দুই পথের পথিক পর্ব-১৭

0
130

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৭
#বর্ষা
কুহেলিকাকে দেখে সবার মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে।তবে কাউকেই যথাযোগ্য জবাব দিচ্ছে না নাহিন। কেননা তার মনেই প্রশ্ন ঘুরছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী কি করে জানলো যে এটাই তার শশুরবাড়ি!কুহেলিকা হাসি হাসি মুখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।সোফায় বসে আছে।নাহিন রান্নাঘরে গেছে।কুহেলিকা সেদিকেই তাকিয়ে। হঠাৎ গানের শব্দ পেয়ে উপরের দিকে তাকায়।শর্ট টপস আর জিন্স পরিহিতা কমবয়সী একটা মেয়ে নামছে।টপসটা একেবারে আঁটসাঁট।কুহেলিকার রুচিতে লাগে লামিয়াকে দেখে।মুখ ফিরিয়ে নেয়।

”জুসটা খেয়ে নেও ভালো লাগবে”

নাহিনের কথায় কুহেলিকা জুসটা নেয়। নাহিন ফিরতে ঘুরতে নিলেই লামিয়া এগিয়ে আসে সেদিক দিয়ে।কুহেলিকা নাহিনের হাত টান দেয়। সোফায় ধপ করে বসে পড়ে নাহিন।আর লামিয়া সে তো মেঝেতে পড়েছে।কুহেলিকা খিলখিলিয়ে হেসে দেয়।তবে পরমূহুর্তেই হাসি থামিয়ে গরম চোখে তাকায় নাহিনের দিকে।আর এদিকে লামিয়াও খেপে কুহেলিকাকে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই নাহিন কুহেলিকাকে পাঁজাকোলা করে দোতলায় নিজের রুমে নিয়ে আসে।

ড্রয়িংরুমে বসে সবই দেখছিলো বাড়ির লোকেরা।জারিফ তো ভয়ে ভয়ে কোনো মতে ডাইনিং এ এসে বসেছে কেননা এই মেয়ে যা গুন্ডি!জিদান ছ্যাচড়ার মতো এখনোও সেদিকেই তাকিয়ে।রাকিব গিয়ে বোনকে সোফায় তোলে।বড় ভাই বাবা মরার পর বাবার শেয়ারের ব্যবসার দেখাশোনা করে। সামনের সপ্তাহে বিয়ের পীড়িতে বসতে চলেছে সে।

—বনু ঠিক আছিস?(রাকিব)
—ভাই ওই মেয়েটার কারণেই আমি পরে গেছি।আর দেখেছো নাহিন আমাকে কোলে না নিয়ে ওই মেয়েটা কোলে তুলে দোতলায় নিয়ে গেলো।(লামিয়া)
—দোষ তো তোরই কেন গিয়েছিলি নাহিনের কাছ দিয়ে?দূর দিয়ে গেলেই তো পারতি।তোকে তো বারণ করা হয়েছে নাহিন ভাইয়ের থেকে দূরে থাকতে।আর কি নাহিন নাহিন করিস?নাহিন ভাই বলবি ওনাকে।(রাকিব)
—আজ আব্বু থাকলে তোমরা আমায় বকার সাহস পেতে না।আজ আমার আব্বু নেই দেখে কেউ ভালোবাসে না আমায়।

লামিয়া কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়।রাকিব দীর্ঘশ্বাস নেয়।বোন এই কথা বলতে পারে দেখে শাসন করেনি কখনো।আর সে বোন আজ বলছে তাকে নাকি কেউ ভালোবাসে না।রাকিব ডাইনিং এ ফিরে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে যায়। রাকিবের মায়ের আশকারাতেই মেয়ের এই অধঃপতন।টেবিল থেকে মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে উঠে চলে যান তিনি।

—ঢং

রাব্বি মুনতাসির ব্যাঙ্গ করে বলে ওঠেন।খুব কম কথা বলা লোকটা যখন কথা বলেন তখন মুখ দিয়ে বিষই বের করেন। অবশ্য তা শুধু পরিবারের মানুষগুলোই জানে।বাইরে তো তিনি দয়ালু,পবিত্র মানুষ সেজে বেড়ান।

কুহেলিকাকে রুমে নিয়ে বিছানা রাখে নাহিন।কুহেলিকার তো শ্বাস ওটা নামা করছে।এতো কাছে কখনো আসা হয়নি তাদের এতো বছরেও।নাহিন কুহেলিকা বিছানায় রাখতেই কুহেলিকা তাকে টান দেয়।নাহিনও বিছানায় পরে যায়।তবে কুহেলিকা সরে গিয়ে হেসে দেয়।

খুনসুটিতে মেতে ওঠে দুজনে।বালিশ নিয়ে কিছুক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি করে।তারপর কুহেলিকা শান্ত হয়ে বসে পড়ে।নাহিনও পাশে এসে বসে।নাহিন কুহেলিকার কপালে চুম্বন করে।কুহেলিকা কিছুক্ষণ নিরব থেকে জোরে করে বালিশ নাহিনকে আঘাত করে।নাহিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

—কি হয়েছে এভাবে তাকাও কেন?(কুহেলিকা)
—মারলে কেন?(নাহিন)
—তোমার সাথে ওই মেয়ের এতো কিসের মোহাব্বত?(কুহেলিকা)
—কার সাথে কিসের মোহাব্বত?(নাহিন)
—ওই যে মেয়েটা নিচে পড়লো।(কুহেলিকা)

নাহিন ভাবে।ভাবতেই পেয়ে যায় কুহেলিকা হয়তো লামিয়ার কথা বলেছে।নাহিন মজা করে বলে,

—দেখে আমি কত সুদর্শন আসতে না আসতেই মেয়েরা লাইন লাগিয়েছে বাসায়।

নাহিনের কথায় ক্ষেপে যায় কুহেলিকা।একেবারে নাহিনের ওপর হামলে পড়ে বলে ওঠে,

—একেবারে খুন করে ফেলবো।
—কাকে?(নাহিন)
—আপনাকে।(কুহেলিকা)
—আমাকে খুন করবে কেন?(নাহিন)
—আপনার দিকে মেয়েরা তাকাবে কেন?(কুহেলিকা)
—এখানে কি আমার দোষ নাকি?(নাহিন)
—অবশ্যই।তোমার দিকে কেউ তাকাবে কেন!(কুহেলিকা)
—আচ্ছা একটা বিষয় বুঝলাম না তুমি আমাকে একসময় তুমি তো আবার একসময় আপনি বলো কেন?(নাহিন)

কুহেলিকা উত্তর না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকে। অবশ্য সেও কখনো চিন্তা করেনি এ বিষয়ে।তবে নাহিন তাকে থাকতে দেয় কতক্ষণ?নাহিন বলে ওঠে,

—এই এখন তো সকাল দশটা বাজে। তুমি কি খেয়ে এসেছো নাকি খাবে?

কুহেলিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে রাগি কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,

—আমার ব্যাগ এনে দেও। আমি শাওয়ার নিবো।
—তুমি ওয়াশ রুমে যাও আমি ব্যাগ আনছি।

নাহিন রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ডাইনিং রুমে গিয়ে মাকেও সেখানে দেখে।নাহিন ব্যাগ কাঁধে নিয়েই মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,

—আম্মু তোমার আরেক মেয়ে এসেছে।দেখবে তোমার মেয়েকে?

আবেগপ্রবণ হয়ে নাসরিন সুলতানা ছুটে আসেন।মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝান তিনি দেখবেন।নাহিন মা’কে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়।ফাতেমা বেগম ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকেন।তবে তাতে লাভ হয় বলে মনে হয় না।

***

চট্টগ্রামে আজ রাত অন্যরকম।চৌধুরী ভিলায় প্রেসদের আস্তানা হয়েছে। স্বনামধন্য সব সংবাদমাধ্যম উপস্থিত সেখানে।তারা জানতে চায় গতকাল মধ্যরাতে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির মানে কি।সত্যিই কি জুনায়েদ কোহিনুর চৌধুরীর খুনি!

পেনড্রাইভ এখন পুলিশের হাতে।তবে তা কপি।সত্যিকারেরটা আদালতে দেওয়া হবে বলেই জানানো হয়েছে।জুনায়েদের মা তো কেঁদে কেটে অস্থির।এতো বছরের পুরনো খুনির শাস্তি কি এখন পাবে সে!কাসেম মির্জা একসময় লয়ার ছিলেন।তাই ছেলের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে নিজেও ফেসেছেন।অপরাধ কারী আর অপরাধ করতে সাহায্যকারী যে সমান অপরাধী।
তিনি বলেছিলেন,

”অতীতে যখন জুনায়েদ খুন করেছিলো তখন তো সে আঠারো বছরেরও কমবয়সী ছিলো,তরুণ ছিলো।আর তখন শাস্তি পেলে তো শাস্তিটা কম হতো।তবে এখন যে তা বহু বছরেরও বেশি হবে শাস্তি ”

পুলিশ বুঝে ফেলেছিলো কাসেম মির্জা আগে থেকেই সব জানতো।তবুও এতবছর লুকিয়ে রেখেছিলো খুনের কথা।জাহিদ তো পুরোপুরি গা ঢাকা দিয়েছে।ভয়ে গায়ের লোম তার খাঁড়া হয়ে গিয়েছে।তাইতো মনের ভয়ে লুকিয়েছে।জয়নুবা বেগম একসাথে দুই শোক সইতে পারলেন না।স্বামী আর পুত্র উভয়েই পুলিশি হেফাজতে।স্ট্রোক করে বসেন তিনি।

—জয়নুবা?

কাসেম মির্জা স্ত্রীর কাছে ছুটে আসতে চেয়েছিলো।তবে পারেনি।পুলিশ বাহিনী হাতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে টেনে বাপ ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে।আর ব্রেকিংনিউজ করছে সাংবাদিকেরা।

***

তানজিল চৌধুরী পায়ের ওপরে পা তুলে হাসছেন।হাসতে হাসতেই তিনি কেঁদে ফেলেন।বুকটা তার ভার হয়ে উঠেছে।জীবন মানে কি শুধুই কষ্ট?না,হয়তো সে আগে তার ভাগের সুখের অংশটুকু উৎযাপন করে ফেলেছে!মেয়ের ছবিটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন তিনি।মেয়েটাই তো এখন সম্বল তার।

তানজিল চৌধুরীর কাছে ফোন আসে স্বনামধন্য এক সংবাদ মাধ্যম থেকে।অপর পাশের ব্যক্তিটি তাকে সম্মান দেখিয়ে বলে ওঠে,

”স্যার আপনার কারণে আজ অনেক বড় সত্য সকলের সামনে আসলো।আপনাকে যে আমাদের সংবাদমাধ্যমে প্রয়োজন তাহলে আমরা সাহসিকতার সাথে সকল অন্যায়কারীদের সত্য ফাঁস করতে পারতাম।”

তানজিল চৌধুরী কিছু বলেন না।কল কেটে দেয়।আবদ্ধ রুমের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে সে।যা চারদেয়ালের মাঝেই ঘুরপাক খেয়ে তাকে আঘাত করে।তানজিল চৌধুরীর মনে হচ্ছে যে,প্রিয়তমা স্ত্রী ডায়ানা তাকে উদ্দেশ্য করে বারবার বলছে তানজিল তুমি বাবার খুনের শাস্তি তো দিলে তবে আমার খুনীকে এখনো ধরলে না।আমি কি তোমার কাছে ফেলনা?তাহলে কেন লাগছে তোমার এতসময়!আমি যে ভালো নেই,আমার বড্ড খারাপ লাগে।

তানজিল চৌধুরী মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে বলে ওঠেন,

—ডায়ানা অপেক্ষা করো,আরেকটু অপেক্ষা করো।আমিও যে ভালো নেই।আমাদের মেয়েটাও তো ভালো নেই।আমি তো প্রমাণ জোগাড় করছি প্রিয়।আমিও যে চাই তোমার খুনি, আমাদের হাসি খুশি পরিবার ধ্বংসকারী যেন শাস্তি পায়।আমার আরেকটু সময় প্রয়োজন।আমি কাউকে ছাড়বো না প্রিয়।করায় গন্ডায় সবাইকে শাস্তি দিবো।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে