দুই পথের পথিক পর্ব-০৯

0
126

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৯
#বর্ষা
নাহিনের হাত ধরে খোলা মাঠের দিকে ছুটে চলেছে কুহেলিকা। দুজনের পোশাকই সবুজ রঙা যেন কপোত-কপোতী! নাহিনের এক হাতে গুঁজে রাখা কুহেলিকার হাত আরেক হাতে লাটাই।কুহেলিকার হাতে ঘুড়ি।আজ মনে রঙ লেগেছে তাদের।পবিত্র সম্পর্কের জোয়াড়ে গা ভাসিয়েছে।একটু উৎযাপন তো হবারই।তবে তা ভিন্ন ধর্মী যা আজ অব্দি কেউই করেনি।

—নাহিন সুতা ছাড়ুন..দ্রুত ছাড়ুন।বাতাস উল্টো দিকে বইছে তো আবার এদিকে..ঘুড়ি পড়ে যাবে।

—আরে প্রিয়তমা ব্যতিব্যস্ত হয়ও না। তোমার স্বামী তোমার পাশেই আছে।

কুহেলিকা পিছে ফেরে নাহিনকে দেখে।মিষ্টি হাসি তার মুখে লেগে।নাহিনের হাসি মুখটা যেন আরো উজ্জ্বলিত হয়।কুহেলিকা আর নাহিনের আনন্দক্ষণ মুহুর্তের ছবি কেউ আড়াল থেকে তুলে নেয়। লোক সমাগম এদিকে অনেক কম।কুহেলিকার নজর এড়ায় না লোকটা।তবে সেদিকে ফিরে মুচকি হাসে সে।যেন তারই কেউ!

কায়ফা মৃত্যুবরণ করেছে আজ সাতদিন।গতকাল রাত্রের পর এখনো অব্দি বাড়ি ফেরার কথা চিন্তাতেও আনেনি কুহেলিকা।নাহিনকে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলো। মানুষ কতোটা জঘন্য হলে বোনের স্বামীকে বিয়ে করার কথা বলে!হ্যা,কুহেলিকার সো কল্ড ফ্যামিলি এমনটাই করেছে।কুহেলিকাকে ইমোশনালী ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছে।

ফ্লাসব্যাক…

রাত নয়টা কি দশটা হবে হয়তো।সিনান কুহেলিকার গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়েছে।গত কয়েকদিন যাবৎ খালাগত মায়ের ভূমিকা পালন করেছে সে।ছেলেটা এখন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।কুহেলিকা লেপটপে কাজ করছিলো তখনই ঘরে ঢোকে রুমানা আফরোজ,কায়েস মির্জা।

—আম্মু তুমি কি ব্যস্ত?

কুহেলিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায় সেদিকে।এনারা নতুন কি ভং ধরেছে তা মস্তিষ্কে নাড়া দেয় না কুহেলিকার।তবে বুঝতে পারে যে এদের কিছু তো চাই নয়তো এতো পেয়ার মোহাব্বত উতরিয়ে পড়তো না।

—জ্বি ব্যস্ত।

—তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে.. শোনো (কায়েস মির্জা)

কুহেলিকার রাগ লাগে।যখন কথা বলবেই তাহলে কেন জিজ্ঞেস করলো সে ব্যস্ত কিনা।রাগ লাগে কুহেলিকার।তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লেপটপ বন্ধ করে বলে ওঠে,

—বলুন‌ শুনছি.

—কুহেলিকা তুমি আমাদের ছোট মেয়ে আর কায়ফা ছিলো আমাদের বড় মেয়ে। সেক্ষেত্রে কায়ফার ছেলে তোমার ভাগ্নে অর্থাৎ সন্তানতুল্য।এখন তুমি কি চাইবে তোমার সন্তানতুল্য ছেলে সৎ মায়ের অত্যাচারে জীবনের মানে হারিয়ে ফেলুক।(কায়েস মির্জা)

—কি বলতে চাইছেন খোলা মেলা বলুন।কথা পেচাচ্ছেন কেন?(কুহেলিকা)

—মানে তুমি সাফিনকে বিয়ে করো।এতে সিনান মায়ের ভালোবাসাও পাবে আর সাফিন স্ত্রীও পাবে।(রুমানা আফরোজ)

—ফাজলামো করতাছেন আমার সাথে?কি বলছেন তা আপনারা আদৌ বুঝতে পারছেন তো!(কুহেলিকা)

—হ্যা হ্যা হ্যা বুঝতে পারছি।তবে তুমি এমন মেজাজ দেখাচ্ছো কেন?তোমার মায়ের অধিকার থেকে বলছি তুমি আজকেই সাফিনকে বিয়ে করবে।আজই কাজী আসবে।চলো কায়েস

রুমানা আফরোজ অধিকার দেখিয়ে কথা বলে বেরিয়ে যান।কুহেলিকা তাচ্ছিল্য হাসি হেসে আলমারি থেকে পোশাক বের করে হ্যান্ড ব্যাগে একসেট জামা ভরে অন্যটা পরিধান করে।নাহিনকে ফোন দিয়েও তেমনটাই করতে বলে। ঘুমন্ত সিনানের কপালে আলতো চুম্বন করে বলে ওঠে,

—খালামনি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো বাবা।

কুহেলিকা ব্যাগ কাঁধে নাহিনের হাত ধরে রুমানা আফরোজের সামনে বের হতে নিলেই রাস্তা আটকে দাঁড়ান তিনি। রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠেন,

—কোথায় বের হচ্ছো তুমি?কাজী আসবে আর কিছুক্ষণের মাঝেই আর তুমি এখন পরপুরুষের সাথে বের হচ্ছো!এই ছেলেকে চলে যেতে বলো।

নাহিন কিছুই বুঝতে পারে না।কেন আসবে কাজী?বিয়ে পড়াতে তো আসবে কিন্তু কার!নাহিন বুঝতে পারে না।কুহেলিকার মুখের দিকে তাকায়।কুহেলিকা চোখ দিয়ে ইশারা করে বোঝায় সে বলবে সব। নাহিন চুপ থাকে। এমনিতেই ফিরতে হবে তাকে। বায়ারদের সাথে কোনো কারণে গ্যাঞ্জাম বাধিয়েছে কর্মচারীরা।এ নিয়েই ঝামেলা।কুহেলিকাকে বলাও হয়নি এবিষয়ে।

কুহেলিকা সাফিনের সম্মুখে দাঁড়ায়। সাফিনের মুখশ্রীতে বেদনা ভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং সে হয়তো আনন্দিত।কুহেলিকা দাঁতে দাঁত চেপে সাফিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

—স্ত্রী মরেছে একমাসও সহ্য হয়না?বিয়ের জন্য নড়চড় করছেন!ছেলেকে একা হাতে বড় করা যায় না?তাহলে ছেলের জন্য কেন মা চাই! নিজের মায়ের মতো কেউই আদর-সোহাগ দিতে পারে না।তাই নিজের শান্তির জন্য ছেলেকে সামনে দাঁড় করিয়ে কাজ হাসিল করবেন না।

ফ্লাসব্যাক এন্ড..

কুহেলিকা নাহিনের হাত ধরে বেরিয়ে আসার পর শুরু হয় আরেক ঝামেলা।সাফিন রাগান্বিত হয়ে জাহিদের কলার ধরে।এই ছেলের কারণেই এমন হচ্ছে।এই ছেলেই পরামর্শ দিয়েছে সবাইকে যে কুহেলিকার সাথে সাফিনের বিয়ে দিতে। রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,

—শয়তান তোর জন্য আজ ওই মেয়েটা আমাকে এতো গুলো কথা শুনিয়ে গেলো।জাস্ট তোর জন্য!

—আরে মিয়া এখন দেখি সব দোষ আমার।তুমি মনে হয় চাও নাই ওরে বিয়ে করতে!তলে তলে যে তোমার কি চলে সবই বুঝি।সাধু সাজতে আইসো না।(জাহিদ)

—জাহিদ মুখ সামলে কথা বল।আমি ওরে চাইছি মানে কি?

একপ্রকার হাতাহাতি শুরু হয় বাড়ির ছেলে আর জামাইয়ের মাঝে।জিহাদ এবাড়িতে থাকে না কোনো এক কারণে। তাই এসময়ে উপস্থিত নেই তার‌ স্ত্রী-সন্তান।সিনান‌ কান্না করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সেসময়ই পা পিছলে পড়ে যায়।সাফিন আগলে রাখতে পারেনা ছেলেকে।মাথা ফেটে ফুলকির ন্যায় রক্ত ঝড়তে থাকে।থামার নাম গন্ধই নেয় না। হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছোটে তারা।

নিকটবর্তী হসপিটালে পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলেও ডক্টররা রক্ত থামানোর আপ্রাণ চেষ্টায় এখনো ব্যস্ত।রক্ত টেস্টের জন্যও পাঠানো হয়েছে। শেষমেশ পুরো দশমিনিটের প্রয়াসে রক্ত ঝরা থামে।তবে প্রচুর রক্ত অলরেডি ঝড়ে গিয়েছে।বাচ্চার ও+ রক্ত লাগবে।দিতে রাজি হয় জাহিদ।মামা হয়ে ভাগ্নেকে তো আর মরতে দিতে পারেনা।

—আপনাদের মধ্যে পেশেন্টের গার্ডিয়ান কে?

নার্সের কথায় বিধ্বস্ত সাফিন এগিয়ে এসে বলে,”আমি ওর বাবা।”

—ডক্টর আপনাকে ডেকেছেন চলুন।

নার্সের পিছুপিছু যায় সাফিন।ডক্টরের কেবিনে যেতেই দেখতে পায় ডক্টর ফাইলে মুখ গুঁজে আছেন।নার্স ডাক দিতেই ওপরে তাকান তিনি। একজন মাঝবয়সী মহিলা ডক্টর।ওয়াইফ ওফ ডক্টর খান।ডক্টর সফিয়া বলে ওঠেন,

—মিষ্টার সাফিন আহমেদ আপনি কি জানেন আপনার ছেলে কোন রোগে আক্রান্ত?

—জানলে কি হসপিটালে আনতে হতো!

সাফিনের ত্যাড়া জবাবে রাগান্বিত হলেও নিজেকে সংযম রাখেন তিনি। কেননা সন্তানের অসুস্থতায় কোনো পিতা-মাতারই মাথা ঠিক থাকে না।উল্টা পাল্টা বকতে থাকে।ডক্টর সফিয়া নিজেকে শান্ত রেখে বলে ওঠে,

—আপনার ছেলে হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত।মেয়েরা সাধারণত এর বাহক আর ছেলেরা আক্রান্ত হয়।এটা জিনগত রোগ।আপনি কিংবা আপনার মিসেস কেউ এই রোগের বাহকের কাজ করেছেন।তাই আপনাদের সন্তানও হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত।

—হিমোফিলিয়া মানে?(সাফিন)

—হিমোফিলিয়া এমন ধরনের রোগ যা ক্ষত স্থান নিজ থেকে রক্তের সাদা অংশ ক্ষরণের মাধ্যমে বন্ধ করতে পারে না। বরং ক্ষতটা তেমনি থাকে একটা দীর্ঘসময়। এছাড়াও হিমোফিলিয়ায় কোথাও সামান্য কাটলেও প্রচন্ড রক্ত ঝড়ে ফলে মৃত্যুসঙ্কা তৈরি হয়।(সফিয়া)

—ডক্টর আমার ছেলে বাঁচবে তো?(সাফিন)

—আল্লাহ,আল্লাহ করেন। প্রচুর রক্ত গিয়েছে ওর।(সফিয়া)

সাফিন যেন আরো ভীত হয়ে পড়ে ডক্টরের কথায়।কই সে তো কখনো খেয়াল করেনি কায়ফার হিমোফিলিয়ার কথা। আচ্ছা কায়ফা কি মেডিসিন নিতো এই রোগের!সাফিন কিছুই জানে না।আসলে সে জানেটা কি তার স্ত্রীর সম্পর্কে?ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলো।বিয়ের পর কি ভালোবাসা উড়ে গেলো!

…..

কুহেলিকা, নাহিন বিকেলে বাড়ি ফিরে জানতে পারে সবাই হসপিটালে।কারণ জেনে নিজেকে অপরাধী লাগতে লাগে তার।কায়ফাকে যে সে কথা দিয়েছে আগলে রাখবে তার অংশকে।সেই কথার অবহেলা সে কিভাবে করলো!

হসপিটালে এসে জানতে পারে ডক্টর সফিয়া ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন।হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বলে,

—আন্টি বাচ্চাকে ঠিক করে দিন।আমি একজনকে ওয়াদা দিয়েছে তার অংশকে আগলে রাখবো।আমি পারিনি।

সফিয়া জড়িয়ে ধরেন কুহেলিকাকে। অনেকদিন পর দেখা।পাশে আছে অচেনা পুরুষ।কুহেলিকার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি পড়তেই নাহিন নিজ থেকে‌ পরিচিত হয়ে নেয়।নাহিন বলে ওঠে,

—আসসালামু আলাইকুম আন্টি আমি নাহিন মুনতাসির কুহেলিকার হাসবেন্ড।

—ওয়ালাইকুমুস-সালাম আমি ডক্টর সফিয়া।

সফিয়া যেন বেশ অবাক হয়েছেন কুহেলিকার হাসবেন্ড শব্দটি শুনে।তবে এবিষয়ে তিনি পরে দেখবেন ভেবে কুহেলিকাকে আস্বস্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যান।সিসিউতে কয়েকটা পাইপের মতো যন্ত্র দ্বারা তার দেহে কি কি যেন দিচ্ছে আবার চেকও করছে।এক হাতের ক্যানোলা দিয়ে রক্ত যাচ্ছে তো আরেক হাতের ক্যানোলা দিয়ে স্যালাইন যাচ্ছে। অবস্থা গুরুতর।

কুহেলিকাকে দেখেই রুমানা আফরোজ,সাফিন ছুটে আসে।সাফিন তো সরাসরি বলেই ওঠে,

—আজ তোমার জন্য আমার ছেলে মরতে বসেছে।ওর কিছু হলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়বো না।শেষ করে দিবো।

কুহেলিকা ছোট সিনানকে স্নেহ করলেও মিথ্যে অভিযোগ নিজের ঘাড়ে নেওয়ার মতো মেয়ে সে না।বাসার হ্যাল্পিং হ্যান্ডদের মুখে আসল সত্যি সে শুনেই এসেছে।তাই তো ফটাফট প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,

—নিজেদের দোষ ঢাকতে আমাকে দোষী বানাচ্ছেন?আমাকে চলে আসতে দেখে জাহিদ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া কে বাধিয়েছিলো?কার কারণে আতঙ্কিত হয়ে পিছলে পড়েছিলো সিনান?কার কারণে!

সাফিন চুপ হয়ে যায়।মাথা কাজ করা তার বন্ধ হয়ে গেছে।কুহেলিকা পাশ ফিরে দেখে নাহিন নেই। অর্থাৎ সে চলে গিয়েছে এয়ারপোর্টের দিকে। বাড়ি ফেরার পথেই নাহিন‌ কুহেলিকাকে জানিয়েছিলো আজ তাকে ইমার্জেন্সিতে সিঙ্গাপুর যেতে হবে। বায়ারদের সাথে বড়সর সমস্যা বাঁধার পূর্বেই!কুহেলিকাও সায় দিয়েছিলো।তবে বাড়ি ফিরে কুহেলিকা এসব জানার পর বলেছিলো,

—আমায় হসপিটালে ছেড়ে আপনি এয়ারপোর্টের দিকে যাইয়েন।

নাহিন যেতে চায়নি।কুহেলিকা জোর করে পাঠিয়েছে কেননা এমনিতেও এদের মন মানসিকতা নিচু পর্যায়ে।তার ওপর একের পর এক আঘাত সহ্য করতে সব রাগ কুহেলিকার ওপর দেখাতে চাইবে ,তবে তার সাথে না পেরে জুনায়েদ মির্জা,কায়েস মির্জা নাহিনের সাথে খারাপ কিছু করতে চাইতে পারে। আর এদের শাস্তি না দেওয়া অব্দি এদের তো আর বাড়ি থেকেও বের করতে পারে না সে!তাই তো নাহিনকেই এখান থেকে নিরাপদ স্থানে পাঠালো।তবে তাকে নিজের করে।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে