তুমি রবে ১০

0
2040
তুমি রবে ১০ . . – “স্যরি! আসলে আমি খেয়ালাই করিনি যে আপনার শরীরটাও ভিজে যাচ্ছে।” – “এত বেশি নার্ভাস হলে এমন অনেককিছুই হওয়া স্বাভাবিক।” মাহি দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বলল, – “নার্ভাস হতে যাব কেন?” – “ও, আপনি নার্ভাস হননি?” মাহি দৃঢ়কন্ঠে বলল, – “একদমই নয়।” – “আমি তো স্পষ্ট দেখছি আপনার হাত পা কাঁপছে আর শুনতেও পাচ্ছি।” মাহি আশফির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, – “কী শুনতে পাচ্ছেন?” আশফি আর একটু এগিয়ে এলো মাহির কাছে। তারপর বলল, – “হৃদপিন্ডের গতিবেগ।” মাহি পুরো থমকে গেল আশফির শেষ কথা শুনে। বলা বাহুল্য, আশফি তার খুব কাছে যতবারই এসেছে ততবারই তার হৃদপিন্ডের গতিবেগ বহু গুণে বেড়ে গেছে। আর এবারও তার ভিন্ন কিছু হয়নি। আর সে থমকে গেল এ কারণেই, আশফি তার এতটাও কাছে ছিল না যেখান থেকে সে তার হৃদপিন্ডের আওয়াজ শুনতে পাবে। তাহলে সে শুনল কী করে? এটা কি তার সিক্সসেন্স নাকি তার উপলব্ধি? মাহি নিমিষে আবার চোখদুটো বন্ধ করে ফেলল। কারণ এ মুহূর্তে আশফি তার খুবই কাছে। যে কোনোভাবে আশফির চোখে তার চোখ পড়লে আশফি বুঝে যাবে তার ভেতরের দূর্বলতা। যেমনটা কাল সে ঘুমের ঘোরে তার ভেতরের ভাবনাগুলো প্রকাশ করে ফেলেছিল। মৃদু আওয়াজে তার থেকে প্রশ্ন এলো, – “তুমি কি ভয় পাচ্ছো?” আশফির মুখে তুমি সম্বোধনটি শুনে মাহি চকিতে তাকাল তার পানে। আশফি তখন থতমত খাওয়া কণ্ঠে বলল, – “স্যরি, বাই মিসটেক।” আশফি কিচেন থেকে বেরিয়ে আসার পথে আবার থেমে গেল। মাহির দিকে ঘুরে সে প্রশ্ন করল, – “বাই দ্যা ওয়ে, আপনি এখানে কেন সেটাই তো জানা হলো না।” – “দিশানকে দেখতে এসেছিলাম দিয়ার সঙ্গে।” – “আর ওগুলো কী?” – “রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম আপনাদের জন্য।” – “কিন্তু আমি তো খাবার নিয়ে এসেছি।” – “তো কী হয়েছে? যেগুলো নিয়ে এসেছেন সেগুলো ফ্রিজে রাখুন রাতে খাবেন আর এগুলো এখন খাবেন।” মাহির এমন জোর কণ্ঠে বলা কথাগুলো শুনে আশফির কেমন যেন খুব ভালোই লাগল। সে স্মিত হেসে তার রুমে চলে গেল। মাহি তখন দাঁড়িয়ে তার হাসিটা কল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মনে মনে সে বলল, – “এভাবে কি হাসিটা না দিলেই হয় না? এই যে আপনি এত মিষ্টি করে হাসেন, আপনি কি জানেন আপনার ওই হাসি মাখা মুখটা তখন আমার কোথায় এসে লাগে? কতটা যন্ত্রণা দেয় আপনার ওই ঠোঁটের হাসিটা তা যদি আপনি জানেন তবে কি আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য হাসিটা বন্ধ করবেন? একদমই নয়, আপনার ঠোঁটদুটোর দু প্রান্তের খাজ আমাকে যে কতটা টানে তা তো আপনি জানেন না। হোক আমার যন্ত্রণা, তবুও আপনি হাসবেন।” দিয়া পুরোই আশ্চর্য হলো মাহিকে তরকারি হাতে নিয়ে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে যে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও তার চোখে বাঁধছে না! এর থেকে বড় আশ্চর্য আর কী হতে পারে?” – “এই আন্ধি!” মাহি চমকে উঠল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল, – “চিল্লাচ্ছিস কেন? আর আমি আন্ধি মানে?” – “মানে আর শোনা লাগবে না। যেন ধ্যানে দাড়িয়ে ছিলি এতক্ষণ, তাই মনে হলো। আর তোর বস যে চলে এসেছে তা দেখেছিস?” – “দেখেছি তো।” – “তাহলে খাবারটা দিবি না ওদের?” – “হ্যাঁ দেবো তো। আমরা কিন্তু খাবারটা দিয়েই চলে যাব।” – “হ্যাঁ।”
দু বান্ধবী মিলে খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে প্রথমে দিশানের রুমে গেল। বিছানার সঙ্গে গা এলিয়ে দিশান ফোনে গেম খেলতে ব্যস্ত তখন। ওদেরকে দেখে ফোনটা পাশে রেখে এক গাল হেসে বলল, – “আমাকে দেখতে এসে দুই বান্ধবী কোথায় চলে গিয়েছিলে বলো তো?” মাহি বলল, – “খাবারগুলো বাড়ছিলাম। টেবিলে সব পরিবেশন করে এসেছি। তোমরা দুই ভাই খেয়ে নিও।” – “মানে? তোমরা কি এখন আলভিদা বলতে চাইছো না কি?” দিয়া তখন বলল, – “হ্যাঁ, তাই তো চাইছিলাম।” – “তাহলে আর আসার কী প্রয়োজন ছিল বিশ মিনিটের জন্য?” দিয়া একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে মাহির দিকে তাকাল। দিশান মাহিকে বলল, – “বিকালটা অন্তত থেকে যাও। বাসায় এভাবে বসে বসে কী পরিমাণ বোর হচ্ছি যদি বুঝতে? তাহলে এই অসুস্থ ব্যক্তিটাকে একটু সময় সঙ্গ দিয়ে তাকে উপকার করতে।” দিশানের কথার মাঝে আশফি রুমে আসলো। তার কথাগুলো শুনে বলল, – “বোর কেন হবে? তোমার ফ্রেন্ড দেখতে এসেছে তোমাকে। তার সঙ্গে গল্পে বসলে তোমার তো ভাইকে লাগেও না। তো এখন তোমার ফ্রেন্ড গল্প করতে চাইছে না কেন?” আশফির কথা শুনে মাহি চোখদুটো ছোট ছোট করে রাগের ভঙ্গীতে তাকাল ওর দিকে। কিন্তু রাগের বদলে তার চোখে এক রাশ মুগ্ধতা ছেয়ে গেল। স্কাই কালার শার্টের সঙ্গে হোয়াইট কালার প্যান্ট। ওপরের দুটো বোতাম সে খুলে রেখেছে। যার জন্য হালকা কিছুটা বুক তার বেরিয়ে আছে। ভেজা চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে কপালটা আবৃত হয়ে আছে। সেই চুলগুলোর ফাঁক থেকে গৌর বর্ণের কপালের কিছু কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে শুধু। তাকে যতভাবেই মাহি দেখে ততভাবেই সে মুগ্ধ হয়। মুগ্ধতার আবেশে অজান্তেই অস্ফুটে সে বলে উঠল, – “উফঃ!” আশফি তখন দাড়িয়ে ফোন স্ক্রল করতে ব্যস্ত ছিল। ওখানে উপস্থিত বাকি দুজন তার বলা শব্দটি শুনতে না পেলেও মাহির অস্ফুট আওয়াজে বলা শব্দটি আশফির কানে পৌঁছাতে আর দেরি হলো না। আশফি চোখ উঁচু করে তার দিকে তাকাতে মাহি দ্রুত তার নজর ফিরিয়ে নিলো। দিশান এরপর বলল, – “দাড়িয়ে আছ কেন তোমরা? শোনো তোমরা দুজন এসেছো যেহেতু সারা বিকালটা আমার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তবেই তোমাদের যেতে হবে।” মাহি আর দিয়া তখন দুজন দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল। তাদের এমন আচরণ দেখে দিশান অভিযোগের সুরে আশফিকে বলল, – “ভাইয়া দেখছো ওরা কেমন করছে? কিছু বলছো না কেন তুমি ওদের?” আশফি ফোনটা পকেটে রেখে দিশানকে বলল, – “তুই কি ডাইনিং এ গিয়ে খাবি নাকি রুমে বসে?” দিশান বলল, – “রুমে বসে খেলেই তো ভালো হয়। কেন?” – “তাহলে তোর ফ্রেন্ডকে বল যেন একটু কষ্ট করে আমাকে হেল্প করে। খাবারগুলো আমি এখানে নিয়ে আসছি।” দিয়া আর মাহি তখন এক সঙ্গে বলে উঠল, – “আমরা নিয়ে আসছি।” দিশান আর আশফি দুজন এক সঙ্গে চমকে ওদের দিকে তাকাল। দিশান হেসে বলল, – “ভাইয়া আমার ফ্রেন্ডগুলো তো খুবই কেয়ারফুলি মনে হচ্ছে।” দিয়া বলল, – “কে আপনার ফ্রেন্ড? আমি আপনার কোনো ফ্রেন্ড নই। অ্যাস অ্যা নেইবার আপনাকে দেখতে এসেছি শুধু।” অনেকটা ঝগড়ার সুরে বলে উঠল দিয়া। দিশান তার তালে তাল মিলিয়ে বলল, – “হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। অ্যাস অ্যা নেইবার ইমপ্রেস করার ধান্দা। বুঝি তো!” দিশানের এ কথার পরই দিয়া শুরু করল তার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া। এক কথা দুই কথায় লেগে গেল তাদের খুনশুটি নামক ঝগড়া। মাহি একবার বিস্মিত হয়ে দিশানের উত্তর শোনে আবার দিয়ার উত্তর শোনে। আশফি কিছুটা হেসে মাহিকে ইশারা করে ডাইনিং এ চলে গেল। ডাইনিং এ এসে মাহি আশফি সঙ্গে সমস্ত খাবারগুলো দিশানের রুমের টি টেবিলে সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। সবশেষে যখন পানির জগ আর মগ আনতে গেল মাহি তখন আশফি ওর পিছু এসে ওর কানের কাছে মৃদু আওয়াজে বলল, – “থাকুন না বিকালটা। ভয় নেই, কোনো অসভ্যতামি করব না।” তার কথা শুনে মাহি ওখানেই থমকে দাড়িয়ে পড়ল। আশফি তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে পানির জগ হাতে নিয়ে রুমে চলে গেল। আর মাহি গ্লাসগুলো হাতে নিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকল। রুমে আসার পর মাহি দেখল দিশান চোখ বন্থ করে আর কান চেপে আছে আর দিয়া একটার পর একটা কথা বলে তাকে ঝেরেই চলেছে। মাহি দিয়াকে থামতে বলে একটু হেসে দিশানকে বলল, – “কানটা খুলতে পারো এখন।” দিশান ‘উহ্’ বলে কান থেকে হাত সরালো। তারপর আশফিকে বলল, – “দাদা ঠিকই বলে ভাই। মেয়েলোক আর খালি কলসি সমান।” আশফি প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে মাহিকে শুনিয়ে জবাব দিলো, – “হ্যাঁ দুটোর ভেতরেই যে শুন্য তাই বাজে বেশি।” কথাখানা বলে মাহির দিকে এক পলক তাকাতে দেখল মাহি চোখদুটো ছোট ছোট করে আর কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আশফি খাবারটা প্লেটে বেড়ে দিশানের হাতে দিলো। তারপর দিয়াকে বলল, – “আপনারা দুজন প্লিজ বসুন। এভাবে দাড়িয়ে থাকার জন্য এসেছেন না কি?” এ কথার প্রেক্ষিতে দিশান বলল, – “হ্যাঁ বসো মাহি, না হলে আমাদের বিয়ে হবে না। ভাইয়ার শখ নেই অবশ্য এতে কিন্তু আমার খুব শখ আবার বিয়ে করে বউকে জ্বালানোর।” মাহি হাসতে হাসতে দিয়াকে বলল, – “যা বস।” দিয়া এসে আশফির পাশে বসল। মাহি দিয়ার পাশে বসতে গেলে দিশান তখন বলল, – “তোমরা তিনজন এভাবে এক সঙ্গে বসে খাবে আর আমি এখানে একা বসব। আমার এখন সত্যিই মনে হচ্ছে আমি রোগী। প্লিজ তোমরা আমাকে এমন একটা অনুভূতি দিও না।” আশফি তখন বলল, – “বস, আমি আসছি।” আশফি উঠতে গেলে দিশান তাকে বলল, – “কোনো প্রয়োজন নেই ভাই। আমার পা নর্মাল আছে তো।” দিশান খাবারের প্লেটটা মাহির হাতে ধরিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। তারপর মাহিকে বলল, – “ধন্যবাদ সুন্দরী। এবার তুমি বসতে পারো।” মাহি বসার পূর্বেই দিশান দিয়ার পাশে এসে বসলো। দিয়া তখন এক লোকমা মুখে পুরেছে। লোকমা মুখে পুরে গাল ফুলিয়ে রাগ চোখে তাকাল দিশানের দিকে। আর এদিকে আশফি দ্বিধা মুখে মাহিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে বলল, – “আপনি আমার পাশের সোফাটাতে এসে বসতে পারেন।” মাহি তার পাশের সোফাতে এসে বসলো। আশফি তখন ভাত মাখতে মাখতে তাকে বলল, – “পুরুষ মানুষের পাশে বসতেও এত আনইজি ফিল হয় কারো!” আশফির পিঞ্চ করা কথার উত্তরে মাহি নিশ্চুপ থাকল। পড়ন্ত বিকেলে রোদ্দুরের মৃদু আভা এসে পড়েছে বেলকনিটাতে। আশফি যখন সারা বিকাল বাসায় থাকে তখন সে কফি হাতে বিকাল থেকে সাঁঝ নামা অবধি বেলকনিতে বসেই কাজে ব্যস্ত থাকে। আজ অবশ্য কাজের মুড না থাকলেও কফির মুডটা ঠিকই রইল। দিশানের রুম থেকে তাদের তিনজনের সোরগোলের শব্দ কানে ভেসে আসছে তার। পাঁচ মিনিটের মতো হলো সে নিজের রুমটাতে এসেছে। কিন্তু মনটা আর নিজের ঘরে টিকল না বেশিক্ষণ। দিশানের রুমে এসে তাদের তিনজনকে বলল, – “কফি চলবে তোমাদের?” দিশান বলল, – “প্রশ্ন করার অপেক্ষা রাখে না ভাইয়া।” আশফি কফি করার জন্য যেতে নিলে মাহি তখন বলল, – “কফিটা আমি তৈরি করে আনি?” আশফি শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। তারপর সে নিজের রুমের দিকে গেল। দিয়া বলল, – “এই তুই গেমটা ছেড়ে চলে যাবি?” দিশান তখন বলল, – “এসব গেম মেয়েদের জন্য নই দিয়াবাড়ি! তাই মাহি আগে ভাগেই হার মেনে নিলো।” মাহি বলল, – “আসলে মোবাইলের গেমের প্রতি আমার সত্যি কোনো ইন্টারেস্ট নেই দিশান। তোমরা দুজন খেল।” – “তুমি তো এমনিতেও হারছিলে। আর এখন তোমার বান্ধবীও হেরে যাওয়ার ভয়ে কেটে পড়বে।” দিয়া তার কথাতে ফোঁস করে উঠল। সে বলল, – “আমি এই গেমের বস বুঝলেন? দেখি আপনি কীভাবে জিততে পারেন।” – “তাহলে শুরু থেকে শুরু করি?” – “অবশ্যই।” মাহি ওদের কান্ডে না হেসে আর পারল না। সে গেম ছেড়ে চলে এলো কিচেনে। কফিটা তৈরি করা শেষে পায়ের নিচে সে তরকারি পড়ে থাকতে দেখে সেটা আবার পরিষ্কার করতে বসলো। তখন আসরের আজানের ধ্বনি কানে ভেসে এলো তার। জায়গাটা পরিষ্কার করে উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় ওড়না দেওয়ার চেষ্টা করল আজান শুনতে পেয়ে। কিন্তু নোংরা হাতে ঠিক মতো সে ওড়নাটা মাথায় তুলতে পারল না। মাহির কফি আনতে দেরি হতে দেখে তখনই আশফি এলো কিচেনে। মাথায় ওড়না তোলার বৃথা চেষ্টাতে ব্যস্ত তখনও মাহি। আশফি একটু কেশে উঠল তখন। মাহি তার দিকে তাকাতে সে ইশারায় তাকে বোঝাল তার আপত্তি না থাকলে ওড়নাটা সে মাথায় তুলে দিতে পারে। মাহি ক্ষণিকের জন্য নীরব থাকলেও মাথা ঝাকিয়ে তাকে সম্মতি দিলো। আশফি এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে গোলাপি বর্ণের ওড়নাটা মাহির মাথাতে উঠিয়ে দিলো আর সামনের এক গুচ্ছ কাটা চুলগুলোও মাহির কানের পাশে গুজে দিলো। মাহি তখন নিস্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে ছিল আশফির দিকে। তারপর তাকে প্রশ্ন করল, – “আপনি কী করে বুঝলেন চুলগুলো আমায় বিরক্ত করছিল?” প্রশ্নটা শুনে আশফি কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল, – “আপনার এই ঘন পাপড়ির সুন্দর চোখটাকে ঢেকে রাখছিল। তাই ওগুলোকে সরিয়ে দিলাম।” কথাটা বলে আশফি এক মগ কফি নিয়ে বলল, – “গেম খেলাটা শেষ হলে একবার আমার রুমে আসতে পারবেন? কিছু কথা ছিল।” মাহি শুধু মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ জানাল। মুখে কিছু বলল না। আশফি তার রুমে যেতেই মাহি হাতটা ধুঁয়ে কফি দুটো নিয়ে আগে দিয়া আর দিশানকে দিতে গেল। তারপর নিজের মগটা হাতে করে আশফির রুমে এলো। আশফি তখন কফি হাতে তার বেলকনির কাউচে বসে রয়েছে। মাহি বেলকনির রেলিং ঘেষে এসে দাঁড়াল। মাহি খেয়াল করল আশফির ডান হাতে সিগারেট জ্বলছে। সেটা দেখে পুরো মেজাজটাই বিগড়ে গেল তার। বাড়িতে একটা ছেলে মানুষও শুধু তার ভয়ে সিগারেট হাতে তুলে না। আর কেউ যদি তার সামনে দাড়িয়ে সিগারেট ফু্ঁকতে থাকে তখন তাকে বলা মাহির কথাগুলো হয়, – “কী ভাই! বিরিয়ানি খাওয়া শেষ হয়নি? হলে হাতটা ধুঁয়ে আসুন প্লিজ।” কিন্তু এ ক্ষেত্রে মাহি কী বলবে ভেবে পেল না। তাই সে কিছু না বলে বেলকনি থেকে চলে আসতে গেলে আশফি তখন বলল, – “কী হলো? কোথায় যাচ্ছেন?” মাহি দাড়িয়ে পড়ে তাকে বলল, – “আপনার বিরিয়ানিটা শেষ করুন। শেষ হলে আমাকে ডাকবেন।” আশফির কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে মাহির বলা ইঙ্গিতটা। মাহি বেলকনি পার করে রুমে ঢোকার পূর্বেই আশফি তার হাতটা টেনে ধরে বলল, – “আরে দাড়ান।” আশফির দিকে সে ঘুরে তাকাতেই আশফি তার হাতটা ছেড়ে দিলো। আচমকা মাহির হাতটা ধরার কারণে আশফি নিজে থেকেই বলল, – “স্যরি।” তারপর সিগারেটটা নিচে ফেলে কাউচে বসে পড়ে বলল, – “আপনার তো দেখছি দারুণ রাগ!” – “আপনি সিগারেটটা কোথায় ফেললেন?” আশফি মাহির দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব রইল। তারপর আবার উঠে দাড়িয়ে নিচে তাকিয়ে উঁকি দিয়ে বলল, – “আজকে আর কেউ বৃষ্টিবিলাস করছিল না। আর বৃষ্টিও তো নেই।” – “যদি নিচে কারো মাথার ওপর গিয়ে পড়ে?” – “যতবার ফেলেছি তার কোনোবারই পড়েনি।” – “তো আপনার মতো শিল্পপতি মানুষ একটা ছাইদানি কি কিনতে অক্ষম?” – “এক্সট্রিমলি স্যরি ম্যাম। কিন্তু আমি নিয়মিত স্মোক করি না। খুবই কম, যার জন্য ছাইদানিটা কেনা হয়নি। তবে এরপর থেকে কিনে রাখব। বলা তো যায় না আবার কার বৃষ্টিবিলাসের কাঁথায় সিগারেট দিয়ে ফেলি।” কথাটা শুনে মাহির রীতিমতো প্রচুর হাসি পেল। কিন্তু সে হাসিটা চেপে রেখে রেলিং ঘেষে দাড়িয়ে বলল, – “রেগুলার যেহেতু করেন না তো একেবারে বাদ দিলে কী হয়?” আশফি কফিটা এক চুমুক দিয়ে বলল, – “প্রচুর টেনশনে থাকলে একটু করি।” – “এই কথাটা প্রায় লোকই বলে। কিন্তু এতে কি টেনশনটা আসলেই কমে না কি টেনশনের কারণটা সমাধান হয়ে যায়?” – “কোনোটাই হয় না। একটা অভ্যাস হয়ে গেছে তাই।” – “অভ্যাসটা বদঅভ্যাস হওয়ার পূর্বে পরিত্যাগ করুন প্লিজ।” মাহির গলাতে অনুরোধের সুর শুনে আশফি তার দিকে তাকাল। তার পুরো চেহারাটার মধ্যেই সে তার আকুল অনুরোধ ফুটিয়ে রেখেছে। আশফি কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে চুপ থেকে তার অনুরোধখানা রাখার প্রতিশ্রুতি দিলো মাথা ঝাকিয়ে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠল, – “আপনি কি এঙ্গেজড?” মাহি তার এ প্রশ্নটার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে মাহি কিছুটা অবাক হলো। তারপর বলল, – “না।” – “কাল ঐন্দ্রী বলছিল বোধহয় এমন কিছু কথা। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কী। বিয়ের কথাবার্তা চলছে না কি?” – “ঠিক তেমনটা নয় আবার তেমনই।” আশফি কফিটা পাশে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, – “ঠিক বুঝলাম না।” – “আসলে খুব ছোট থেকে সোম ভাইয়ার ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির খুব ভালো সম্পর্ক। আমার স্কুল লাইফ থেকে ভার্সিটি লাইফ অবধি আমাকে সিকিউরিটি দেওয়ার মতো করেই সবসময় আমার সঙ্গে থেকেছে সে। যার জন্য আমার পরিবার খুব ভরসা করে ওকে। তাদের একরকম ইচ্ছা আমার বাকি জীবনের দায়িত্বও তার হাতে তুলে দেবে।” – “আচ্ছা আপনাকে ও কেন এভাবে সব সময় সিকিউরিটি দিতো? মানে বিশেষ কোনো কারণ বা ঘটনা আছে?” – “আমি যখন ক্লাস নাইনে তখনকার ঘটনা। একদিন স্কুল শেষ করে বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেদিন আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। মাগরিবের আজান দেওয়া শেষ তখন। আমাদের মহল্লার গলি তখন একটু ফাঁকাই সেদিন। কারণ রমজান মাস শুরু হয়েছে তখন। তাই সবাই ইফতার করতে ব্যস্ত। আমি আমার বাসার গলিতে তখনো ঢুকিনি। হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত ধরে টেনে আমার মুখ চেপে ধরে একটা দোকানের পিছে নিয়ে যায়। তার চোখ দুটো ছাড়া মুখটা ঢাকা ছিল।” এটুকু বলে মাহি কিছুটা সংকোচবোধ করল পরের কথাগুলো বলতে। আশফি তা বুঝতে পেরে বলল, – “কথাগুলো বলতে আপত্তি হলে স্কিপ করে বাকি ঘটনা বলুন।” – “আমি বলছি। দোকানের পেছনটা অন্ধকারই ছিল। তাই সে মুখটা খুলে ফেলে আমাকে চুমু দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে এমনকি আমার ড্রেসের ক্রস বেল্টটাএ সে টেনে খোলার চেষ্টা করে। আমি তখন তার তলপেট বরাবর আমার হাঁটু দ্বারা আঘাত করি। সে ব্যাথায় ককিয়ে উঠে দূরে সরে যায়। তারপর আমা দৌড়ে চলে আসি সেখান থেকে। এই একটা ঘটনার পর থেকে আমাকে প্রথম কিছুদিন আমার চাচাতো ভাই লিমন স্কুলে দিয়ে যেত আর নিয়ে যেত। এরপর ও ক্যাম্পাসে চলে গেলে সোম ভাই সবসময় আমার সঙ্গে থাকত।” কথাগুলো শেষ করে মাহি আশফির দিকে তাকাল। মাহি খেয়াল করল তার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে। আশফি তখন নিচে তাকিয়ে ছিল। সে জিজ্ঞেস করল, – “আপনি তার মুখটা দেখতে পাননি?” – “না, প্রথমত আমি খুব ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আর দ্বিতীয়ত দোকানের পিছে ক্যারাম খেলার জায়গা ছিল। আর জায়গাটা আটকা থাকার কারণে ভালোই অন্ধকার ছিল।” – “আচ্ছা এ প্রসঙ্গ বাদ দিন। আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাইছি।” – “করুন।” আশফি বেশ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করল, – “সোমকে আপনি পছন্দ করেন?” মাহি আশফির প্রশ্নে সরাসরি উত্তর না দিতে পারলেও আশফি তার মুখভঙ্গীর মাঝে তার উত্তর পেয়ে গেল। এবার আশফি উঠে এলো মাহির কাছে। মাহিকে বলল, – “আপনি খুব বাবা-মা বাধ্য সন্তান তা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি তাদের কথা, তাদের আদেশ নিষেধ মেনে চলেন এটা খুবই ভালো। কিন্তু আপনি আপনার পছন্দ অপছন্দও যদি অন্য কারো ওপর ছেড়ে দেন তাহলে এটাকে বাধ্য হওয়া বলে না, বলে দাসত্ব। আমি কিন্তু আপনার বাবা-মাকে মেনশন করছি না এখানে। আচ্ছা আপনি একদিন একজনের বাইকে চড়ে অফিস এসেছিলেন। আমার যদি ভুল না হয় তাহলে সে সোম ছিল।” – “হ্যাঁ।” – “প্রচন্ড বিরক্ত ছিলেন আপনি সেদিন তার উপর। রাস্তার মাঝে এই যে আপনার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সে আপনার চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে কানের পিছে গুজে দিয়েছিল, সেটা আমি কী করে বুঝলাম বলুন তো?” – “কী করে বুঝলেন?” – “আপনার চেহারাটা দেখে। আপনি রীতিমতো তার হাতের রিমোট হয়ে গেছেন সেটা কি আপনি জানেন?” – “আসলে আমার পরিবার…” আশফি মাহির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, – “আপনার পরিবার আজ যদি আপনাকে বলে কারো বাসার চাকরগিরি করতে তো আপনি সেটাই করবেন। আপনি হচ্ছেন সেই টাইপের মানুষ।” মাহি আশফির দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে। মাহি বলল, – “আপনি মূলত আমাকে যেমনটা ভাবছেন আসলে ঠিক…” – “আসলে ঠিক তেমনটাই আপনি। আপনি জানেন দিশানের এই অবস্থা কেন। আর তার জন্যই আপনি আজ অফিসে আসেননি। কারণ আপনি আমার মুখোমুখি হতে পারবেন না। কিন্তু আপনি কি এটা জানেন যে আপনার জন্যই দিশানের আজ এই হাল?” মাহি বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আশফিকে বলল, – “আমার জন্য? কী বলছেন আপনি?” – “হ্যাঁ আপনার জন্যই। আমি সেদিন শুনেছি ঐন্দ্রীর কথাগুলো। এর আগেও আপনার কিছু ছেলে বন্ধুদের সে মেরেছে। কী কারণে? আপনার সঙ্গে মেশার জন্য। আজ দিশান কেন মার খেল তার কাছে? আপনার সঙ্গে ও বন্ধুর মতো মিশেছে বলে।” – “তো এখানে আমার দোষ কোথায়?” – “আপনি এখনো বুঝতে পারছেন না আপনার দোষ কোথায়? আপনি কখনো তার এই কাজগুলোর জন্য প্রতিবাদ করেছেন? বলুন? আপনি তার কথামতোই উল্টে সেই সব বন্ধুগুলোকে এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু তার প্রতিবাদস্বরূপ আপনি একটা বাক্য উচ্চারণ করেছেন তার প্রতি? আজকে দিশানকে সে মেরেছে। এর বিপরীতেও কি আপনি একটা কথা বলেছেন? বলেননি নিশ্চয়। কারণ সে আপনার উডবি বলে? আপনার পরিবার তাকে খুব পছন্দ করে আর ভরসা করে বলে? তাহলে আমি বলব আপনি আর সে সমান দোষী। এই যে সোম আপনার সঙ্গে মেশার জন্য এতগুলো ছেলেকে মেরেছে এতে আপনি খুব হ্যাপি ফিল করেন বা সোমকে নিয়ে প্রাউড ফিল করেন, রাইট? এটাই ভাবেন হয়তো একটা ছেলে আপনার জন্য কতটা পজেসিভ, কতটা চিন্তিত আপনাকে নিয়ে, তাই না?” আশফির শেষ কথাগুলো শুনে মাহির খুব কান্না পেয়ে গেল। কান্নাটা গলাতে ধরে সে আশফিকে বলল, – “আপনি কিন্তু একটু বেশিই বলছেন।” – “বেশি কোনটা? আপনার সোমকে এই ব্যাপারগুলোতে প্রশ্রয় দেওয়াটা না কি আপনার এই ব্যাপারগুলোতে চুপ থাকাটা? সে কতটা ন্যারো মাইন্ডেড তা তো বলার অপেক্ষা রাখেই না। আর তার মতো ছেলেকে যে জীবনসঙ্গী করার মতো একটা বাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে আমি শুধু তার কথা ভাবছি। মানে সে কি নির্বোধ না কি সেও তার মতোই মনের অধিকারী?” এবার মাহি তার কান্নাটা আর চেপে রাখতে পারল না। কাঁদার মুহূর্তে সে বলল, – “আর কিছু বলার আছে আপনার?” এই প্রশ্নটা শুনে আশফির রাগটা যেন আরও বেশি বেড়ে গেল। সে আশা করেছিল এত কিছুর পর মাহি হয়তো তার সিদ্ধান্তটা যে ভুল তা বুঝতে পারার কথা বলবে। কিন্তু আশফি এটাও জানে এত কিছু বলার অধিকার তার নেই। তবে আজ সে কথাগুলো না বলেও শান্তি পাবে না। তাই সে বলল, – “ওপস্ স্যরি! প্রচন্ড বাঁধছে কথাগুলো? যতই হোক, সে আপনার পরিবারের পছন্দ করা ভরসাপূর্ণ একটি মানুষ। তাকে অসম্মান করাটা আপনি কী করে মেনে নেবেন? কিন্তু আমি তো তাকে আপনার মতো সম্মান করতে পারব না। তাকে তার যোগ্য জায়গা আমি দেখিয়ে দেবো। সে আপনার উববি নাকি আপনার পরিবারের ভরসাপূর্ণ মানুষ এটা তো আমি দেখব না। আমি শুধু দেখব তার মতো ছোট মনের মানুষকে কেউ অ্যাক্সেপ্ট করে তার ছোট মনের পরিচয় কী করে দিতে পারে সে।” আশফির এই একটা কথার উত্তরও মাহি দিতে পারল না। প্রচন্ড খারাপ লাগল তার। আর দেরি না করে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে সে চলে গেল তার ফ্লাট থেকে। …………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে