দুই পথের পথিক পর্ব-১৮

0
153

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১৮
#বর্ষা
”আম্মু,আম্মু দেখো তোমার ছেলে আমার সাথে কেমন করে?”
কুহেলিকার মাসুমিয়াতে যেন মাত্র একদিনেই নাসরিন সুলতানা সুস্থ হয়ে গেছেন পুরোপুরি।পরিবেশ ফ্যাক্ট নামক চিকিৎসার ফল।আমরা যদি অসুস্থ, অপরিষ্কার পরিবেশে থাকি তাহলে আমরা অনুভবও করবো তেমনটাই।তবে নিজেকে যদি ভালো পরিস্থিতিতে রাখার চেষ্টা করি তাহলে কিন্তু একটু হলেও সুস্থতা থাকে।ভালো পরিবেশ বলতে সুস্থ পরিবেশ যেখানে মানুষের মনে এক আর বাইরে আরেক নয়।

—নাহিন তুমি আমার আম্মাজানকে কি করেছো?
নাসরিন সুলতানা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন।নাহিন আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
—আম্মু আমার বউ তো আমার ঘরেই আসে না।
—নির্লজ্জ,বেহায়া কোথায় কি বলতে হয় তাও জানেন না!

কুহেলিকা কয়েকটা কথা শুনিয়ে দ্রুত নাসরিন সুলতানার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পথিমধ্যে দেখা হয় লামিয়ার সাথে।এইটা দ্বিতীয় দফায় দেখা।প্রথমদিনের পর আজকে আর দেখা হয়নি তাদের। এখনই হলো।কুহেলিকা এড়িয়ে যেতে চাইলে লামিয়া পথ আটকে বললো,
—বড়লোকের ছেলে দেখে লোভ সামলাতে পারোনি তাইনা?নাহিনকে নিজের রুপের আগুনে আটকেছো নাকি বিয়ের আগে নিজের সতি….

লামিয়া সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারে না।তার পূর্বেই কুহেলিকা কষে চড় লাগায়।লামিয়া উল্টো মারতে নিলে কুহেলিকা হাত ধরে ফেলে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,
—বয়স তো আঠারোও পেরয়নি এখনি কথার যা তেজ কয়দিন পর তো মেয়ে তোমায় কয়লা রুপে দেখতে হবে।সাবধানে থাকো, আগুনে নিজেকে জ্বালিয়ে মেরো না।
—মানে?

কুহেলিকা লামিয়ার হাত ঝাড়া মেরে ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।জারিফ দূর থেকে দেখছিলো।কাছে এসে লামিয়ার গালে কষে চড় লাগায়।লামিয়া রাগান্বিত হয়ে যায় জারিফকে দেখে। কেঁদে দেয় রাগে।জারিফ লামিয়ার গাল চেপে বলে ওঠে,
—কালকে তোকে কতবার বলছি যে এই মেয়ের সাথে লাগতে যাস না মেরে ফেলবে।তাও কেন তোর ওর সাথে লাগতে হবে!ভালো ভাবে থাকার চেষ্টা কর নয়তো আবারো সেখানে রেখে আসবো তোকে।

শেষের কথাটা জারিফ আস্তে বলে।লামিয়া কেঁপে ওঠে।ভয় যেন তাকে জেঁকে ধরে।মাথা চেপে ধরে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।জারিফের মুখে ভেসে ওঠে ক্রুড় হাসি।তবে তা হাসি মিলিয়ে সে কেটে পড়ে সেখান থেকে।
লামিয়া দরজা আটকে মেঝেতে বসে পড়ে। মাত্র কয়েকমাস সে বাসায় এসেছে।তার আগের দিনগুলো তো ছিলো আরো নির্মম। সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে মানসিক হাসপাতালে রোগী করে রাখা হয়েছিলো।প্রতিনিয়ত কি ছাইপাশ খাওয়াতো ওকে।জ্ঞান‌ হারিয়ে ফেলতো।তারপর জ্ঞান ফিরলে মনে হতো ওর শরীরের একপাশ কেউ কেটে ফেলেছে।সারাদেহে থাকতো দাগ।যেন জঙ্গলী লতাপতার ওপর টানা হয়ে ওকে।

লামিয়ার মনে পড়ে আরো দুঃখময় ঘটনা। বাকিদের সাথে বনিবনা করে থাকতে যে সে পারতো না। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হয়ে কিভাবে সে পাগলামি করবে তাদের সাথে!লামিয়ার জীবনে তিনটা বছর তো সেই পাগলা গারদেই শেষ হয়ে গিয়েছে।বুকের মাঝে তৈরি করে বিভৎস সব স্মৃতি।
লামিয়া মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে থাকে।এমনটা তাকে পাগলা গারদে থাকতে প্রায়ই করতো হতো।প্রায়ই তাদের শক দেওয়া হতো।তখন মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হতো যাতে চিৎকারের আওয়াজ বাইরে না আসে।

রাকিব হবু স্ত্রীর সাথে প্রেমালাপ করতে করতে রুমের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ দৃষ্টি আটকায় কুহেলিকার দিকে।অতি চেনা পরিচিত মুখ লাগে।তবে চিনতে পারে না সে।কুহেলিকা তাকানো মাত্রই চোখ চোখ পড়তেই রাকিব নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।

কুহেলিকার কাছে এই পরিবারকে বড্ড অদ্ভুত লাগে।আজকে সে নাহিনের থেকে জেনেই ছাড়বে কেন নাহিন তাকে এতদিন বলেনি তার পরিবার আছে,সে অনাথ না।আজ কুহেলিকা জানতে চায় সব না হলেও দুই একটা প্রশ্নের উত্তর।যদিওবা কুহেলিকা জানে সময় সব প্রশ্নের উত্তর দেয়।

নাহিন মায়ের সাথে কথা শেষে ঘরে এসে বউকে ভাবুক দেখে ভ্রু কুচকায়। অবশ্য এই বাজে অভ্যাসটা কুহেলিকার।নাহিন কুহেলিকার সামনে গিয়ে ধপ করে বিছানায় সুয়ে পড়ে।কুহেলিকার মাঝে ভাবান্তর দেখা যায় না।নাহিন এবার প্রশ্নই করে,

—কুহু কি হয়েছে?
—আপনি আমায় আগে কেন জানাননি যে আপনার পরিবার আছে?(কুহু)
—প্রয়োজনীয় ছিলো না তো।(নাহিন)
—পরিবারকে আপনি অপ্রয়োজনীয় বলছেন?(কুহু)
—আমার আম্মু ছাড়া সবাই আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়।(নাহিন)
—বাবাইও?(কুহু)
—হুম।(নাহিন)
—সব বাবা সন্তানের ভালো চায়।আর সে বাবাকে অপ্রয়োজনীয় বলছেন!(কুহু)
—আমার আব্বু কখনো আমাদের ভালো চায়নি।যদি চাইতো তাহলে নায়মা আপির অন্যায়কারীদের খোলা বেঁচে থাকতে দিতো না।(নাহিন)
—নায়মা আপি?(কুহু)
—শুনবে আমার জীবনের সবচেয়ে কালো গাঁথা?(নাহিন)

কুহেলিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।নাহিনের চোখে অনেক কথাই ঘুরছে। মস্তিষ্ক বলতে দ্বিধায় আছে।আর হৃদয় একাকী এই ভার বহনে বড্ড ক্লান্ত!এবার যে রেহাই চায়।নাহিন বলতে শুরু করে,

—আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন বাসায় ফিরে দেখলাম আমার আপি বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।আর তার চোখ গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।এতো করে জিজ্ঞেস করলাম কেউ বললো না আমার আপি কেন কাঁদছে।তখন কিন্তু সে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।ভালো মন্দ বোঝার বোধও তার হয়েছে।কোনো উত্তর না পেয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। সারাদিন আপার রুমের আশপাশ দিয়ে টইটই করলাম।না আম্মু একবার আপিকে কি জেনো‌ বুঝিয়ে গেলো সেও কাঁদল।আর কেউ আসেনি।

ঘটনা আমি জানতে পারলাম তখন যখন রাত প্রায় বারোটা।পানি তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙ্গে যায়।পাশের পানির গ্লাসটাও ফাঁকা।পানি খেতে বের হলাম। হঠাৎ ভেসে এলো কতগুলো কথা।আপির রুমে থেকেই আসছিলো।আমি চুপিচুপি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমি বিহীন সবাই ছিলো। চাচা আপাকে বলছিলো কিছু একটা গোপন করতে আর আমার গুণধর চাচাতো ভাইয়েরা‌ মেঝের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলো।আমি ভেবেছিলাম হয়তো হাস্যকর কিছু হচ্ছে সেখানে।যখনই ঢুকতে যাবো রুমে তখনই এমন একটা শব্দটা শুনলাম রুহ কেঁপে উঠলো।একটু হলেও বোধ শক্তি হয়েছিলো আমার‌ তখন।আপিই আমায় শেখাতো সব।ভালো মন্দের জ্ঞান দিতো।

আমার আব্বু ছিলেন বড় ভাই ভক্ত।পুরো ভক্ত না অন্ধ ভক্ত।আমি শুধু ছোট চাচুকেই দেখেছিলাম যিনি একটু অন্যরকম।বড় চাচাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন না, নিজের ইচ্ছায় সব করতেন।তো সেই ভাইয়ের অন্ধ ভক্তির ফায়দা লুটেন বড় চাচা।ভাইকে বলেন,ছেলেরে একটা ভুল করেই ফেলেছে এখন এসব বাইরে জানাজানি হলে মেয়ের সম্মানও যাবে।আবার ছেলেদের ভবিষ্যৎও খারাপ হবে।চাচার কথায় ছিলো স্বার্থপরতা।আপি বিরোধিতা করে সেদিন প্রথমবার সবার মুখের ওপর বলেছিলেন,আমার জীবন তো এমনিতেও শেষ হলে গেলো চাচা।তাই আমার মিথ্যে উছিলা দিয়ে নিজের মেয়ে লোভী ছেলেদের বাঁচাতে আসবেন না।সেদিন জোভান ভাই সকলের সামনেই বলেছিলো,ধর্ষিতা চুপ থাক।এখনো মুখেমুখে বড় বড় কথা।সেদিন না চাচী তাদের শাসন করেছিলো আর না চাচা।এমনকি আমার আব্বু উল্টো আমার আপিকে চড় লাগিয়েছিলো মুখেমুখে কথা বলায়।তিনি এতটায় অন্ধ ভক্ত ছিলেন যে নিজের হাতে যে নিজের মেয়ের অপরাধীদের ছেড়ে দিচ্ছেন বুঝতেই পারলেন না।আম্মু সেদিন শুধু কেঁদেছিলো।আমি সবই দেখেছিলাম তবে ভয় পেয়েছিলাম।কাউকে বলিনি আমি যে সব জানি। তিনদিন কাটলো সেই ঘটনার। হঠাৎ পরেরদিন সকালে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো আমার আপি সুইসাইড করেছে।তখনও আমি চুপ ছিলাম এতোটা বোধ শক্তি যে তখনও হয়নি।তবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠতেই যেন শান্ত শিষ্ট আমি বদলে গেলাম।প্রতিদিন মারামারি করে বাসায় ফিরতাম।সেদিন বড় চাচি আমায় শাসন করতে আসলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলেছিলাম, নিজের ছেলেদের তো জানোয়ার বানিয়ে আমার বোনটাকে হত্যা করেছো।কখনো যদি ফিরি ভেবে নিও তোমাদের শাস্তি এসেছে।তোমাদের সবাইকে সবার কৃতকর্মের শাস্তি দিতে আমি ফিরবো তখন।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে খালামনির বাড়িতে চলে গেলাম। তাদের সব বললাম।আমার খালু আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন।আমার খালা তো হা হুতাশ করে জ্ঞান হারালেন।তারা ছিলেন নিঃসন্তান তবে ভালোবাসায় ভরপুর ছিলো তাদের সংসার।আমাকে আর আপিকে সন্তান স্নেহ দিতেন।আমার খালা,খালু আমাকে আবারো ফেরত পাঠানোর সাহস পেলেন না।আমায় নিয়েই পাড়ি জমালেন ভীমদেশে।

নাহিন থেমে গেলো।তার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে।এখন হয়তো সে কাউকে খুনও করে ফেলতে পারে।কুহেলিকা জানতো না তার প্রিয়তম নিজের মাঝে এতো কষ্ট নিয়ে আছে।কুহেলিকার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।কেন সে তার প্রিয়তমের কষ্ট নিজের সাথে ভাগ করে নিতে ব্যর্থ হলো।নাহিন পানি খেয়ে আবারো বলে ওঠে,

—তারপর সব তুমি জানো।
—ওয়াদা করছি আপুর মৃত্যুর পেছনে যে আছে তাদের আমরা ছাড়বো না। আপনার পাশে আছি।ওই জানো*** খুন করে ফেলবো।আইন যদি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয় তবে রক্তে হাত রাঙাবো।

কুহেলিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে নাহিন।আচ্ছা যাদের জীবনে বিপর্যয়ের হাতছানি আছে তারাই কি এক হয়!অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে। দু’জন দুইজনের কষ্টের সঙ্গিও হতে পারবে।সামলাতে পারবে একে অপরকে।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে