তৃণকান্তা পর্ব-১০

0
1207

তৃণকান্তা
পর্ব : ১০
– নিশি রাত্রি

কপাল চাপড়ে,
” হায় আল্লাহ কপালে যে কি আছে আল্লাহই ভালো জানে। ”
কল ব্যাক করতে যাওয়ার আগেই বাইকের হর্ণ বেজে উঠলো। হর্ণ শুনেই আঁৎকে উঠলো মাইশা। এই হর্ণ তার পরিচিতো। চিরপরিচিতো এই হর্ণ। ছেলেটা বড্ড পাগল। জ্বালিয়ে মারবে একদম। অনেকটা বিরক্তি নিয়ে রুমের লাইট অফ করে জানালার পর্দাটা সরাতেই দেখা গেলো, রহিম মামার দোকানের সামনে বাইকে ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে তূর্য । রাগে শরীর নিশপিশ করছে মাইশার। তূর্যের মোবাইলে কল দেয়ার সাথে সাথেই রিসিভ করে তূর্য। মাইশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– বাসার সামনে কি করছো তুমি?
– আরে বিয়ে করেছি তো বউকে ছাড়া থাকা যায়? তাই চলে এসেছি।
– তূর্য!
– আই মিস ইউ বেবি।
তূর্যের কণ্ঠস্বর কেমন যেনো নেশাগ্রস্ত মনেহলো। অনেকটা কর্কশ গলায়,
– তুমি ড্রিংক করেছো?
– ওহু। একটু খেয়েছি। একটু খেলে নেশা হয়না।
মাইশা রাগে ফোঁপাতে লাগলো। মাইশা রেগে গেলেই সাপের মতো ফুসফাস করতে থাকে। আর চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়তে থাকে। না পারে কিছু বলতে আর না পারে সহ্য করতে। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো তূর্য। এটা মাইশার বদ অভ্যাস গুলোর মধ্যে একটা। মাইশাকে রাগানোর জন্যই মাতালের এক্টিং করছিলো তূর্য।
মাইশা কিছু বলার আগেই তূর্য হেসে বললো,
– সরি সরি আম জোকিং ইয়ার। কোনো ড্রিংক ফিংক করিনি আমি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তোমাকে ।
মাইশা যেনো স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।
– হয়েছে দেখা?
– অন্ধকারে কাছে থেকে অনুভব করা যায় দুরে থেকে নয়।
– লাইট অন করা যাবেনা। তোমার আশেপাশে অনেক মানুষ।
– আমি সামনে থেকে দেখে তবেই যাবো।
– তূর্য। অনেক রাত হয়েছে বাসায় যাও।
– ওহু।
তূর্য নাছোড়বান্দা। যা একবার মুখ থেকে বের করবে সেটা করেই সে ক্ষান্ত হবে। বেশি কিছু বললে একদম বাসায় চলে আসবে।
– ওকে দাঁড়াও আমি আসছি। পাঁচ মিনিট।
কিন্ত কি ভেবে আবার বললো,
– না। একদম না আমি দুষ্টুমি করেছি। বাসায় গিয়ে কল দিচ্ছি।
কথাটা মাইশার কান অবধি পৌঁছানোর আগেই কানের কাছ থেকে মোবাইল নামিয়ে নেয় মাইশা। পার্স থেকে একশ টাকার একটা নোট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কেউ দেখলে একটা বাহানা তো দেখাতে হবে। এই মূহুর্তে দোকানে যাবার বাহানা ছাড়া আর কোনো বাহানাই খুঁজে পেলো না মাইশা।
বাড়ির বাইরে পা দেবার আগে মামির রুমে গেলো। মানুষটা যেমনই হোক না কেনো কোলে পিঠে করে মানুষতো করেছে তাকে। হোক না খারাপ তাতে কি। কাঁটা গাছ থেকেও তো ভালো কাঠ হয়। তাই বলে কি সেটাকে অগ্রাহ্য করা যায়?
বেঘোরে ঘুমোচ্ছে রাহেলা। বেচারি দিনদিন কেমন যেনো বদরাগী হয়ে যাচ্ছে। অল্প একটুতেই রেগেমেগে আগুন। আজকাল ঘুমের অসুধ খেয়ে ঘুমায়। ঘুমালে আর দিন দুনিয়ার খবর থাকে না। ফ্যান ঘুরছে। মামা ফিরতে ফিরতে রাত বারোটারও বেশি বেজে যায়। মামার জন্য অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে গেছে মামি। কেমন কুঁচকে শুইয়ে আছে । ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিয়ে কাঁথাটা তার গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো মাইশা। তূর্য যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান থেকে একমিনিটের পথ দুরে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা। কিন্তু তূর্য সেখানে নেই। মোবাইলের ডিসপ্লেতে টাইমটা দেখলো, অলরেডি দশ মিনিট অভার হয়ে গেছে। আসবে না ভেবে হয়তো তূর্য চলে গেছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বাসার দিকে পা বাড়ালো মাইশা। তবে বাসায় না গিয়ে ছাদের দিকে হাঁটতে লাগলো । আজ চাঁদটারও যেনো মন খারাপ। কেমন নিভুনিভু জোসনা। ছাদের বাউন্ডারি ধরে একমনে কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো মাইশা। আচ্ছা চাঁদটাও কি আজ তার মতো একা?
হঠাৎ করে ভেসে এলো সেই মনকাড়া কণ্ঠ।

চাঁদ শোনো,
আজ তোমার জোসনা বিলিয়ে দিওনা আমায়।
আমি অন্ধকারেই খুঁজে নিবো আমার প্রেয়সীকে।
আমার প্রেয়সী যে বড্ড লজ্জাবতী।
লজ্জা পাবে তোমার আলোতে আমায় দেখে।
আমাকে তুমি অন্ধকার করে দাও,
জোসনা ঢেলে দাও আমার প্রেয়সীর মুখে।
তোমার আলোতে মন ভরে দেখি তাকে।

মাইশা পিছুফিরে তাকাতেই দেখলো দু’হাত বুকে গুঁজে চিলেকোঠার দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। মুখে সেই এক চিলতে হাসি। এক পা দুইপা করে এগিয়ে এসে মাইশার কাছে। দুহাতের বেড়াজালে আটকে দেয় মাইশাকে। তূর্য কানের কাছে ফিসফিসিয়ে,
– বলেছিলাম না কাছে থেকে দেখে তবেই যাবো।
– লোকে দেখলে কি বলবে?
– কেউ কেউ বেঘোরে ঘুমোচ্ছে, কেউ জেগে জেগে প্রেমালাপ করছে, কেউবা বুকে আগুন নিয়ে প্রাক্তনের কথা ভাবছে আর কেউবা আমার মতো তোমাকে একটা নজর দেখার জন্য ছটফট করছে।
– ভয় হয় তূর্য। এভাবে কাছে এসো না। যদি বিচ্ছেদ হয় আমাদের? বিচ্ছেদের যন্ত্রণা যে আরো বেশি হয়।
আস্থাশীল কণ্ঠ তূর্যের।
– আমি আছি তো। শুধু বিশ্বাস রাখো। আর পাশে থেকে হাতটা ধরে রেখো।
এই কথাটার মধ্যেও যেনো বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পায় মাইশা।
মাইশাকে গভীর ভাবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তূর্য। তূর্যের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মাইশা।
এই বাহুডোরটা যেনো সোনার পালঙ্ক। যেখানে শরীর হেলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যের প্রজাপতিরা তাদের ডানা ঝাপটে এগিয়ে আসে। মাইশা ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর আগেই প্রেয়সীর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বিদায় নেয় তূর্য।

আজ মাইশার অফিসের প্রথম দিন। তূর্য খুব ভোরেই কল করে ডেকে দিয়েছে মাইশাকে। মেয়েদের তো আবার রেডি হতে তিনদিন লাগে। যদিও এই দিকটা দিয়ে মাইশা সো ফাস্ট। সাজগোজ ব্যাপারটাতে একদম সিম্পল মাইশা। কিন্তু তারপরও আজ প্রথম দিন।
সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য কাপড় বাছাই করতে আলমারিটা খুলতেই কচি কলাপাতা রঙ্গের শাড়িটা চোখে পড়লো মাইশার। শাড়িটা বের করে হাতে নিতেই তূর্যের দেয়া নামটা মনেহলো, তৃণকান্তা।

তূর্যকে বস করার একমাত্র উপকরণ হলো শাড়ি। শাড়ি পরলেই কেমন হা হয়ে তাকিয়ে থাকে তূর্য। তখন নাকি এক অন্যরকম এক মাইশা মনেহয় তাকে। তূর্যকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য অনেক খুঁজে এই শাড়িটা কিনেছিলো মাইশা।
একদিন ভোর প্রায় পাঁচটার দিকে তূর্য কল দেয়। এতো ভোরে কল পেয়ে অনেকটা চমকে উঠে মাইশা। রিসিভ করতেই তূর্য বললো,
– তৃণকান্তা! কি করছো?
– কি?
– আজ স্বপ্নে তোমাকে আমি তৃণকান্তা নাম দিয়েছিলাম। ভুলে গেছো?
– সকাল সকাল কি ভং ধরেছো বলো তো?
– আজকে কি স্বপ্ন দেখেছি জানো?
– আমার সাধের ঘুম নষ্ট করে এখন তোমার স্বপ্ন শুনাতে এসেছো? তোমাকে কাছে পাই চুল টান একটাও কম হবে না মনে রেখো।
– তুমি এমনিতেই আমার চুলের বারোটা বাজিয়ে দাও।
– তা কি স্বপ্ন শুনি মশাই।
– তুমি একদম কচি কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরে আছো। দুজন মিলে হাত ধরে কোনো ট্রেনের রাস্তায় হাঁটছি।
– তারপর নিশ্চয়ই ট্রেন এসে চাঁপা দিয়ে চলে গেছে? তুমিও মারা গেছো আমিও মারা গেছি স্বপ্ন শেষ?
তূর্য হেসে,
– না। রাস্তার পাশেই ফুটপাত ধরে একটা ছোট মেয়ে এতোগুলো ঘাসের তৈরি গহনা নিয়ে হাটছিলো বিক্রি করার জন্য। সেখান থেকেই কিছু গহনা কিনে তোমায় পড়িয়ে দিলাম।
তোমাকে কি মিষ্টি লাগছিলো জানো? তারপরই তোমাকে দেখে তোমার নাম দিয়েছি তৃণকান্তা।
– তুমি যেমন অদ্ভুত তোমার দেয়া নামটাও অদ্ভুত। তৃণকান্তা। উচ্চারণ করতে গিয়েই ক’জন যে দাঁত ভাঙ্গবে হিসেব নেই।

সেদিন স্বপ্নটা হেয়ালি ভাবে শুনলেও অনেক খুঁজে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি কিনেছিলো মাইশা। সেটা পরে তূর্যকে যখন দেখিয়েছিলো তূর্য নিজ হাতে হাতে ঘাসের তৈরি গহনা বানিয়ে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলো,
আমার স্বপ্নের তৃণকান্তা। স্বপ্নের থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে তোমায় মাইশা।
শুধু খিলখিলিয়ে হেসেছিলো মাইশা। আগের কথা ভেবেই আনমনে হাসলো মাইশা। রেডি হয়ে মামা মামীকে সালাম করে নাস্তা করে বেরিয়ে গেলো মাইশা। এই সময় তূর্যেরও অফিস। দুজনের পথ দুইদিকে। তূর্য তবুও চেয়েছিলো মাইশাকে পৌঁছে দিতে। কিন্তু মাইশা না করেছে। এতো প্রেশার নেয়ার কি দরকার?

এভাবেই কাটছে সময়। দিন আর রাত্রির মধ্যে তর্কবিতর্ক করে কখনো বিজয়ী হয় দিন কখনোবা রাত। দিনের পর রাত। আবার রাতের পর দিন। এর মধ্যে খন্ডবিখন্ড সকাল, দুপুর কিংবা গোধূলি কখনোবা সন্ধ্যা। মাইশার সাথে রাহেলা সম্পর্কটা আগের থেকে এখন বেশ স্বাভাবিক। মাইশা নিজেই ডেকে ডেকে এটা সেটা দেখাচ্ছে। কখনো বা রাহেলাও তাকে ডাকছে। দিনে অফিস রাত জেগে প্রেমালাপ করা যেনো রোজকার একটা রুটিন হয়ে গেছে তূর্য আর মাইশার।

আজও ক্লান্ত শরীরে অফিস করে মাত্রই বাসায় ফিরেছে মাইশা। দরজার খোলা দেখে অনায়াসে হেলেদুলে ড্রইংরুমে পা ফেলতেই একটা অচেনা সুর ভেসে এলো। আড়চোখে তাকাতেই দেখলো, ছ’ফুটেরও বেশি লম্বা, মোটামুটি স্বাস্থবান একটা লোক বসে বসে ফোনে কথা বলছে। তাকে ছাড়া আর কেউ নেই এই রুমে। কৌশলসম্পন্ন করতে লোকটাকে সালাম দিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়ালো মাইশা । যাওয়ার পথে অজানা মন কেনো যেনো বারবার পিছু ফিরে তাকানোর তাড়া করছিলো তাকে । কিন্তু কেনো? সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না মাইশা। তবে বাধ্য মন যেনো বলছে, তোকে তাকাতেই হবে। মাইশা তাকাতেই দেখলো লোকটিও কেমন একদৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হওয়াতেই চোখ নামিয়ে ভেতরে চলে যাওয়ার আগেই পিছু ডাকলো আমিন।
– মাইশা! এদিকে আয় তো মা।
বলতে বলতে লোকটির পাশে গিয়ে বসলো আমিন।
মাইশাও এক কদম দু কদম করে এগিয়ে গেলো তাদের দিকে । অচেনা মানুষটা তখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে। তবে এবার খুব বিরক্ত হলো মাইশা। মনেমনে বললো,
অদ্ভুত স্বভাব দেখছি এই লোকের। এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকে?
তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে,
– জি মামা।
– বস এখানে। আমার ভাগ্নী মাইশা। লেখাপড়ার পাশাপাশি জবও করছে। মাত্রই অফিস থেকে এসেছে। আহা! ছেলের বউ করার কথা অনেকেই ভাবছে, এদিক সেদিক থেকে নানান প্রস্তাব আসছে। তবে ভাগ্নীকে আমি বিয়ে দিয়ে রেখেছি। কিছুদিন পরই অনুষ্টান করে ছেলের হাতে তুলে দিবো।
মামার কথা শুনে চমকে উঠলো মাইশা। বিয়ে! মামা কিসব বলছে বুঝে উঠতে পারলো না মাইশা। তবে সেও লোকটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। লোকটি ভ্রুজোড়া কুঁচকালো। মুখের ভাবভঙ্গি এমন যেনো তিনি মামার কথাটা শুনে অনেকটা বিরক্ত হয়েছেন। তারপর কপাল কুঁচকে চোখজোড়া টেনে বললো,
– আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি মাইশা।
লোকটার কথার পিঠে মাইশা কিছু বলার আগেই মামা বললো,
– ইনি তোমার বাবা।
মনের অজান্তেই অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
– বাবা!
মহান আল্লাহর দেয়া কি সেই যোগসূত্র। বাবা বলেই কি অবচেতন মন বারবার পিছু ডাকছিলো? এটাই কি রক্তের টান?
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে