তুমি রবে ১১

0
2212
তুমি রবে ১১ . . আশফি যা বোঝাতে চেয়েছে তা যে মাহি বুঝতে পারেনি তাতে সে নিশ্চিত। কারণ মেয়েটা প্রচুর ইমোশোনাল আর বোকা। সে শুধু হয়তো আশফির রাগ আর তার বকাটাই দেখল। কিন্তু তার এত রাগ হওয়ার কারণটা সে বুঝল না। বুঝলে কী আর এভাবে রেগে বেরিয়ে যেত? আশফি ভারী একটা শ্বাস ছেড়ে বসলো। দিয়া আর দিশান আশফির উচ্চস্বর শুনতে পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে তারা ওর সব কথাই শুনেছে তখন। দিয়া কিছু না বলে চলে গেল নিজের ফ্লাটে। দিশান এলো ভাইয়ের কাছে। – “ভাইয়া মাহি কিন্তু সত্যিই খুব ইনোসেন্ট।” – “আমি কখন বললাম সে দোষী?” – “তুমি তো তাই-ই বললে।” – “দিশান বোকার মতো কথা বলিস না। আমি ওকে কী বোঝাতে চেয়েছি তা কি তুই বুঝিসনি?” – “বুঝেছি তো। কিন্তু তুমি একটু সফ্টলি বললেও পারতে।” – “কী করে সফ্ট হবো আমি? একে তো তোর এই হাল করল ওই ছেলেটা। তার উপর মাহিকে সে নিজের দাসী বান্দির মতো উঠতে বসতে বলে। আর মাহি সেটা চুপচাপ মেনে নেয়। কেন ও কি অন্ধ না প্রতিবন্ধি? যে ওকে ওর হুকুম মেনে চলতে হবে? সব থেকে বড় ব্যাপার ও এই যুগের মেয়ে হয়ে এমনভাবে কী করে চলা ফেরা করতে পারে? আর ওই ছেলে কি আদৌ ওর যোগ্য? যে এখনই মাহির ভালো লাগা মন্দ লাগার দাম দেয় না। সে কি বিয়ের পর ওকে এক পয়সার মূল্য দেবে? কখনোই না। আমি শুধু মাহিকে এটাই বোঝাতে চেয়েছি ও ওই ছেলেকে রিফিউজড করুক। ওর মতো মেয়ের যোগ্য ছেলে ওই সোম নয়।” – “তোমার সব কথাগুলোই ঠিক। কিন্তু এখানে কি তোমার এগুলো বলার অধিকার আছে বলো?” – “হ্যাঁ জানি। কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছিল না এগুলো না বলা পর্যন্ত।” – “আর একটা ব্যাপার কী জানো? এই ছেলের নেগেটিভ সাইড এত দ্রুত ওর পরিবারের চোখ পড়বে না। কখন পড়বে বলো তো?” – “যখন মাহিকে পার্মানেন্টলি ওর হুকুমের দাস বানাবে।” – “হ্যাঁ রাইট। তুমি দেখো, এর আগে ওর পরিবার কখনোই সোমকে চিনবে না। বরং মাহি যদি এখন সোমকে রিফিউজডও করতে চায় তখন ওর পরিবার মানে ওর বাবা-মায়ের কথাগুলো এমন হবে যে ‘সোমের মতো ছেলে তুই আর একটাও পাবি না। এত বেশি টেক কেয়ার কেউ তোকে করতে পারবে না।’ আসলে আমাদের সমাজে এমন ধরনের পরিবারগুলোই তো বেশি।” – “যা খুশি করুক সে। তাতে আমার কী? সামান্য বোধটুকু যার হলো না যে এখনই তাকে ওর কথা মতো উঠতে বসতে হয় তবে বাকি জীবনটা তাকে কী করতে হবে?” – “যাই হোক বাদ দাও। এটা আমার তোমার বিষয় নয়। তবে মাহি কিন্তু সত্যি খুব কষ্ট পেয়েছে।” – “জানি, ও কাঁদছিল।” – “তাও তুমি বকলে ওকে?” – “ওর শেষ কথাটা শুনে রাগটা বেশি চড়ে গিয়েছিল।” রাত ঠিক এগারোটার সময় শায়খের কিছু কনস্টেবল সিভিল ড্রেসে দাঁড়িয়ে রইল মিরপুর দুইয়ের একটি গলিতে। আশফি আর শায়খ ইমরানের কার শোরুমে গেল। তারপর একটি কার পছন্দ করে সেটা ড্রাইভ করে দেখার জন্য শায়খ ইমরানকে বলল, – “ভাই একটু ঘুরিয়ে দেখতে পারল ভালো হতো।” ইমরান বলল, – “হ্যাঁ অবশ্যই। আপনারা চালায় দেখেন, কোনো প্রবলেম নাই।” – “কেউ আসবে না আমাদের সঙ্গে?” – “হ্যাঁ চলেন আমিই যাব।” আশফি বসলো ড্রাইভিং সিটে। শায়খ পেছনের সিটে বসে ইমরানকে বলল, – “আপনি সামনে গিয়ে বসেন ভাই।” – “আচ্ছা।” গাড়িটা কিছুদূর চালিয়ে আনার পরই শায়খ পেছন থেকে ইমরানের মাথায় খুব জোরে কিল মেরে বেল্ট দিয়ে ওর গলা আটকে ধরল। আশফি গাড়ি থামিয়ে ওর হাতটা বেঁধে আবার ড্রাইভ করে সোজা সেই গলিতে চলে এলো যেখানে কনস্টেবলগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আশফি গাড়ি থেকে নেমে ইমরানকে টেনে নামিয়ে ওর পেটে কয়েকটা ঘুষি মেরে বলল, – “তোর সাগরেদগুলোকে ফোন কর। ফোন করে বল মেয়েলি কেসে ফেঁসে গিয়েছিস এই গলিতে এসে। এলাকার পোলাপান তোকে ধরে রেখেছে।” ব্যাথায় ইমরানের কথা জড়িয়ে এলো। সে বলল, – “ভাই কাদের কথা বলতেছেন? আর আমাকে ধরছেন ক্যান?” – “তোর বন্ধু সোম, আশিক, ফয়সাল আর রিমন ওরা আমার বাসার সামনে এসে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে তাকে মেরে আবার বাসার সামনেই ফেলে গিয়েছিল। এখন মনে পড়ছে মূল ঘটনা?” ইমরান মুখ নেড়ে কিছু বলতে গেলে আশফি তখন বলল, – “তোর একটা কথাও আমি শুনব না। ওই গাড়িতে চারজন ছিল। তাদেরকে ফোন কর।” – “জি ভাই করতেছি।” ইমরান আশফির বলা কথাগুলোই একে একে চারজনকে ফোন করে বলল। তার মাঝে শুধু সোম বলল সে এখন ঢাকার বাহিরে। বাকি তিনজন আসছে বলে জানাল। ঘন্টাখানেক পর যখন সোম বাদে বাকি তিনজন এলো তখন ওরা এসে জায়গাটা পুরো ফাঁকা পেল। তারপর তারা ফিরে আসতে গেলে পেছন থেকে কনস্টেবলগুলো, শায়খ আর আশফি ওদের ধরে উত্তম মধ্যম দিলো বেশ কিছুক্ষণ। কনস্টেবল একজন পুলিশের গাড়ি নিয়ে এসে ওদের তিনজনকে উঠিয়ে নিলো। ওদেরকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর আশফির সঙ্গে ওর গাড়িতে এসে বসলো শায়খ।
ঘাম মুছতে মুছতে শায়খ বলল, – “মেরে তো ভাই মজা পেলাম না।” – “আমার তো মূল টার্গেট যে ছিল তাকেই পাওয়া হলো না।” – “হ্যাঁ, একজন তো বেঁচে গেল। এরপর তো সে এগুলো জেনে সাবধান হয়ে যাবে।” – “কিন্তু তুই এটা করলি কেন?” – “কোনটা? ওই যে নিয়ে গেল ওদের? ওটা তো একটা কামায়ের ধান্দা আর কী। কাল সকালেই তো ছাড়াতে চলে আসবে ওদের। আর সেই সাথে আমাদের কিছু ইনকাম হবে।” – “বুঝলাম, এই হলো তোরা পুলিশ না?” শায়খ শুধু হাসলো আশফির কথাতে। বাসায় ফিরে রুমে ঢুকে আগে একটা শাওয়ার নিলো আশফি। গোসল করে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে যখন চুল মুছছিল তখন খেয়াল গেল হাতের দিকে। হাতের আঙুলের উল্টো পিঠে ভালোই ব্যাথা পেয়েছে সে ওদেরকে মারার সময়। আঙুলগুলোতে ব্যাথা পেয়ে হাতটা নাড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কেবিনেটের ড্রয়ার খুলে যখন অয়েন্টমেন্ট নিয়ে সেটা লাগাতে বসলো তখন ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল। দ্রুত গিয়ে মেসেজটা ওপেন করল সে। কিন্তু ঐন্দ্রীর মেসেজটা দেখে হতাশ আর বিরক্ত চোখে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে তারপর বাধ্য হয়ে সে ঐন্দ্রীর মেসেজের রিপ্লাই করল, – “আসব।” মেসেজটা রিপ্লাই করে সে আনোয়ারকে কল করল। আনোয়ার দ্রুত রিসিভ করে বলল, – “স্যার এখনি সেন্ড করতে যাচ্ছিলাম।” রাগান্বিতভাবে আশফি বলল, – “কতক্ষণ লাগে সেন্ড করতে?” ফোনটা কাটতেই সে তার কাঙ্ক্ষিত মেসেজটি পেয়ে দ্রুত মেসেজের নাম্বারটিতে টেক্সট করল একটি। প্রায় ঘন্টা দুই সময় পার হয়ে গেল কোনো রিপ্লাই এলো না। আশফি তার রিপ্লাইয়ের জন্য ওয়েট করতে করতে এক সময় ঘুমিয়েই গেল। খুব ভোরে উঠে মাহি প্রাতঃকাজ সেড়ে ফোনটা বালিশের নিচ থেকে বের করল সময় দেখার জন্য। তারপর সময় দেখে সে খাবার ঘরে এসে কিছু খেয়ে আবার ঘরে ফিরে এলো। কাল প্রায় অর্ধেক রাত অবধি সে কেঁদেছে। যার দরুন মাথাটা তার এখনো ভার হয়ে আছে। আবার শুয়ে পড়ল সে। ভেবে নিলো আজও অফিসে যাবে না। রাতে ঘুমটাও ভালো হয়নি। তাই শুতেই ঘুমের ভাবটা চলে এলো। তখন রুমে ঢুকল মুমু। কাল রাতে মেয়েটার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। এই একটাই বেঁচে থাকার সম্বল তাদের। তার কষ্ট এরা কখনোই সহ্য করতে পারবে না। মেয়েটা কোনোদিনও তাদের সাথে একটু উঁচু গলায় কথা বলেনি। কিন্তু কাল সে অনেক বড় বড় কিছু কথা বলে ফেলেছে তাকে। যার মূল প্রসঙ্গ ছিল সোম। মুমু মেয়ের কথাতে পরিষ্কার হলো সে সোমকে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এখানে যে তার হাত পা বাঁধা। একজনকে সাপোর্ট করতে গিয়ে সে যে ভুলটা করেছিল সেই ভুলটা সে মাহির বেলাতে করতে চায় না। আর তার কথাই বা কে শুনবে। এই পরিবারের রীতিনীতি তো আলহাজ সাহেবই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর কথাল বিপক্ষে যাওয়ার ক্ষমতা যে মুমু হারিয়ে ফেলেছে। হাতে এক গ্লাস হরলিক্স মেশানো দুধ নিয়ে মাহির কাছে এসে বসলো। মাহি এমনিতে কখনোই দুধটা খায় না। কিন্তু তাতে হরলিক্স মেশানো থাকলে সে এক ফোঁটাও গ্লাসে রাখে না। মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আলতো করে ডেকে তুলল মুমু। চোখদুটো মেয়েটার একদম ফুলে আছে। ফুলবেই তো। সারাটা রাত ধরে না ঘুমিয়ে নিশ্চয় কেঁদেছে। মাহি চোখ মেলে তাকালে মুমু বলল, – “অফিস যাবি না?” মাহি দায়সারা কণ্ঠে জবাব দিলো, – “না।” – “কালও তো যাসনি।” মাহি নীরব থাকল। – “আচ্ছা দেখা যাবে। ওঠ, এটা খেয়ে নে। কাল রাত থেকে তো কিছুই খাসনি।” – “আমার নাস্তা হয়ে গেছে। সকালে উঠে খেয়ে নিয়েছি।” মুমু টেনে ধরে মেয়েকে উঠিয়ে কোলের মধ্যে নিলো। মাহি শুধু মায়ের বুকে মাথা দিয়ে হেলান দিয়ে রইল। – “এখন তোর সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। হতে পারে নিজে যোগ্যতা অর্জন করে অনেক বড় কিছু হতে পারলে তখন তোর সিদ্ধান্ত তোর দাদু আর বাবা মেনে নেবে। এখনই তো তোকে তাঁরা বিয়ে দিচ্ছে না।” – “আমার বয়সটা এখন বিশে আটকে নেই মা। সর্বোচ্চ এক বছর থাকতে পারব এভাবে।” – “এই এক বছরের ভেতর কার কী বদলে যায় তা কি আমরা বলতে পারি? এমনও তো হয়, বিয়ের আসরে বিয়ে ভেঙে যায়। আবার যার সাথে হওয়ার কথা নয় তার সাথেই হয়ে যায়। আর কালকের কথা আজকে ভেবে ঘরে বন্দি হয়ে থাকার কোনো মানে হয়?” – “আমার অফিস যেতে ভালো লাগছে না।” – “শুধু শুধু অফিস কামায় করার কোনো প্রয়োজন নেই। অফিস শেষে দরকার হলে দিয়ার কাছ থেকেও ঘুরে আসিস। যা, ওঠ তো। আর বিছানায় থাকিস না। তাহলে অলসতা ঘিরে ধরবে।” ঘুম থেকে উঠতে আশফির আজ একটু দেরি হয়ে গেল। চোখটা মেলতেই কাল রাতে দেওয়া তার মেসেজের কথা মনে পড়ল। কোনো রিপ্লাই এসেছে কি না তা দেখার জন্য ফোনটা হাতে নিলো। কিন্তু না, কোনো রিপ্লাই আসেনি। সকাল সকাল মনটার এক কোণ মন খারাপের মেঘে কালো হয়ে গেল। দ্রুত নাস্তা করে রেডি হয়ে সে অফিসের উদ্দেশে চলে এলো। আজ অফিসে আরও আগে তাকে পৌঁছাতে হবে। অফিসে এশর লিফ্টের কাছাকাছি আসতেই দেখল মাহি তখন লিফ্টে ঢুকেছে। আশফি দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে লাগল কিন্তু তখনই লিফ্টটা বন্ধ হয়ে গেল তার মুখের সামনে। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কাজটা যে মাহি ইচ্ছা করে করেছে তা সে জানে। অফিসে ঢুকে মাহিকে ডেস্কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নিজের কেবিনে চলে এলো সে। তারপর ভাবতে থাকল কী উপায়ে সে মাহিকে ডাকবে। আবার ভাবল অফিসে কোনো কথা বলা যাবে না। তাহলে তার নিজের রুলসই সে ব্রেক করবে। কিন্তু এদিকে আবার কথা না বলেও শান্তি লাগছে না। কেবিন থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে সোজা মাহির ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়াল সে। মাহি তাকে আড়চোখে দেখে আবার দৃষ্টি পিসিতে রাখল। মিলি, রাতুল এবং অন্যান্য এমপ্লয়ি আশফিকে তাদের ডেস্কের সামনে দেখে সালাম জানাল। আশফি তাদের সালামের উত্তর দিয়ে সবার কাজের খবর নিয়ে আবার চলে এলো কেবিনে। প্রচন্ড ছটফট করছে তার মন। তার ইচ্ছে করছে মাহিকে টেনে ধরে কেবিনে নিয়ে এসে কথা বলতে। এদিকে ঐন্দ্রী আজ প্রচন্ড ফুরফুরে মেজাজে আছে। খুব দ্রুত আশফির পরিবার তাদের বাসায় আসবে ইনভাইটেশন পেয়ে। সে বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্য ঐন্দ্রী আশফির কেবিনে আসলো। আশফি তখন তার আহত হাতটা ধরে বসে রয়েছে। ব্যাথার যন্ত্রণায় সে কলমটাও ধরতে পারছে না। ঐন্দ্রী কেবিনে ঢুকেই লক্ষ্য করল তার হাতটা। আশফির কাছে এসে বলল, – “আশফি কী হয়েছে তোমার হাতে?” আশফি মুখে বিরক্তির ছাপ টেনে বলল, – “কিছু না।” – “কিছু না মানে? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার আঙুলগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। অয়েন্টমেন্ট লাগিয়েছো?” – “না, আর ঐন্দ্রী এটা অফিস। ব্যাপারটা মাথায় রাখবে প্লিজ।” – “সেটা পরে দেখা যাবে।” এই বলে ঐন্দ্রী বাহিরে চলে গেল। তারপর আনোয়ারকে দোকানে পাঠিয়ে একটা অয়েন্টমেন্ট নিয়ে আবার এলো সে আশফির কেবিনে। একটু জোর করেই সে আশফির আঙুলে সেটা লাগিয়ে দিতে শুরু করল। অফিসে আজ খুশি না আসার কারণে মাহি তার কাজগুলো কমপ্লিট করে আশফির কেবিনে এলো। নক করে ভেতরে ঢোকার পারমিশন চাইলে আশফি তার কণ্ঠ শুনে তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলো। মাহি কেবিনে ঢুকে দেখল ঐন্দ্রী আশফির হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগাতে ব্যস্ত। এটা দেখে সে বলল, – “স্যরি। আমি পরে আসছি।” আশফি তাকে কিছু বলার পূর্বেই মাহি বেরিয়ে এলো। মেজাজটা আরও কয়েকগুণ খারাপ হয়ে গেল তার। ঐন্দ্রীকে সে ধমকে বলল, – “ঐন্দ্রী তুমি তোমার কেবিনে যাও। এটা অফিস। ব্যক্তিগত সম্পর্কটা ব্যক্তিগতভাবে রাখাই ভালো।” ঐন্দ্রী নিজেও রেগে গিয়ে বলল, – “তুমি কি মাহি আমাদের এভাবে দেখেছে বলে রাগ করছো? ও তো আমার ফ্রেন্ড। তো সমস্যা কোথায়?” – “তোমার ফ্রেন্ড, আমার তো আর ফ্রেন্ড নয়। তুমি যাও তো প্লিজ। আমার মেজাজ ভালো নেই।” আশফির এমন আচরণে ঐন্দ্রী প্রচন্ড আহত হলো। চোখদুটোতে পানি টলমল করে উঠল তার। তারপর আর কোনো কথা না বলে সে সোজা চলে গেল তার কেবিনে। দৃশ্যটা দেখার পর থেকে মাহি আর এক ফোঁটাও কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। যতবারই সে কাজ সামনে নিয়ে বসছে ততবারই তার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে চোখের পর্দায়। এক সময় নিজের প্রতি নিজেই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে সে বলল, – “কী হয়েছে আমার? কাজ করতে এসেছি, কারো প্রেমের দৃশ্য নিয়ে ভাবতে আসিনি। আর এত ভাবার কী আছে এখানে? এটা তো স্বাভাবিকই। ঐন্দ্রী তার ফিওন্সি। আমি তো সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এমন তো আরও অনেক কিছুই হবে তাদের মাঝে। অনেক নোংরা চিন্তা করা হয়েছে। অন্যের ফিওন্সিকে নিয়ে এতদূর ভাবার মতো নোংরা কাজটাও আমার দ্বারা হলো। আর কী বাকি আছে? আর তো কিছুই বাকি নেই। দুনিয়ার সব থেকে ছোট মন মানসিকার মানুষ আমি। সত্যিই নিকৃষ্ট মানুষ আমি।” আনোয়ার এসে দেখল মাহি মাথায় হাত রেখে বসে আছে। মাহিকে বলল, – “স্যার ফ্রি হয়েছেন। আপনাকে ডাকছেন।” মাহি মাথা তুলে বলল, – “জি যাচ্ছি।” আনোয়ার যেতেই মাহি এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। সে ঠিক করল আজ থেকে সে তার এই অর্থহীন ভাবনাগুলো একদম মাটি চাপা দেবে। সব থেকে বড় ইচ্ছাটাই তাকে হয়তো মাটি চাপা দিয়ে ফেলতে হবে নীরবে। তাই ছোট ব্যাপারগুলো থেকেই শুরুটা করা ভালো। ফাইলগুলো হাতে নিয়ে সে আশফির কেবিনে এসে ঢুকল। তার কাছে আসতেই মাহির নজর গেল তার হাতের দিকে। হাতটা এত বেশি লাল দেখে মাহির তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো এত আঘাত পাওয়ার কারণ। কিন্তু সে তখনই তার ইচ্ছেটাকে ডেবে রাখল ভেতরে। আজ থেকে এই মানুষটার সব ভাবনা থেকে সে নিজেকে বিরত রাখবে। মাহি ফাইল থেকে কাগজগুলো বের করে মেইন পয়েন্টগুলো সম্পর্কে আশফির কাছে বিবরণ দিতে শুরু করল। আশফি কাগজটার দিকে তাকিয়ে মাহির কথার মাঝে জিজ্ঞেস করে উঠল, – “আমি কি তখন বলেছিলাম কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে?” কাজের কথার মাঝে আশফির এই উদ্ভট প্রশ্নটা শুনে মাহি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, – “স্যরি স্যার?” আশফি এবার মাহির দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলল। আর মাহি তার চাউনির দিকে না তাকাতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলল। আশফি বলল, – “কেন চলে গেলেন তখন? আমি কি কলেছিলাম যেতে?” মাহি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। আশফি এবার জিজ্ঞাসা করল, – “আর কাল রাতে আপনি আমার মেসেজ দেখতে পাননি?” মাহি এবারও নিশ্চুপ। – “আশ্চর্য! কথা বলেন না কেন?” মাহি কাটা জবাব দিলো, – “না দেখতে পাইনি। স্যরি স্যার একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার জানমতে অফিসে অফিস সংক্রান্ত কোনো কাজ বা কথা ব্যতিত অন্য কোনো আলোচনা করা নিষিদ্ধ।” মাহির এ কথার পর আশফি কিছুটা চুপসে গেল। এটা তারই গড়ে তোলা রুলস। যেটা আজ তাকে মাহি শিখিয়ে দিচ্ছে। তার কাছে ব্যাপারটা অনেকটা এমন মনে হলো, আমার বিড়াল আমাকেই ম্যাও শেখায়। আশফি মাথাটা নেড়ে মাহির কথার সম্মতি জানিয়ে বলল, – “অবশ্যই। তবে আপনি কী করে জানলেন যে অফিসের কাজ ব্যতিত আমি আপনাকে নক করেছি?” প্রচন্ড রাগ কণ্ঠে মাহি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, – “কারণ আপনি লিখেছেন কাল সকালে আপনার জন্য অফিসের সামনে যেন দাঁড়িয়ে ওয়েট করি।” কথাটা বলেই মাহি থমকে গেল। নিজের জালে সে নিজেই ধরা খেয়েছে। আশফির ঠোঁটে তখন মৃদু হাসি। – “মেসেজটা দেখেননি অথচ জেনে গেলেন আমি কী লিখেছি?” মাহি হাতের কলমটা রেখে শান্ত কণ্ঠে আশফিকে প্রশ্ন করল, – “আপনি কী বলতে চান বলুন?” – “অফিসে থাকাকালীন অফিসের কাজ সংক্রান্ত কোনো কথা ব্যতিত আমি কোনো বিষয়ে কথা বলি না। ছুটির পর আমার জন্য বাহিরে দাঁড়িয়ে ওয়েট করবেন।” কথাটা বলে আশফি তার কাজে মনোনিবেশ করল। রাগে মাহির শরীরটা জ্বলে উঠল তখন। কেবিন থেকে বেরিয়ে সে মনে মনে পণ করে নিলো অফিস ছুটি হওয়ার পর একটা মুহূর্তও সে দাঁড়াবে না বাহিরে। অফিস ছুটি হওয়ার দশ মিনিট আগে ঘড়ির টাইম দেখল আশফি। মাহি বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে সে খুব ধৈর্য সহকারে ওয়েট করছে ছুটির সময়ের জন্য। কেন যেন তার মনে হচ্ছে মাহি তার জন্য ওয়েট না করেই চলে যাবে। কারণ সে যে খুব জিদি আর অকারণবশত রাগী হওয়া একটা মেয়ে তা আশফি জানে। তাই সে হাতে দশ মিনিট থাকতেই মাহিকে ডেস্কে দেখে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ছুটি হওয়ার পর মাহি বেরিয়ে এসে ভাবতে থাকল আশফি হয়তো চলে গেছে। অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। আশফির গাড়িটা মাহি খেয়াল না করে তার গাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় আশফি আচমকা তার সামনে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। মাহি চমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তখন। আশফি সিটে বসে তাকে বলল, – “উঠে আসুন।” – “মানে?” – “গাড়িতে উঠুন আগে। তারপর বলছি।” – “দুঃখিত সম্ভব নয়।” এই বলে মাহি গাড়িটা ক্রস করার আগেই আশফি তার হাত ধরে ফেলল। তারপর বলল, – “আমি কোনো রোড সাইড রোমিও নই ঠিক আছে? এভাবে বার বার গাড়িতে ওঠার কথা বললে লোকে কী বলবে? তাই বাধ্য হয়ে হাতটায় ধরতে হলো।” মাহির কোনো জবাবের অপেক্ষা না করে তাকে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে ওঠাল সে। আকাশটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে। মাঝে মধ্যে থেকে থেকে মেঘের বিকট গুমগুম আওয়াজে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার পর থেকে আশফি একটা কথাও এখন অবধি বলেনি। আর মাহি সিটে বসার পর থেকে মূর্তি বনে সামনে তাকিয়ে বসে আছে। আশফি গাড়িটা নিয়ে এলো নদীর পাড়ে একটু জনমানবহীন জায়গা দেখে সেখানেই গাড়িটা থামাল। গাড়ি থেকে নেমে মাহির পাশে এসে দরজাটা খুলে বলল, – “আসুন।” মাহি মৌনতা বজায় রেখে গাড়ি থেকে নামল। বাহিরে প্রচন্ড শীতল বাতাস। নদীর কিছুটা কাছে এসে দাঁড়াল মাহি। আর তার পিছে এসে দাঁড়াল আশফি। মাহির ওড়নার আঁচলাটার অংশ এসে ছড়িয়ে পড়তে থাকল আশফির গায়ে। কিন্তু তাতে সে বাধ সাধল না। মাহি নদীর পানে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, – “বলুন কী বলবেন?” – “স্যরি।” মাহি নিশ্চুপ রইল। আশফি এসে তার পাশে দাঁড়াল এবার। – “আমি আসলে আপনার বোকামিগুলো মেনে নিতে পারছিলাম না। দিশানের মার খাওয়াটা এক ব্যাপার আর আপনার এই বোকামির সিদ্ধান্তে আটকে থাকাটা এক ব্যাপার। কাল আমি আপনার এই সিদ্ধান্তের জন্যই এত কিছু বলেছিলাম। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়। আমি জানি আপনি তার সম্পূর্ণ বিপরীতটাই ভেবে নিয়েছেন। ভেবেছেন ভাইয়ের মার খাওয়ার ব্যাপারটা হজম হচ্ছিল না বলে আপনাকে কথা শুনিয়েছি।” মাহি দৃষ্টি তার নদীর পানে রেখেই বলল, – “আপনার অফিসের রুলস আপনি তৈরি করেছেন যাতে অফিসে শান্তি আর শৃঙ্খলা বজায় থাকে। রুলস ব্রেক হলে আপনি প্রচন্ড রেগে যান, তাই না?” – “এসব কথা কেন?” – “আমার পরিবারে এমন বিশেষ কিছু নিয়ম আছে যা আমার দাদু তৈরি করেছে। সেই নিয়মের বাহিরে এলে তার সঙ্গে আর তার পরিবারের সঙ্গে আজীবনের জন্য সম্পর্ক চুকিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। খুব আপন একটা মানুষ ছিল আমার। যার কোলে চড়ে, কাঁধে উঠে আমি বড় হয়েছি। যে ছিল পরিবারের সবার চোখের মণি। মানুষটাকে পরিবারের সকলের মধ্যে আমার দাদু বেশি তাকে ভালোবাসতো। তার জন্য খুব সুন্দর একটি মানুষকে দাদু নির্বাচন করেছিল তার জীবনসঙ্গী করার জন্য। কিন্তু সেই মানুষটা একদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে ঘর বাঁধার জন্য পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। দুর্ভাগ্যবশত সেই রাতে সে আমার দাদুর মুখোমুখিই হলো। দাদু তাকে আকুতি মিনতি ভরা কণ্ঠে বহু বুঝিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে আমার দাদুকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে চলে যায় তার পছন্দের মানুষটির সঙ্গে। আর তার জন্য দাদু যাকে নির্বাচন করে রেখেছিল সে এই সংবাদ শুনে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ভাগ্যের জোরে সে বেঁচে গেলেও আজ সে উন্মাদ। কারণ প্রচন্ড ভালোবেসেছিল সে ওই মানুষটাকে। তার চলে যাওয়ার দিন সে আমাকে প্রচন্ড আদর করেছিল সেই রাতে। যেই রাতটার কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। মনে পড়লে আমার প্রচন্ড কষ্ট হয়, কান্না ধরে রাখতে পারি না। এই যে দেখুন এখনো পারছি না।” কথাগুলো বলে চোখের কোণটা মাহি মুছে নিলো। আশফি শুধু তার দিকে চেয়ে কথাগুলো শুনছিল। মাহি আবার বলতে শুরু করল, – “ভেবেছিলাম একদিন না একদিন সে ফিরবে আবার আমাদের কাছে। কিন্তু সে আমাদের সকলের মায়া ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে পারি জমাল। শুনেছি তার নাকি একটা খুব সন্দর পরীর মতো মেয়ে আছে। প্রচন্ড দেখতে ইচ্ছা হয় তাকে। মাঝে মাঝে ভাবি তাকে কি সেই মানুষটা আমার থেকেও বেশি তাকে আদর করে?” মাহি থেমে গেল। তারপর আশফির দিকে ঘুরে বলল, – “দাদু বলেন, তিনি যাকে বেশি ভালোবেসেছেন সেই তাঁকে কাঁদিয়েছে। আমাকেও দাদু প্রচন্ড ভালোবাসেন। আমাকে সে বলেন, ‘এই কষ্টটা যদি তোর থেকেও পাই তবে সেদিন এই মায়াপুরীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাব।’ আমার জীবনে আমি তাঁকে কোনোদিনও কষ্ট দিতে পারব না। এরপর থেকে দাদু আমাদের পরিবারের একটা রুলস তৈরি করে দিয়েছেন। এ পরিবারে কেউ যদি তার নিজের পছন্দে জীবনসঙ্গী নির্ধারণ করে তবে সে যেন বিনাবাক্যে পরিবার ত্যাগ করে। তার পরিবারে থাকতে হলে তার পছন্দ অপছন্দকেই প্রাধান্য দিতে হবে। আর সবাই তা মানেও। কারণ আমাদের পরিবার, আত্মীয়দের মাঝে দাদু এমন একটা মানুষ যার সিদ্ধান্তে কেউ কিছু করে কোনোদিন ঠঁকেনি বা খারাপও থাকেনি।” মাহি এবার নীরব বনে গেল। আশফির চাহনিতে চেয়ে তার কষ্টটা যেন দ্বিগুণ হয়ে মনটার সঙ্গে চোখদুটোও জলে ছেপে ভারী হয়ে গেল। কিন্তু তাকে তো তা তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না। দ্রুত আশফির নজর থেকে নজর সরিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল নদীর পানে। আশফি এবার বলল, – “আপনি আমাকে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার একটা কথার উত্তর দিন তো। আপনি তো আর সেই মানুষটার মতো অন্য কাউকে নির্বাচন করে আপনার দাদুর নির্বাচিত মানুষটাকে অবহেলা করছেন না। আপনি সেই মানুষটার দোষগুন বিবেচনা করে তাকে অপছন্দ করছেন। তাহলে দুটো ব্যাপার কি ভিন্ন হলো না? আপনার দাদু তার পছন্দকে প্রাধান্য দিতে বলতেই পারেন। কিন্তু আপনাদের মতামতের মূল্য তো তিনি অবশ্যই দেবেন।” – “আমার মতামত তো কখনো তিনি চাননি। তাহলে আমি আমার মতামত সেখানে দিই কী করে?” আশফি এবার রেগে উঠে বলল, – “অদ্ভুত কথা! এখানে চাইতে হবে কেন? আপনি নিজে জানাবেন আপনার মতামত।” মাহি এবার আশফির সমান রেগে গিয়ে তাকে বলল, – “আপনি কেন বুঝতে পারছেন না এখানে আমার মতামত তাকে জানানো মানেই তার পছন্দকে আবার অগ্রাহ্য করা। ঠিক যেটাই আমার ওই কাছের মানুষটাও করেছিল। তাহলে তার মাঝে আর আমার মাঝে পাথর্ক্য থাকল কোথায়? আর আমার দাদু একজন বিচক্ষণ মানুষ। তিনি সব বুঝে আর ভেবেই সব কাজে সিদ্ধান্ত নেন। হয়তো সোমের মাঝেও তিনি এমন কিছু পেয়েছেন যার জন্য তিনি আমার যোগ্য সোমকেই ভাবেন।” আশফি চড়া গলায় বলল, – “তার মানে আপনি ওকেই বিয়ে করবেন তাই তো?” – “যদি কপালে সেই থাকে তাহলে তাই।” আশফি জোর কণ্ঠে বলল, – “আপনি ওকে কখনোই বিয়ে করবেন না।” মাহি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠল, – “তাতে আপনার কী? আমার পরিবার, আমার বিয়ে, সিদ্ধান্তও আমার। আমি তাকে বিয়ে করব নাকি অন্য কাউকে করব সেটা তো আপনার ভাববার বিষয় নয়। আপনি কেন এত ভাবছেন?” আশফি আসক্তিভরা চোখে চেয়ে রইল মাহির দিকে। মাহির কথাগুলো শুনে সে বলার মতো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল যেন। ঠিকই তো, সে তো মাহির কেউ নয়। তবে কেন সে মাহির ব্যাপারে এত নাগ ডোবাবে? আর মাহিই বা কেন তার কথা মান্য করবে? রাগে তার চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে উঠল। কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে এসে বসলো। কিন্তু মাহি স্তব্ধ হয়ে মাথা নত করে দাড়িয়ে রইল তার স্থানে। চোখের পানিটুকু এবার সরাসরি মাটিতে পড়তে থাকল তার। আশফি গাড়ির হর্ণ বাজাল মাহিকে গাড়িতে উঠে আসার জন্য। মাহিকে তার বাসা অবধি পৌঁছে দিয়ে আশফি বাসায় ফিরে এলো। রুমে ঢুকেই হাতের মোবাইলটা আছাড় মারল নিচে। গলা থেকে টাইটা খুলেও ছুড়ে নিচে ফেলল। সিগারেটের বক্সটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে এসে বসলো সে। সিগারেটটা ধরাতেই গতকাল মাহির বারণ করা কথাগুলো মনে পড়ল তার। সেটা মনে পড়তেই যেন আরও বেশি করে সিগারেট টানতে শুরু করল সে। সন্ধ্যা পার হতে চলল কিন্তু তার সিগারেট খাওয়া শেষ হলো না। গাড়ি থেকে সে মাহিকে একটা শব্দও আর বলেনি আর ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। মাহির দিকে তাকালে রাগের পরিমাণটা তার আরও বেশি বেড়ে যেত তখন। পরে নিজের অধিকারের গন্ডি পেরিয়ে তাকে হয়তো আবার যা তা বলে বসতো। ফোনটা ফ্লোরে পড়ে একদম ভেঙে গেছে। আবরার তাকে কল করে না পেয়ে দিশানের কাছে কল করলেন। দিশান কথা বলে আশফির রুমে এসে তাকে এই হালে দেখে দ্রুত তার কাছে এগিয়ে এলো। কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না এই মুহূর্তে। কারণ ফোনের ওপাশে তাদের দাদা রয়েছেন। – “ভাইয়া দাদা কথা বলবে।” আশফি সিগারেটটা হাতে ধরেই ফোনটা কানে নিলো। দাদাকে সালাম জানিয়ে ওপাশ থেকে তিনি যা বললেন তাঁর উত্তরে আশফি শুধু ‘আচ্ছা’ বলে সম্মতি জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলো। ফোনটা রাখার পর দিশান কিছু বলতে যাবে তাকে। তার আগেই আশফি তাকে বলল, – “কোনো প্রশ্ন করিস না এখন। পরে কথা বলব, রুমে যা।” দিশান বিনাবাক্যে তার রুমে চলে গেল। মিনহাজ আর তার স্ত্রী রুবা প্রচন্ড খুশি হলো আবরার সাহেব, হীরা আর তাদের দুই নাতিকে দেখে। কুশলতা বিনিময় করে তাদের ড্রয়িংরুমে বসতে দিলো। ঐন্দ্রী আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। ওপর থেকে নেমে এসে সে আবরার আর হীরাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলে হীরা তাকে বলল, – “পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা আমার পছন্দ নয় দাদীবু। তুমি আমার পাশে এসে বসো।” ঐন্দ্রী হীরার পাশে বসে আশফির দিকে তাকাল। আশফি তার নজরটা তার নতুন ফোনের দিকে রেখে বসে আছে। তার কালকের আচরণ আর আজকের আচরণে ঐন্দ্রীর ভেতরটা বারবার কেঁদে উঠছে। যাকে এত বেশি ভালোবাসে সে, অথচ সেই মানুষটা একটাবারও তার দিকে ফিরে তাকায় না। তারপর সে নিজের মনকে শান্তনা দিলো এটা ভেবে, আশফির অ্যাটিটিউডই তো এমন। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে নিশ্চয় ওকে পছন্দ করে। নইলে আজ সে এঙ্গেজমেন্টই বা কেন করতে আসবে? দিশানের মুখে টান টান হাসি। সে অনেক কথাই বলতে থাকল ঐন্দ্রীর বাবা মায়ের সঙ্গে। দুপুরের লাঞ্চ শেষে তারপর মূল কথায় এলো মিনহাজ আর আবরার। আশফি তখনো ফোন চাপতে ব্যস্ত। আসার পর থেকে সে সৌজন্যমূলক কথা ছাড়া আর কোনো বাড়তি কথা বলেনি কারো সঙ্গে। মিনহাজ তাকে বলল, – “আশফি তুমি একটু আমার পাশে এসে বসবে?” আশফি মিনহাজের এমন প্রশ্নে একটু অবাক হলো। কিন্তু তা সে চেহারার মাঝে আড়াল রেখে মিনহাজের পাশে এসে বসলো। মিনহাজ তার পকেট থেকে আংটি বের করে যখন আশফির হাতটা চাইল তখন আশফি চোখে মুখে বিস্ময়পূর্ণ ভাব এনে বলল, – “এসব কী আঙ্কেল?” মিনহাজ তার এমন প্রশ্নে কী উত্তর দেবে বুঝে আসলো না তার। তবে সে এটুকু বুঝতে পারল আশফি তাদের আজকের দিনের আয়োজনটার কারণ জানে না। আবরার তখন বলল, – “আংটিটা পরো জোজো। আংটি কেন পরানো হয় সেটা তো নিশ্চয় জানো।” …………………………….. (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে