দুই পথের পথিক পর্ব-১০

0
115

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১০
#বর্ষা
সিনানের মৃত্যুতে মির্জা বংশ যেমন স্তব্ধ,স্তব্ধ কুহেলিকা নিজেও। ছোট্ট বাচ্চাটা তাদের ছেড়ে চলে গেল!কুহেলিকা ওয়াসরুমে গিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে।যাদের সাথে ওর ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয় পথের পথিক হয়।সিনানও তেমনি অন্য পথের পথিক হয়ে হারিয়ে গেলো কুহেলিকার থেকে।

হসপিটালের ঝামেলা মিটিয়ে বাড়িতে ফেরে সবাই। দাফন করতে করতে সন্ধ্যা।সিনানের মৃত্যু হয়েছে ওর্গান ফেলিয়ারের কারণে।সাফিন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে সব দেখছে।যেন অনুভূতিশূন্য দাঁড়িয়ে সে।

কুহেলিকা কি করবে বুঝতে পারছে না।নাহিন সিঙ্গাপুর পৌঁছে গেছে।সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো না পৌঁছালেই হয়তো আশ্চর্যজনক হতো। নাহিন বুঝতে এবং বোঝাতে পারছে না কিছুই। কেননা সে নিজেই কিছু বুঝতে পারছে না।

কুহেলিকা ফোন বন্ধ করে নিজের রুমে সুয়ে আছে।কায়ফার মৃত্যুতে মির্জা বংশের আত্মীয়স্বজনের কোন এক কারণে দেখা মেলেনি।তবে সিনানের মৃত্যুতে সবাই আসছে,এসেছে।কুহেলিকা নামাজে লুটিয়ে কাঁদছে তবে সিনানের মাগফিরাত কামনা করছে। কেননা সে যে জানে মানুষ জাতি শুধু কয় মুহূর্তের সান্ত্বনা দিয়েই নিরুদ্দেশ। শুধুমাত্র আল্লাহই আছেন যিনি সবকিছু আবারো নতুন করে সাজান,কষ্ট হ্রাস করেন।

ড্রয়িংরুমে কুহেলিকাকে নিয়ে এই মুহূর্তেও সালিশী করছে রুমানা আফরোজ।জাহিদ বাবা-মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে‌ ক্ষিপ্ততা দেখিয়ে।জুনায়েদ ঘাড়ত্যাড়ার মতোই রয়ে গেছে।আর কায়েস মির্জা? কায়সার নারি ছেঁড়া ধনকে আগলে রাখতে না পারার দুঃখে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে সিনানের সামনে।সাফিন নিরব অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।

—কিরে আপা কুহু বলে ফিরে আসছে কই ও? তোদের এতো বিপদের মাঝেও দেখছি না যে!

বোন রামিজা আফনানের কথায় আফসোসের সুরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,

—দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ওই মেয়ে।ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসে আছে দেখগে।

—কুহু তো এমন ছিলো না আন্টি।

রামিজা আফনানের বড় ছেলে রুবেল আহমেদ বলে ওঠে।কুহেলিকার বছর ছয়েকের বড় সে।কায়ফার থেকেও বড়।তবে এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও এখনো অব্দি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি কোনো এক কারণে।রুমানা আফরোজ ভাগ্নেকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন,তবে মন মানসিকতা ভালো না হওয়ায় আর বলেন না।চুপ থাকেন।

—এই কুহু দরজা খোল।দরজা খোল বলছি।

নামাজ পড়ে মাত্রই উঠেছিলো কুহেলিকা। হঠাৎ দরজা ধাক্কা, পাশাপাশি পুরুষনালী কন্ঠস্বর ভেসে আসতে এগিয়ে যায় সে।দরজা খোলে।অপরিচিত পুরুষ মুখশ্রী।তবে কেমন জানি চেনা চেনা ঠেকছে।তবে স্মরণে করতে পারছে না।পুরুষটা কুহেলিকাকে ডেঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলে,

—কিরে দাঁড় করিয়ে রাখার প্ল্যান করিছিলি নাকি?

—কে আপনি?(কুহেলিকা)

—তোর নানা।

—মিফতি?(কুহেলিকা)

—তাহলে ম্যাডাম এতক্ষণে চিনেছেন আমাকে।ভুলেই তো গিয়েছিলেন।তা এতগুলো বছর কোথায় ছিলেন আপনি?(মিফতি)

—অনেক জায়গায় ছিলাম।কত জায়গার নাম শুনবি।(কুহেলিকা)

—সব জায়গার।(মিফতি)

—দিল্লি,বাংলাদেশ,সিঙ্গাপুর,কাতার,কানাডা,ইতালি,লন্ডন,লসএঞ্জেলেস,জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড,দুবাই।(কুহেলিকা)

—বাপ রে বাপ।(মিফতি)

কুহেলিকার সাথে মিফতির সম্পর্কে সখ্যতায় ঘেরা। ছোট্ট থেকেই ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে তাকে এই ছেলেটা। চৌধুরী বংশের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড আবার ফ্যামিলি লয়ারের একমাত্র ছেলে মিফতি। ইসতেগফার আংকেলের ছোটো ছেলে।প্রায়ই আসতো আংকেলের সাথে তাইতো পরিচয়,বন্ধুত্ব।

মিফতি পাঁচ ফুট ছয়।আর কুহেলিকা পাঁচ ফুট চার।একই কলেজে পড়া সূত্রে একসঙ্গে যাতায়াত ছিলো তাদের।মাঝে যে বন্ধুত্বের গ্যাপ তৈরি হয়েছিলো তা ঘুচে গিয়েছিলো বিগত দুই বছরে।মিফতি দেখতে মাশাআল্লাহ।সাদা ত্বকের বিড়াল ছানা। চোখগুলো ছোট ছোট।বাম গালে চোখের নিচে তিল আর চাপ দাঁড়িতে জাস্ট অস্থির লাগছে তাকে। অবশ্য কুহেলিকা তাকে বিড়াল ছানা বলেই ডাকে।

রোহানী দাঁড়িয়ে আছে কুহেলিকার দরজায়।মিফতি যে কুহেলিকার বেডে আধশোয়া হয়ে কথা শুনছে তারই একটা ছবি লুভে নেয় সে।তবে এ যে যথেষ্ট নয়।তবুও পাঠিয়ে দেয় নাহিনের নাম্বারে।তবে কেন জানি লেখা ওঠে ‘কুডেন্ট সেন্ড’।রোহানী রাগের মাথায় ফোন ছুঁড়ে মারে।গিয়ে লাগে মিফতির পায়ে।’আহ’ বলে আর্তনাদ করে দাঁড়িয়ে যায় সে। রোহানী ভয় সেয়ে পালিয়ে যেতে চাইলেও মোবাইলের জন্য ভেতরে আসে।

—এক্সট্রেমলি সরি আমি তোমাদের কথা শুনছিলাম না। আমার মোবাইল হ্যাঙ করছিলো তাই আরকি রাগে…

—তাই নাকি রোহানী?তাহলে মিফতি আর আমার পিক আসলো কোথা থেকে?

রোহানী ঘামতে থাকে।বড় এক বাঁশ খেতে চলেছে সে।তবে ভুল স্বীকার করার পাত্রী সে আদৌতে না। রোহানী যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলে ওঠে,

—হয়তো হ্যাঙ হবার কারণে অজান্তেই উঠেছে।

—আচ্ছা।তাহলে তোমার ফোনটা একটু দেখি ঠিক আছে কিনা।

—এখন তো ঠিক হতেই পারে তাই নয়কি!

—তাও ঠিক।আচ্ছা নেও তোমার ফোন। ইচ্ছে হলে থাকতে পারে।

রোহানী দ্রুত বেরিয়ে আসে।বড় বাঁচা বেঁচেছে।আজকে নয়তো এই বাড়ি থেকে পাঠ চুকিয়ে বেরিয়ে যেতে হতো।রোহানী দ্রুত সরে আসে সেখান থেকে।রাইসার ঘরে ঢুকে যায়।রাইসা রামায়সাকে নিয়ে ঘরেই আছে। কেননা রাইসা প্রেগন্যান্ট আর এঅবস্থায় মৃত্যু দেখতে যাওয়া নাকি অকল্যাণকর। পাশাপাশি মৃত্যু দাফন করে এসে গোসল না করা অব্দি নাকি কাউকে ছুলেও অকল্যাণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

—কিরে কই গেছিলি তুই?সিনানকে দেখেছিস?বাচ্চাটা আমায় মামী মনি মামী মনি বলে ডাকলে কি যে মায়া লাগতো!

রাইসার কন্ঠে দেখতে যাওয়ার ছিলো আকুলতা।তবে নিয়ম গেড়েছে বাড়ির বড়রা।জয়নুবা আর কাসেম এসেছেন পরিবারের বড় বলে কথা।জয়নুবার আদেশেই ঘরবন্দি রাইসা।

—আপু বাদ দেও তো।যার মরার সে মরেছে।তাকে নিয়ে এতো ভাবলে দেখবে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে আর তোমার বেবির ক্ষতি হবে।আর সিনানকে নিয়ে ভাবার পরিবর্তে নিজের মেয়েটাকে নিয়েও একটু ভাবো।আজ খাইয়েছো ওকে?

রোহানীর কথায় রাইসার মনে পড়ে না আজকে সে মেয়েটাকে দুপুরে কিছুই খাওয়ায়নি।তাই হয়তো এতো কাঁদছিলো।মোবাইল দেওয়ার পরও তো কত কাঁদছিলো।তারপর চকলেট পেয়ে কান্না থামালো।

—ইশ আমি তো ভুলেই গেছিলাম।আমার বাচ্চাটা এখনো খায়নি।আমি গিয়ে খাবার নিয়ে আসি‌।

—আপু তুই পাগল!মরা বাড়িতে কি খাবার রান্না আদৌ হয়?আর তাছাড়া তোর বাইরে বের হওয়া নিষেধ।ঘরে থাক আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। পাঁচ মিনিটে চলে আসবে।আমি নিয়ে আসছি।

রোহানী বেরিয়ে যায় খাবার আনতে।সত্যিই হয়তো একজন মেয়ে যতই খারাপ হোক না কেন সে যদি তার বোনকে ভালোবাসে তবে সে তার বোনের অংশকে নিজের মেয়ে হিসেবেই তার জন্য সব করতে চায়।তবে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতাও থাকে। পরিস্থিতি মানুষের ভেতরকার ভালো মানুষী মেরে ফেলে,বাহির করে প্রতারণা,ছল-চাতুরী।এমনও তো হতে পারে যে তার অতীত বড্ড ভয়ংকর।

…..

রোহানী যেতেই মিফতিও বেরিয়ে গেছে।আবার কখন এসে কি করতে চায়!কুহেলিকার ফোনে ‘আব্বু’ দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে কল আসে।কুহেলিকা আঁতকে উঠে।চারপাশ ভালো করে দেখে কেউ দেখলো কিনা।না,কেউ দেখেনি।কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা যায় পুরুষনালী শক্ত কন্ঠস্বর।

—কুহু সিনানের মৃত্যুর পেছনে কি তুমি?

—ছিঃ আব্বু তুমি ভাবলে কি করে যে ওতোটুকু বাচ্চার সাথে আমি কিছু করবো!

—আমি সিনানের অল ফাইল রিড করেছি।ওর তো মারা যাওয়ার কথা নয়। তুমি যদি কিছু নাই করো তাহলে করলো কে?

—আব্বু সিনানকে কি খুন করা হয়েছে?

—আমার সন্দেহ আছে।

—আব্বু আমি এই পরিবারকে ঘৃণা করি।একটা বাচ্চাকেও বাঁচতে দিলো না এরা!এরা মানুষ নামক জানোয়ার।

—কুহু উত্তেজিত হয়ো না। নয়তো আমরা ওদেরকে ওদের প্রাপ্য শাস্তি দেওয়াতে পারবো না।

কুহু চুপ হয়ে কাঁদতে থাকে।কোন জানোয়ার কেড়ে নিলো ওই ছোট্ট প্রাণ! এতোক্ষণ তো ভাবছিলো আল্লাহ আল্লাহর মঞ্জুরিতে দান করা প্রাণ নিজ ইচ্ছায় কেড়ে নিয়েছে।মনকে শান্ত করেছিলো। কিন্তু এখন কিভাবে শান্ত করবে সে তার মনকে!শেষমেশ শয়তান গুলো একটা বাচ্চাকে বাঁচতে দিলো না।ধিক্কার মির্জা পরিবারকে।

দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কানে আসতেই দ্রুত কল কেটে দেয় কুহেলিকা।নৌশিন এসেছে।কায়ফার মামাতো বোন‌।তাদের জানা মতে কুহেলিকারও মামাতো বড় বোন।নৌশিন এসেই কুহুর মুখোমুখি হয়ে ঠাস ঠাস করে দুই ঘা লাগায় কুহেলিকার গালে।

—আটবছর দূরে থেকে খুনি হয়েছিস?প্রথমে কায়ফা আর এখন ওর ছেলেকে!কি চাস তুই।সাফিন দুলাভাইকে বিয়ে করতে চাস।চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার।

কুহেলিকা পাল্টা চড় মারে।বড় বলে ছেড়ে দেয় না। ধৈর্যের পরীক্ষা অনেক দিয়েছে আর কত দিবে!এখন থেকে যা হবে সব সামনাসামনি।কুহেলিকার চড় খেয়ে ফুঁসতে থাকে নৌশিন।কিছু বলতে উদ্ধত হওয়ার পূর্বেই কুহেলিকা বলে ওঠে,

—জানবে না শুনবে না থাপ্পর মারবে!কুহেলিকাকে দূর্বল ভেবে ভুল করো না।আমি কুহেলিকা চৌধুরী অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার আছে।আর কিসের এতো মোহাব্বত দেখাচ্ছো তোমরা!কায়ফা আপু যখন মারা গেলো কাউকে তো দেখলাম উঁকি দিতেও।আজ সাফিনের মৃত্যুতে মায়া দেখাতে এসেছো নাকি খুন করে পালিয়ে যেতে না পারায় থাকতে এসেছে এই বাড়িতে?

—কুহেলিকা?

—গলা নামিয়ে।আমার বাড়িতে আমি গলা উঁচিয়ে কথা বলা কাউকে সহ্য করবো না।গেট লস্ট ফর্ম মাই রুম।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে