“তিমির” পর্ব ৪…

0
1885

“তিমির” পর্ব ৪…

ঘুম থেকে উঠে সামনের দেয়ালের ঘড়িটায় তাকিয়ে দেখলাম, নয়টা বেজে গেছে। ইশ! আমি এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? মনে পড়ল, আমি তো কখনও রাতে এগারোটার পর জাগি না। কালরাত বারোটা পর্যন্ত জাগতে গিয়ে কবে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি। তড়িঘড়ি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসিয়ার ঘরে গেলাম। তার ঘুম অনেক হালকা। সামান্য শব্দে সে জেগে যায়। কিন্তু আমি এবার দরজা খোলার পর সে জাগেনি। পা টিপে টিপে আমি এগিয়ে গেলাম, কালরাতের অসম্পূর্ণ কাজটা করার জন্য। আমি আসিয়ার কানে মুখ রেখে চিৎকার করে বললাম, “হ্যাপী বার্থডে…”
আসিয়ার ভয় পেয়ে উঠার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু সে এখনও ঘুমে তলিয়ে আছে। নিরাশ হয়ে আমি আসিয়াকে জাগাতে ওর বাহু ধরলাম। ওর গায়ে জ্বর এসেছে। জ্বর? এতোগুলো প্ল্যানিং কি তবে ভেস্তে যাবে? এখন আমাদের শপিং করতে যাওয়ার কথা ছিল। বাবা বলেছিলেন, এখানে রাতে পার্টি করা হবে। আমাদের ফ্রেন্ডদের সাথে আমরা মজা করতে পারব। তাদেরও ইনভাইট করতে হবে। অনেক বড় একটা কেক আনা হবে। আমি তড়িঘড়ি করে আসিয়াকে তোলার চেষ্টা করলাম। সে তার দুর্বল চোখ মেলে তাকালো।
অতঃপর বাবা ডাক্তারকে আনালেন আসিয়ার জন্য। ওর গায়ের তাপমাত্রা একশ তিন ডিগ্রি। কালরাত বোধ হয় সে ঠান্ডা পানি খেয়েছিল। ঠান্ডা পানি খেলেই তার গলা ব্যথা শুরু করে। সেই ব্যথা নাসিকা পর্যন্ত ছড়ায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হলে মাথা ঝিমঝিম করে তার গায়ে জ্বর উঠে। গতবার এমনটা হওয়ার পর তার ঠান্ডা পানি খাওয়া বন্ধ করে দিতে বলেছি। কিন্তু সে এই শীতের সময়ে বরফ ঠান্ডা পানি খেয়েছে। বাবা তার কথা চিন্তা করতে গিয়ে রীতিমতো তাকে বিছানা থেকে উঠতেই নিষেধ করে দিলেন। ক্রমে দশটা বেজে যায়। আসিয়ার শরীর একটু স্বাভাবিক হলে সে বলল, “আমরা শপিং করতে কখন বেরুব?”
“কিসের শপিং? আগে একবার দেখ, নিজের কেমন অবস্থা করেছিস।”
“আরে এই জ্বর ছোটখাটো ব্যাপার।”
“বাবা বকবে।”
সে চিৎকার করল, “বাবা, আমি আলিয়ার সাথে শপিং করতে যাচ্ছি।”
“একদমই না।” তিনিও তদ্রূপ চিৎকার করে ধমকের সুরে বললেন। হয়তো হলের সোফায় পেপার পড়ছেন। আমি আসিয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।
“আমি যাবই। এটা কোনো কথা হলো? বার্থডে কি বারবার আসে? যদি আর কখনও সুযোগ না পাই…”
আমি ওর মুখে হাত চেপে ধরলাম, “এমনটা বলবি না। তোর বার্থডে পার্টি হবেই। ড্রেস নাহয় আমি কেনে আনব। তুই রেস্ট কর। রেস্ট করলে সন্ধ্যার আগে সুস্থ হয়ে উঠবি।”
“আমার পছন্দ তোর সাথে মিলে না। আমি নিজেই কিনব।”
“বাহ্! তা কীভাবে? এই জ্বর নিয়ে?”
“আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাব, এমন জ্বর নেই। এই জ্বর প্রায়ই হয়ে থাকে। প্লিজ।”
“কিন্তু কীভাবে? বাবা হলঘরে আছেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া বেরুলে তিনি দেখবেন।”

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


“দেখবেন না।”
“শিওর?”
“হুম। ওটার চিন্তা আমার ওপর। তুই গিয়ে রেডি হয়ে আয়। বাবাকে বলিস, আমার কাপড় তুই কিনবি।”
“আচ্ছা।”
আমি রেডি হয়ে ওর ঘরে এলাম। আসিয়ার বিছানার পাশে এককোণায় থাকা ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসিয়া দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা অনেক লম্বা। সেটিতে আসিয়ার সম্পূর্ণ শরীর প্রতিফলিত হয়েছে। সেই আয়নায় আমি আমার মুখও দেখতে পেলাম। আমার চোখের নিচের কালো অংশটা এখন নেই। কালরাত আমি স্বপ্ন দেখিনি। হয়তো এটারই ভালো প্রভাব। স্বপ্ন হয়তো এখন থেকে আর দেখব না। কারণ আমার মনে কোনো ভয় আর নেই। আসিয়া এসে বলল, “বাবাকে এখনও বলিসনি?”
“যাচ্ছি তো। কিন্তু তুই কীভাবে যাবি?”
“ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি তোর সাথে গ্যারেজের সামনে দেখা করব।”
আমি হা করে রইলাম। সে দরজা বেঁধে দেয়। বাবা হল থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
“আমি।” হলে এসে বললাম, “একটু বাইরে বেরুচ্ছি।”
“কোথায় যাচ্ছ?”
“শপিং।”
“আসিয়ার পাশে তোমার থাকা উচিত।”
“আমি জানি। কিন্তু ওর জেদের কারণে..”
“আচ্ছা, বুঝেছি। সাবধানে যেও।” তিনি মজিদ ভাইকে ডাকলেন, “মজিদ, ওকে নিয়ে যাও।”
মজিদ ভাই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আমি বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিচে এলাম। মজিদ ভাই ততক্ষণে গ্যারেজের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে আসিয়াকে দেখলাম না। কীভাবেই বা দেখব? বাবার চোখের সামনে দিয়ে সে কোনোভাবেই আসতে পারত না। সামনের দরজা ছাড়া বাড়ি থেকে বেরুনোর আর কোনো পথই যে নেই! আমি গাড়ির দরজা খুলে অবাক বনে গেলাম। আসিয়া অলরেডি ওপাশের সিটে বসে আছে। আমি তার পাশে বসে দরজা বন্ধ করলাম। তখনও আমি থ হয়ে ছিলাম, কোনোভাবে বললাম, “কীভাবে?”
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করল।
সে বলল, “সিক্রেট।”
“আমাকে বলা যাবে না?”
“না বলে একেবারে দেখালে কী সমস্যা হবে?”
“না, তা তো আরও ভালো।”
“তবে অপেক্ষা কর। পরে দেখাব।”
গাড়ি বাড়ির গেইট পেরিয়ে মেইন রোডে উঠল। আমার নজর গাছগুলোর দিকে যায়। যতক্ষণ ওগুলো নজরে পড়ছিল, ততক্ষণ আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। হ্যাঁ, হয়তো সামনে থেকে এটিকে জঙ্গল দেখায় না। কিন্তু পেছনে অনেক গভীর জঙ্গল আছে। বাবাকে জঙ্গলের কথা কাল জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, এখানে সত্যিই জঙ্গল আছে। ওখানে কেউ গেলে আর ফিরে আসে না, এমন একটা কথা এই গ্রামে প্রচলিত হয়ে গেছে। এখানে জনবসতি কম থাকার এই এক কারণ, গ্রামের অর্ধেক অংশ জুড়ে এই জঙ্গল বিস্তৃত। এই বাকি খোলা জায়গাগুলোতে যে সাধারণ লোক থাকত, তারা জঙ্গলের কারণেই বহু আগে জায়গা বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্রে চলে গেছে। তাদের মতে এখানে নানা ধরনের জীবজন্তু আছে। তার মাঝে কিছু ভয়ংকরও আছে। বাবা জায়গাটা কেনার আগে যাচাই করে দেখেছিলেন, জঙ্গলের কারণে সাধারণ জীবনে প্রভাব ফেলবে না। তাই তিনি বিপুল জায়গা এবং সেই সাথে কিছুটা ছাড় পাওয়ায় কেনে নিয়েছিলেন। এই গ্রামে থাকা অধিকাংশ অধিবাসীই বাবার মতো প্রতিপত্তিশালী। তিনি আমাকে তাঁর এক ধনী প্রতিবেশীর কথা বলেছেন। লোকটির নাম বরকত, বাবার সাথে রেষারেষি আছে। কেন তা জানি না। তবে তারা বন্ধু। বাবা তাদের সম্পর্ক ঠিক করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। আরেকজন প্রতিবেশী বন্ধুর নাম আজাদ। লোকটিও অনেক ধনী। বাবার চেয়ে বেশি। এই জঙ্গলটি তাঁর ভাইয়ের নামেই। বাবাকে বললাম, মনে তো হয় না, এটা কোনো জঙ্গল। তিনি বললেন, সামনের দিক থেকে মোটেই লাগে না। তুমি ওখানে যাবে না। আমরা কেউই ওখানে যাই না। আমি বলেছিলাম, আমার ওখানে যাওয়ার কোনো দরকারই নেই।

আমরা শহরে পৌঁছার পর মলে গিয়ে কেনাকাটা করলাম। আসিয়া গাউন কেনে আমাকেও একটি সিলেক্ট করে দেয়। আমি ওটা কিনে নেই। আমারটা প্লেইন হোয়াইট, তারটা হালকা গোলাপি। শপিং করে আসার পর তার নির্দেশে ওকে বাইরে রেখে আমি একাই বাসায় ঢুকি। বাবা কেনাকাটার কথা জিজ্ঞেস করলেন। পছন্দমতো কাপড় নেওয়ার কথা তাঁকে জানাই। যখন আমি আসিয়ার ঘরে পৌঁছাই, তখন আবারও হতবাক হই। সে আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছে। যেন সে ঘর থেকে বেরই হয়নি। এরপর আমরা দু’জন ফ্রেন্ডের লিস্ট বানিয়ে তাদের ইনভাইট করতে লাগলাম। সাঈদ, মৌমিতা, ফারহা, রুমন, ধ্রুব এদের আমিই ফোন দেই।
সাঈদকে বললাম, “আজ বাসায় এসো। আসিয়ার বার্থডে।”
“ইয়াহু, অনেক মজা হবে।”
“হুম, আসিয়া গানবাজনার কথা ভাবছে।”
“এই, তোমার তো ওসব পছন্দ নয় তাই না?”
“হু। কিন্তু তার খুশির জন্য আমাকে পার্টিতে থাকতে হবেই। আমি এসবে অভ্যস্ত নই।”
“আমি জানি। মৌমিতাকে ফোন দিয়েছ?”
“এইতো দেবো।”
এই সময় বাবা এসে অতিথির লিস্টে তাঁর পক্ষের লোকগুলোকে অ্যাড করে গেছেন। এরপর আমি মৌমিতাকে ফোন দিয়ে পার্টির কথা জানাই, “শোন, সবসময় কানে হ্যাডফোন দিয়ে রাখলে হবে না।”
“দিব। কিন্তু এমনিই।”
“দিবিই। হা হা হা।”
সবশেষে ধ্রুবকে ফোন দিয়ে বললাম, “তুমি আমার পক্ষ থেকে ইনভাইটেড। আর হ্যাঁ, যদি ইচ্ছা হয়, তোমার ভাইয়াকেও আনতে পার।”
“ওর গার্লফ্রেন্ড মুনতাহা আগেই ওকে ইনভাইট করেছে।”
আমি নীরব রইলাম।
সে হয়তো বুঝেছে, “আসিয়া ভাইয়াকে পছন্দ করে তাই না?”
“হু।”
“সেদিন দেখেছিলাম তাকে কাঁদতে। আমি ভাইয়াকে বুঝিয়েছি, মুনতাহা তার জন্য পারফেক্ট নয়। কিন্তু সে কাউকে কষ্ট দিতে পারে না।”
আবারও অদ্ভুত। এই রহস্যময় ছেলেটির ব্যাপার আমাকে সারাক্ষণ ভাবায়।
“আমি বুঝতে পারছি। তুমি মুনতাহার মস্তিষ্ক পড়েছ। তাই না?”
উত্তর হিসেবে ওর হাসির আওয়াজ পেলাম। সে বলল, “আচ্ছা, একটা কথা বলো। তুমি টিকটিকিকে ভয় পাও?”
“না। আমি ছোটবেলায় অনেক লেজ ছিঁড়েছি।”
“ছিঃ, তেলাপোকা?”
“তেলাপোকা দিয়ে আমাদের কলেজে শেষবার একটু করে ব্যবহারিক ক্লাস করেছিলাম। মানে যাস্ট পাগুলো কেটেছি।”
“ইয়াক। সাপ?”
“সাপকে কেবল বিষের দিক থেকেই ভয় পাই। আমাদের আগের বাসাটা ঝোপঝাড়ের ভেতর ছিল। সাপ ধরার অভ্যাস আছে। আবার সরাসরি হাতে ধরিনি।”
“এটা বলো, ভয় কাকে পাও তুমি?”
“হা হা।” সত্যটা বললাম, “ভূতকে ভয় পাই।”
“ভূত?”
“আমি জানি না, ওটা বাস্তবে নাকি কল্পনায়। কিন্তু আমি ভূতকে ভয় পাই। ভূত বলে সংজ্ঞায়িত করব কিনা বুঝছি না। তবে বলব, ওটা ‘খারাপ কিছু’।”
“কোনোবার দেখেছ?”
“সরাসরি দেখিনি। তবে অনুভব করেছি। আমার জীবনে নতুন কিছু এলে আমি তা নিয়ে স্বপ্ন দেখি, মায়ের মৃত্যুর পর থেকে। আমি এখানে আসার আগে স্বপ্নে দেখতাম, বীভৎস, দুর্গন্ধময় এক অচেনা লোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।”
“তোমার এখানে আসার আগের ঘটনাগুলো আমায় খুলে বলো। প্লিজ। আমার জানতে ইচ্ছে করছে।”
“আমার মা মৃত্যুর আগে কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চোখের নিচে কালো হয়ে গিয়েছিল। মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে আমাকে তিনি তাঁর কাছে একদমই থাকতে দিতেন না। মাঝে মাঝে তাঁর জিহ্বা অনেক সাদা হয়ে যেত, চোখ লাল হয়ে যেত। অদ্ভুত অনেক কিছুই হতো। আমি তা মনেও করতে চাই না। শেষমেষ তিনি অনেক ছটফট করে মারা গেলেন। এরপর থেকে আমার দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু হয়। একটা রাতও ভালো করে ঘুমাইনি। প্রতিরাত আমি ওই বীভৎস জিনিসকে অস্পষ্টভাবে দেখেছি। এরপর আমার স্বপ্ন পালটায়। একমাস পর আমাকে হঠাৎই ছেলেপক্ষ দেখতে আসে। খালা আমাকে এসবের কথা কিছুই জানাননি। রাতের বেলায় বিয়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর মাথায় আঘাত করে পালিয়ে যাই। এমন সময় আমি বাবাকে পেয়ে যাওয়ায় আশা ফিরে পেয়েছি। তাঁর সাথে এখানে চলে আসার পর দেখলাম, এখানে আমাকে অপছন্দ করার মতো কেউই নেই। তাই এই জায়গাকে আমি নিজের বাড়ি হিসেবে ভেবে থাকতে শরু করেছি। সেই রাত আমি প্রথমবার ভিন্ন স্বপ্ন দেখি। দেখি আমাকে বিয়ে করতে আসা খালার বীভৎস দেবরকে। পরের রাত স্বপ্নে তোমাকেও দেখি। এখন আপাতত কিছু দেখি না।”
সে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি অতিরিক্ত চিন্তা কর। যা চিন্তা কর, তা দিয়ে সম্ভাবনার একটা দেয়াল তৈরি করে তুমি এই স্বপ্নগুলো দেখ। তোমার মনের কারণেই তুমি এসব দেখছ। প্লিজ, নিজেকে সুখে রাখার চেষ্টা কর। ফ্রেন্ড হিসেবেই বলছি।”
“আমি চেষ্টা করছি। তুমি এসব কথা আমার দুর্বলতা সম্বন্ধে জানার জন্যই কি জিজ্ঞেস করেছ?”
“না। তোমাকে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগে। তোমাকে জানার চেষ্টা করছি, এটাই। আর কিছু না।”
তার সাথে কথা শেষ করে ফোন রেখে দেই। সন্ধ্যার দিকে আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর আমরা কাপড় পরতে যাই। তখন খেয়াল করলাম, অতিথিরা আসতে শুরু করেছে। কেউ হয়তো এখন আমার ঘরের দিকেই আসছে। আমি তড়িঘড়ি করে গাউনটা ঠিক করে দাঁড়ালাম। এই প্রথমবারের মতো গাউন পরায় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ধ্রুব এবং মৌমিতা আমার ঘরে এলো। আমি তখনও ড্রেসিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সাহস করে আমি এক পা বাড়াই, ঠিক তখনই গাউনের নিচের অংশ এবং ওড়না একই সাথে পায়ের নিচে চাপা পড়ায় আমি ফ্লোরে পড়ে যাই। ধ্রুব তড়িঘড়ি করে আমাকে তুলল, “ব্যথা পাওনি তো?”
শুরুতেই এমনটা হওয়ায় আমার লজ্জা লাগল। “ব্যথা পাওয়ার মতো করেই পড়েছি।”
“ওহ্, কোথায় ব্যথা পেলে? এই ধরনের গাউন দুইহাতে একটু উঁচিয়ে রেখে হাঁটতে হয়, তুমি জানো না?”
“না। তুমি ফ্যাশন নিয়ে অনেক ধারণা রাখ। তোমার মডেলই হওয়া উচিত।”
“দেখ, এসব পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যাপার। আমার ওরকম কোনো দক্ষতা নেই। ভাইয়াই আমার ওয়্যারড্রো-এর দিকটা দেখেন। আর এতদিন যাদের কাছে থেকেছি, তাদের স্ট্যান্ডার্ডেরই ধারণা পেয়েছি।”
“ওহ্,” আমি কথা বলা থামালাম। পড়ে যাওয়ার সময় ব্যথা পেয়েছিলাম। কোথায় পেয়েছিলাম আন্দাজ করতে পারিনি, এতক্ষণ মাথা ঝিমঝিম করায়।
ধ্রুব বলল, “তুমি ঠিক আছ?” মৌমিতাও পাশে বসল। সে আমাকে ভাগ্যিস বিছানায় বসাল। নইলে আবারও পড়ে যেতাম। এবার অসার হয়ে।
বামহাতের একটি আঙুলের এক জায়গার মাংস উঠে গিয়েছে। ভেতরের রক্ত দেখা যাচ্ছে। আমি ড্রেসিং টেবিলের একদিকের ভেঙে যাওয়া গাছের ধারালো অংশটা দেখলাম। পড়ার সময় আমার আঙুল ওখানেই আঁচড় খেয়ে ছিলকে গেছে। যখনই এই ধারণাটা মাথায় এলো, মাথা আরও তীব্রভাবে ঝিমঝিম করতে লাগল। বারবার দৃশ্যটাই চোখে ভাসছে। মৌমিতা আমাকে শুইয়ে দেয়। ধ্রুব হয়তো এখন দেখেছে, কোথায় ব্যথা পেয়েছি। আমি চোখ বাঁধার পর একটু-আধটু খেয়াল করলাম, ও হয়তো আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। সে হেসে বলল, “তুমি কিনা রক্তকে ভয় পাও না।”
“পাই না।” চোখ খুলে বললাম, “কেটে যাওয়ার দৃশ্যটাকেই ভয় পাই।”
সে বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকাল, “তুমি অদ্ভুত। এটা সামান্য একটা ক্ষত। তুমি বেহুঁশ হয়ে পড়ছ।”
“এটা প্রথমবার নয়। কলেজে একবার, স্কুলে একবার হয়েছে…”
মৌমিতা আমাকে কথা বলতে নিষেধ করল। সে আমাকে পানি খাওয়ায়। আমি সুস্থ হওয়ার পর আমরা বাইরে গেলাম। রীতিমতো পার্টি শুরু হয়েছে। গাউন আরও দু’জন পরেছে, আমার মতোই সাধারণ ডিজাইনের কিন্তু ক্লাসিক। আসিয়াই সবচেয়ে গর্জিয়াস গাউন পরেছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের বন্ধু-বান্ধব, বাবার কিছু বন্ধুএবং তাদের পরিবার, ফুফি, ফুফাতো ভাই-বোন সকলে মুহূর্তটাকে জমজমাট করেছে। কিছুক্ষণ গানবাজনা হওয়ার পর আসিয়া কেক কাটে। এরপর পুনরায় পার্টি শুরু হয়। আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। মৌমিতা আমাকে নিয়ে যায়। আমি যেটুকু নাচতে পারি, তা দিয়ে নিজেকে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম। কারণ আমার নিজেকে সুখে রাখতে হবে। বিভীষিকাময় জীবন এখন অতীত হয়ে গিয়েছে।
নাচার একফাঁকে খেয়াল করলাম, জিসান ভাই আর মুনতাহা একসাথে নাচছে। আমার কিছুটা খারাপ লাগল। আরেকদিকে ধ্রুব একপাশে একা দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে হাতের ইশারায় ডাকলেও সে এলো না। আমি নিজের মতো করেই আসিয়ার সাথে ফুর্তি করতে লাগলাম। দশটার দিকে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হয়। সাড়ে দশটার দিকে ডিনার সেরে আমি আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়ি।
এতক্ষণ এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, খাবার কী কী খেয়েছি তাই মনে নেই। এতটা ক্লান্ত আগে কখনওই হইনি। কারণ আগে কখনও এটুকু রাতকে এতবড় করে কাটাইনি। বাইরে এখনও পার্টি চলছে। এগারোটার আগে কেউ বাসায় যাওয়ার প্ল্যান করে আসেনি। আমার কেবল সাড়ে দশটা পর্যন্তই শক্তি ছিল। এজন্য বিছানায় এলিয়ে পড়ার পর কবে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পাইনি।
সকালে যখন চোখ খুলি, তখন ঘড়ি দেখার পরিবর্তে বাবার বিষাদময় চেহারা দেখলাম। কিছুটা রেগেও আছেন। খেয়াল করলাম, গাউনটা না খুলেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
বাবা বললেন, “এটুকু দায়িত্ববোধও কি তোমার নেই?”
“কী হয়েছে?” আমি উদ্বিগ্ন উঠলাম।
“আসিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। বোনের খেয়াল রাখতে পারো না? তার আশেপাশে থাকতে পারতে না?” বলতে বলতে তাঁর চোখে পানি এলো।
“আসিয়া?” আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। বাবা হয়তো ভুলভাল কিছু বলছেন। সে কাউকে না জানিয়ে কোথায় যাবে? “আমি রাতে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, দাঁড়ানোর শক্তিও ছিল না।”
বাবা আমাকে আবারও তিক্ততা মিশ্রিত কথা শুনাতে যাচ্ছিলেন। আমি শুনলাম না, দৌড়ে বাইরে বেরুলাম। বাবা হয়তো উল্টাপাল্টা কিছু বলছেন। আমি নিজ থেকেই আসিয়াকে খুঁজতে লাগলাম। আমার চুল এখনও খোলা। কয়েকটা পিন হয়তো চুলে জট পাকিয়েছে। মাঝে মাঝে গাউনের কারণে পড়তে পড়তে উঠছি। আসিয়ার ফোনটা তার ঘরেই আছে। কিন্তু সে কোনোদিকেই নেই!
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[বিরক্তিকর পর্ব অনেক গেল। এখন থেকে হয়তো রহস্যই জমাট বাঁধবে। কিন্তু এটুকু পর্যন্তও অনেক রহস্য লুকিয়ে রেখে এসেছি। স্বপ্নের কারণ, দুর্বলতার কারণ সবকিছুই বেরিয়ে আসবে। কেউ হয়তো এগুলো মিল আছে ভাবছেন। কিন্তু এমনটা নয়। মিল হতেই পারে। ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করতে যাইনি। আমার কাহিনি, প্লট ভিন্ন। যাস্ট পরী উপন্যাসের আবিরদের পরবর্তি পর্যায়টা তুলে ধরার জন্যই এই সিরিজটা শুরু করা। আলিয়া তো কোনো গোয়েন্দা বা পুলিশ নয়, তাই তাকে আমার কাছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিধারী করতে হয়েছে। তাকে নিয়ে যে সমস্যাগুলো পরবর্তীতে বাঁধে, তা তার দুর্বলতার কারণেই। আর যা কিছু হয়, সবের অন্তিম পর্যায়ে আলিয়ার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। সে এমন একটা মেয়ে, অন্ধকার যাকে আকৃষ্ট করে। এজন্য এর নামকরণ তিমির রেখেছি।]