দখিনা প্রেম পর্ব-১১+১২

0
1016

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১১ + ১২ ||

—“তোর মায়ের ওয়াদা কী ভুলে গেছিস সেহের?”

সেহের ছলছল দৃষ্টিতে জোহরার দিকে তাকালো। জোহরা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে সেহেরের দিকেই তাকিয়ে আছে। সেহের মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে না জানালো!

—“তাহলে কোন সাহসে ওই বাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে আছিস? তোর নিজের ভাগও তো ওই বাড়িতে আছে তাই না?”

—“কিন্তু মা আমার তো কোনোকিছুরই ভাগ চাই না শুধু বাবার…”

—“ওটা কখনোই সম্ভব না। তোর মায়ের ওয়াদা ছিলো তুই তোর বিয়ের আগ অবধি ওই বাড়িতে থাকবি যতো কিছু হোক। এখন কিছু না বলে বাইরে গিয়ে সবাইকে বলবি তুই ওইবাড়ি যাবি! যদি না বলিস তোর মা তোকে অভিশাপ দিবে!”

সেহেরের চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে গেলো। আবারও সেই নরকে তাকে যেতে হবে শুধুমাত্র মায়ের ওয়াদা রাখতে। আল্লাহ তার আর কতো পরীক্ষা নিবে সে জানে না। কোনো উপায় না পেয়ে সেহের বাইরে আসলো। দাদীমা অত্যন্ত রেগে কবিরকে বকেই চলেছে আর কবির! সে চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে! সেহের দাদীমার এগিয়ে আসতেই দাদীমা বললো,

—“দেখ ফুল চিন্তা করিস না এই যমগুলা তোরে এইহান থেইকা লইয়া যাইতে পারবো না! তোর এই দাদী থাকতে আমি জীবনেও তোরে আর রিমনরে নিতে দিমু না!”

—“কাকে কী বলছেন মা? সে তো আগেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে!”

বলতে বলতেই জোহরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সকলে নির্বাক হয়ে তাকালো সেহেরের দিকে। সেহের চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কবির এই সুযোগে বলে উঠলো,

—“মা আমারে ক্ষমা কইরা দেও আমি অনেক ভুল করসি, তুমার লগে খারাপ কতা কইসি তার জন্য মাফ কইরা দাও। তাও দয়া কইরা আমার পুলা আর মাইয়াটারে আমাগো থেইকা দূরে রাইখো না। এই পুলাডারে যে অনেক কষ্টের পর ফল হিসাবে পাইসি। জোহরাও পুলাডারে ছাড়া ঘুমাইতে পারে না খালি কান্দে!”

—“তো তোর পোলারেই নিয়া যা আমার ফুলরে ক্যান নিবি?”

—“ফুলের বাড়ি যে ওইডা। ওরে না নিলে কেমনে হইবো! অনেক অন্যায় করিছি তার ফল পাইসি এতদিন। তুমি দয়া কইরা আটকাইয়ো না। পোলা মাইয়া ছাড়া আমার ঘর পুরাই অন্ধকার!”

দাদীমা চেহারায় রাগীভাব রেখেই চুপ করে রইলেন। জোহরা সেহেরকে হালকা ধাক্কা দিতেই সেহের বলে উঠলো,

—“যাই না দাদী! বাবা তো ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেই!”

আবিদ রেগে সামনে যেতে নিতেই জেঠু আবিদের হাত ধরে আটকালো! দাদীমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো,

—“বেশ! তইলে ওগো লগে আমারেও লইয়া যাবি! আমি না গেলে ফুল এই বাসা থেইক্কা কুথাও যাইবে না!”

—“আইচ্ছা মা তাই হইবো! যা ফুল মা সব গুছায় নে!”

কবিরের কথায় সেহের মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলো। জোহরা এবং কবিরের চোখচোখি হতেই কবির চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো। অবশেষে দাদীমাকে নিয়ে সেহের এই বাড়িতে প্রবেশ করলো! সেহের যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই তার মাকে দেখছে। তার মা যেন হাসিমুখে তাকে স্বাগতম করছে। দাদীমা কিছু না বলে সেহেরের হাত ধরে সেহেরের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা ধুম করে বন্ধ করে দিলো। জোহরা রিমনকে আদর দিয়ে বলে,

—“বাবা যা উপরে গিয়ে রেস্ট কর!”

রিমন মাথা নাড়িয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলো। রিমন চলে যেতেই জোহরা কপট রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,

—“সেহেরকে এনেছো ভালো কথা ওই বুড়িটাকে কেন এনেছো? বুড়ি যদি কোনোভাবে আমাদের পরিকল্পনা বুঝে যায় তখন কী করবে?”

—“আরে শান্ত হও, আমি সব ভাইবা চিন্তাই রাখসি! বিয়ার দিন নাহয় বুড়িরে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিমু! তহন তো টেরও পাইবো না।”

—“তা ঠিক বলেছো। সব ঠিকমতো হবে তো?”

—“অবশ্যই!”

বলেই কবির শয়তানি হাসি দিলো। সামনে তার যে টাকা কামানোর বড় কাজ আসছে! এদিকে খাবারের সময় ছাড়া দাদীমা আর সেহের রুম থেকে বের হয় না। বলা যায় দাদীমা বের হতে দেয় না। সে কোনোভাবেই নাতনিকে কাজ করতে দিবেন না। এদিকে সেহের ঘর থেকে বের হয় না দেখে জোহরারও যেন রাগের শেষ নেই! পুরো সংসারের কাজ এখন তার ঘাড়ে। সব করতে করতে সে ভিষণ ক্লান্ত। দাদীমা ঘর থেকে বের হলে তপাকে দেখলেই শুরু হয় কথা-কাটাকাটি! দাদী তো পুরো সাবান পানি ছাড়া ধুঁয়ে সাফ করে দেয়! সে যেহেতু বৃদ্ধ মানুষ সেহেতু তার ঝগড়া সম্পর্কে বেশি অভিজ্ঞতা! দাদীর সামনে তপা যেন ছোট পুঁটিমাছ। রিমন তো হাতে মুড়ি নিয়ে ওদের ঝগড়া দেখতে বসে। জোহরা চেয়েও তার শাশুড়ীকে থামাতে পারে না। শেষে সেহেরের কাছে গেলে সেহের দাদীমাকে টেনেটুনে রুমে নিয়ে আসে। এই রোজকার ঝগড়া-ঝাঁটি, সংসারের জন্য খেটে মরতে মরতে জোহরার অবস্থা খারাপ। প্রতিদিন এসব বিষয়ে নালিশ শুনতে শুনতে কবির সাহেব অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। শেষে খুব জোরে চেঁচিয়ে বলে,

—“থামাও তোমার এই ভাঙ্গা রেডিও! এতোদিন কাম না কইরা কইরা নাক টাইন্না ঘুমাইসোছ তাই তুরর এই অবস্থা! কয়বার কমু ১ লক্ষ টাকার বন্ধন এইডা তাই মুখ বুইজ্জা সইয্য কর! আরেকবার তোর এই বালের কতা হুনাইতে আইবি তো ওই প্রথম মহিলার মতো তোরেও মাইরা গাঙ্গে নিয়া ফালায় আমু! যত্তোসব!”

বলেই বিছানার অপর পাশে কাত হয়ে শুয়ে পরলো কবির। আর জোহরা সেখানেই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এই কাজের জন্য তার প্রথম স্বামী তালাক দিলো এখন তো তালাক নয় রীতিমতো একেবারে মেরে ফেলার হুমকি খেলো স্বামীর কাছে, চাইলেও কিছু বলতে পারবে না। সারাদিন কামলার মতো খাটো আর স্বামীসেবা করো। স্বামীসেবার কথা ভাবার সময়ই কবির বলে উঠলো,

—“পা ডা টিপ্পা দে ব্যথা করে!”

জোহরা সেখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। জোহরার উত্তর না পেয়ে কবির বিকট হাক ছাড়তেই জোহরা ভয়ে ভয়ে গিয়ে পা টিপতে মনোযোগী হলো!

—“মা প্লিজ! ইদের আরও ৫ দিন বাকি এতো আগে কেন যাচ্ছো?”

—“পাঁচদিন তো কী হয়েছে? আগে থেকেই যাবো ব্যাস! জানিস না এই ইদের সিজনে রাস্তায় কী পরিমাণ জ্যাম হবে? না বাবা আমার পক্ষে ওই জ্যামে বসে থাকা সম্ভব না। আগে যাওয়াই ভালো!”

—“আগে গেলে অফিস কে সামলাবে মা?”

—“কেন ভাই তুই তো আছিসই। আমি নাহয় কিছুদিন চিল মুডে থাকি। আর কতো দৌড়াবো!” রুবাই অসহায় সুরে বললো। রুবাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সা’দের বাবা জুবায়েরও বলে উঠলো,

—“হ্যাঁ সেই তো। আর তোর তো এখন শুটিংও নেই ফ্রি আছিস! তাহলে তোর সামলাতে আপত্তি কোথায়?”

—“এই তোমরা বারবার ওকে অফিস সামলানোর কথা বলছো কেন? সা’দ যাবে না আমাদের সাথে?”

—“তোমার ছেলে যাবে বলে কী তোমার মনে হয়? সে তো গতকালই বাবাকে বলে দিয়েছে ইদের আগেরদিন সে গ্রামে পৌঁছাবে!”

এবার সা’দের মা উত্তেজিত হয়ে গেলো। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,

—“কী বলছিস বাবা? এতোদিন একা থাকবি কী করে? খাবি কী? তোর যদি কোনো সমস্যা হয় তখন তোকে কে সামলাবে?”

—“আহা মা এতো উতলা হচ্ছো কেন? আমার এই চারদিন কিছু শুটিং প্লেসে যেতে হবে। আর আপু তো বললো সে চিল করতে চায়, তাই আমি নাহয় আপুর জায়গায় কিছুদিন দেখি। আমার অফিস আর এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই সময় চলে যাবে। আর খাবার হোটেল বা নিজে রান্না করে খাবো!”

—“ওরে আমার লক্ষি ভাইটা! এতোদিন অফিস জয়েন করবে না বলে কতো কী করলো আর এখন সে অফিস জয়েন করবে এমডি হয়ে!”

—“নাহ। জাস্ট এই চারদিনের জন্য। আমার আর কাজ কী, ফাইল আদান-প্রদান আর সেই সামান্য সিগনেচার এইটুকুই তো!”

—“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম, সাবধানে থাকিস। আমি কারীবকে ফোন করে আসতে বলছি, বাসায় একা থাকা লাগবে না!”

—“আমি বাচ্চা না মা, যে একা বাড়িতে থাকতে পারবো না। আর কারীবকে আগেই ফোন করে দিয়েছি আসছে সে। এখন তোমরা রওনা হও নয়তো আবার জ্যামে পড়বা! সাবধানে দেও আল্লাহ হাফেজ।”

—“হু, তোকে আমি এড্রেস মেসেজ করে দিবো নে, সঠিক সময়ে চলে আসিস আর নিজেও সাবধানে থাকিস!” বলেই রুবাই জুবায়ের এবং মায়ের সাথে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

কারীব কতক্ষণ ধরে তার স্যারকে দেখছে। এদিকে সা’দ একমনে তার ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব বিষয়ে তার যেন কোনো হেলদোল নেই। কারীব যে কখন এসেছে সা’দ তাকেও খেয়াল করেনি। খেয়াল করবে কী করে সে যে তার ফোনের স্ক্রিনে থাকা তার মায়াবীনিকে দেখছে। সেদিন থেকে তার ফোন এবং ল্যাপটপ মায়াবীনিময়। সেটা অবশ্য কারীব জানে তাও জেনে না জানার ভান ধরে থাকে। এখনও সে জানে স্যার সেই মেয়েটাকেই দেখছে। কারীবের মাথায় হঠাৎ-আসা একটা বুদ্ধি আসলো। সে সা’দের ধ্যান ভাঙাতে হালকা কাশলো। সা’দের ধ্যান ভাঙতেই সে ফোন রেখে কারীবের দিকে তাকালো। কারীব নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলে,

—“স্যার কোথাও ঘুরতে যাবেন?”

—“সে সময় নেই, আমাদের তো এখুনি শুটিং প্লেস খুঁজতে বের হতে হবে নাকি?”

—“আমাদের হয়ে আমি সাব্বিরকে পাঠিয়েছি। সাব্বির ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আপনাকে এড্রেস আর প্লেসের ছবিগুলাও পাঠাবে। তাহলে আমাদের ঘুরতে সমস্যা কী? মাঝেমধ্যে হুটহাট ঘুরাঘুরি করাটা কিন্তু খারাপ না!”

—“তা ঠিক বলেছো! কিন্তু যাবে কোথায়?”

—“নরসিংদী।”

—“সেখানে কেন?” চোখ বড়ো বড়ো করে বললো সা’দ। সা’দের প্রশ্নে কারীব আমতা আমতা করে বললো,

—“জায়গাটা আমার বেশ লেগেছে স্যার, তাই গ্রামে ঘুরার জন্য ওই জায়গাটাই পারফেক্ট। আর সেদিন বিকালে তো আপনি একা ঘুরেছিলেন আমি কাজের কারণে তো আর ঘুরতে পারিনি!”

সা’দ কী ভেবে চুপ হয়ে গেলো। হঠাৎ কিছু একটা ভাবতেই তার মন আনন্দে নেচে উঠলো। সেই গ্রামে গেলে তো সে তার মায়াবীনিকেও দেখতে পারবে৷ সা’দের যেন খুশির শেষ নেই। তবে খুশিটাকে বহিঃপ্রকাশ না করে শান্ত সুরেই বললো,

—“ঠিক আছে তোমার যেহেতু দেখার ইচ্ছে তাহলে চলো।”

—“উহু স্যার ভুল বললেন। ইচ্ছেটা আমার নয় আপনার। এতদিন পর নিজের প্রেয়সীর সাথে যে সাক্ষাৎ করবেনবসেই লোভটা ধরে রাখতে পারেননি আপনি। তবে নো চিন্তা স্যার, আপনাদের মিল করানোর শপথ এই কারীব আগেই নিয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!” কথাগুলো মনে মনে ভেবে কারীব মুচকি হাসি দিলো। সা’দ যাওয়ার আগে নিজের ডিএসএলআর এবং জুম ক্যামেরাওগুলো নিতেও ভুললো না।

সেহের নিজের ঘরে গিয়ে দেখলো তার দাদীমা বিছানায় শুয়ে কাঁতরাচ্ছে! সেহের এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে দাদীর কাছে গেলো।

—“দাদীমা এই দাদীমা কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন? ও দাদীমা বলো না তোমার কী হয়েছে?”

দাদীমা চোখমুখ কুচকে অনেক কষ্ট করে বললো,

—“বাতের ব্যথায় মইরা যাইতাসি রে ফুল! তুই কী আমার লেইগা ফাতেমার ওই বাটা ওষুধ টা আইন্না দিতে পারবি? সারা বাড়ি খুঁজ্জি! এই ওষু কোনোহানেই পাইলাম না!”

—“এ তুমি কী বলছো দাদীমা! চাচীর বাসায় নেই?”

দাদীমা মাথা নাড়ায় যার অর্থ নেই। এদিকে সেহের পরলো আরেক ঝামেলায়। এখন প্রায় শেষ বিকাল, কিছুক্ষণ পরেই সূর্য ডুববে। ফাতেমা খালার বাড়িও পাশের গ্রাম! সেহের যাবে কখন আর আসবে কখন? আর না গেলেই বা দাদী সুস্থ হবে কী করে? সেহের আবার জিজ্ঞেস করলো,

—“দাদীমা আবিদ ভাইকে বলেছো?”

—“না! হেই তো বাড়িতই নাই, হেরে কেমতে কমু!”

এবার সেহের মহা ক্যারা কলে পরলো। বাড়িতে তপা বা রিমন নেই। জোহরা গেছে পাশের বাড়িতে। এবার সেহেরের যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। সেহের মাথায় ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে দাদীকে বললো,

—“দাদী একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো আমি যাচ্ছি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে।”
ব্যথায় দাদীমা উত্তরে কিছুই বলতে পারলো না। সেহের বাসা থেকে বের হয়ে দূরে যেতেই কেউ বলে কাউকে ফোন করে বলে উঠলো,

—“ভাই ফুলটুশি মাত্র বাসা থেইকা বাইর হইলো!”

—“কী বলিস! তাহলে পিছু নে আর আমাকে জানা কই যাচ্ছে। আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি!”

—“আইচ্ছা ভাই তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”

অপরজন উত্তরে কিছু না বলে কল কেটে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

—“আজ তোরে আমার হাত থেকে কে বাঁচাইবো সেহের?”
বলেই পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠলো এবং বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

চলবে!!!

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১২ ||

কারীব আর সা’দ জঙ্গলটায় ঘুরাফেরা করছে। সা’দ ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন পোজে বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলছে। সা’দের ফটোগ্রাফি ভিষণ পছন্দ। যখন ভার্সিটি অধ্যায়নরত ছিলো তখন এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে তার ছবিটি ম্যাগাজিনে গিয়েছিলো। সেই থেকে মূলত এই মুভী-ড্রামাতে তার আগ্রহ শুরু হয়। আজও সা’দ যেন সেই বয়সে চলে গেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে সে ছবি তুলছে অনবরত। কারীবের হঠাৎ দূরে খেয়াল যেতেই দেখলো সেহের জঙ্গলে ঢুকছে। এ দেখে কারীবের খুশির রেশ রইলো না। সে তখনই সা’দকে বলে উঠলো,

—“স্যার! আমার ওই দিকটা থেকে ঘুরে আসি আপনি আপনার ফটো ক্লিক কন্টিনিউ করুন।”

বলেই সা’দকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কারীব সেই স্থান থেকে কেটে পরলো। সা’দ ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। আবারও সে ছবি তোলায় মনোযোগী হলো। হঠাৎ তার ক্যামেরায় চলে আসলো সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটি! সা’দ আবার স্থির হয়ে গেলো, আবারও সেই অদ্ভুত অনুভূতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। বুকের ভেতরের ধুকধুক শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এভাবে এই জায়গায় তার মায়াবীনিকে দেখতে সা’দ তা ভাবতেই পারেনি। কতোদিন পর তার মায়াবীনিলে সশরীরে দেখলো আহ! ভাবলে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মায়াবীনি প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে কোনো কিছু নিয়ে বড্ড চিন্তিত। সেই চিন্তার রেশ তার চেহারা দৃশ্যমান! সেহের সা’দের প্রায় কিছুটা দূরে, তাইতো সা’দ সেহেরকে ক্যামেরা জুম করে দেখছে। আর এটাও ফলো করছে সেহের ঠিক কোথায় যাচ্ছে। হঠাৎ সা’দ খেয়াল করলো তার মায়াবীনির কেউ পিছু নিচ্ছে। এটা দেখে সা’দ ক্যামেরা নামিয়ে দেখলো। হ্যাঁ আসলেই কেউ ফলো করছে৷ ব্যাপারটা কেন যেন সা’দের ঠিক লাগলো না। সা’দ তৎক্ষনাৎ ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে সে নিজেও পিছু নিলো।

সেহেরের তখন থেকে মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিচ্ছে কিন্থ যতবার সে পেছনে ফিরছে ততবারই কাউকে দেখতে পায় না। পরে মনের ভুল ভাবলেও এখন নিস্তেজ জঙ্গলে শুকনো পাতায় পা পরার মতো খসখস শব্দ সে ঠিকই পাচ্ছে। তার ঠিকই অনুভব হচ্ছে সে ছাড়াও কেউ তার পিছে আছে। সেহের পিছে না ফুরে আল্লাহ’কে ডাকতে ডাকতে জঙ্গল থেকে জলদি বের হওয়ার দোয়া করছে। মাগরিবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। আস্তে আস্তে আঁধার নেমে আসছে। হঠাৎ একজায়গায় এসে থেমে গেলো সেহের। ভয়ে তার গলা বারবার শুকিয়ে আসছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। সেহের যেন নড়তে ভুলে গেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে। সেই মানুষটা আর কেউ নয় রাফসান! সেই পুরানো বিশ্রী হাসি দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেহের ভয়ে এক ঢোক গিলে পিছে ফিরে দৌড় লাগাতেই কারো বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো। সেহের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার সামনে থেকে সরে ছেলেটার দিকে তাকালো। অচেনা একটা ছেলে যাকে সেহের কখনো দেখেনি। তবে এই ছেলেটার দৃষ্টিতেও নোংরামি স্পষ্ট! সেহের ভয়ে ভয়ে একবার পিছে তো আরেকবার সামনে তাকাচ্ছে। রাফসান পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,

—“কী সুন্দরী ভয় লাগছে? চিন্তা করো না সোনা আজকের রাতটায় এমনিতেই একটু আকটু কষ্ট লাগবে, পরে আর লাগবে না। খুব আনন্দ পাবে তুমি জানেমান!”

রাফসানের এসব বিশ্রী কথাবার্তায় সেহেরের গা গুলিয়ে আসছে। সেহের নাক সিটকিয়ে কাঁপা গলায় বলে,

—“তোদের আমি কোনোদিন ধরা দিবো না!”

বলেই উত্তর দিকে দিলো দৌড়! কিন্তু সে বেশিদূর যেতে পারলো না তার আগেই রাফসান তার কাঁধের জামার অংশে ধরে আটকায়। কাঁধের অংশ এতো জোরেই টান দেয় যে কাঁধ থেকে ডানপাশের অর্ধেক হাতা ছিঁড়ে রাফসানের হাতে চলে আসে। আর সেহের ছিটকে দূরে পরে যার ফলে এক ধারালো গাছের ডালের সাথে তার ডানহাতের শিনা কেটে যায়! সেহের ব্যথায় কিছুটা শব্দ করে উঠলো। রাফসান জামার ছেঁড়া অংশ ফেলে সেহেরের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেহেরের ওড়নাসহ চুল টেনে উঠে দাঁড় করালো! চুলের ব্যথায় সেহের গোঙ্গানি করে নিজের চুল থেকে রাফসানের হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু ডানহাতে গভীর চট পাওয়ায় সেহের প্রায় নেতিয়ে আছে তার উপর চুল টেনে ধরার অসহ্য যন্ত্রণা! রাফসান আরও জোরে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—“যতো যা-ই করিস আজ তুই আমার হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না! চল আমার সাথে!”

বলেই রাফসান টেনে হিঁচড়ে সেহেরকে নিয়ে যেতে লাগলো। আর সেহের বারবার রাফসানকে অনুরোধ করছে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেহেরের আকুতি ভরা কথাগুলো রাফসানের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। সে এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে। রাফসানের সাথের ছেলেটাকে ইশারা করতেই ছেলেটা চলে গেলো আর রাফসান সেহেরকে নিয়ে একটা মাটির বানানো পুরানো কুড়েঘরে ঢুকলো। সেখানে কিছু নেই বললেই চলে৷ রাফসান সেহেরকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সেই কুঁড়েঘরে ফেললো। এতে একটা শুকনো কাঠ সেহেরের হাঁটুতে লাগলো যার ফলে সেই কাঠ ভেঙ্গে দুই খন্ড হয়ে গেলো। সেই কাঠের চাপেও সেহেরের হাঁটুর অনেকখানি ছিলে যায় এবং গড়িয়ে গড়িয়ে রক্তও পরা শুরু হলো। সেহের চিল্লিয়ে “আল্লাহ গোহ” বলে উঠলো। রাফসান পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,

—“কী সুন্দরী কষ্ট হচ্ছে? চিন্তা করিও না সোনা, আমি আদর দিয়ে দিয়ে তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবো।”

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। সেহের রাফসানের কন্ঠে নিজের আহত দেহ নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো আর পিছে দিকে যেতে যেতে বললো,

—“আমার ধারেকাছে আসবি না। আসলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো, তাও তোর মতো অমানুষের কাছে নিজের সতিত্ব বিসর্জন দিবো না!”

রাফসান উচ্চসরে হেসে বললো,

—“বাহ বেশ বুলি ফুটেছে আজ তোর! এই অবস্থা এতো তেজ আসে কোথা থেকে তোর? তবে আমিও দেখে ছাড়বো তুই তোর সতিত্ব কতক্ষণ আগলিয়ে রাখিস!”

সারাশরীরের অসম্ভব যন্ত্রণা এবং রক্তক্ষরণের ফলে বারংবার সেহেরের চোখ বুজে আসছে আর সব আবছা লাগছে। কিন্তু সেহের হার মানবে না, এর চেয়েও কষ্ট সহ্য করেছে সে। এই কষ্ট তার কাছে খুবই স্বল্প। তবুও সেহের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দুর্বল হয়ে কিছুদূর পিছু যেতেই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে পরলো। রাফসান হাসতে হাসতে নিজের গাঁয়ে থাকা শার্টটা খুলে সেহেরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। সেহেরের এখন আর কোনো উপায় নেই একমাত্র আল্লাহকে ডাকা ছাড়া। সেহের বারংবার আল্লাহকে ডাকছে আর অনেককিছু নিয়্যত করে চলেছে। রাফসান আর দুই ধাপ এগোতেই কেউ তার পিঠে জোরে লাথি দিলো। এতে রাফসান অন্যদিকে ছিটকে পরলো। বিকট শব্দে সেহেরের নিভু নিভু চোখ অটোমেটিক বড় হয়ে গেলো। সে এখন রাফসানকে স্পষ্ট পরে কাতরাতে দেখছে। এবার সেহের সামনের মানুষটাকে আবছা আলোয় দেখে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো। এ যে সেই বিদেশি যে ওই এক চেয়ারেই বসে থাকতো। তাকে এই মুহূর্তে এরকম একটা জায়গায় কল্পনায়ও আশা করেনি। সা’দ রক্তচক্ষু নিয়ে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে সে এই কুঁড়েঘরে পৌঁছিয়েছে। তখন পিছু নিতে নিতে সে একটা শিকলের সাথে পেঁচিয়ে পরে গিয়েছিলো। যা ছুটাতে ছুটাতে তার অবস্থা খারাপ। নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় সে কারীবকেও সাহায্যের জন্য ডাকতে পারেনি। তবে মেসেজ করেছে।

সা’দ রাফসানের কাছে গিয়ে রাফসানকে সর্বশক্তি দিয়ে ইচ্ছা মতো পিটালো। সা’দ কপট রেগে চেঁচাতে চেঁচাতে বললো,

—“তোদের মতো জানোয়ারের জন্য আমাদের পুরুষজাতিকে আজ অবধি বেশিরভাগ মেয়ে বিশ্বাস করতে পারে না! তোর সাহস কী করে হলো এভাবে মেয়েটার উপর অত্যাচার চালিয়ে তার সর্বনামশ করার চেষ্টা করা? মেয়েরা ভোগবিলাসের বস্তু নয়! অন্য মেয়ের দিকে এমন বিশ্রী নজর দেয়ার আগে পারলে নিজের মা-বোনের দিকে নজর দিয়ে দেখ কেমন লাগে! শালা কুলাঙ্কারের বাচ্চা! তোকে তো মন চাচ্ছে কুপিয়ে মেরে ফেলি! এতো লালসা থাকলে নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়ে নিজের ভোগ-লালসা পূরণ কর না, ওদের মতো নিষ্পাপ মেয়েদের কেন নজর দিয়ে তাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছি! সবার সামনে ভালো মানুষ আর ভেতরে ভেতরে কুত্তার মতো লেজ নাড়লেই তুই ভালো হিয়ে যাবি না!”

সা’দের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেহের। কী এক মুগ্ধতা যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না, তার আগেই সেহের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এদিকে সা’দের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাফসান নিজের শার্ট নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। সা’দ নিজের হাত ঝাড়তে ঝাড়তে রাগ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ তখনই তার সেহেরের দিকে নজর গেলো। কী করুণ অবস্থা সেহেরের। সা’দ নিজের গাঁয়ের কোর্ট খুলে সেহেরের গাঁয়ে জড়িয়ে দিলো। অজানা আতঙ্কে তার বুক কাঁপছে, আরেকটু দেরী করে ফেললে কী সর্বনাশটাই না করে ফেলতো ওই জানোয়ারটা। ভাবতেই সা’দের গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠছে। সা’দ এখন ভাবতে লাগলো কী করবে! শেষে উপায় না পেয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে নেটওয়ার্ক আনার জন্য হাত উঁচু করে আশেপাশে ঘুরছে সে। কারীবকে এখন তার ভিষণ প্রয়োজন।

এদিকে এক মহিলা সেই কুঁড়েঘরের সামনে দিয়ে যেতে নিতেই দুজনকে এক ঘরে দেখে ফেলে, সাথে সেহেরের করুণ অবস্থাও সে ভালোভাবে দেখলো। মহিলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। তার চেহারায় আতঙ্ক দৃশ্যমান! মহিলা আর এক মুহূর্ত দেরী না করে দৌড়ে গ্রামে ছুটে গেলো।

চলবে!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে