তো এতো কিছুর পরও চুপ না থেকে চলে যেতো।যেখানে ওর মা নিজেই ওকে সাপোর্ট করতো।

”মা,মা”

জিদান,জারিফ,জোভান তিন ভাই একসাথেই বাসায় আসে।জিদানের বউ প্রেগন্যান্ট হওয়ায় বাপের বাড়ি আছে। জারিফের স্ত্রী নোভা একাকী থাকতে পারলেই বাঁচে তাই এতশব্দেও বাইরে আসেনি।আর জোভানের স্ত্রী সে তো মজা নিয়ে নাহিনের কাজগুলো দেখছে। শাশুড়িকে শাস্তি পেতে দেখে বেশ মজা পাচ্ছে।গরিব ঘরের মেয়ে বলে কথায় কথায় অপমানের পাশাপাশি একগাদা কাজ তাকে দিকেই করিয়ে নেয়।

—ওহ আমার বড় ভাইয়ারা কেমন আছো?

তিনভাই নিজের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নাহিনের দিকে তাকায়। সৌজন্যমূলক কোনো কথা না বলে সরাসরিই বলে ওঠে,

—এখানে কি চাই‌ তোর?কি জন্যে এসেছিস?(জোভান)

—বাহরে আমার বাড়িতে আমি আসবো না!(নাহিন)

—তোর বাড়ি?তোর বাড়ি আসলো কোত্থেকে?(জারিফ)

—মানলাম তোমাদের সাথে শেয়ারে বাড়িটা।তবে যাই বলো না কেন অধিকার তো আমারও আছে।(নাহিন)

—আগে পা নামিয়ে ভদ্র ভাবে বস।তারপর অধিকার নিয়ে কথা বলতে আসিস।আর কিসের অধিকার তোর?কে তুই?(জিদান)

—কে আমি?সত্যিই তো কে আমি?(নাহিন)

—একদম ফাজলামো করবি না নাহিন।

তিন ভাই একত্রেই শাসিয়ে ওঠে।নাহিন মুখ বাঁকিয়ে তা লক্ষ করে তবে গ্রাহ্য করে না বেশি।এদেরকে গুরুত্ব দেওয়া মানে কুকুরকে গুরুত্ব দেওয়া।এদের চরিত্রগুলোই যে এমন!নাহিন বলে ওঠে,

—আমি নাহিন মুনতাসির।এই বাড়ির তেত্রিশ পার্সেন্ট শেয়ারের মালিক।

—তুই যদি মাত্র তেত্রিশ পার্সেন্ট হোস আমরা তিন ভাই মিলে কত পার্সেন্ট হবো বুঝতেই পারছিস?

জিদানের কথায় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে নাহিন। মায়ের হাতে খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

—ভাই তুমি কি করো?ব্যবসা করো নাকি…

—ব্যবসা করি!(জিদান)

—ওহ আই সি

নাহিন হাসতে থাকে।একজন ব্যবসায়িকের মুখে এরকম তারছিড়া মার্কা কথা শুনলে যে কেউই হাসতে বাঁধতে হবে।যারা সামান্য বুদ্ধিসম্পন্ন আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দিক্ষিত তারাও অতি সহজেই সহজ হিসেবটা বলতে পারতো। নাহিন অবশ্য আগের থেকেই খবর নিয়েই এসেছে এর ব্যবসার বিনিয়োগের চার ভাগের একভাগও মুনাফা এখনো অব্দি অর্জিত হয়নি।টাকা শুধু ঢেলেই গিয়েছে ফল আর আসেনি।

***

কুহেলিকার সামনে পুরো দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফিন স্যার।তার মুখে একটাই কথা সে জানতে চায় তার ছেলের খুনি কে।আজ হয়তো কুহেলিকাকে মারবে নয়তো ছেলের খুনির নামটা শুনবে।বউ আর ছেলের শোকে যে পুরোপুরি পাগল বনে গিয়েছে সাফিন তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়।এই যে দাঁড়িগুলো অসমান ভাবে বেড়ে পুরো সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী লাগছে তাকে। চুলগুলো একেবারে অগোছালো, দাঁড়িগুলোও যেন কতদিন পরিষ্কার করা হয় না!আগে তো বেশ ভালোই লাগতো দাঁড়িতে তাহলে এখন এমন লাগে কেন!

কুহেলিকা সাফিনের সাথের ছেলেগুলোর সাথে কিছু কথা বলে ফোন হাতে নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের ফোনে টাকা পৌঁছে যায়।সাফিন নিরুদ্দেশ ছিলো এতোদিন।আজ হঠাৎ পাওয়ায় কুহেলিকার অনূভুতি কেমন তা অজানা। ছেলেগুলোকে চলে যেতে দেখে সাফিন চিৎকার করতে করতে বলে ওঠে,

—ওই তোমরা চলে যাচ্ছো কেন?আমি বলেছি তো আমি টাকা দেবো।শুধু সাহায্য করো!আমার ছেলেটা যে আমার কাছে ইনসাফ চায়।আমি জানতে চাই আমার ছেলের খুনি কে!

সাফিন কান্নায় ভেঙে পড়ে।কুহেলিকার মায়া হয়।তবে সাফিন এখন যেই অবস্থায় আছে তাকে দেখে পুরো সাইকো মনে হচ্ছে। কথা বার্তার ধরণ যে ওরকমই।আচ্ছা কুহেলিকা কি বেশি ভাবছে নাকি সাফিন অভিনয় করছে? কিন্তু কেউ এতো নিখুঁত অভিনয় করতে পারে! মানুষ ধোঁকা খেতে খেতে সত্যিকেও মাঝে মাঝে ধোকার চোখেই দেখে।

—জানতে চান কে আপনার ছেলের খুনি?

কুহেলিকার কথায় পিচঢালা রাস্তার ওপরে হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থাতেই অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।যেন বড্ড অসহায় সে। আচ্ছা সে যে বললো তার ছেলে ইনসাফ চায়। কিভাবে চায়?নাকি পুরোটাই তার কল্পনায় রটিত কোনো ঘটনা!আচ্ছা এমষ যদি হয় যে কোনো একদিন চোখ খুলে নিজেকে অন্য কোথাও অন্য কারো পরিচয়ে যদি আবিষ্কার করতে হয় তখন কি করবে কুহেলিকা!আত্মা কেঁপে ওঠে। এমনিতেই তো এই জীবনে এতো জটলা,যদি তার ভাবনার মতো কোনো ঘটনা ঘটে সে তো বেঁচে থেকেই পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে!

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে