দখিনা প্রেম পর্ব-১৩

0
1071

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৩ ||

গত সন্ধ্যা থেকে সেহের নিখোঁজ। সকাল হয়ে গেলো এখন অবধি সেহের বাড়ি ফিরেনি। দাদীমা তো “ফুল” “ফুল” বলে মরণকান্না জুড়ে দিয়েছে। তাকে কেউ থামাতে পারছে না। আবিদ তার বন্ধুদের নিয়ে পুরো গ্রাম খুঁজেও সেহেরকে পায়নি। ওদিকে কবির জোহরার সাথে কথা কাটাকাটি চরম হয়েছে৷

—“কই থাকোস তুই হারাদিন? এই কয়টাদিনের লেইগা মাইয়াটারে আটকায় রাখতে পারলি না? তোর লেইগা আমার এক লাখ টেকা গাঙ্গে গেলো মা**!! ভাইরা বাড়িত থেইকা যাক তারপর দেহিস তোরে কী করি!”

—“বিশ্বাস করেন আমার ধারেকাছেই ছিলো সেহের। হঠাৎ কই চলে গেলো কি জানি। দয়া করে বিশ্বাস করেন আমি সত্যি কইতাসি!”

—“এই চুপ মা**!! আর একটা মিথ্যাও কবি না। ধারেকাছে থাকলে কী উইড়া উইড়া হারায় গেলো! আর একটা শব্দ করবি তো তোরে আমি মাইরা পাতালে পুঁইত্তা রাখমু।”

জুবায়ের আর তার পুরো পরিবার গ্রামে পৌঁছিয়েছে প্রায় ৭টা নাগাগ! এখানে এসে এসব কান্ড দেখে তাদের হুঁশই উড়ে গেছিলো৷ হ্যাঁ জুবায়ের জেঠু এবং কবিরের মেজো ভাই! অফিসের কাজের কারণে প্রায় অনেক বছরই আসেনি, তবে মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে দেখা করে যেতেন জুবায়ের। তবে সা’দ বা রুবাই কোনোদিন গ্রামে আসেনি। জুবায়ের কে দেখে দাদীমা তাকে ধরেই অনেকক্ষণ কাঁদলো। আসিয়া(সা’দের মা) চাচীকে জিজ্ঞেস করেছিলো,

—“কে নিখোঁজ ভাবী?”

—“সুফিয়ার মেয়ে।”

—“সুফিয়ার মেয়ে মানে? সুফিয়ার মেয়েও ছিলো?” অনেকটা অবাক হয়ে বললো আসিয়া!

—“হ্যাঁ আছে।”

—“আমাদের কেন জানানো হয়নি?”

—“কবির ভাই চাইতো না ফুলের কথা কেউ জানুক!”

আসিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কবির কেমন বাবা যে কিনা নিজের মেয়েকে আড়ালে রেখেছে। আসিয়ার কেমন রহস্য লাগছিলো। কবির তো মেজো ভাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারা, গতকাল রাত থেকে আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেনি সে। রুবাইয়ের কেন যেন বিরক্ত লাগছে এই পরিবেশ। দাদী তো কান্নার চটে রুবাইকে খেয়ালই করেনি। তবে রুবাই বুঝতে পেরেছে এখানকার অবস্থা। তাও সে মাকে বলে নিজের ঘরেই আছে, বের হয় না। কান্নাকাটি তাকে কেমন যেন অস্থির করে দেয়। আসিয়াও বলেছে যেন রুবাই বের না হয়, পরিস্থিতি ঠিক হলে সে নিজেই ডেকে পাঠাবে। রুবাইও বেশি কিছু না বলে সেই যে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিয়েছে এখনো উঠেনি। এদিকে জুবায়ের বা আসিয়ার চোখে ঘুম নেই। এই পরিস্থিতিতে কারই বা ঘুম আসবে? তারা কী ভেবে গ্রামে এসেছিলো আর এখন কী হচ্ছে৷ দাদীমা সেহেরের জামা-কাপড় জড়িয়ে কেঁদেউ চলেছে আর দাদীমার চারপাশে পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। জেঠু ভাঙ্গা গলায় জুবায়েরকে বললো,

—“তোর ছোট ছেলে আসেনি?”

—“না ভাই, আমাদের অনুপস্থিতিতে ও অফিস সামলাচ্ছে। তবে চিন্তা করিও না দু’দিন পর চলে আসবে!”

জেঠু আর কিছু বললো না, আনমনে সামনে তাকিয়ে রইলো। তার মনেও নানান দুশ্চিন্তা উঁকিঝুঁকি মারছে। আবিদ এখনো বাহিরেই আছে, বাসায় ফিরেনি। হঠাৎ কেউ বাইরে থেকে বলে উঠলো,

—“আরে আমাদের ফুল মামুনি আইসে সক্কলে দেইখা যাও!”

সেহেরের কথা শুনে দাদীমার কান্না থেমে গেলো। সে চাচীর সাহায্যে একপ্রকার ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে গেলো আর তার পিছে বাকিরা! সদর দরজার সামনে গিয়ে দেখলো ফাতেমা খালা সেহেরকে ধরে আছে। সেহেরকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে, সাথে মুখটাও শুকিয়ে গেছে। আসিয়া তো মুগ্ধ হয়ে গেলো সেহেরকে। সেহের তার মায়ের চেয়েও সুন্দরী হয়েছে তবে চেহারাটা সুফিয়ার সাথে মিলেনি। সেহেরকে দেখে দাদীমা ছুটে গিয়ে সেহেরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কবির আর জোহরা দূরে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হঠাৎ কী মনে হতেই কবির নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারলো! জোহরা তা লক্ষ্য করে অবাক হয়ে বললো,

—“কী হলো আপনে কপালে চড় মারলেন কেন?”

—“আরে বলদি আমি তো এসব ঝামেলার মদ্দৈ ভুইলাই গেসিলাম জুব ভাই আর ভাবীরা এই মাইয়া সম্পর্কে জানতো না। এহন তো ভাই, ভাবী আমারে উল্টা পাল্টা ভাববো। যদি ঢাকায় লইয়া যায় তহন কী হইবো?”

—“আরে চিন্তা কইরেন না, উনি তো এহনো কিছুই কয় নাই। আর ঢাকায় কেমতে নিয়া যাইবো তার আগেই তো আপনে সেহেররে….”

—“ও হ ভুইলাই গেছিলাম। আইচ্ছা বাকিটা পরে দেখতাসি!”

সেহের আসার কিছুক্ষণ পর আবিদ খবর পেয়ে সেওও ফিরে এলো। আবিদ বোনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসেছিলো। সকলে এক প্রশ্ন করেছিলো সেহের কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেছিলো আর কীভাবেই বা তার এই অবস্থা হলো।? সেহের উত্তর দেয়ার আগেই তার পাশে থাকা গ্রামের চিকিৎসক ফাতেমা খালাই সকল জবাব দিয়েছেন।

—“ওর দাদীর জন্য আমার কাছে ওষুধ আনতে যাইয়াই জঙ্গলে পইরা গেছিলো তাই হাত-পায় এমন কাটাকাটি। কষ্ট টস্ট কইরা রাস্তায় আসতেই আমার এক লোক ওরে দেখে আর আমার কাছে নিয়া আসে। আমিই সারারাত ওর চিকিৎসা করি, কিন্তু তোমাগো খবর দেয়ার মতো কাউরে পাই নাই তাই খবরও দিতে পারি নাই। তবে চিন্তার কিছু নাই, দুইদিন বিশ্রাম করলেই ঠিক হইয়া যাইবো।”

এসব শুনে সকলেই ভালোভাবে শাসালো সেহেরকে যেন আর এভাবে বাসা থেকে বের না হয়। সেহেরকে পেয়ে সবাই খুশি। রিমন তো সেহেরের পাশেই বসে আছে। সেহেরের প্রতি সকলের আদিখ্যেতা দেখে তপা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। কারো তাকে দেখার মতো সময় নেই। তপা ধপাধপ পা ফেলে মায়ের কাছে গিয়ে রাগান্বিত হয়ে মিনমিন করে বললো,

—“আর কতোক্ষণ এইসব তামাশা চলবে মা? আমার একদমই সহ্য হচ্ছে না!!”

—“তামাশা শেষ হতে আরও কিছুদিন বাকি তাই সবুড় কর। কথায় আছে না সঁবুড়ে নেওয়া ফলে। আর যদি সহ্য করতে না পারোস উপরে নিজের ঘরে যাইয়া বইয়া থাক! ভাল্লাগছে না তোর এসব ঘ্যানঘ্যানানি।”

তপা তাই করলো, কাউকে কিছু না বলে সে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলো। সেহেরকে ধরে সেহেরের ঘরে নিয়ে আসলো ফাতেমা খালা। সেহের হাঁটতে হাঁটতে মিনমিন করে ফাতেমা খালাকে বললো,

—“আপনার মিথ্যা বলা উচিত হয়নি,খালা। সকলকে সত্যিটা জানানো উচিত ছিলো!”

ফাতেমা খালা চাপা স্বরে বলে,
—“কিছুই করার ছিলো না মা। সত্য জানলে আঙুল তুমার উপ্রে উঠবে যেখানে তুমার কোনো দোষই ছিলো না। আর আমরা গেরামের মানুষ, ওনারা ২-৪ লাইন বেশি বুঝবেই। তাই কিছু বলার সাহস হইলো না!”

সেহের আর কিছু বললো না। কান্নার কারণে তার গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে সে নিজের কান্না থামিয়ে রেখেছে। গতরাতের ঘটনা সেহেরকে অনেকটা অশান্ত করে চলেছে।

—“মামা ওই ছেলেকে ধরতে পেরেছেন?”

—“হ্যাঁ মামু পেরেছি। ওরে এবার নরসিংদী নয় ঢাকার জেলখানায় নিয়া আসছি। আমার আদেশ ছাড়া ওই রাফসান কিছুতেই ছাড়া পাবে না। বেশ কড়াভাবেই কেস দিয়েছি। শালার দুই নম্বরি করার জায়গা নাই!!”

—“ঠিক আছে মামা। খেয়াল রাখবেন যাতে ধোলাইটা বেশি খায়! ওর জন্য আমার অবস্থা হেল হয়েছে।”

—“চিন্তা করিস না ভাগ্নে আমি গিয়ে সামলিয়ে এসেছি তো নাকি?”

—“কোথায় সামলালে? ঝামেলা লেগেছেই তো আগে!”

—“কিছু করার নেই। কিছু মাস পর ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিস!”

সা’দ কল কেটে দিলো। কেন জানি সে ডিভোর্সের কথাটা মাথায় আনতে পারছে না। সা’দ এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাচ্ছে। কারীব একদম চুপ হয়ে ড্রাইভ করছে। তার ভেতরেও অশান্তি চলছে। চেয়েছিলো কী আর হয়ে গেলো কী! কারীব নিজের মনে মনে একশোবার নিজেকে বকছে তো বকছেই। এদিকে সা’দের মনে অন্যকিছু চলছে।

১০ মিনিট হলো জ্যামে আছে সা’দ। তখনই সা’দের ফোনে কল এলো। কলটা তানজীলের। সা’দ রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই তানজীল বললো,

—“আর কতক্ষণ সা’দ, আমি তো ওয়েট করছি!”

—“জ্যামে আছি আর ১০ মিনিট লাগবে।”

—“ওকে। এখন তো অন্তত বল কী জন্য জোর করে আমায় দেশে আনালি?”

সা’দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“আমি বিয়ে করেছি ভাইয়া!”

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে