দুই পথের পথিক পর্ব-১৫+১৬

0
128

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৫
#বর্ষা
সাইক্রাটিস্টের সাথে কথা বলছে কুহেলিকা।সাফিনের মেন্টাল হেলথ নিয়েই কথা চলছে অবশ্য।চল্লিশ বছর বয়সী সাফিন ওসিডি রোগে আক্রান্ত বলেই টেস্টে জানা গিয়েছে।কুহেলিকা কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চায় না বিধায় বোন জামাইকে সাইক্রাটিস্টের সরণাপন্ন করে সাফিনের ফুফি সোহাগী বেগমকে জানিয়েছে। অবশ্য তাদের আসতে ঢের দেরি‌।তাই কুহেলিকা ডক্টর মালহোত্রার সাথে কথা বলছে।

—ডক্টর এই ওসিডি রোগটা কি যদি খুলে বলতেন.

—ওসিডির পূর্ণরুপ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার। নিশ্চই এর পূর্ণরুপ শুনেই বুঝে ফেলেছেন এই রোগটা কেমন হতে পারে।ছয় বছর বয়স থেকে যেকোনো বয়সে নর-নারী, শিশু যে কারো হতে পারে।যেহেতু আপনি বললেন মিষ্টার সাফিন অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে তার ছেলে সিনানের মৃত্যুর পর থেকে, সেহেতু ধারণা করা হয় সাফিন সেই আঘাতেই ওসিডিতে আক্রান্ত হয়েছে।

ডক্টরের কথায় কুহেলিকা মাথা ঝাঁকায়।সে বুঝেছে।তবে প্রশ্ন জাগে সাফিন কি আর সুস্থ হতে পারবে?তাই কুহেলিকা সময়ব্যয় না করেই বলে ওঠে,

—আচ্ছা ডক্টর সাফিন স্যার কি সুস্থ হবেন?

—সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেকে ছয়মাসে একেবারে ভালো হতেও পারে।আবার অনেকে ভালো হওয়ার পর আবারও আক্রান্ত হয় এই রোগে।যারা সুস্থ হয় না তাদের ঔষধ খেয়ে আর থেরাপি নিয়েই স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হয়।

কুহেলিকার ফোন বেজে ওঠে।এক্সকিউজ মি বলে সরে আসে কুহেলিকা।তার ম্যানেজার ফোন দিয়েছে। ম্যানেজারের ফোনে ভ্রু কুঁচকে যায় কুহেলিকার।সময় দেখে নেয়।এসময় তো ফোন দেওয়ার কথা নয়!ফোন রিসিভ করতে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওপাশ থেকে ইংরেজি ভাষায় গটগট করে ম্যানেজার বলতে থাকে,

—ম্যাম নাহিন স্যার সিঙ্গাপুর নেই।এমনকি কানাডাতেও ব্যাক করেননি। বরং তিনি গতকালই বাংলাদেশে পৌঁছেছেন।

কুহেলিকার কপালে চিন্তান ভাঁজ পড়ে।যদি নাহিন বাংলাদেশে এসেও থাকে তাহলে সে কোথায় গেলো!আর আসবে তা তো একবারও জানালো না তাকে।সে শান্ত মস্তিষ্কে বলে ওঠে,

—নাহিনকে বলো না যে আমি জানি ও সিঙ্গাপুরে নেই।আর তোমার সাথে যে আমার কথা হয়েছে তাও যেন কেউ না জানে।

—আচ্ছা ম্যাম।

কুহেলিকা ফোন কেটে দেয়। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে।তবে হঠাৎ করে মেয়েলী কন্ঠের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরকে যায় সে।শব্দের উৎস খুঁজতে সেদিকে যায়।পঞ্চাশের বেশি হবে এমন বয়সী মহিলা নার্সদের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন।কুহেলিকাকে দেখে নার্স কিছু একটা দেখায় মহিলাকে।ছুটে এসে কুহেলিকার দুই হাত ধরে ঝাকুনি দেয়।বলে ওঠে,

—আমার সাফিন পুত্তার কই?তুমি না আমারে ফোন দিছিলা।আমার ভাতিজা কই?

কুহেলিকা পর্যবেক্ষণ করে মহিলাটিকে।মুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট।চোখে অশ্রুকণা চিকচিক করছে।কন্ঠটাও কান্নায় মোড়ানো।পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শার্ট প্যান্ট পড়া ষাটোর্ধ্ব একজন পুরুষ আর সাফিন স্যারের কিছুটা কমবয়সী একজন লোক।কুহেলিকা বলে ওঠে,

—সাফিন স্যার ওভজার্ভেশনে আছে।

—সাফিন ভাইয়ের কি হইছে?

কুহেলিকা ছেলেটার দিকে তাকায়।হয়তো ছেলেটা ইতস্ততবোধ করে এতে।কুহেলিকাও বিষয়টা বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়,মুখে কিছু বলে না।তবে ছেলেটা পরিচয় দিতে বলে ওঠে,

—আমি সাফিন ভাইয়ের ফুফাতো ভাই নোমান আহসান। মিরপুরে ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট আছে।আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।

—আমি কুহেলিকা চৌধুরী। সম্পর্কে কায়ফা মির্জার বোন।

—আপনার সম্পর্কে আগে শুনিনি তো তাই চিনতে পারিনি।তা একটু পরিষ্কার করে বলুন তো কি হইছে সাফিন ভাইয়ের আর ভাবী,ছটু ওরাই বা কোথায়?

কুহেলিকা শুনে অবাক হয় যে সাফিন স্যারের আত্মীয়রা জানেই না যে কায়ফা,সিনান আর নেই।কুহেলিকা নিজের অবাকত্ব আড়াল করে বলে ওঠে,

—কায়ফা আপু প্রায় তিন সপ্তাহ আগেই পরলোক‌ গমন করেছেন।আর তার একসপ্তাহ পরেই সিনান…!আর একসাথে দুইটা শোক স্যার সহ্য করে উঠতে পারেননি হয়তো তাই ওসিডি রোগ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে ভেতর থেকে।

—কি কায়ফা,সিনান মারা গেছে মানে?

পঞ্চাশোর্ধ মহিলার মাঝে ফুটে উঠে কৌতুহলের রেখা।তার মাঝে দুঃখের চেয়ে যেন কৌতুহল বেশি।কুহেলিকার মনে হচ্ছে এনারা যতটা মোহাব্বত দেখাচ্ছে ঠিক ততটা এনারা নন।তবুও কুহেলিকা সম্পূর্ণ ঘটনা আবারো শোনায় তাদের যা সবাই জানে ঠিক তেমন করেই।

***

নাহিনের বিছানায় শুয়ে আছে লামিয়া।এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য তবে বয়সে সে অষ্টাদশী রমনী।গায়ের রক্ত দুধে আলতা।তবে পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ।পোশাক-আশাকে বিদেশী ভাব তবে কেরেক্টার যে খুব একটা ভালো নয় নাহিন তা এই একদিনেই বুঝে ফেলেছে।কালকে থেকেই নাহিনের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি কেমন বেহায়াপনা করছে ছিঃ!

—এই মেয়ে তুমি আমার ঘরে কি করছো?

ডিনার শেষে মাত্রই ঘরে ফিরেছে নাহিন। বিছানায় নজর যেতেই রাগে শরীর রি রি করে ওঠে তার। বর্তমান যুগের মেয়েগুলো এতো বেহায়া কেন?নাহিনের মনে একবার এমন প্রশ্নের উদয়ন ঘটে তবে পরমূহূর্তেই মনে পড়ে সব মেয়ে তো বেহায়া না,কিছু কিছু মেয়ে পারিবারিক শিক্ষার অভাবে, সুস্থ পরিবেশের অভাবে বেহায়া হয়ে উঠছে।

—কথা কানে যায় না?

নাহিনের চিৎকার এবার যেন কেঁপে ওঠে লামিয়া।দ্রুত শোয়া থেকে বসে পড়ে।বলে ওঠে,

—আপনার যদি কিছু লাগে তাই দেখতে এসেছিলাম।

—আমার কিছু লাগবে না।বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে।

নাহিনের কথায় লামিয়া বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে যেতে নেয়।নাহিন বিড়বিড় করে কিছু কথা বলে লামিয়াকে দাঁড় করিয়ে বলে ওঠে,

—আমার রুমের আশেপাশেও যেন আর তোমাকে দেখতে না পাই মনে থাকে যেন।

—আপনার রুমের পাশ দিয়েই তো নিচতলায় যাওয়ার সিঁড়ি।তাহলে নিচতলায় যাবো কিভাবে?

নাহিন লামিয়ার মুখের ওপরেই দরজা লাগিয়ে দেয়।নাহিনের ভাবতেও অবাক লাগছে একই স্থানে বড় হয়েও জিনিয়া আর লামিয়ার মাঝে কত ফারাক।জিনিয়া কত ভদ্র, সহজ-সরল আর এই মেয়েটা আস্তো একটা বেহায়া।

বিছানার চাদর উঠিয়ে ময়লা কাপড়ের ওখানে রেখে আরেকটা চাদর বিছিয়ে নেয় সে। নিজের দেহে যাতে অন্য কোনো রমনীর দেহের গন্ধও না ছোঁয়া লাগে তাই এই প্রচেষ্টা।বোন হলেও এই মেয়ে যে তাকে ভাই মানে না তা এই মেয়ের কাজেই প্রকাশিত। ভাই-বোনের সম্পর্ক হয় বন্ধুর মতো আর যা লামিয়ার কর্ম দেখেই মনে হচ্ছে অসম্ভব।

নাহিন মোবাইল হাতে কল লাগায় তার কাঙ্খিত রমনীর কাছে। মুহূর্ত দুই বাদেই কল রিসিভ হয়।যেন তার কলের জন্যই অপেক্ষায় ছিলো সে।কুহেলিকা নিজের রাগ,চিন্তা,অভিমান গোপন করে বলে ওঠে,

—কেমন আছো?
—আলহামদুলিল্লাহ।তুমি কেমন আছো?
—আছি ভালোই।কি করছো?
—বিছানায় সুয়ে পড়লাম। তুমি?
—মাত্র বাসায় আসলাম।
—কুহেলিকা তুমি বড্ড বেখেয়ালে হয়ে উঠছো দিনকে দিন।কত রাত হয়েছে সেদিকে খেয়াল আছে!
—কাজ ছিলো তাই দেরি হয়েছে।আচ্ছা শুনো ফ্রেশ হয়ে ফোন দিবো।
—শুধু ফ্রেশ হয়ে না বরং ডিনার কমপ্লিট করে তারপর।রাখছি।

নাহিন কল কাটতেই কুহেলিকার চোখ পড়ে ড্রয়িংরুমে বসে থাকা জুলফিকারের দিকে।এইটা তো সেই ইন্টার্নটা। এখানে কি ওর?আর রুমানা আফরোজই বা কেন এতো সেবা সুশ্রসা করছে এর!কুহেলিকা এগিয়ে যেতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে কায়েস মির্জা।কুহেলিকাকে দেখে তিনিই নিজ থেকে বলে ওঠেন,

—কুহু এই হলো জুলফিকার তোমার ….

কায়েস মির্জা কথা সম্পন্ন করার পূর্বেই কারেন্ট চলে যায়।কুহেলিকার নিউরনগুলো দ্রুত কাজ করতে থাকে।এইপাশটায় তো কখনো কারেন্ট যায় না।তাহলে হঠাৎ কি করে আজই কারেন্ট গেলো!কোনো বিপদ আসছে কি!

কুহেলিকার আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝেই জেনারেটর সাপ্লাই চালু হয়ে যায়।একদম কুহেলিকার সামনাসামনি জুলফিকার দাঁড়িয়ে।কুহেলিকা ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে।একেই মনের ভেতরকার ভয় তারওপর আরেক মুসিবত যে কেউ ভয় পাবেই।কথায় আছে মানুষকে মারতে হলে তার জীবন কেড়ে নিতে হয় না বরং তাকে ভীত করতে হয়।আর একবার যে ভীত হয়ে পড়ে সে জীবিত থেকেও মরার ভয়ে মৃতদের তালিকায় পৌঁছে যায়।

চলবে কি?

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৬
#বর্ষা
জুলফিকারের পরিচয় জেনে একটু নয় বরং প্রচন্ড অবাক হয়েছে কুহেলিকা। জুলফিকার আর কেউ না বরং ওর ভাই হয় সম্পর্কে।কায়েস চৌধুরী আর রুমানা আফরোজের ছেড়ে যাওয়া বড় ছেলে।কুহেলিকার বিশ্বাস হয় না যে এই ছেলে তাদের ছেড়ে গেছে। বরং ওর মনে হচ্ছে যে হয়তো কায়েস চৌধুরী আর রুমানা আফরোজ পরিকল্পনা করেই ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।

খাবার টেবিলে বসে জুলফিকার জুনায়েদের সাথে বকবক করছে।কুহেলিকা দোতলার করিডোর থেকে দেখে। সিঁড়ি বেয়ে ডাইনিংরুমে চলে আসে। কুহুকে দেখেই থেমে যায় ওদের বকবক করা। জুলফিকার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,

—ম্যাম গতকালকে আপনি অফিসে আসলেন না কেন?

—আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?

কুহেলিকা প্লেট উল্টিয়ে খাবার নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে। জুলফিকার নিম্ন আওয়াজে সরি বলে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।একটু পরই রামায়সা ছুটে এসে কুহেলিকার কোলে বসতে চায়।এতদিনে ফিরেছে তাহলে পুচকিটা। অবশ্য খালার বিয়েতে যাবেনা তো কি করবে!

রোহানী পাগলামি শুরু করেছিলো।রাইসা বোনকে কান ধরে বাবার বাড়ি নিয়ে গেছে। জোরজবরদস্তিতে রোহানীরই বয়ফ্রেন্ড লুকাসের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। অবশ্য এবাড়ির সবাই আমন্ত্রিত ছিলো।তবে কেউই যায়নি।কুহেলিকা এ বিষয়ে বেশি কিছু জানেও না।রামায়সাকে কোলে তুলে নেয়। জুনায়েদ আড়চোখে দেখে।কুহেলিকার নজর এড়ায়নি বিষয়টা।কুহেলিকা জানে একদিন এই বাচ্চাটাও ওকে ঘৃণা করবে ওর বাবাকে শাস্তি পাইয়ে দেওয়াতে।

—রামায়সা কেমন কাটলো মামনির বিয়ে?
—খুব ভালো। কিন্তু ওরা আমার মামনিকে নিয়ে চলে গেলো।
—এটাই যে নিয়ম মামনি।
—তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যাবে?
—হুম।
—পিপি প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না।
—আমি তোমায় ছেড়ে যাবো না।তোমায় নিয়ে যাবো ঠিক আছে?
—পাপাই,মাম্মামও যাবে?
—উমম না। শুধু তুমি আর আমি।

কুহেলিকা খেতে খেতে রামায়সার সাথে দুষ্টুমি করতে থাকে।আর রামায়সাকেও একটু করে খাইয়ে দেয়।কুহেলিকার ছোট থেকেই বাচ্চা পছন্দের।ষোড়শী বয়সে বান্ধবীদের বলতো দেখিস আমি আঠারোতে বিয়ে করে ঊনিশে মা হবো। ছোট্ট দেহটাকে নিজের মতো করে বড় করবো।

রামায়সা চলে যায় রাইসার কাছে।একটা বাচ্চা খুব করে হলে কিছু সময়ই মা’কে না দেখে থাকতে পারে।তারপর সে প্রচন্ড রকম ভীত হতে শুরু করে, কাঁদতে শুরু করে। বুকের ভেতর কেমন যেন করে ওঠে।যেমনটা মায়ের ভেতরেও হয়। বারবার বাচ্চাটার জন্য চিন্তা হয়।

কুহেলিকা ঘরে চলে আসে।সকাল সকালই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হবে।নাহিনের বর্তমান লোকেশন ওর জানা।ফোন ট্রাক করেছে। মুফতি গেটে এসে ফোন দেয়। এয়ারপোর্ট অব্দি যাবে সে।কুহেলিকা ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে আসার সময় কায়েস মির্জাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

—আমি ঢাকা যাচ্ছি।চার-পাঁচদিন ঢাকাতেই থাকবো।আমায় নিয়ে ভাববেন না।

কুহেলিকা কিছু শোনার অপেক্ষা না করে দ্রুত পায় বেরিয়ে আসে।বাইকে উঠে বসে।তবে মুফতি আর নিজের মাঝে কাঁধের ব্যাগটা রাখে।বাইক চলতে শুরু করে। মুফতি বলে ওঠে,

—কিরে পাগল এতো সকাল সকাল ঢাকায় তোর কাজ কি?

—আছে কিছু কাজ।

—ওই বিয়াত্তা মহিলা শোন আমারে একটা গার্লফ্রেন্ডের ব্যবস্থা করে দে।

কুহেলিকা চিমটি দেয় মুফতির ঘাড়ে।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

—আমি বিয়াত্তা? তুই বিয়াত্তা,তোর তোর তোর গার্লফ্রেন্ড বিয়াত্তা।

—বিয়াত্তা মানে জানোস?

কুহেলিকা ডানে বামে মাথা নাড়ায় অর্থাৎ সে জানে না। মুফতি বাঁকা হেসে দুষ্টামি করে বলে ওঠে,

—বিয়াত্তা মানে হচ্ছে যেই মেয়ে অবিবাহিত জীবনের মতো বিবাহিত জীবনেও আগের মতোই থাকে।

—ওহ,আচ্ছা তাহলে অবিয়াত্তা মানে কি উল্টো হবে?

মুফতি বাইক থামায়। গাট্টা মেরে বলে ওঠে,

—এজন্যই বলি বিদেশ গিয়ে ধলাদের মধ্যে বড় না হয়ে দেশে থাক। সব কিছুর মানে শিখবি।আমি মজা করে বলছি আর তুই সিরিয়াস নিয়ে বসে আছিস!স্টুপিড।

কুহেলিকা কিছু বলে না।যেই শব্দ আগে শুনেনি সেই শব্দ বলবেটা কি করে। অবশ্য শুনলেও যে তার মনে নেই।কুহেলিকা খেয়াল করে এয়ারপোর্টের সামনেই বাইক থামিয়েছে মুফতি।কুহেলিকা বিনা শব্দব্যয়ে এয়ারপোর্টে ঢুকে যায়।

ফ্লাইটে ওঠার আগে কুহেলিকা ফোন দেয় তানজিল চৌধুরীকে।একবার ,দুইবার, তিনবার ফোন দেয়।রিসিভ হয়না।চিন্তা লাগতে লাগতে কুহেলিকার।তখন ফোনটা বেজে ওঠে কাসফিয়া চৌধুরীর ফোন।কুহেলিকা রিসিভ করে।

—কুহু ব্যস্ত তুমি?
—না তবে ফ্লাইটে উঠবো একটু পর।কেন?
—না মানে আজকে আমার বাসায় তো পার্টি আর তুমি থাকবে না তা ভেবেই খারাপ লাগছে।
—দুঃখিত আমি তো ঢাকা যাচ্ছি।আপনারা ইঞ্জয় করুন।
—আচ্ছা সাবধানে যেও।

কাসফিয়া চৌধুরী কল রেখে নাহিদ খান আর তানজিল চৌধুরীর দিকে তাকায়।তানজিল চৌধুরী বোনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে বলে ওঠে,

—কি হইছে আপা?
—কুহেলিকা ঢাকা যাচ্ছে আসতে পারবে না।

তানজিল চৌধুরী অবাক হয়।তার মেয়ে ঢাকায় যাচ্ছে আর সেই জানে না।ফোন হাতে নেয়।মেয়ের তিনটা কল। সর্বশেষে ম্যাসেজ।”আব্বু ঢাকায় যাচ্ছি।চার-পাঁচ ঢাকাতেই থাকবো।এদিকটা তুমি সামলে নিয়ো।আর ঢাকায় চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি আবারো রিওপেন করবো।সব প্ল্যান ফিক্সড ”

তানজিল চৌধুরী ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।মোবাইল চুরি হলেও ভয় নেই।তিনবার পাসওয়ার্ড ভুল হলে মোবাইল একাই লক হয়ে যাবে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট,ফেস সেন্সর ছাড়া আর খোলা যাবে না।পার্টি ইঞ্জয় করতে থাকে।বহুদিন এমন পার্টিতে আসা হয়না তার। সাংবাদিক পেশাতেই ঢুবে ছিলো এতদিন।

কুহেলিকা ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যায় ঢাকাতে। উদ্দেশ্য নাহিন।ওভার বুক করার দশ মিনিটের মাঝেই চলে আসে।কুহেলিকা আধাঘণ্টার দূরত্বের একটা এড্রেস দেয়।গাড়িতে গা এলিয়ে দেয়।

নাহিন সকালে উঠেই রান্না ঘরে ঢুকেছে।মায়ের জন্য নিজে থেকে কিছু বানাচ্ছে।তার সন্দেহ মায়ের খাবারে কিছু মেশানো হচ্ছে যার কারণে সে নিজেই এখন খাবার বানাতে এসেছে।

—ভাইয়া কি করছো?

জিনিয়ার কন্ঠে সেদিকে তাকায় নাহিন।ফর্মাল ড্রেসে জিনিয়া।হয়তো অফিসে যাবে।নাহিন মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে,

—এইতো বনু মায়ের জন্য খাবার বানাচ্ছি।

—আম্মু,চাচি তো সকালের খাবার বানিয়েছে ভাই।

জিনিয়ার কথায় কিছুই বলে না নাহিন।ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে ওঠে।কুহেলিকার ফোন।জিনিয়ার চোখ এড়ায়না বিষয়টা।ভাইকে প্রাইভেসি দিতে রান্না ঘর ত্যাগ করে বিদায় জানিয়ে।কল রিসিভ করতেই কুহেলিকা বলে ওঠে,

—বাইরে আসো দ্রুত।

নাহিন কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।তার পূর্বেই কল কেটে দেয় কুহেলিকা।নাহিন দ্রুত বেরিয়ে আসে।কুহেলিকাকে দেখে চমকে ওঠে, আঁতকে ওঠে।এই বাড়িতে কিছুতেই রাখা যাবে না ওকে।এই বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো নারীদের খুবলে খায়!

—কুহু তুমি এখানে?
—বাহরে শশুর বাড়িতে আসবো না?
—কুহু আমি তোমাকে পরে সব খুলে বলবে। তুমি এখান থেকে চলে যাও প্লিজ।জায়গাটা তোমার জন্য বিপদজনক।
—ওয়াদা করেছিলাম সবসময় তোমার পাশে থাকবো।
—এখন এই ওয়াদা মানতে হবে না।আগে তোমার সেফটি।

কুহেলিকা নাহিনকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় বাড়ির।নাহিনের সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা জানলো কিভাবে যে সে এখানে!নাহিন বুঝে ফেলে এই ঘাড় ত্যাড়া মেয়েকে এখান থেকে সরানো সম্ভব না।তাই ঘাড়ের ব্যাগ খুলে নিজের হাতে নিয়ে নেয়।ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো জারিফ,জিদান‌।বসে বসে কফি খাচ্ছিলো।জিদান বসেছিলো সদর দরজার মুখোমুখি।

—ভাই মা*টা কিন্তু অস্থির।তবে কে এইটা?

জারিফ পেছন ফিরে তাকায়।হাত-পা কাঁপতে থাকে তার।মাসও হয়নি এখনো।এই মেয়েটা তাকে হাত পা বেঁধে যে বেধড়ক মার মেরেছে সেদিনের পর আর মেয়েদের তাকানোর সাহস হয়নি।

অতীত,,,

জারিফ সেদিন ফুটপাতের এক পাগলের সাথে খারাপ কাজের চিন্তা করছিলো।আর তখনই কুহেলিকা কোথা থেকে এসে যেনো মাথায় বারি মারে।মাটিতে ব্যথায় লুটিয়ে পড়ে জারিফ। মূহূর্তেই হাত পা বেঁধে ফেলে কুহেলিকা।আরো কয়েকজন ছিলো সেখানে‌।সবাই মিলে বেধড়ক মার মেরে তাকে লেকের ওখানকার ফুটপাতে ফেলে আসে। ভাগ্যক্রমে পুলিশ টহল দিতে এসে তাকে দেখে।নয়তো সেদিন যে কি হতো!এখনো মনে পড়ে কুহেলিকার বলা কথাগুলো,,

”তোদের মতো জানো**দের কারণে ফুটপাতের এই পাগলেরাও মা হচ্ছে। অপবিত্র হচ্ছে তোদের দ্বারা।আর যদি কখনো কারো দিকে তাকাস চোখ উপরে ফেলবো”

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে